সাধারণ আপেক্ষিকতা: নিউটন থেকে আইনস্টাইন

লিখেছেন:প্রবীর রুদ্র

Imagination is more important than knowledge.

There are only two ways to live your life. One is as though nothing is a miracle. Other is as though everything is a miracle.

 

– Albert Einstein

 

আলবার্ট আইনস্টাইন (ছবি -উইকিপিডিয়া) 

 

1905 সালে আইনস্টাইন চারটি যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যা স্থান, সময়, ভর এবং শক্তির মৌলিক ধারণাগুলি সম্পর্কে আমাদের বোধগম্যতায় বিপ্লব ঘটায়। প্রকৃতির চারটি বিস্ময়কর তত্ত্ব যা আইনস্টাইনকে আলোচ্য বিষয় করে তুলেছিল সেগুলি হল (ক) আলোক-বৈদ্যুতিক প্রভাব (Photoelectric effect) (খ) ব্রাউনিয়ান গতির ব্যাখ্যা (explanation of Brownian motion)। (গ) বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব  (Special Theory of Relativity) এবং (ঘ) বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত সমীকরণ, E=mc2.

সুইজারল্যান্ডের বার্নের একজন পেটেন্ট ক্লার্ক থেকে আইনস্টাইন ১৯০৮ সালে বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক বা লেকচারার হন। পরের বছর তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। অল্পদিনের মধ্যেই আইনস্টাইন ১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে প্রাগের চার্লস-ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ অধ্যাপক হলেন। তার মাত্র এক বছরের মধ্যেই ১৯১২ সালে তিনি জুরিখের ইটিএইচ-এ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। এরপর তিনি জার্মানিতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং শেষ পর্যন্ত ১৯১৪ সালের ১লা এপ্রিল বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।

এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে এই সমস্ত পরিবর্তনের মাঝে আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের (যা তিনি ১৯০৫ সালে প্রস্তাব করেছিলেন) সাধারণীকরণের (Generalizing the theory of Relativity) মূল ধারণাকে পুষ্ট করতে থাকেন। সেটা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়। বলাই বাহুল্য মানবতার জন্য সংকটময় এক পরিস্থিতি। কিন্তু এই সমস্ত কিছু আইনস্টাইনের মনের উপর খুব কম প্রভাব ফেলেছিল বলেই মনে হয়। বরং এক অসম্পূর্ণতার অনুভূতি তাঁকে দিন-রাত তাড়া করে যাচ্ছিল।

 

সমস্যাগুলির বিবরণ

পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যায়, নির্দেশতন্ত্র বা রেফারেন্স ফ্রেম (Reference Frame or Frame of Reference) হলো একটি বিমূর্ত সমন্বয় ব্যবস্থা (abstract coordinate system), যার উৎপত্তি, অভিযোজন এবং মাপ (scale) ভৌত স্থানে (physical space) নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই রেফারেন্স পয়েন্টগুলি কিছু জ্যামিতিক বিন্দুর সমন্বয়, যার অবস্থান গাণিতিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি একটি দৃষ্টিকোণকে বোঝায় যেখান থেকে পরিমাপ বা পর্যবেক্ষণ করা হয়। 

উদাহরণ: কল্পনা করুন আপনি একটি চলন্ত গাড়িতে বসে আছেন এবং আপনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। আপনার কাছে বাইরের গাছ, বিল্ডিং ইত্যাদি সবই চলন্ত বলে মনে হচ্ছে। গাড়ির ভিতরে আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে, গাছগুলি পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আবার অন্যদিকে, গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে, সেই একই গাছ এবং বিল্ডিংগুলি স্থির বলে মনে হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আপনার রেফারেন্স ফ্রেম হল গাড়ি, যেখানে বসে আপনি গাছগুলিকে আপনার সাপেক্ষে চলমান হিসাবে উপলব্ধি করছেন এবং গাড়িটিকে স্থির ভাবছেন। গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির রেফারেন্স ফ্রেম হল ভূপৃষ্ঠ, যেখানে গাছগুলি স্থির মনে হচ্ছে এবং গাড়িটি চলছে।

একটি ইনার্শিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্স (Inertial frame of reference) হল একটি রেফারেন্স ফ্রেম যেখানে কোনও বাহ্যিক শক্তি থেকে মুক্ত বস্তু ধ্রুবক বেগের সাথে চলে, অর্থাৎ বিশ্রামে থাকে বা একটি স্থির গতিতে একটি সরল রেখায় চলে। এই ধরনের ফ্রেমে, নিউটনের গতির প্রথম সূত্রটি সত্য: একটি বস্তু তার গতির অবস্থায় থাকবে (হয় বিশ্রামে বা একইভাবে চলমান) যদি না কোনো বাহ্যিক শক্তি দ্বারা সে প্রভাবিত হয়। যদি একটি ফ্রেম ত্বরান্বিত হয়, যেমন একটি গাড়ি একটি বক্ররেখার চারপাশে ঘুরছে বা একটি লিফ্ট (elevator) উপরের দিকে বা নীচের দিকে যাচ্ছে, সেটি একটি নন-ইনার্শিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্স (non-inertial frame of reference) হিসাবে বিবেচিত হবে। এই ধরনের ফ্রেমে, বস্তুগুলি এমন বল অনুভব করতে পারে যাকে ছদ্ম-বল (pseudo-force) বলা হয় যা একটি ইনার্শিয়াল ফ্রেমে বিদ্যমান থাকবে না।

আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব শুধুমাত্র ইনার্শিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমগুলির (inertial frame of reference) জন্য বৈধ ছিল। কিন্তু বাস্তবে প্রায় সব ফ্রেমই ত্বরান্বিত (accelerated) হয়। একটি চলন্ত গাড়িকে প্রয়োজন অনুযায়ী ত্বরান্বিত বা মন্থর করতে হয়। একইভাবে একজন সাইকেল চালককে সাইকেল চালানোর সময় ব্রেক ব্যবহার করতে হয় যা তার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ঘর্ষণের কারণে মাটিতে চলমান ফুটবলের গতি কমে যায়। এগুলি সবই ত্বরান্বিত (non-inertial or accelerated) রেফারেন্স ফ্রেম যেখানে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব প্রযোজ্য নয়। সুতরাং আমাদের আপেক্ষিকতার একটি সাধারণ তত্ত্ব প্রয়োজন যা সমস্ত রেফারেন্স ফ্রেমের (inertial and non-inertial) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে ।

 

কেন মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব

তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সাধারণীকরণের জন্য আইনস্টাইন জানতেন যে তাঁর তত্ত্বে ত্বরণকে (acceleration) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ত্বরণ সৃষ্টি হয় বল (Force) থেকে। একটি মহান অন্তর্দৃষ্টিতে আইনস্টাইন দুটি বিষয় বুঝতে পেরেছিলেন যা তিনি সমতুল্যতার নীতি (Principle of Equivalence) হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন :

ক) জড় এবং মহাকর্ষীয় ভরের সমতুল্যতা (Equivalence of Inertial and Gravitational mass)

খ) পৃথিবীর মতো একটি বিশাল বস্তুর উপর দাঁড়িয়ে থাকার সময় স্থানীয়ভাবে যে মহাকর্ষীয় বল অনুভূত হয় তা একজন পর্যবেক্ষকের দ্বারা ত্বরান্বিত রেফারেন্স ফ্রেম-এ অনুভূত ছদ্ম বলের সমান (Acceleration and Gravitation are locally indistinguishable) 

এলিভেটর পরীক্ষা: কল্পনা করুন আপনি গভীর মহাকাশে একটি লিফটের ভিতরে আছেন, যে কোনো মহাকর্ষীয় উৎস থেকে অনেক দূরে, এবং লিফটটি স্থির গতিতে উপরের দিকে ত্বরান্বিত হচ্ছে। আপনি অনুভব করবেন যে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোই একটি শক্তি আপনাকে মেঝেতে ঠেলে দিচ্ছে। যদি লিফটে কোন জানালা না থাকে এবং আপনি ত্বরণ সনাক্ত করতে না পারেন তবে আপনি বলতে পারবেন না যে এই বলটি অভিকর্ষের কারণে নাকি লিফটের ঊর্ধ্বগামী ত্বরণের কারণে। উভয় ক্ষেত্রেই (মাধ্যাকর্ষণ বা ত্বরণের প্রভাবে) আপনি এমন একটি শক্তি অনুভব করবেন যা আপনাকে লিফটের মেঝের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, কিন্তু আপনি লিফটের বাইরে না তাকিয়ে দুটি পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন না।

সুতরাং মহাকর্ষীয় এবং ত্বরণের প্রভাব সমতুল্য এবং স্থানীয় পরীক্ষাগুলি উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। আইনস্টাইন বুঝলেন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মধ্যে ত্বরণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে তাকে মাধ্যাকর্ষণের মুখোমুখি হতেই হবে। শুরু হলো অনন্তের এক মহা অন্বেষণ। তিনি অন্তর থেকে অনুভব করেছিলেন যে এটি সত্যিই মাধ্যাকর্ষণের একটি তত্ত্ব হতে চলেছে। ১৯০৭ সালে এই সমস্যাগুলিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে শুরু করেন আইনস্টাইন। তিনি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের (যিনি ১৯০০ সালে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন) সাথে এই ব্যাপারে পরামর্শ করেন এবং মাধ্যাকর্ষণ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে তার উদ্দেশ্য বিষয়ে তার সাথে আলোচনা করেন। কথিত আছে যে প্ল্যাঙ্ক তাকে বলেছিলেন - “দুটি সম্ভাবনা রয়েছে: (ক) মাধ্যাকর্ষণ সমস্যা এত কঠিন যে সম্ভবত আপনি কখনই সফল হবেন না। (খ) আপনি যদি সমস্যার সমাধান খুঁজেও পান তবে কেউ আপনাকে বিশ্বাস করবে না।"

 

আইজ্যাক নিউটন (ছবি - উইকিপিডিয়া) 

 

প্রচলিত নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের দুর্বলতা

মহাকর্ষের প্রথম গ্রহণযোগ্য তত্ত্বটি আইজ্যাক নিউটন দিয়েছিলেন সপ্তদশ শতকে। এটি বলে যে:

একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব দ্বারা বিভক্ত যেকোনো দুটি ভর একে অপরকে একটি বল দ্বারা আকর্ষণ করবে যা ভরের গুণফলের সরাসরি সমানুপাতিক (directly proportional to the product of the masses) এবং তাদের মধ্যকার দূরত্বের বর্গের সাথে বিপরীতভাবে সমানুপাতিক (inversely proportional to the square of the distance between them)।

সেই সময়ে তত্ত্বটি ত্রুটিহীন বলে মনে হয়েছিল এবং সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়েছিল। সাধারণ মানুষের কাছে নিউটন ছিলেন ঈশ্বরতুল্য এবং খুব কম লোকেরই তার বুদ্ধি এবং সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস হয়েছিল। অধিকন্তু মাধ্যাকর্ষণ সমস্যার সমাধান করা খুব কঠিন ছিল এবং তাই খুব কম লোকই এই বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।

কিন্তু কিছু স্বাভাবিক প্রশ্ন থেকেই যায়:

- মহাকর্ষ বলের উৎস বা উৎপত্তি কি ?

- এই বল কে তৈরি করছে ?

- এই বলের উপস্থিতির কারণ কি ?

এসব প্রশ্নের কোনো যৌক্তিক উত্তর নিউটন বা তার তত্ত্বের কাছে ছিল না। 

 

যে তত্ত্বটি উপরের প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়েছে

 

মাধ্যাকর্ষণের স্বরূপ (ছবি - সিম্পল উইকিপিডিয়া)

আমরা আগেই দেখেছি যে সমতুল্যতার নীতি বলে - মাধ্যাকর্ষণ এবং ত্বরণ স্থানীয়ভাবে পৃথক করা যায় না। এ থেকে আইনস্টাইন বুঝলেন - স্থানকাল নিশ্চয়ই বেঁকে গিয়ে ত্বরণের একটি রূপ হিসাবে প্রকট হয়। এই ধারণা বোঝায় যে বিশাল বস্তুগুলি (যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, ইত্যাদি) স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয় এবং এই বক্রতাকে অভিকর্ষ হিসাবে অনুভব করা হয়। আইনস্টাইন যুক্তি দিয়েছিলেন যে স্থান-কাল (স্থান এবং সময় একসাথে) একটি প্রসারিত ফ্যাব্রিক বা বস্ত্রের মতো। যখন আমরা এই ধরনের বস্ত্রের উপর কোন ভর (বস্তু) রাখি তখন স্বাভাবিকভাবেই এটি নিজের চারপাশে একটি বক্রতা তৈরি করে। এটি স্থান-কালের বক্রতা (বাঁকানো বা মোচড়) যা ভরের চারপাশে একটি মাধ্যাকর্ষণ কূপের জন্ম দেয়। যখন একটি দ্বিতীয় ভর সেই কূপের মধ্যে এসে পড়ে তখন স্বাভাবিকভাবেই এটি প্রথম ভর বা বস্তুটির দিকে চলে যায়। দেখে মনে হয় প্রথম বস্তুটি পরের বস্তুটিকে একটি বল দ্বারা আকর্ষণ করছে । আইনস্টাইন বলেছিলেন এটাই মহাকর্ষ !! এটি মোটেও কোন বল নয় যেমন নিউটন প্রায় আড়াইশো বছর আগে প্রস্তাব করেছিলেন। এটি এমন একটি ঘটনা যা স্থান-কালের জ্যামিতি বা বক্রতা দ্বারা সৃষ্ট হয়। একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে প্রথম বস্তুটি তার চারপাশে যে মাধ্যাকর্ষণ কূপের জন্ম দিয়েছিল, সেই কূপের মধ্যে দ্বিতীয় কোন বস্তু আসলে সেটি তার চারপাশের স্থানকালের আকৃতির (জ্যামিতির) কারণে প্রথম বস্তুটির দিকেই ছুটে যাবে । তার কাছে আর কোন পথ নেই। 

তাই অভিকর্ষ কোন বল নয়। এটি আসলে স্থানকালের জ্যামিতির প্রভাব বা প্রকাশ। সত্যিই কি সুন্দর অন্তর্দৃষ্টি !! একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি !! আমাদের সাধারণ মন কেবল বিভ্রান্ত হয়ে তার সৌন্দর্য এবং আভায় হারিয়ে যেতে পারে!! এমনই ছিল আইনস্টাইনের কৌতূহলী মন এবং অসাধারণ প্রতিভা।

 

গৌরবের শিখরে পৌঁছানোর এক ভয়ানক প্রতিযোগিতা

আইনস্টাইন ১৯১২ সালেই সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বাস্তব ধারণা তৈরি করে ফেলেছিলেন, কিন্তু এই তত্ত্বের গাণিতিক প্রকাশ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। তত্ত্বের কোনো অর্থপূর্ণ গাণিতিক বিকাশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে তার বাঁকা স্থানের জ্যামিতি (Geometry of curved space/ non-Euclidean Geometry) সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। 

আইনস্টাইন এমন জ্যামিতিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তবে ডেভিড হিলবার্ট এই গণিত খুব ভালো ভাবেই জানতেন। তিনি ছিলেন সেই যুগের এক গাণিতিক প্রতিভা। হিলবার্ট সমস্যাটি নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন এবং আপেক্ষিকতা তত্ত্বের গাণিতিক বিকাশ শুরু করলেন, যা আইনস্টাইনের কাছে একটি আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠলো। আইনস্টাইন ভাবলেন তার সৃষ্টির কৃতিত্ব অন্য কেউ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাকে যা করার দ্রুত করতে হবে কারণ তার হাতে সময় খুব কম।

 

ডেভিড হিলবার্ট (ছবি -উইকিপিডিয়া) 

 

আইনস্টাইনের বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যান সে যুগের একজন মহান গণিতবিদ ছিলেন। এই বিপদ থেকে রেহাই পেতে আইনস্টাইন সেই বন্ধুর শরণাপন্ন হলেন। তার সাহায্যে আইনস্টাইন রিম্যানিয়ান জ্যামিতির (Riemannian Geometry) পাঠ শিখেছিলেন এবং তার তত্ত্বের গাণিতিক বিকাশ শুরু করেছিলেন। অন্যদিকে হিলবার্ট নিঃশব্দে কিন্তু দ্রুততার সাথে তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। গৌরবের শিখরে পৌঁছানোর দৌড় যতই তীব্রতর হতে থাকে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় দুটি অসীম প্রতিভার (একজন পদার্থবিদ, অন্যজন গণিতবিদ) দ্বন্দ্ব দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল এবং ফলাফলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।

অদৃষ্টের ইচ্ছায় এই দুই মহান মনীষী স্বাধীনভাবে এবং প্রায় একই সাথে তাদের গন্তব্যে পৌঁছান। ১৯১৫ সালের মধ্যে উভয়ের কাছেই সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের নিজস্ব গাণিতিক সংস্করণ প্রস্তুত ছিল। সতর্কতার সাথে যাচাই করে দেখা যায় যে দুটিই একই জায়গায় এসে মেশে এবং দুটিই সঠিক। সত্য এক ও অদ্বীতিয়। সেখানে পৌঁছাবার একাধিক পথ থাকতেই পারে, কিন্তু সব কটা পথই একই জায়গায় গিয়ে মেশে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে সত্যে পৌঁছাবার পথগুলি বিরল এবং কঠিন। সেই পথ খুব বেশি মানুষ অনুসরণ করতে পারেন না। কিন্তু সেই পথ অনতিক্রম্য নয়। নিষ্ঠা, অনুশাসন, অধ্যবসায় ও প্রতিভার দ্বারা সেই পথ অনুসরণ করে লক্ষে পৌঁছানো সম্ভব।  এই দুই বিজ্ঞানীর কীর্তি আমাদের এই শিক্ষাই দেয়।

হিলবার্ট স্বীকার করেন যে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পেছনে আইনস্টাইনের অবদান বেশি এবং তাই সেই তত্ত্বের কৃতিত্ব অবশ্যই আইনস্টাইনেরঈ পাওয়া উচিত। এটা মনে রাখা উচিত যে এই তত্ত্বের প্রকৃত ভিত্তি আইনস্টাইনই স্থাপন করেছিলেন এবং সম্ভবত এটিই তার কৃতিত্ব ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট। সমস্ত বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়ে দিয়ে অবশেষে ১৯১৬ সালে, আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অ্যানালেন ডের ফিজিক (Annalen der Physik) পত্রিকায় প্রকাশ করেন।

 

বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় থেকে প্রতিক্রিয়া

এই তত্ত্ব গ্রহণ করা বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। তত্ত্বটি পদার্থবিদ্যার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আইজ্যাক নিউটনের আড়াইশো বছরের মহাকর্ষ তত্ত্ব ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক যেমন কয়েক বছর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তাই ঘটলো। বিজ্ঞ্যানী মহলে সবাই সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পক্ষে পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ দাবি করলো।

তত্ত্বের অপ্রচলিত প্রকৃতি অনেক মহান বিজ্ঞানীর দ্বারা সমালোচিত হয়েছিল। কেউ কেউ এমনও ভেবেছিলেন যে সাধারণ আপেক্ষিকতা পদার্থবিদ্যার কোন তত্ত্ব নয়, আসলে এটা কোন বিজ্ঞানই নয়, শুধুমাত্র একটি কল্পনা। অনেকে বললেন আইনস্টাইন একটি কাল্পনিক জগতে বাস করছেন এবং তত্ত্বটি তারই একটি প্রতিফলন।

ফিলিপ লেনার্ড-এর (নোবেল বিজয়ী, ১৯০৫) মতো পরীক্ষামূলক পদার্থবিদরা আইনস্টাইনের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং তাকে প্রকাশ্যে উপহাস করেছিলেন। তিনি বলেন, পদার্থবিদ্যা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের বিষয়। আমরা যা দেখি তাই বিশ্বাস করি। বৈজ্ঞানিক মহলে আইনস্টাইনের মতো স্বপ্নদ্রষ্টার কোন স্থান নেই। এই সব ঘটনা থেকে আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন যে সমালোচকদের থেকে তার তত্ত্বকে বাঁচাতে হলে তাকে একটি অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত করতেই হবে।

 

সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রমাণ

আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল। এবং আইনস্টাইনের তত্ত্ব সম্পূর্ণও ছিল। কিন্তু তা কারো মনে কোন দাগ কাটতে পারেনি কারণ কেউ সেটা বিশ্বাস করেনি। এটা আইনস্টাইনের জন্য আরও বড় একটি পরীক্ষা ছিল। তিনি ভাবতে শুরু করলেন যে তত্ত্বের জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লড়াই করেছিলেন তার প্রমাণ তিনি কিভাবে দেবেন ! তাছাড়া তিনি মোটেও পদার্থবিদ্যার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পারদর্শী ছিলেন না। তাই এটি তার জন্য একটি কঠিন কাজ ছিল।

 

সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রমাণ (ছবি - https://kids.frontiersin.org/articles/10.3389/frym.2022.747040)

কিন্তু আবারও তার অসাধারণ প্রতিভা থেকে বেরিয়ে এল একটি অসামান্য চিন্তা। তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতার সম্ভাব্য প্রমাণ হিসাবে সূর্যের চারপাশে নক্ষত্রের আলোর বাঁক বা মহাকর্ষীয় লেন্সিং (Gravitational Lensing)-এর প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে দূরবর্তী নক্ষত্রের আলো যা আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছানোর আগে সূর্যের পাশ দিয়ে ভ্রমন করে, তা সূর্যের কাছাকাছি তাদের যাত্রাপথ থেকে বেঁকে যায়। সূর্যের ভর বিশাল হওয়ার দরুন এটির চারপাশের স্থান-কাল একটি বিশাল বক্রতা তৈরি করে। সূর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারার আলো এই বক্রতা অনুসরণ করবে এবং বেঁকে যাবে। ফলে আকাশে তারার একাধিক ছবি তৈরি হবে। এটি সাধারণ আপেক্ষিকতার সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। তাই আইনস্টাইনের তত্ত্ব সঠিক হলে তারার আলো সূর্যের চারপাশে বেঁকে যাবে এবং যদি তা না হয় তবে আলো সোজাভাবে ভ্রমণ করবে। আইনস্টাইন সারা বিশ্বের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এটি পরীক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।

 

আর্থার এডিংটন (ছবি - উইকিপিডিয়া) 

 

আর্থার এডিংটন (একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী) সহ অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী, এই পরীক্ষাটি করার জন্য উৎসাহিত হয়েছিলেন। শক্তিশালী সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ক্ষীণ তারার আলো পর্যবেক্ষণ করা খুবই কঠিন একটি কাজ। তাই তারা তাদের পর্যবেক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ সূর্যগ্রহণ বেছে নিয়েছিল। ১৯১৯ সালে, এডিংটনের সম্পূর্ণ সূর্যগ্রহণের পর্যবেক্ষণ আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের পক্ষে দৃঢ় প্রমাণ প্রদান করে। এই জার্মান তত্ত্বের একটি ব্রিটিশ প্রমাণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী যুগে বিশ্ব শান্তির বার্তা বহন করে এনেছিল। আইনস্টাইন এমন একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে কোন যুদ্ধ থাকবে না, রক্তপাত থাকবে না, থাকবে শুধুই শান্তি। এমনকি তার সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বও তার এই মানবিক অনুভূতির বার্তা দিয়েছিল।

১৯২১ সালে, আইনস্টাইন নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন, তবে তার আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের জন্য নয়। ১৯০৫ সালে আলোক-বৈদ্যুতিক প্রভাব (Photoelectric effect) আবিষ্কারের জন্য তাকে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মানটি প্রদান করা হয়। বলা হয় যে এতে তিনি খুবই হতাশ হয়েছিলেন। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বকে 'পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে সুন্দর তত্ত্ব' হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। আজ অবধি এই অনবদ্য সৃষ্টি - নোবেল পুরস্কার না পাওয়া একটি সেরা তত্ত্ব হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের পথে একজন অসাধারণ মানুষের অক্লান্ত সাধনার ফসল। আইনস্টাইনের অনেক প্রশ্নের ঈশ্বর প্রদত্ত একটি সহজ উত্তর।

I am not a genius, I am just curious. I ask many questions and when the answer is simple, then God is answering

 

– Albert Einstein




 

2 Comments
Leave a reply