পথিকবাবু ছেলের জন্য যোগমায়া ভ্যারাইটিজ স্টোর থেকে একটা চাইনিজ কলম কিনলেন। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, ঘটনাটা এখনকার নয়। আজ থেকে প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছর আগেকার ঘটনা। আর সে সময় কলম হিসেবে চাইনিজ কলম ছিল প্রায় সবার কাছে প্রিয় কারণ বলপেন তখনও ততটা জনপ্রিয় হয়নি যতটা জনপ্রিয় ছিল কালি কলম আর এইসব কালি কলমের মধ্যে সেরাদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল এই চাইনিজ কলম।
পথিকবাবুর ছেলে অভিরূপের খুব পছন্দের কলম এই চাইনিজ কলমের ভক্ত। সে চিত্তরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। যাই হোক পথিকবাবু কলম কিনে ফিরে আসার সময় অভির জন্য কয়েকটা জিনিস কিনে নিয়ে আসতে যাবেন এমন সময় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মাঝ বয়স্ক একটা লোকের সাথে তাঁর মুখোমুখি ধাক্কা হয়ে গেল।
খুব একটা জোরে না লাগলেও তাঁর পকেটে থাকা চাইনিজ কলমটি খসে মাটিতে পড়ে গেল। তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন ওই মাঝবয়সী ব্যক্তির হাতেও একটি চাইনিজ কলম ধরা ছিল, আর সেটিও মাটিতে পড়ে গেছে। দুজনের কাছে একই মডেলের চাইনিজ কলম। তিনি তাকিয়ে দেখলেন প্রায় চল্লিশ বছরের কাছাকাছি চোখে চশমা পরিহিত পাতলা গোছের ভদ্রলোকটি একটা পড়ে যাওয়া কলম তার দিকে বাড়িয়ে বলছেন - আয়াম ভেরি ভেরি সরি... একটু অন্যমনস্ক ছিলাম কিনা.... বুঝলেন মশাই.... এই নিন আপনার কলমটা....
পথিক বাবু বললেন, আমিও অন্যমনস্ক ছিলাম মশাই। বা বলা ভালো একটু তাড়াহুড়োতে ছিলাম। তা আপনি কলমটি কার জন্য কিনলেন দাদা?
সেই লোকটি একটু রহস্যের হাসি হেসে বললেন, এই কলম তো আর লেখার জন্য কিনিনি মশাই। এটা....মানে শুধুমাত্র আমার কালেকশন। আর আপনি?
পথিক বাবু বললেন, আর বলবেন না মশাই। ছেলের পছন্দ শুধু চাইনিজ কলম। অন্য কোনো কলমে সে হাতই দেবে না। ওরও কিন্তু আপনার মতোই কলমের কালেকশন রয়েছে। কী আর করা?
ওই ব্যক্তি বললেন, তা আপনার বাড়ি কোথায়?
পথিকবাবু হেসে বললেন- পশু হাসপাতালের সামনে সুফল পল্লীতে আমার বাড়ি। যাই হোক আমাদের ধাক্কাধাক্কিতে দু'চারটে কথা হয়ে গেল। কি বলুন? তা আপনার নাম?
আমার নাম কমলেশ। আপনার ছেলের কলমের কালেকশন দেখার ইচ্ছে রইলো। তা আপনার নাম?
আমার নাম পথিক পাল। হ্যাঁ, আসুন না একদিন আমার বাড়ি। আমাদের বাড়িতে যে কোনোদিন আপনার চায়ের আমন্ত্রণ রইলো।
হঠাৎ দুটো পুলিশ ভ্যান দেখা গেল। পথিকবাবু খেয়াল করলেন পুলিশের গাড়ি দেখেই কমলেশবাবুর চোখে কেমন একটা চঞ্চলতার ভাব ফুটে উঠেছে।
কমলেশবাবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে বললেন, আজকে একটু তাড়া আছে দাদা... তবে আমি খুব তাড়াতাড়ি আপনার বাড়িতে দেখা করছি। আর একটা কথা বলি। এই কলমটা আপনার ছেলের জন্য কিনেছেন, তাই অন্য কাউকে দেবেন না যেন।
পথিক বাবু বললেন - সে তো বটেই।
বাড়ি ফিরে পথিকবাবু তাঁর ছেলে অভিকে চাইনিজ কলমটি হাতে দিয়ে বললেন, দেখ দেখ। এটা কিন্তু আগের চেয়েও ভালো, এতে ড্রপারে করে কালি ভরতে হবে না, কারণ এতে কালি ভরার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। যা তো একছুটে কালির দোয়াতটা নিয়ে আয়। আমি তোকে কলমটাতে কালি ভরার কায়দাটা শিখিয়ে দিচ্ছি।
অভির আনা কালির দোয়াতটা নিয়ে পথিকবাবু পেনের ঢাকনাটা খুললেন। আর তারপর নিবের পুরোটা কালির দোয়াতে ঢুকিয়ে দিলেন। কলমের মাঝখানটা যেখানে টিউবের মতো অংশটা রয়েছে সেখানে একটা হাল্কা চাপ আর ব্যাস দেখতে দেখতে কলমটা কালিতে পূর্ণ হয়ে গেলো। অভি খুব খুশি। সে চিৎকার করে বললো বাঃ, বাবা তুমি সত্যিই আমার জন্য খুব সুন্দর চাইনিজ কলম এনেছো। আমি আমার পড়ার রুমে যাই বরং।
পথিকবাবু কমলেশবাবুর সাথে ধাক্কার ঘটনাটা জানিয়ে বললেন - হ্যাঁ, তাই যা। আমিও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি রে।
রুমে এসে অভি কলমটা নেড়েচেড়ে দেখলো। বেশ সুন্দর ডিজাইন। কলমের গায়ে নকশা কাটা। এবারে সে একটি খাতা নিয়ে নিজের নামটা লিখতে চেষ্টা করলো। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কলমটি দিয়ে সে এমনকি একটা আঁচড়ও কাটতে পারলো না। না, এমন তো হওয়ার নয়। তার সংগ্রহে প্রায় খান পঞ্চাশেক চাইনিজ কলম আছে। কয়েকটা ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি কলমেই খুব সুন্দর লেখা যায়। তাহলে এই এত সুন্দর কলমটাতে লেখা যাচ্ছে না কেন?
অভি অনেকবার কলমটিকে ঝাড়লো। নিবটাকে কাপড় দিয়ে মুছলো এবং নিবটাকে বারবার কাগজে ঘষলো। তবু বিন্দুমাত্র লাভ হলো না। অভি তখন টিউবটার গার্ড অর্থাৎ উপরের ঢাকনাটিকে খুলে ফেললো।
এই ঢাকনাটি একটি পাইপের মতো। কি মনে হওয়াতে অভি ঢাকনাটার ভিতরে চেয়ে দেখলো এবং অবাক হয়ে গেলো। অভি তাকিয়ে দেখলো একটা সাদা মতো কাগজের টুকরো পাইপের মতো ঢাকনাটির ভিতরে আটকে রয়েছে। সে খুব সাবধানে একটি কাঠি নিয়ে কাগজের টুকরোটি বার করলো। আর তারপর সে খুব ধীরে ধীরে মোড়া কাগজের টুকরোটিকে অর্থাৎ চিরকুটটিকে মেলে ধরলো।
সে দেখল চিরকুটটিতে লেখা আছে, -
শিবুর দোকানে পাওয়া যায়
কলম আর কালো জিরে
তার বুক চিরে দিলেই
পেয়ে যাবে আসল হিরে...
লাইন চারটি পড়া হয়ে গেলে কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেলো অভিরূপ। এমনিতে সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়লেও স্বভাবে খুবই ডানপিটে। গল্পের বই এর যাকে বলে পোকা সে। আর গোয়েন্দা গল্প হলে তখন তো তার চোখ বই থেকে সরানো মুশকিল। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরিটি, অর্জুন, গোগোল, শার্লক হোমস ইত্যাদি গোয়েন্দাদের বইগুলি যেন গুলে খেয়েছে সে। তারও স্বপ্ন সে বড়ো হয়ে ফেলুদা বা ব্যোমকেশের মতো গোয়েন্দা হবে। রাতে মাঝে মাঝে সে স্বপ্নও দেখে ফেলুদার মতো তার ডাক পড়েছে কোন কেস সমাধান করার জন্য।
অভিরূপের কাকাবাবু অনিকেত মুখুজ্জে টাউন থানার বড়বাবু। তিনি খুব ভালোবাসেন অভিকে। মাঝেমধ্যেই কাকা-ভাইপোর আড্ডা বসে বাড়িতে। কাকাবাবুর কাছ থেকে নানা কেস সমাধানের গল্প শুনতে শুনতে অভি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে। আবার অভির কথাও মন দিয়ে শোনেন তিনি।
অভি কলমের ভেতর থেকে পাওয়া চারটি লাইন নিয়ে ভাবতে বসল। কিন্তু কিছুতেই ভেবে পেলনা কলমের ভিতরে কাগজের চিরকুটটি এলো কোথা থেকে? তাছাড়া যে চারটি লাইন লেখা রয়েছে তারই বা অর্থ কী?
তাছাড়া এতো সুন্দর একটা কলমে লেখা পড়ছে না কেন? তাহলে কি এর পিছনে কোনো রহস্য আছে?
সে অনুমান করলো কমলেশবাবুর সাথে ধাক্কার লাগার পর অবশ্যই তার বাবার কেনা কলমের সাথে কমলেশবাবুর কলম পাল্টাপাল্টি হয়েছে। নচেৎ এতো সুন্দর একটা কলমে লেখা পড়বে না কেন? তার থেকেও বড় কথা একটা নতুন কেনা কলমের ভেতরে ওরকম রহস্যময় চিরকুট থাকবে কেন?
অভির কাকাবাবু একটা বিশেষ কাজে জেলার বাইরে গেছেন। অভি ভাবলো, সে একটা ফোন কল করবে তার কাকাবাবুকে। পরক্ষণেই সে ভাবলো, না। তার কাকাবাবু হয়তো বিশেষ কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন, তাই তাঁকে এসময় বিরক্ত করা মোটেই ঠিক হবে না। তাছাড়া সে ভবিষ্যতে গোয়েন্দা হতে পারবে কিনা তারও একটা পরীক্ষা হতে পারে এই কলম রহস্য সমাধান।
অভি নিশ্চিত হতে না পারলেও তার অনুমান কমলেশবাবু দুএকদিনের মধ্যে অবশ্যই কলমটি নিতে আসবেন কারণ কলমটির মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো রহস্য আছে।
অভি আবার ছড়াটি নিয়ে ভাবতে বসলো। যেহেতু কলমটাতে লেখা পড়ছে না তার মানে কলমটিতে নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি রয়েছে। আচ্ছা চিরকুটটিতে কি কোনো বার্তা রয়েছে? সেটির সমাধান করতে পারলেই কি কলমটা দিয়ে লেখা যাবে?
প্রথম দুটি লাইনে তো কোনো রহস্য নেই বলেই মনে হচ্ছে। পরের দুটো লাইনই গোলমেলে।
তার বুক চিরে দিলেই
পেয়ে যাবে আসল হিরে…
এক্ষেত্রে হিরে বলতে কি হিরে জহরতের কথা হচ্ছে নাকি? তাছাড়া বুক চিরে দেওয়া বলতে কার বুক চেরার কথা বলা হচ্ছে?
রাত্রে খাবার পর সে আবার নিজের রুমে এসে কলমটিকে নিয়ে পড়লো। আরেকবার সে চেষ্টা করলো কলমটি দিয়ে লেখার। কিন্তু না, সব চেষ্টা বৃথা। অবশেষে ছড়াটি নিয়ে ভাবতে লাগলো সে। তার বুক চিরে দিলেই..... পেয়ে যাবে.....
শিবুর দোকানে পাওয়া যায়
কলম আর কালো জিরে…
অভি জানে কালো জিরে পোস্ত দানার থেকে সামান্য বড়ো তাই তার বুক চেরার প্রশ্নই নেই। বাকি থাকলো কলম। তাহলে কি কলমটির বুক চেরা অর্থাৎ কালি ভরানোর টিউবটিকে চেরার কথা বলা হয়েছে। টেবিলে রাখা চাইনিজ কলমটিকে হাতে নিলো সে। আরেকবার লেখার চেষ্টা করলো। শেষ পর্যন্ত কলমটির যে কালির টিউব আছে তার উপরের স্টিলের আবরণটিকে সে খুলে ফেললো।
কি মনে হওয়াতে সে টিউবটিকে হালকা চাপ দিলো। এর ফলে নিব দিয়ে কালি বেরোনোর কথা। কিন্তু না, কোনো কালি তো বেরোলো না। অভি আবার একটু জোরে চাপ দিলো। এবারও কোনো কালি বেরোলো না এবং টিউবটিতে চাপ দিতে একটু হলেও কষ্ট হলো। অভি সেই ছোটো থেকে চাইনিজ কলমে লিখছে তাই এই কলমের অনেককিছুই তার জানা। সে অনুমান করলো টিউবের অগ্রভাগে অর্থাৎ নিবের গোড়ায় অবশ্যই কোনো না কোনো গোলাকার বস্তু আটকে আছে তাই কলমটাতে লেখা পড়ছে না।
আচ্ছা সেই গোলাকার বস্তুটি কি ছড়াতে বলা আসল হিরে? তাহলে কি সে একবার টিউবটিকে চিরে দেখবে? কিন্তু অতো সুন্দর একটা কলম নষ্ট করতে তার মন চাচ্ছিল না। কলম রহস্যের সমাধান করতে হলে অন্য কোনো উপায়ই কি নেই?
অনেক ভাবার পর সে কলমটি নিয়ে বাথরুমে গেলো। তারপর একটা পরিষ্কার জায়গা বেছে নিয়ে কলমের নিবটি একহাতে ও অন্যহাতে কলমটির প্রান্তদেশ ধরে নিবটিকে জোরে টানলো। সাথে সাথে কলমটির নিবসহ কালি বেরিয়ে এলো। হ্যাঁ, তোমরা ঠিক ধরেছ চাইনিজ কলমটির নিব ও কালির সাথে বেরিয়ে এলো কালো জিরের থেকে বেশ কয়েকগুন বড়ো সাইজের একটি হিরে যেটি বাথরুমের হালকা আলোতে ঝিকমিক করতে লাগলো।
তার মনে হলো চাইনিজ কলম রহস্যের সমাধান বোধহয় সে করতে পেরেছে। অভি তক্ষুণি তার কাকাবাবুকে ফোন করে সব জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো। সে জানে বাকি ব্যাপারটা ভালোভাবেই সামলাতে পারবেন তার কাকাই অনিকেতবাবু।