‘কোটা’ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রে বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতন

লিখেছেন:প্রণব দে

বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ হলেও, এপারে যারা বাংলাভাষী, তাদের সাথে বাংলাদেশের এক ধরনের মানসিক নৈকট্য, এখনও মনে হয়, বর্তমান। দেশভাগ দেশীয় বুর্জোয়া - ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্রের রাষ্ট্রিক রাজনীতির দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সাংস্কৃতিক পরম্পরার ধারাবাহিকতা, দুই দেশের বন্ধনরজ্জু এখনও বোধ হয় বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি। গত ৫ আগস্ট ২০২৪, প্রতিবেশী দেশটিতে এক বড়ো রকমের পালাবদলের ঘটনা ঘটে গেল, যে ঘটনার অনুরণন এপার বাংলার চিত্তকেও দোলায়িত করেছে। 

শুরুটা হয়েছিল চাকরিতে সংরক্ষণ বা কোটার হারের সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরির প্রায় ৫৬ শতাংশই ছিল সংরক্ষণের আওতায়। তার মধ্যে ৩০ শতাংশই ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ও তাদের উত্তরসূরীদের জন্য সংরক্ষিত। উত্তরসূরীদের জন্য এই সংরক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত প্রলম্বিত করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। ২০১৮ সাল থেকে ছাত্রছাত্রীদের তরফে সরকার নির্ধারিত সংরক্ষণের হার পরিবর্তনের দাবিটি বেশ জোরালো কণ্ঠে উত্থাপিত হতে শুরু করে। ক্রমাগত ছাত্র আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকার সমস্ত রকম সংরক্ষণ তথা কোটা বাতিল করে দেয়। আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে যায়। 

কোটা বাতিলের সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে, জনা কয়েক ব্যক্তি তিন বছর বাদে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। হাইকোর্ট ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি আদেশ বাতিল করে, কোটা প্রথা পুনর্বহাল করে। 

হাইকোর্টের এই আদেশের পর বাংলাদেশের ছাত্র-সমাজ আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আদালত কর্তৃক আদেশ প্রদানের পরের দিনই ৫ ও ৬ জুন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কোটা ব্যবস্থার সংশোধনের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অনেকের সন্দেহ, সংবিধানে সমাজের দুর্বল শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের বিধান থাকা সত্ত্বেও, শেখ হাসিনা সরকারের সমগ্র সংরক্ষণ বাতিল করা আসলে ছিল একটা কৌশল, যাতে আদালতে আদেশ বাতিল হলে, সরকার দায় এড়াতে পারে। যাই হোক, ১ জুলাই থেকে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী সমাজ আন্দোলনে সামিল হয়। তাঁদের দাবি ছিল— ১) সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা বাতিল, ২) সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ন্যায্য হারে কোটা, ৩) চাকরি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা ব্যবস্থার জন্য সংসদে প্রয়োজনীয় আইন প্রবর্তন। ৭ জুলাই বাংলাদেশ ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। হরতাল এরপর চলতেই থাকে। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের বিদ্রুপ করে মন্তব্য করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?”। এই মন্তব্য বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভের আগুণে ঘৃতাহুতি সঞ্চার করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রীরাও দলে দলে আন্দোলনে সামিল হয়। রোকেয়া হলের ছাত্রীরা তালা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসে। 

সরকার ইন্টারনেট সংযোগ ছিন্ন করে দেয়। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন, ‘ছাত্রলীগের’ সদস্যরা দলীয় নির্দেশে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালাতে শুরু করে। এমনকি ঢাকা মেডিকেল কলেজে শুশ্রূষারত আহত আন্দোলনকারীদেরও ছাত্রলীগের সদস্যরা রেয়াত করেনি। ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে যুবক আবু সাঈদ নিহত হন। ঐ একই দিনে সাভারের কাছে, পুলিশের রাবার বুলেটের আঘাতে নিহত হন শেখ আশাবুল ইয়ামিন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিন মোট ৬ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হন। পুলিশি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে শুধু শিক্ষার্থী মহল নয়, জনকণ্ঠও সোচ্চার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সরকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ছাত্রলীগের প্রতি ভয়ভীতি কাটিয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলি থেকে, আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার করে। সংগ্রাম শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর্যায় থেকে উন্নীত হয়ে জনগণের আন্দোলনে পরিণত হয়।

১৮-১৯ জুলাই সমগ্র বাংলাদেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। সরকার সর্বত্র কারফিউ জারি করে। RAB, BGB প্রভৃতি আধা-সেনাবাহিনীকেও বিক্ষোভ দমনে নিয়োজিত করা হয়। কারফিউ উপেক্ষা করেই মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে শামিল হয়। আন্দোলন যত অগ্রসর হয়, দিনে দিনে লাশের পাহাড় ভারী হতে থাকে। নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারে ক্ষমতাসীন দলের আক্রমণে ‘কোটা আন্দোলনে’ ঠিক কতজন নিহত হয়েছেন, তার সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। শেখ হাসিনা সরকার ১৫০ জনের মৃত্যুর খবর স্বীকার করেছিল (The Hindu, 30 July, 2024) । বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘প্রথম আলো’-র তথ্য অনুযায়ী ১৬ থেকে ২৬ জুলাই, এই ১১ দিনে ২০৯ জন আন্দোলনকারী নিহত হন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিপোর্ট বলছে, ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্টের মধ্যে ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, “The majority of deaths and injuries have been attributed to the security forces and the student wing affiliated with the Awami League. These casualties resulted from the use of live ammunition and other force against protesters who while acting violently reportedly were not armed, or only lightly armed, as well as from instances of security forces unlawfully using lethal force against protesters posing no apparent threat, unarmed protesters, and bystanders, including at least 4 journalists and at least 32 children, with many more injured and detained – a number of whom were seemingly deliberately targeted” (সূত্র- Preliminary Analysis of Recent Protests and Unrest in Bangladesh, 16 August 2024)। 

৯ জুন ২০২৪ তারিখে শেখ হাসিনা সরকার হাইকোর্টের ‘কোটা বহালের’ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। কিন্তু আপিলের নিষ্পত্তি নিয়ে সরকারের তরফে একটা গড়িমসি ভাব ছিল। অবস্থার প্রেক্ষিতে ১৯ জুলাই মধ্যরাতে, সরকারের তিন মন্ত্রী ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ তিন প্রতিনিধির সাথে আলোচনায় বসেন। আন্দোলনকারীরা তাঁদের দাবিপত্র পেশ করেন। আন্দোলন জারি থাকে। এই অবস্থায় কার্ফুর মধ্যেই, ২১ জুলাই রবিবার, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তড়িঘড়ি সরকারের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে। সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করে, ৭ শতাংশ কোটা বজায় রেখে বাকি ৯৩ শতাংশ উন্মুক্ত করে দেয়। সাত শতাংশের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের উওরসূরীদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ পদ সংরক্ষণের আদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। একইসঙ্গে আদালত শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়। প্রধান বিচারপতি রায় ঘোষণার সময় বলেন, ‘গত ১০ জুলাই প্রদত্ত এক আদেশে এই আদালত হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা দিয়েছিল এবং এর (হাইকোর্টের রায়ের) কার্যক্রম স্থগিত করে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিল। এই অন্তর্বর্তী আদেশের ফলে ২০১৮ সালে সরকারের কোটা বাতিল সংক্রান্ত পরিপত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু এই আদেশটির অর্থ আমাদের শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েরা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে, অনাকাঙ্খিত ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে, ঝরে গেছে অনেক প্রাণ, যা মোটেই কাম্য ছিল না’ (সূত্র- দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৬ জুলাই ২০২৪)।

সুপ্রিম কোর্টের আদেশে শিক্ষার্থীদের ‘কোটা’ সংক্রান্ত দাবির আংশিক সমাধান হলেও, ততদিনে কিন্তু  আন্দোলনের মোড় ঘুরে গেছে। ব্যাপক গণহত্যা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের এযাবৎ সঞ্চিত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। ২৫ জুলাই ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলামের বক্তব্য’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ বিবৃতি ফেসবুকে পাওয়া যায়। বিবৃতিটিতে বলা হয়—

“কোটা সংস্কার প্রজ্ঞাপন ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু কথা—
★ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারসদের সাথে আলোচনা ব্যতীত জারি করা কোটা সংস্কারে প্রজ্ঞাপন চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে আমরা গ্রহণ করছি না। যথাযথ সংলাপের পরিবেশ তৈরি করে নীতিনির্ধারণী জায়গায় সকলপক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন দিতে হবে।
সরকার চাইলে যেকোনো সময়ই ইচ্ছামত কোটা পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারে। তাই অংশীদারদের অংশগ্রহণে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে যা কোটা পদ্ধতির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করবে। কোটার যেকোনো পরিবর্তন এই কমিশনের সুপারিশ সাপেক্ষে হতে হবে। এবং আমাদের একদফায় সংসদে আইন পাশের বিষয়টি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তাই কোটা সমস্যার এখনো চূড়ান্ত সমাধান হয়নি।
২০১৮ সালেও আন্দোলনের চাপে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল ৬ বছরেই সেটা বাতিল করা হয়৷ আমরা এই পরিপত্র বা প্রজ্ঞাপনের খেলায় আর বিশ্বাস করি না।
★ দ্বিতীয়ত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর কেবল কোটা সংস্কারের ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই। তাই প্রজ্ঞাপন জারির সাথেই এ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটবে না। ছাত্র-নাগরিক হত্যা ও গুম-খুনের বিচার, রাষ্ট্রীয় ক্ষয়ক্ষতির বিচার, মামলা প্রত্যাহার ও ডাকসু সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনসহ নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তি, আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণ এবং সকল ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী রাজনীতির উৎখাত ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিচারের দাবিতে দফাভিত্তিক আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
★ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা-নিপীড়ন চালিয়ে রক্তাক্ত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। হত্যা, গুম, গ্রেফতার, ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন ও প্রোপাগান্ডা— রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল শক্তিকে ব্যবহার করে সরকার আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছে। ফলে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। সরকারের দমন-পীড়ন নীতির কারণেই এই অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাই এর দায় সম্পূর্ণভাবে সরকারকেই নিতে হবে।
সরকার এখন এসব দমন-পীড়ন ও হত্যাকে আড়াল করছে এবং মিডিয়াকে ব্যবহার করে কেবল নাশকতার ঘটনা প্রচার করছে যার সাথে আন্দোলনকারীদের কোনো সম্পর্ক নাই। এবং পুরো ঘটনাকে 'সরকার বনাম বিরোধী দলের সংঘাত' হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই আন্দোলন ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের পাশে অভিভাবকসহ সর্বস্তরের নাগরিকে রাজপথে নেমে এসেছিল। ছাত্র-নাগরিকরাই সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
★ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে আট দফা ও নয়দফা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। আট দফা ও নয় দফার সাথে কোনো নীতিগতবিরোধ নেই। মূল বক্তব্য একই।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক হলে সকলের সাথে আলোচনা করে আমরা চূড়ান্ত বক্তব্য ও কর্মপরিকল্পনা সকলের সামনে পেশ করবো।
এখন আমাদের জরুরি চারটি দাবি হলো— ইন্টারনেট খুলে দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যাহার করে সকল ক্যাম্পাসের হল খুলে দেওয়া, কারফিউ প্রত্যাহার করা এবং সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আমাদের দুটি দাবি ইতোমধ্যে আংশিক পূরণ হলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাস খুলে দিতে হবে ও কারফিউ প্রত্যাহার করতে হবে।
★ সারাদেশের অনেক সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারী আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইছেন, করনীয় জানতে চাইছেন। সকলের প্রতি আহ্বান থাকবে”

কার্যত গণ-প্রতিরোধ চলতেই থাকে। সরকারি স্তরে ব্যাপকহারে ধরপাকড়ও চলতে থাকে। শুধুমাত্র ঢাকাতেই তিন হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ নেতৃবৃন্দকেও গ্রেপ্তার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ব্যাপক গ্রেপ্তার ও হত্যার বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন। সমাজের প্রতিটি স্তরে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মূর্ত হয়ে ওঠে। আন্দোলনের তীব্রতার মুখোমুখি হয়ে ১ আগস্ট আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাতেও আন্দোলনের তীব্রতা কমেনি। ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে আলোচনায় আহ্বান করেন। আন্দোলনকারীরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অনির্দিষ্টকালের জন্য 'সর্বাত্মক অসহযোগের' ডাক দেয়। প্রায় সর্বত্রই হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। ৪ আগস্ট সরকারের দমননীতির ফলে সারা দেশে প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু ঘটে। গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায় (সূত্র- The Guardian, 4 Aug 2024)। সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ৫ আগস্ট ঢাকা অভিযানের ডাক দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা ঐদিন পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনের অবসান ঘটে।

সংরক্ষণ তথা কোটা নিয়ে অসন্তোষ এই উপমহাদেশে যুবসমাজের কাছে বরাবরই এক স্পর্শকাতর বিষয়। অপ্রতুল কর্মসংস্থান সব দেশেই এক জীবন্ত সমস্যা। বিশ্বায়নের অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরেও ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের’ জন্য ৩০ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণ— শিক্ষিত যুবসমাজের ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ আছে। ছয় বছর আগে, বিষয়টি নিয়ে যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন থেকেই, সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি না করে, শেখ হাসিনা বিষয়টি নিয়ে প্রায় ছেলেখেলা করেছিলেন। প্রথমত, তিনি বলেন, নীতিগত কারণে নয়, “বিরক্ত হয়ে” তিনি ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য, “তখনই বলেছিলাম যে কোটা বাদ দিলে দেখেন কী অবস্থা হয়। এখন দেখেন কী অবস্থা তৈরি হয়েছে?” (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ জুলাই ২০২৪)। অর্থাৎ বিদ্যমান কোটা প্রথা বদলের ইচ্ছা তাঁর ছিল না। চাকরিপ্রার্থী যুবকদের সবক শেখাতে তিনি সেটা বাতিল করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, পরে হাইকোর্ট যখন কোটা প্রথা পুনর্বহাল করে, তখন সরকারের গয়ংগচ্ছ মনোভাব এবং আন্দোলন দমনে দল ও প্রশাসনকে নিয়োজিত করার মধ্য দিয়েই তাঁর মনোভাব পরিষ্কার ব্যক্ত হয়েছিল। বিশেষত ‘রাজাকার’ মন্তব্য বারুদে অগ্নি সংযোগ করে। 

বারুদটা হলো শেখ হাসিনা সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষের তীব্র ক্ষোভ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তারপর থেকে ৪ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত টানা ১৫ বছর শাসনক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় আসীন ছিলেন, এমন ভাবার কারণ নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি সংবিধান সংশোধন করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিধানটি বাতিল করে দেন। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন পরিচালিত হয়। তিনটি নির্বাচনেই ব্যাপক রিগিং হয়। ২০১৪ সালে প্রধান বিরোধী দলগুলি নির্বাচন বয়কট করে। বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ভাষায়, “দেশে বিগত ১৫ বছর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথ রুদ্ধ ছিল। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য পতিত সরকার নির্যাতন ও দমন-পীড়নসহ নানা প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেয়। প্রশাসন থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায়ও সরকার হস্তক্ষেপ করেছিল। তারা দেশের বিচার বিভাগ অকার্যকর করে ফেলেছে। মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সাংবিধানিক সংস্থাগুলো কাজ করতে পারেনি। পেশিশক্তি ও রাজনৈতিক নিয়োগের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেরুদণ্ডহীন ও মাস্তানদের আস্তানা হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। কমেছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। একদিকে ব্যাংক প্রভাবশালীদের নানা অজুহাতে ঋণ দিয়ে ব্যাংকিং খাতকে করেছে দুর্বল; অন্যদিকে হাজারো কোটি টাকা পাচার হয়েছে।…সব মিলিয়ে দেশে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার পরিবেশ ছিল না। ফলে বেড়েছে সামাজিক বিষণ্নতা ও অস্থিরতা।…সাধারণ মানুষের মনে এ প্রশ্ন ছিল যে, স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম-দুর্নীতির শেষ হবে কবে। মানুষ প্রশ্ন করেছে, কিন্তু তা কখনও বড় আন্দোলনের দিকে যায়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সেদিকে যাওয়ার কথা ছিল না। কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত ধরে এ আন্দোলন শুরু হয়নি। কিন্তু সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই আন্দোলন। আন্দোলন দমনের জন্য শেখ হাসিনা যে হিংস্র পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা-ই এই আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দিয়েছে।” (প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪) বাংলাদেশের অপর এক মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ বদরুদ্দিন উমর-এর ব্যাখ্যায়, “শুধু ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের কারণে জনগণ এ অভ্যুত্থানে নেমেছে এমন নয়। সারা দেশে জনগণের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সবকিছুর দাম বেপরোয়াভাবে বেড়েছে। সরকার জনগণের মতপ্রকাশের ওপর, বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। সংবাদপত্রগুলোয় সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যায় না। এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই। তাদের ধারণা, এ সরকার যত দিন থাকবে তত দিন পর্যন্ত ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, দেশের টাকা পাচার, সরকারের প্রজেক্ট থেকে টাকা চুরি, এসব বন্ধ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। কাজেই অভ্যুত্থান এখন হয়েছে।” (বণিক বার্তা, ২৯ জুলাই ২০২৪)। 

সব মিলিয়ে এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণেই শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে। ‘কোটা’ সেক্ষেত্রে স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে মাত্র। 

একটা বড়ো ধরনের সামাজিক আলোড়ন যখন উপস্থিত হয়, কিছু সুযোগসন্ধানী তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সদ্য-অতীত আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের সংগঠিত প্রয়াস ছিল না। ফলে আন্দোলনে কিছু বেনোজল প্রবেশ করেছিল, যার ফলে হয়তো কোথাও কোথাও সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়েছিল। তবে এটা ঘটনা, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে এবং পরে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ক্রোধের শিকার হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্তাব্যক্তিরাও ছিলেন। সাম্প্রদায়িক শক্তি যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সুযোগ নেবে, এটা অনস্বীকার্য। মুহাম্মদ ইউনুস-এর অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে ‘আয়নাঘরের’ মতো ভয়াবহ গুমঘর থেকে অনেক বন্দিদের উদ্ধার করেছে। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক সংকট, বেকার সমস্যা ইত্যাদি সমাধানে এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলায় তারা কতটা সফল হবে, এখনই তা বলার সময় আসেনি। ইতিমধ্যেই সাভারে পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের উপর পুলিশের ঘটনা নজরে এসেছে। আগামী দিনে, শ্রমজীবী জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান না হলে, সমস্যার সমাধান কঠিনতর হয়ে উঠবে। 

 

0 Comments
Leave a reply