এই মেয়ে শোন
এই রাত এই ভোর
যতখানি পুরুষের
ততখানি তোর!
কিংবা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘নো মিনস নো, ইয়েস মিনস ইয়েস’, ১৪ই আগস্ট মেয়েদের রাস্তা দখল রাত দখলের রাতে এমন অজস্র স্লোগান আর হাতে হাতে লেখা পোস্টার, শহরে মফস্বলে গ্রামে হাজারে হাজারে মেয়েদের উচ্চকণ্ঠ উপস্থিতি মানুষকে হতচকিত করে দিয়েছিল। মেয়েদের দাবি - রাতের অধিকার আমাদের দিতে হবে, মানুষ হিসাবে সমস্ত অধিকার আমাদের দিতে হবে, তা ঘরে - কর্মক্ষেত্রে - পথে - সমাজে - সমস্ত জায়গায়। অগণিত নির্ভীক মেয়েরা সমস্ত বাধা, সমস্ত সামাজিক ঘেরাটোপ, বাড়ির বন্ধন ছিন্ন করে রাস্তায় মাঠে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিল। দাবি করেছিল জাস্টিসের। কোন এক অজানা মেয়ে ডাক দিয়েছিল মেয়েরা রাত দখল কর। মধ্যরাতের এই অভিযানে পুরুষরাও শামিল হয়েছিল। কোন নেতা কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব কেউ এই সমাবেশ এই মিছিলে নেতৃত্ব দেয়নি। এই সমাবেশ ছিল নিরস্ত্র কিন্তু শক্তিশালী। ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী আত্মনিয়ন্ত্রিত সপাট। শুধু কলকাতা নয়, মুম্বাই চেন্নাই বেঙ্গালুরু শিলং হায়দ্রাবাদ দিল্লী দার্জিলিং থেকে শুরু করে লন্ডন নিউইয়র্ক শুধু নয়, কেমব্রিজ অক্সফোর্ড আইভী লিগের কলেজ গুলি অবধি আর জি কর কলেজের নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল।
আর জি করের ধর্ষণ ও খুনের আইনগত জাস্টিস পাওয়া যাবে কিনা সেটা এখনই বলা যায় না ঠিকই কিন্তু এই আন্দোলন অনেকগুলি প্রশ্নকে সামনে জোরালোভাবে এনে দিয়েছে। প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এবং মেয়েদের আন্দোলন ছিল একেবারেই পৃথক যদিও দুটো মিশে ছিল। যথার্থভাবে এ প্রশ্ন উঠেছিল যে থ্রেট কালচারের থেকেও রেপ কালচার অনেক বেশি গভীরভাবে সমাজিক সুতরাং এর বিরুদ্ধে দাবিও অনেক গভীর। সমাজের উপরিতলের নির্বিরোধী প্রতিবাদহীন আত্মকেন্দ্রিক ওটিটি প্লাটফর্মে মগ্ন নেট দুনিয়ায় ব্যস্ত তরুণ তরুণীদের দেখে মনে হয় না যে তাদের মধ্যে এত ক্রোধ এত ঘৃণামিশ্রিত ক্ষোভ জমেছে আগ্নেয়গিরির লাভার মত। শুধুমাত্র সমাজের উপরিতলের বাস্তবতা দেখে সমাজকে বিচার করা যায় কিনা এ ঘটনা আমাদের সামনে এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। “আর নয়” এই বার্তা প্রত্যেকটি সমাবেশে, মেয়েদের শরীরী ভাষায়, আন্দোলন ও সমাবেশের ব্যাপ্তিতে, স্লোগানে ফুটে উঠেছে। কেননা মেয়েদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে অবমাননা - যে পীড়ন - যে বদ্ধতা তিলে তিলে সহ্য করতে হয়, - সমাজ বাহ্যিক বস্তুগত অনেকদিক থেকে ‘উন্নত’ হলেও ওই অবস্থার এমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। না হলে আজ থেকে প্রায় ৭৬ বছর আগে জ্যোতির্ময়ী দেবী লিখেছিলেন “মেয়েদের পরিচয় - হয় শুধু সম্পর্কের ইতিহাস, নয় পরিচয়হীন সম্পর্কহীন রূপবহ্নিবিলাসে পোড়ানো ও পুড়ে যাওয়ার কাহিনী, এছাড়া আর কোন পরিচয় - মানুষের পরিচয় পৃথিবীর ইতিহাসে স্পষ্ট করে পাওয়া যায় না। চিরকালই তারা হয় সতী সীতা সাবিত্রী নয় উর্বশী বসন্তসেনা ক্লিওপেট্রার দলে।” শুনে মনে হয় না এটা একদম এখনকার কালের রচনা! বর্তমানেরও প্রশ্ন, মেয়েরা এই পরিচয় থেকে মুক্তি পাবে কী করে?
এই আন্দোলন কি শুধু প্রতিবাদী মেয়েদের রাস্তায় নামিয়েছে পুরুষদেরও কি বহু প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় নি? পুরুষদেরও তো মানুষ হয়ে উঠতে হবে। পরিবারে সমাজে রাষ্ট্রে পুরুষরাই তো মূলত পিতৃতন্ত্রর ক্ষমতা-কাঠামোকে ধরে রাখে। পিতৃতন্ত্রের সেই কাঠামো তো জেন্ডার স্টিরিওটাইপ দিয়ে সচল ও সবল থাকে। সমাজে পুরুষদের এই আধিপত্যকামী অবস্থান থেকে না সরলে তারা তো পুরুষই থাকবে মানুষ হয়ে উঠবে না। শুধু স্ত্রীলিঙ্গ নয় পুংলিঙ্গও তো একটি সামাজিক নির্মাণ। প্রকৃতিগত বা জৈবিকভাবে মেয়ে-ছেলে নারী-পুরুষ পৃথক কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের পৃথক করা যায় কিভাবে? যুক্তিগ্রাহ্য পথে তো তা করা যায় না। অথচ সমাজে পরিবারে ভাষায় কাব্যে সাহিত্যে এই বিভাজন প্রবল ভাবে উপস্থিত। আমরা কি জানতাম না এমনকি যুবতী কান্তা স্ত্রী রমণী এই শব্দগুলির মধ্যে দিয়েও নারীকে সহিংসভাবে ভোগ্য বস্তুরূপে চিহ্নিত করা হয়? অন্যদিকে বীরত্ব বুদ্ধিমত্তা শৌর্য্য সাহসিকতা ইত্যাদি শব্দকে পৌরুষের প্রতিশব্দ হিসেবে ধরা হয়। রাজনৈতিক রাষ্ট্রের মেরামতি দিয়ে কি এই কৃত্রিম সামাজিক নির্মাণকে ভেঙে নারী-পুরুষের মানুষ হয়ে ওঠার অভিমুখ তৈরি হবে? সামাজিক সমস্যা তো সামাজিকভাবেই সমাধা করতে হয়। যেমন বিজ্ঞানের সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান সম্ভব। এখানেই যত জটিলতা।
আন্দোলন কে কেন্দ্র করে রাজনীতি ও অরাজনীতি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এ কথা ঠিকই যেখানে সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে এক রাজনৈতিক রাষ্ট্রের প্রবল নাছোড় হস্তক্ষেপ আছে (অবশ্য অন্য কিছু হওয়ারও কথা নয়) সেখানে মনে হতেই পারে যে রাজনীতির বাইরে যেনবা কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। আবার এ কথা সত্যি যে এমন অনেক বিষয় আছে যার প্রকৃত স্বরূপ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত না করে বিচার করলে সে নিয়ে আন্দোলন বা সংগ্রাম বিপথগামী ও দিশাহীন হয়ে যায় । বিভিন্ন ধারার রাজনীতির সাথে এই বিষয়গুলির নানান সম্পর্ক আছে এটাও সত্যি। কিন্তু আজ যেমন লিঙ্গরাজনীতি বা জাতপাতের রাজনীতির, এক কথায় রাজনীতির প্রবল দাপটে লিঙ্গভেদ বা জাতপাত ভেদের সাথে মানুষের মানব প্রকৃতির যে সরাসরি বিরোধ আছে এটাই আড়ালে চলে গেছে। রাজনীতির যে একটা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র আছে সেটাই ভুলে যাওয়া হয়েছে। অংশটাই সমগ্র হয়ে উঠেছে। ফলে এই সমস্ত ভেদাভেদের বিরোধী সামাজিক প্রতিবাদ সংগ্রাম শুধু বেশ কিছু ক্ষমতালোলুপ রাজনৈতিক দলের ক্ষমতালাভের স্বার্থ সিদ্ধি করেছে। সমস্ত সামাজিক আন্দোলন সরকার পরিবর্তনের অন্ধ গলিতে অবরুদ্ধ হয়েছে। অথবা 'ক্ষমতায়ন'এর নামে ছিটেফোঁটা আর্থিক কড়ি হাতে ধরিয়ে 'বাজার সমাজ' (market dystopia) নামক এক দানব জলায় টেনে আনা (যার এক উচ্চকিত রূপ আমরা দেখেছি বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকে "feminisation of labour" দিয়ে) সাথে অবশ্য কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট জুটে গেলে তো কথাই নেই! তাহলে কী মেয়েদের আর্থিক 'সক্ষমতা'র (যার জন্য লড়াইয়ের অনেক পথ পেরোতে হয়েছে) কোনও মূল্য নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু মূল প্রশ্ন মানুষ পরিচয়ের অভিমুখে অগ্রগতি - সে বিচার করলে তা কিন্তু যৎসামান্যই। বরং এই 'সক্ষমতা' এক ধরনের ভ্রান্তিবিলাস তৈরি করে । এতদসত্ত্বেও আজও অনেককেই বলতে শোনা গেছে যে সমস্ত কিছুর নাকি শেষ নির্ধারক রাজনীতি। এটা কি চেতনার জগতের বন্ধ্যাত্ব? নাকি বুর্জোয়া গনতন্ত্রের ঘেরাটোপে দীর্ঘদিনের বাস্তব চিন্তা আর কাজের ইতিহাসের ফল যাতে রাজনীতির আতশ কাঁচে সবকিছুকে দেখার অভ্যাস এখন প্রায় প্রাকৃতিক নিয়ম বা স্বাভাবিক মনে হয়?
মেয়েদের মনুষ্যেতর পরিচয় থেকে বন্ধনমুক্তির আন্দোলনে জাস্টিস স্লোগানের বিরোধিতা করে অনেকেই বলেছেন - কার কাছে তোমরা জাস্টিস চাইছ? যেন বা সমস্ত আন্দোলনের দাবি উপস্থিত করার জন্য একটা রাজনৈতিক এজেন্সি লাগবেই। প্রশ্ন জাগে সামাজিক চেতনা কি কোনও শক্তি নয়? মেয়েরা তো সেই সামাজিক চেতনার কাছেই দাবি উপস্থিত করেছিল ন্যায়ের। বলতে চেয়েছিল – এসো, আমাদের অব্যক্ত চাহিদার ভাষা দাও। এই দহন জ্বালা থেকে মুক্তি দাও। সামাজিক চেতনা কি এর জন্য প্রস্তুত? একেবারে আন্দোলনের শুরুতে আমার এক সুহৃদ বলেছিলেন যে, এই আন্দোলন কে প্রকাশ করার ভাষার অভাব - এটাই এই আন্দোলনের সবথেকে বড় সমস্যা। অর্থাৎ এই আন্দোলনকে ধারণ করা - নেতৃত্ব দেওয়া - দিশা দেখানো সামাজিক চেতনার ক্ষমতায় কুলোবে না। তাহলে কি এই আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক জগতের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন? অন্তত যেভাবে আন্দোলনকারী মেয়েরা রাজনীতির পরিমন্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছে সশব্দে অথবা নিঃশব্দে – সেখান থেকে মনে হয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতা তারা অন্তত সচেতনভাবে না বুঝলেও বাস্তবতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রকাশ করেছে তাদের আকাঙ্ক্ষা। খেয়াল করলে এও আমাদের নজরে পড়তে বাধ্য যে রাজনীতির কারবারীরা মেয়েদের আন্দোলনকে খুব গুরুত্ব দেয়নি বরং তাদের মূল নজর ছিল জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলন দখল নেওয়ার প্রতি, সরকারী গাফিলতি তঞ্চকতা কুপ্রশাসন ইত্যাদির প্রতি যেখান থেকে ক্ষমতার ক্ষীরমধু পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কথা হচ্ছিল রাজনীতির সীমাবদ্ধতা নিয়ে। এর শিকড় ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বের (বুর্জোয়া বিপ্লব) সাথে জড়িয়ে আছে। মধ্যযুগীয় বিশেষাধিকারের অবসানে সেই সময়ের বিচারে যখন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল তাকে সমাজবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক মুক্তি বলে সঠিক আখ্যাই দিয়েছিলেন। কেননা রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে একজন ব্যক্তিমানুষ। কিন্তু সেই বুর্জোয়া বিপ্লব ধর্ম থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পারেনি কেবলমাত্র ধর্মের স্বাধীনতা পেয়েছে। ঠিক যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে মুক্ত হয়নি, ব্যক্তিগত সম্পদ এর অধিকার পেয়েছে। রাজনৈতিক রাষ্ট্র এবং ধর্মের এক অদ্ভূত সাযুজ্য লক্ষণীয়। রাষ্ট্র যেমন মানুষের বিমূর্ত রূপ, অন্যদিকে ধর্ম মানুষের চেতনায় বাস্তবতার বিমূর্ত রূপ। ধর্ম যেমন বাস্তবতার ভ্রান্তিবিলাস আবার বর্তমান গনতন্ত্র হল স্বাধীনতার ভ্রান্তিবিলাস। কেন?
রাজনৈতিক মুক্তি সামাজিক মুক্তি নয়। সমাজ তো নানা স্তর বিভাগে বিভক্ত। রাজনৈতিক মুক্তি আর্থিক সামাজিক বিভাজন থেকে নাগরিক সমাজকে মুক্ত করেনি। নাগরিক সমাজ এখানে সমগ্র জনসাধারণ,আজ আমরা চলতি অর্থে যে নাগরিক সমাজকে দেখি গুটিকয়েক শহুরে লেখাপড়া জানা মধ্যবিত্তের চোখে, সেটা কিন্তু নাগরিক সমাজ নয়। রাষ্ট্র কিন্তু একজন নাগরিককে সামাজিক মানুষ হিসেবে দেখেনা। তাকে দেখে একজন ব্যক্তিমানুষ – আইনত মানুষ হিসাবে, রাষ্ট্রের সামনে নাগরিক বিমূর্ত, রাষ্ট্রের মধ্যে অবজেক্টিফায়েড। সে কারনে বলা হয় – আইনের চোখে নাগরিকের শ্রেণী ভাষা লিঙ্গ জাতি ধর্মবিশ্বাস পেশা আর্থিকসঙ্গতি কিছুই গ্রাহ্য নয়, অথচ সমাজ ঐসব বিভাজনে বাস্তবে দীর্ণ বিভাজিত। আবার সিভিল / নাগরিক সমাজ নিজেই রাষ্ট্র হতে পারে না তাকে রাষ্ট্রে অংশ নিতে হলে প্রতিনিধির মাধ্যমে যেতে হয় কেননা সমগ্র জনসাধারন সকলেই ব্যাক্তিগতভাবে আইন প্রনয়নকারী হলে সিভিল সমাজকেই বিলুপ্ত হতে হবে। রাজনৈতিক রাষ্ট্র এভাবেই কেবলমাত্র নাগরিক সমাজের মুখোমুখি হতে পারে অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক রূপেই তাকে ধারন করতে পারে। একইসাথে এই অবস্থাটা নাগরিক সমাজ / জনসাধারনের সাথে রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ। এ হল আদতে কেবলমাত্র তাদের দ্বৈততার ঐক্য। নাগরিক সমাজের সাথে রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সমন্বয়কারী ঐক্য কি তাহলে অসম্ভব? এ কেবল বুর্জোয়া / পুঁজিবাদী সমাজেই ঘটতে পারে। কিন্তু মানুষ দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়ে। মানুষের দুই সত্তা – সামাজিক সত্তা ও রাজনৈতিক সত্তার মধ্যে কী ঐক্য হতে পারে? না। বিরোধটাই অনিবার্য। কেন? রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সামাজিক শক্তিকে সামাজিক ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। সামাজিক ক্ষমতা থেকে সামাজিক শক্তি বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে রাজনৈতিক ক্ষমতার রূপে। রাষ্ট্র সমাজের মাথায় চেপে বসে। সবকিছুই যেনবা রাষ্ট্রের এক্তিয়ারে। সে কারনে মার্কস "ইহুদি প্রশ্নে" বুর্জোয়া বিপ্লব থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মুক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন – "Political emancipation is the reduction of man. On the one hand to a member of civil society, to an egoistic, independent individual, and, on the other hand to a citizen, a juridical person" এখানে reduction of man কথাটা লক্ষ্য করার মতো এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক জগতের সীমাবদ্ধতা এখানেই। ব্যক্তি মানুষ হয়ে পড়ে বিমূর্ত নাগরিক মাত্র, সামাজিক ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি মানুষ। অথচ মানুষ রাজনৈতিক সত্তা থেকে মুক্ত না হলে মানব প্রজাতি সামাজিক ক্ষমতারূপে নিজস্ব প্রকৃত ক্ষমতাকে চিনতে পারে না, সংগঠিত করতে পারে না। যতক্ষন পর্যন্ত ব্যক্তিমানুষ প্রত্যেকদিনের জীবনে - নিজের প্রেক্ষিতে - বিশেষ কাজে - বিশেষ সময়ে মানুষ না হয়ে উঠছে, নিজের প্রকৃত ক্ষমতাগুলিকে চিনতে পারছে এবং সংগঠিত করতে পারছে, রাজনৈতিক ক্ষমতারূপে সামাজিক ক্ষমতাকে নিজস্ব সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে ততদিন মানবমুক্তি সম্ভব হয়ে উঠবে না। রাজনৈতিক রাষ্ট্র স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা রূপে এই মুক্তির সামনে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং সেটা কেবল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই নয় শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একইভাবে সত্য।
তাহলে প্রশ্ন থাকে যে, সামাজিক শক্তি থেকে সামাজিক শক্তির বিচ্ছিন্নতার ভিত্তি কী? মার্কস অন্তত সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে যাত্রা করতে গিয়ে পলিটিক্যাল ইকনমির ব্যবচ্ছেদে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ১৮৫৬ সালে ‘এ কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকনমি’ তে বলেছিলেন, আমার অনুসন্ধান আমাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছিল কোনও আইনী সম্পর্ক বা রাজনৈতিক রূপের বোঝাবুঝির মধ্যে নয়, বা মানবমনের তথাকথিত সাধারণ বিকাশের ভিত্তিতেও নয়, বরং তার উদ্ভব খুঁজতে হয়েছে মনুষ্যজীবনের বস্তুগত অবস্থার মধ্যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ এবং ফরাসী চিন্তাবিদদের অনুসরণে হেগেলের সামগ্রিক চিন্তনে যা 'সিভিল সমাজ' কথাটার মধ্যে ধৃত আছে - সিভিল সমাজের ব্যবচ্ছেদ খুঁজতে হয়েছে পলিটিক্যাল ইকনমিতে। মানুষের অবজেক্টিফিকেশন কীভাবে ঘটে তার স্বরূপসন্ধান। মানুষের মৌলিক চরিত্র হল তার শ্রম দিয়ে প্রকৃতিকে ব্যবহার করে যা সৃষ্টি করে তা নতুন শুধু নয় , একই সাথে সে নিজেকেও নতুন করে সৃষ্টি করে, আবিষ্কার করে। কিন্তু মানুষের সৃষ্ট সম্পদ থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পুঁজিবাদের উৎপাদন কর্মে। মনুষ্য শ্রমসৃষ্ট সম্পদ পণ্য অর্থ ও পুঁজি রূপে সেই মানুষেরই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একইভাবে মনুষ্যসমাজ সৃষ্টি করে সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র, কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সামাজিক ক্ষমতা থেকে বস্তুত নিজের স্বরূপ থেকে। জড়িয়ে পড়ে তার সামাজিক অস্তিত্ব এবং স্বরূপের মধ্যে সংঘাতে।
মেয়েদের নিজস্ব মুক্তির দাবির আন্দোলনের আলোচনায় মানবমুক্তির আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে মানুষ হিসাবে নারীর পরিচয়ের অভিমুখ আছে মানুষের রাজনৈতিক সত্তা থেকে মুক্তির সাথে যুক্ত হয়ে। বরং বলা ভাল রাজনৈতিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক অধিকারের কারাগার থেকে মুক্তির সাথে এবং ধর্মের অলীক জগত থেকে মুক্তির সাথে যুক্ত হয়ে আছে সামাজিক বৈষম্যবিরোধী প্রতিটি আন্দোলন। কেবল কিছু রাজনৈতিক অধিকার, আইনকানুনের দাবির শর্তপূরণ থেকে সেই মুক্তির দাবির অভিমুখে যাত্রাপথ দিশা পায় না, বরং অধিকারের কানাগলিতে হারিয়ে যায়। অধিকারের আইনী স্বীকৃতি দাবীটুকুকে যৌক্তিকতার মোড়ক দিতে পারে ঠিকই কিন্তু প্রতিদিনের জীবনে অধিকার ভোগ করার বাস্তব অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে না। সে কারণে অধিকার বা গণতন্ত্রকে রাজনীতির সীমানার বাইরে সামাজিক ক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত করার দাবী প্রয়োজন। একসময় সামাজিক গনতন্ত্র কথাটা খুব জনপ্রিয় ছিল যাকে আজ বাস্তবে আর খুঁজে পাওয়া ভার। কেউ এ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে ভারতে বুর্জোয়া বিপ্লব বা গণতন্ত্রের অস্তিত্ব কোথায়? আজ তো ভারতে ব্যক্তিগত পরিসরেও (এমনকি কারো প্রেম-বিবাহ বা খাদ্য-নির্বাচনের স্বাধীনতায়) রাষ্ট্রের জবরদস্তি অনুপ্রবেশ আপামর জনতার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে মানিয়ে নিলেও প্রতিবাদও কম হচ্ছে না। 'পারশোনাল ইজ পলিটিক্যাল' এই শ্লোগান ‘নারীবাদী’ আন্দোলনে আজ আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই বয়ান ব্যক্তি অধিকারের পুনরুদ্ধারের প্রেক্ষিতে যৌক্তিক। যেটুকু লড়াই করে পাওয়া গেছে তাকে রক্ষা করতেই হবে। কথা হল সেই রাজনৈতিক অধিকারের সীমানা নিয়ে। বিমূর্ত নাগরিক থেকে প্রকৃত ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠার। ব্যক্তি মানুষের থেকে সামাজিক শক্তির বিচ্ছিন্নতার। বর্তমান সময়ে আমরা যে নাগরিক সমাজের আন্দোলন দেখতে পাই সেখানে সামাজিক ন্যায়ের দাবি কেন্দ্রিক আন্দোলনই প্রধান। রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকা অবস্থায় সামাজিক ন্যায় আদৌ পূরণ করা কতখানি সম্ভব এ বিষয়ে জানিনা তারা কতখানি সচেতন। বর্তমান আলোচনা সাধারণ বিশ্বপ্রেক্ষিত ধরেই করা আর ভারতে যেটুকু বুর্জোয়া গণতন্ত্র আছে সেখানে সেই গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব এবং মানবমুক্তির পরিপ্রেক্ষিতের সাথে নারীর মানুষ হয়ে ওঠার আন্দোলনের যোগসূত্র অস্বীকারের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
সমাজের ভাঙনের চিহ্ন আজ সর্বত্র। কিন্তু দৃষ্টি নেই সামাজিক সংকটের প্রতি। ব্যক্তির অহংবোধ আজ রক্তাক্ত এবং আহত। বরং বলা ভালো ব্যক্তির অহংবোধ বস্তুজগতের দখলে চলে গেছে। শুধু পড়ে আছে বস্তুজগতের ফাই-ফরমায়েস খাটার জন্য শৃংখলপরায়ণতা এবং কর্তব্যবোধ। অথচ পুরাতন যুগের ধ্বংসস্তূপের কিনারায় দাঁড়িয়ে ব্যক্তির অহংবোধকে নতুন যুগের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য পরিবর্তনশীল বাস্তবের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা দরকার। সে কারণেই মানবমুক্তি প্রসঙ্গের অবতারণা। পুঁজিবাদী জগতের বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাষ্ট্রের যৌক্তিকতাকে বারবার প্রমাণ করতে গিয়ে এবং পরবর্তীকালে পুঁজিবাদের কল্যাণকামী রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে মানবমুক্তির প্রসঙ্গ অনেকখানি পিছনে চলে গেছে এবং রাষ্ট্র বা রাজনীতিকেন্দ্রিক বোধ এবং বিচার আজ সারা সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। কিন্তু যেভাবে বিদ্রোহী চেতনার নানা প্রকাশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্দোলনে দেখা যাচ্ছে সেখানে মনেই হয় ব্যক্তির অহংবোধ স্পর্ধিত ও বিদ্রোহী চেতনায় ধীরে ধীরে ঋদ্ধ হয়ে উঠছে যার একটি নমুনা আমরা দেখলাম আর জি কর কেন্দ্র করে নারীর মানুষ হয়ে ওঠার জন্য লড়াইয়ে বাঁধভাঙা বিস্ফোরণে। বন্ধনহীন প্রমিথিউস কিম্বা পিসারভের মতো স্বপ্নসন্ধানী হতে প্ররোচিত করছে আজকের ইতিহাস। যদি আমরা বিদ্রোহী চেতনার সমস্ত উপাদানকে একজোট করতে না পারি এবং সেই শক্তিকে সংহত করতে না পারি তাহলে ইতিহাসের দিকনির্দেশ আমরা ধারণ করতে ব্যর্থ হব।
ছবি - রাজর্ষি ঘোষ