রাতের আঁধারেও নারীদের স্বাধীনতা চাই
আজ এই লেখা যখন লিখছি, তখন চারদিকে বিসর্জনের সুর। দূরে কোথাও যেন ঢাক বাজছে। পড়ন্ত বিকেলে তার সেই তাল মৃদুমন্দ হয়ে ধরা দিচ্ছে বন্ধ জানলার এইপাশে। আবার এসো উমা। আমাদের বিসর্জন যদিও আগেই হয়ে গেছে। বরং, বলা উচিত হয়ে চলেছে অবিরত। নয়াদিল্লি, উত্তর প্রদেশের উন্নাও, হাথরস হয়ে, কামদুনি সন্দেশখালি হয়ে সেই বিসর্জনের সুর এবার আছড়ে পড়েছে, খোদ কলকাতা শহরে। সাথে আরো আছে - জয়নগর, যাত্রাগাছি। একেকটা সময় আমাদের কত রকম, কত বিভিন্ন ভাবে মানুষ চিনতে সাহায্য করে। আমাদের মত যারা সামান্য মানুষ, যারা কেউ কোনোদিন মিছিলে হাঁটে নি, কেউ কোনোদিন ভাবেনি তাদের গলা মেলাতে হবে কোনো জ্বলন্ত সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারাও আজ রাস্তায় নেমেছেন। আমাদের দেশের, এই রাজ্যের যারা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী দীর্ঘ আন্দোলনের পর এবার তারা আমরণ অনশনে বসেছেন। ঘরের কাছাকাছি যদি উদাহরণ দিই, আমাদের নিস্তরঙ্গ পাড়ায়, যেখানে ঢিল মারলেও এত শব্দ হবে না, সেখানে সাধারণ বাড়ির গৃহবধূরা এগিয়ে এসেছেন রাত দখলের কর্মসূচিতে। কিছু ক্ষেত্রে বাড়ির পরিচারিকারা, খুব স্বাভাবিকভাবেই যারা উচ্চশিক্ষিতা নন এবং কোনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যাদের থেকে আশা করাও অনুচিত - ১৪ই আগষ্ট তারাও এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেছে, আমিও রাত হাঁটব। আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাবে? আবার উলটো দিকে দেখি শাসক দলের নেতৃত্বে বর্বর ট্রোল নেমেছে অপরাধের ও আন্দোলনের অভিঘাতকে লঘু করতে। শারোদৎসবকে কেন্দ্র করে তাকে সুচারুভাবে আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি শাসকদল ডাক্তারদের গণশত্রু প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। তাদের বক্তব্য ডাক্তারদের আন্দোলনে গণ পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে, হচ্ছে রোগীমৃত্যুও। যদিও তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। এমকি তাদের এটাও প্রশ্ন, যে ছাত্ররা বিরিয়ানি খেয়ে আন্দোলনে নেমেছে কেন? আন্দোলনের সাথে বিরিয়ানির কী বিরোধ যদিও আমার অজানা। ডাক্তারদের ধর্না মঞ্চে দেখেছি কিভাবে আইটি কর্মীরা ডাক্তারদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, হাজারে হাজারে সাধারণ মানুষ কিভাবে নিজের সর্বস্ব লুটিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র ছাত্রদের পাশে থাকার ইচ্ছায়। কেউ হয়ত নিয়ে এসেছে নিজের ক্ষেতের শসা, কেউ হাতপাখা, কিছু না পারলে ফুড ডেলিভারি অ্যাপের মাধ্যমে খাবার কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে ডাক্তারদের নামে। আবার সম্প্রতি দেখছি, এমন ট্রোলও হয়েছে যে অনশন করলে বায়ো টয়লেট লাগবে কেন। আসলে সব অনশনে যে ওজন বাড়ে না, সেটা শাসকদলের একনিষ্ঠ কর্মীরা বুঝবে কীভাবে। এক মহিলা ডাক্তার শাসকদলের একপেশে বক্তব্য তার সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমান্বয়ে পোস্ট করে চলেছেন। কোনো ভাবেই তাকে থামানো যাচ্ছে না। বোঝানো যাচ্ছে না, যারা এই মুহূর্তে লড়ছেন, তারা কিন্তু তারই স্বার্থে পথে নেমেছে। খুবই হতাশাজনক। অন্যদিকে বাংলার এক বিরাট অংশ - যারা শিক্ষিত, যারা মধ্যবিত্ত, যারা সাতে পাঁচে থাকে না তারাই এবার নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রশ্ন তুলছে রাজা তোর কাপড় কোথায়?
রাজা তোর কাপড় কোথায়?
বস্তুত এ আন্দোলনের অনেকগুলো দিক আছে। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ধরণের সম্পূর্ণ ঝান্ডা বিহীন আন্দোলন অশ্রুত। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও হতাশার বারুদে আগুন দিয়েছে নয়ই আগস্টের ঘটনা। অনেকে প্রশ্ন করছেন, শুধু এই ঘটনা কেন? আগে কি ধর্ষণ কোথাও হয় নি? এই যে একটি আদিবাসী মেয়েকে ধর্ষণ করা হল, তখন তো কেউ প্রতিবাদ করে নি। ঠিকই তো, সামাজিক প্রেক্ষাপটে দুটোই সমান অপরাধ। প্রতিবাদ তারও হওয়া উচিত। কিন্তু মধ্যবিত্তের সব মেনে নেওয়া মানিয়ে নেওয়ার দুনিয়ায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে যে আর জি করের ঘটনা, তা কিন্তু একটু হলেও আলাদা। এখানে ধর্ষিতা একজন উচ্চশিক্ষিতা, মেধাবী, সফল মানুষ উপরন্তু আবার সরকারি চাকুরিরতা। এবং নিকৃষ্টতম ঘটনাটি ঘটেছে তারই কর্মস্থলে। অর্থাৎ কর্মস্থলেও নারীদের কোনো সুরক্ষা নেই। আগুন এসে নিজের ঘরের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালে তার প্রতিবাদ হবে বইকি। এবং এই আন্দোলনের দ্বিতীয় অভিঘাত, এটা এখন দিনের আলোর মত স্পষ্ট, যদিও তার প্রত্যক্ষ্য প্রমাণ নেই, এই ধর্ষণের ঘটনা শুধুমাত্র ধর্ষণের অভিপ্রায়ে নয়, বরং এর পেছনে কিছু বৃহত্তর ষড়যন্ত্র রয়েছে। সেই ষড়যন্ত্র কোনোদিন সামনে আসবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। শিক্ষিত মানুষ, তার উপর তারা যদি হয় ডাক্তার, বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, সেই মানুষগুলি অপরাধ করলে তার তথ্য প্রমাণ মেলা যে দুষ্কর হবে সেতো খুবই স্বাভাবিক। সিবিআই তদন্তে কতটা সে দুর্নীতির তথ্য সামনে আসবে তা একমাত্র সময়ই বলতে পারে। তাহলে, দেখা যাচ্ছে যে মানুষগুলিকে সাধারণে প্রায় দেবতার মর্যাদা দেয় তারাও কিন্তু রক্ত মাংসেরই মানুষ। তাদের দেহেও লোভ লালসার মত রিপু সঞ্চার ঘটে। তৃতীয়ত, পোটেনশিয়াল রেপিস্টদের হাত থেকে কোনো বয়সের নারীই সুরক্ষিত নয়। প্রবীণাদের উপর যৌন লালসা চরিতার্থ করার কিছু ঘটনা আগেও সামনে এসেছে, কিন্তু জয়নগরের ঘটনায় ধর্ষিতা একটি শিশু, মাত্র নয় বছর তার বয়স। হতবাক হয়ে যাই, এ কী ধরণের সমাজে বাস করছি আমরা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন এখন এটাই ধর্ষণ কি তাহলে ক্ষমতাবানের অস্ত্র মাত্র বিরোধীদের কন্ঠ রোধ করার? দিকে দিকে শাসকের চরিত্রে (সে যে রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষই হোক না কেন), মানসিকতায় কি এই চিন্তা জাঁকিয়ে বসেছে, যে কোনো নারী মাত্রেই, সে যদি প্রতিবাদ করে তাকে ধর্ষণের বা সেই হুমকি দেওয়ার অধিকার তার আছে? কিংবা দুর্বলকে পাড়িয়ে দেওয়ার বা তার কন্ঠরোধ করার অধিকার তার আছে? উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে তো সত্যিই বিপদ। সেক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিক একা নিজের জোরে তো তার কোনো প্রতিকার করতে পারবে না। এবং বস্তুত এখনো এত মানুষ রাস্তায় নামার পরও আমরা কি তার কোনো প্রতিকার করতে পারছি। নইলে যে আন্দোলন সমাজের ভিত্তি ধরে হ্যাঁচকা টান মারল, সেই মানুষগুলির উপর যেভাবে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে শাসকদল কুৎসিত আক্রমণ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? কেনই বা তাদের ধর-পাকড় করা হবে যাদের দোষ শুধুমাত্র এটাই যে তারা উৎসবের মন্ডপগুলিতে তিলোত্তমার সুবিচার চেয়ে স্লোগান তুলেছিল? মনে রাখা দরকার, একজন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ কিন্তু প্রশ্ন তুলবে। তুলবেই। বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন ফোরামে প্রশ্ন তুলবে। তাকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।
দ্রোহের উৎসব
একটি উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনীতি করা মানে, কোনো নির্দিষ্ট দলের অন্ধ আনুগত্য নয়, বরং সে দলকে দেশের দশের উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই রাজনীতি। একজন শিরদাঁড়া যুক্ত রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন মানুষ, যাদেরকে আমরা সহজভাষায় শিক্ষিত বলতে পারি, তারা ঠিক কে ঠিক, এবং ভুল কে ভুলই বলবে সে তারা যে রাজনৈতিক দলের সদস্যই হোক না কেন। পরিশেষে বলি এই মানুষগুলোর দ্রোহের বোধনেই কিন্তু সমাজের আবর্জনা পুড়বে। এই পুজোয়, বরং শুধু এটুকুই সিলভার লাইনিং থাক যে, প্রশ্ন তোলার এবং প্রশ্ন করার মানুষ জাগছে এই পোড়া দেশে। ভবিষ্যৎ হয়ত এতটাও খারাপ নয়, যদি তাদের সে স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ঝিমিয়ে না পড়ে। পুরোগামীর এই সংখ্যা সেই আগুনের পথপ্রদর্শকদেরই সম্মান জানায়।
সম্পাদক, পুরোগামী
১২/১০/২০২৪
চিত্রঋণ - রাজর্ষি ঘোষ