পুরোগামী চতুর্থ সংখ্যা (জুলাই, ২০২৪)

লিখেছেন:পুরোগামী সম্পাদক-মন্ডলী

বিস্মৃত নায়ক মানবেন্দ্রনাথ 

বড়ো মাপের মানুষ হলেই তিনি চিরস্মরণীয় হবেন এমন কোন নিয়ম নেই। বিস্মরণ আমাদের স্বভাব বলে নয়,মানুষটি স্বক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন কিনা সেটাই স্মরণীয় হবার ক্ষেত্রে অনেক সময় প্রধান মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত রাজনৈতিক পরিসরে অসফল ব্যক্তিত্বের বিস্মরণের সম্ভবনা তুলনায় বেশি। এদিক দিয়ে দেখলে মানবেন্দ্রনাথ রায় আছেন আমাদের বিস্মরণের তালিকার একেবারে উপরের দিকে। একে ক্ষমতার রাজনীতিতে অসফল, তার উপর তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ এবং চিন্তক – বিপ্লবী-দার্শনিক। একারণেই হয়ত বা তাঁকে ভুলে যেতে বেশি সময় আমরা নিইনি। ১৮৮৭ সালের ২১শে মার্চ ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার আড়বেলিয়ায় তাঁর জন্ম। আজ ২০২৪ সালে ২১ শে মার্চ মাসে তাঁকে স্মরণ করার মানুষ এদেশে খুব কমই আছে।

বঙ্গে নবজাগরণের শুরু রামমোহনের হাত ধরে। তারপর বিদ্যাসাগরের  আবির্ভাবে তা বিকশিত হল। এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন সমসাময়িক এবং পূর্বজদের অনুসারী অক্ষয় কুমার দত্ত, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমূখ আরো কয়েকজন নারী-পুরুষ। বাংলা ভাষার মাধ্যমে আমাদের মননের শতফুল ফুটিয়ে গেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। মানুষের মধ্যে অফুরন্ত আত্মসৃজনের সম্ভবনার সন্ধান এরা সকলেই দিয়ে গিয়েছেন। মানবেন্দ্রনাথও আত্মসৃজনের ধারা বেয়েই নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। পৃথিবীর তিনটি মহাদেশে তিনি তাঁর কাজের পরিচয় রেখে গেছেন।

সশস্ত্র বিপ্লবের পথ ধরে যে যাত্রা তিনি শুরু করেছিলেন তা শেষ হয়েছিল মানবতাবাদী দর্শনে। এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে অন্তত দু’বার তাঁর চিন্তাধারা বড়ো রকমের বাঁক নিয়েছিল। প্রথমবার জাতীয়তাবাদ থেকে মার্কসবাদে, দ্বিতীয়বার মার্কসবাদ থেকে মানবতাবাদে। ১৯১৫ সালে জার্মান-প্রতিশ্রুত অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি বিশ্বযুদ্ধের আবহে ছদ্মবেশে, ছদ্মনামে জাভায় রওনা হন। জাভা থেকে জাপান, জাপান থেকে চীন, আবার জাপান এবং শেষে আমেরিকায় পৌঁছান। সেখানেই র‍্যাডিক্যাল চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিলে আমেরিকান পুলিশের নজর এড়িয়ে তাঁকে মেক্সিকো পাড়ি দিতে হয়। সেখানেই তিনি বলশেভিক নেতা বোরোদিনের সংস্পর্শে এসে মার্কসবাদকে গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগেই মেক্সিকোর সোশ্যালিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত হয়। লেনিনের  আহ্বানে ১৯২০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় অধিবেশনে মানবেন্দ্র যোগ দেন। ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে পুঁজিপতিদের ভূমিকা ও সর্বহারা দলের ভূমিকা নিয়ে লেনিনের সঙ্গে তাঁর কয়েকটি বিষয়ে মতের মিল হয়নি। শেষে অধিবেশনে রায় ও লেনিনের দুটি থিসিসই গৃহিত হয়। এরপর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অনেকগুলি নীতিনির্ধারক কমিটিতে তিনি উচ্চপদে নিয়োজিত হন। প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও তাঁর প্রয়াসে গঠিত হয়। ১৯২৭ সালের পর থেকে স্ট্যালিন প্রবর্তিত নানা নীতি ও কর্মসূচির সঙ্গে মানবেন্দ্রের মতাদর্শগত অমিল হয়। রায় জার্মানির কমিউনিস্ট অপজিসনের পত্রিকায় কমিন্টার্নের কিছু নীতির সমালোচনা করে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। এ কারণে ১৯২৯ সালে তাঁকে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

ভারতবর্ষে ১৯২৪ সালের বিখ্যাত কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি ছিলেন এক নম্বর আসামি। দেশে ফিরলে দীর্ঘ মেয়াদের হাজতবাস অবশ্যম্ভাবী। তবু ১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি গোপনে দেশে ফেরেন এবং ১৯৩১ এর জুলাই মাসে গ্রেপ্তার হন। প্রথমে ১২ বছরের হাজতবাসের সাজা হলেও আপিলে তা কমে দাঁড়ায় ছয় বছর। হাজতবাস তাঁর জ্ঞানের পিপাসাকে রুদ্ধ করতে পারেনি। জেলে বসে  সমাজ ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের উপর গভীর অধ্যয়ন এবং লেখায় নিয়োজিত রইলেন। কর্তৃপক্ষ অধ্যয়নে বাধা দিলে আইনস্টাইন ব্রিটিশ শাসকদের চিঠি লিখে তাঁর লেখা পড়ায় বাধা না দেবার অনুরোধ জানান।

রাজনৈতিক জীবনের উষালগ্ন থেকেই তিনি গান্ধীজির প্রবল সমালোচক। তবু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিলেন। কিন্তু কংগ্রেস দলটিকে গণতান্ত্রিক ও আরো র‍্যাডিক্যাল চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করতে তাঁর বক্তব্য দলে গুরুত্ব পায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘিরে রায়ের মতামতগুলি কংগ্রেসের সঙ্গে মেলেনি। ১৯৪০ সালে তিনি ও তাঁর অনুগামীরা কংগ্রেস থেকে বেড়িয়ে ‘র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট’ পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতবর্ষের  ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এই দলের শোচনীয় পরাজয় হয়। এইসময় তাঁর চিন্তার জগতেও  উল্লখগযোগ্য পরিবর্তন এসেছিল।

মানবেন্দ্রনাথ তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন একজন বিপ্লবী হিসেবে। আমেরিকায় পাবলিক লাইব্রেরীতে পঠন-পাঠন তাঁর চিন্তার পালে নিয়ে এসেছিল নতুন বাতাস। তিনি উপলব্ধি  করেছিলেন জাতীয়তাবাদ আবেগকে মথিত করে ঠিকই কিন্তু শাণিত করে না যুক্তি ও বুদ্ধিকে। সোভিয়েত রাশিয়ার অভিজ্ঞতা তাকে শেখালো জাতির মত শ্রেণিও এক সমষ্টি। শ্রমিক-শ্রেণীর নামে সেখানে প্রশ্রয় পেয়েছে রাষ্ট্র এবং দল। তিনি দেখলেন সমষ্টির সঙ্গবদ্ধ চাহিদায় ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষীয়মান, যূথবদ্ধ অহং-এর কাছে ব্যক্তি-মানুষ বলি প্রদত্ত। তিনি নব-মানবতাবাদ নামে এক নতুন দর্শন কতগুলি থিসিসের মাধ্যমে প্রস্তুত করলেন। নব মানবতাবাদে তা ২২ থিসিস নামে পরিচিত।

এ লেখার প্রথমে আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণতার কথা উঠেছিল। কিন্তু এরই সঙ্গে এ  প্রশ্নও ওঠে যে মানবেন্দ্র নিজে এর জন্য কতটা দায়ী ছিলেন। ১৯১৫ সালে মানবেন্দ্র যখন দেশ ছাড়ছেন, সে বছরেই ২১ বছরের প্রবাস-জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরলেন গান্ধীজি। দেশে ফিরে তিনি ভারতীয় ঐতিহ্য ও পরম্পরারর সঙ্গে একাত্ম হয়ে দেশবাসীর আস্থা অর্জন করলেন। ভারতের ‘এলিট’ রাজনীতি তাঁর ছোঁয়ায় ‘মাস-মুভমেন্ট’ এ পরিণত হল। এদিকে অনেক পরে ১৯৩০ সালে তাঁর বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মানবেন্দ্র যখন দেশে ফিরে এলেন তখন তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যের থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে। দেশের মানুষের কাছে তিনি প্রতিভাত হলেন ভারতীয় সংস্কৃতির নিরিখে একজন ভিনদেশি হিসেবে। তাঁর ‘দার্শনিক বিপ্লব’; ও ‘বৈজ্ঞানিক রাজনীতি’ তাঁর সকল অনুগামীরা কি উপলব্ধি করেছিলেন? মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বহুদিন ধরেই গান্ধীজিকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে এসেছেন, অপরদিকে গান্ধী তাঁর ভাষণে বা লেখায় মানবেন্দ্রনাথের উল্লেখ খুব কমই করেছেন। মানবেন্দ্র কংগ্রেসে যোগ দিলে গান্ধী তাঁকে তাঁর প্রার্থনা সভায় যেতে বললে নিরীশ্বর মানবেন্দ্র তা প্রত্যাখ্যান করেন। স্ট্যালিন বা গান্ধীর সঙ্গে কিছুটা রফা তাকে তথাকথিত রাজনৈতিক সাফল্য দিত হয়ত, কিন্তু তিনি রাজনীতিতে নৈতিকতাকে বরাবর মূল্য দিয়ে এসেছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল মানব প্রজাতির উন্নতি ও অগ্রগতির পেছনে রয়েছে মানুষের দুর্মর স্বাধীনতা স্পৃহা এবং অনন্ত জিজ্ঞাসা। তবু সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিরসনে গান্ধীর শেষ জীবনের প্রয়াসকে তিনি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধীর মত মানবেন্দ্রনাথও এক বিকল্প সমাজ ও রাষ্ট্রিক ভাবনার রূপরেখা এদেশের জন্য রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর দেশনেতাদের দৃষ্টি সেদিকে পড়েনি।

 

- অপূর্ব দাশগুপ্ত, প্রধান সম্পাদক, পুরোগামী  

 

0 Comments
Leave a reply