ধানের গন্ধে রাত

লিখেছেন:সুনীল কর্মকার

 

বিশাল শোভাযাত্রা। গোষ্ঠে যাচ্ছে গোপাল। সেই উপলক্ষে মেলা বসেছে বাসুদেবপুর গ্ৰামে। আগেও মেলা বসত কিন্তু এবছরটায় যেন সবার মনে আলাদা উৎসাহ। বিশাল আয়োজন। পরিক্রমা শেষে গ্ৰামের দক্ষিণ প্রান্তে মেলার মাঠে বকুল তলায় ঠাকুর অবস্থান করবে।

শোভাযাত্রায় চতুর্দোলার পরেই কীর্তনের দলে নবনিযুক্ত মহান্ত বাবাজী। সঙ্গে চলেছে গ্ৰামের যুবকের দল। মধ্যমণি দীর্ঘদেহী, সৌম্যকান্তি পঞ্চায়েত মেম্বার জ্যোতির্ময়। জ্যোতির বাম হাতে ধূপসী, ডান হাতে চামর। অবিরাম বাতাস দিয়ে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। বিশাল শোভাযাত্রায় ভক্তদের ভক্তিস্রোতে যেন প্রলয় নেমেছে। নবনির্বাচিত গ্ৰাম্য কমিটি এবং তার সম্পাদক জ্যোতি-ই এই গণজাগরণের কাণ্ডারী। শচীদাস আখড়ার সেবায়েত অথচ এমন ভাব দেখায় আখড়াটা যেন তার পৈত্রিক সম্পত্তি। জ্যোতি এবং তার বন্ধুরা মিলে দলিল বের করে জানল আখড়ার অধিকার গ্ৰামবাসীর। শুরু হল আন্দোলন।

আন্দোলনের চাপে সেবায়েত তার পরিবার নিয়ে আখড়া ছাড়তে বাধ্য হোল। তারপর শুরু হল মন্দির স়ংস্কারের কাজ। জেলাপরিষদ, ব্লক, পঞ্চায়েতের লোকজন নিয়ে এসে শুরু হল  নতুন কমিটির নির্বাচন। সর্বসম্মতিক্রমে জ্যোতির্ময় সম্পাদক নির্বাচিত হলো। আখড়ার খোল নলচে বদলে গেল। চালু হল নতুন নিয়ম। আগে ভোর চারটেয় ঘন্টা ধ্বনিতে গ্ৰামবাসীদের আহ্বান করা হত প্রার্থনার জন্য। মা বৌরা সব কাজ ফেলে শুদ্ধ বস্ত্রে ছুটত আখড়ার দিকে। কিছুদিনের মধ্যে নতুন মহান্ত নিযুক্ত হলে নতুন নিয়ম কানুন চালু হল। ভোর বেলায় আর সন্ধ্যেয় মাইকে প্রার্থনা সঙ্গীত ও হরিনাম প্রচারিত হতে থাকল। পাড়ায় পাড়ায় হরিনামের দল তৈরী হলো। আখড়া থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হলো। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য  আখড়ার দরজা খুলে দেওয়া হল। গ্ৰামে অন্য কোন দল নয় – সনাতন ভারতের ধর্মের যারা প্রচারক তারাই থাকবে।

*** 

এই উৎসবের টানে গোকুল অনেক দিন পর গাঁয়ে ফিরেছে। আধ ময়লা গামছায় মুখটা ঢেকে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সবার আড়ালে সেও গ্ৰাম পরিক্রমা করছে। তারপর যাবে মেলায়। বছর ঘুরে গেল সে গাঁ-ছাড়া। তার ঘরটা আর নেই। স্ত্রী রাধা নিষেধ করেছিল আসতে। শোনেনি। প্রাণের টান। অনেকটা হাঁটায় বাঁ পায়ের ব্যথাটা চাগাড় দিচ্ছে। জ্ঞাতি ভাইদের দূর থেকেই দেখছে। কথা বলতে সাহস হচ্ছে না। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। সবাই বেশ ফুর্তিতেই আছে। গোকুলের মনে আনন্দ নেই। ভাবে মানুষ কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি সব ভুলে যায়? সে কেন পারছে না। জ্যোতিকে দূর থেকে দেখে তার শরীর উত্তেজিত হতে থাকে। ইচ্ছে হয় এই মুহূর্তে জ্যোতির টুঁটি ছিঁড়ে দেয়। ও মানুষ নয় – একটা জানোয়ার। ওর শরীরে অত্যাচারী জমিদারের রক্ত বয়ে চলেছে। ওর পূর্বপুরুষরা এতো অত্যাচারী ছিল যে ওদের নামে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেত। গোকুল বাবা দাদুদের কাছে শুনেছে বর্গা আন্দোলনের সময় মাঠেই যখন ধান ভাগ করা শুরু হল তখন জ্যোতির বাবা বাইরে থেকে গুন্ডা এনে এ গাঁয়ের সানাই দাস, দিবাকর বাদ্যকর, আর মুচিরাম দাসকে গুলি করে হত্যা করে। কৃষকের সে ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে তিনটি শহীদ স্মৃতি। আজ ও কেউ কেউ স্মৃতি তর্পণ করে। জ্যোতির দিকে গোকুলের নজর। ওর জন্যই সে ঘরছাড়া। সেদিনের স্মৃতি এখনো তাজা।

*** 

গতবার পঞ্চায়েত ভোট হচ্ছে গাঁয়ে। আগের রাতে জ্যোতি  বাইক বাহিনী নিয়ে পাড়ায় ঢুকে শাসিয়ে গেল কেউ যেন বুথ মূখো না হয়। যদি কেউ ভোট দিতে গেছ তো ফল হাতে হাতে পাবে। মেয়েদের বললো সাদা থান পড়ার যদি ইচ্ছে হয় তবে যেও। গোকুলের জোয়ান বৌ রাধা কথা শোনেনি। পাড়ার মেয়েদের জুটিয়ে তাদের কাছের মানুষকে ভোট দিতে গিয়েছে অমনি রাস্তাতেই বাধা দিয়ে জ্যোতি আর তার ছেলেরা বলে তোমাদের ভোট হয়ে গেছে বুথে মুড়ি ঘুগনি খেয়ে বাড়ি যাও। কীজন্যে কষ্ট করতে এলে। কালকে বারণ করেছিলাম না? 

রাধারা বলল "নিজেদের ভোট নিজেরা দেব"। এই বলে এগোতে গেলেই কোথা থেকে জ্যোতির ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বেধরক লাঠি চালাতে আরম্ভ করল। 

মুহুর্মূহু বোমা পড়ছে। চর্তুদিকে ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে এল। রক্তের হোলিখেলার মধ্যেই কারো মাথা ফাটল, কারো পা ভাঙল – সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই রাধারা থানায় গেল বিচার চাইতে। দারোগাবাবু সব শুনে বললেন --সাহস করে ভোট দিতে গিয়েছিলে – ফল তো পেতেই হবে। রাধা দারোগাবাবুকে বলেছিল – আমাদের অন্যায়টা কী বুঝিয়ে দেন। কেন আমরা ভোট দিতে পাবোনা? আমাদের ভোট কেন অন্যরা দেয়? দারোগাবাবু কোন জবাব না দিয়ে রাধাদের লক আপে ঢোকাতে বলে। খবর পেয়ে গোকুলরা পেছন পেছন থানায় এসে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল – এটা কী বিচার হলো? যারা মারধোর করল, হাত পা ভেঙে দিল, আমাদের ভোট চুরি করল তাদের বেলায় কিছু না, আর আমাদের মেয়েদের লক আপে ভরলেন? গোকুলের কথায় দারোগাবাবু মেজাজ হারিয়ে ছুটে এসে গোকুলের চুলের মুঠি ধরে এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে বলতে লাগলেন — শ্লা শুয়োরের বাচ্চা – নেতাগিরি করবি? তোদের জমানা শেষ। চৌত্রিশ বছর ধরে অনেক অত্যাচার করেছিস এবার মজা দ্যাখ বলে একজন কনেষ্টবলকে বলে – একে ঢুকাও। নেতাগিরি ফলাচ্ছি। সেদিন রাত্রে গোকুলের উপর এতো অত্যাচার করেছিল যে হাত পা ভেঙেই দিয়েছিল। পুলিশ হেফাজতে জেলের হাসপাতালে কয়েকমাস। প্রায় মাস ছয়েক পর গোকুল জামিন পেয়ে একবার লুকিয়ে গাঁয়ে আসে। ডান পা-টায় তার এখনো ব্যথা। কাকা সনাতনের সঙ্গে দেখা করে। রাধা আসেনি। সামান্য কথাবার্তা হয়। 

গোকুল বুঝতে পারে সবাই যেন আতঙ্কে রয়েছে। মন খুলে কেউ কথা বলছেনা। আখড়া নিয়ে গোটা গাঁ এক হয়েছে – গোকুল বলে, ভালোই তো আছো।

কাকা বলে – সিটো উপর উপর। না গেলেই বেপদ। 

গোকুল বলে — 

কাকা এ রকমটো তো হবেই এটা জানতুম। জমি গুলান যখন থেকে বর্গা হল তখন থেকি বাবুরা ভেতরে ভেতরে জ্বলছিল। গরীবদের জোটান ভাঙতে নানা ছল খুঁজছিল। পারছিল না। 

তা কাকা জমিগুলানের কী উপায় হবেক? চাষবাস না করলে খাবো কী গো? 

সনাতন বলে — সবাই জমি মালিকদের ফেরৎ দিছে। দু - পাঁচ হাজার করে দিছে। ওতেই খুব খুশি। ওই টাকায় ক'দিন খাবিরে? কেউ বুঝল না। একদিন গাঁয়ে মিটিন হলো। ওই আখড়ায়। থানার বড় বাবু, পেধান, বিডিও, সভাপতি সব এলো। আমাদেরকে ডাকলো। বিডিও বললে আগের সেদিন আর নাই। গাঁয়ে দলাদলি ভালো নয়। দলাদলি হলে গাঁয়ের ক্ষেতি। তোমাদের নুতন মেম্বর জ্যোতি কাজের ছেলে। সব সমস্যা ওকেই বলবে। ও দেখবে। জমি নিয়ে বিবাদ মিটিয়ে নাও। কথা শুনে সবাই লাফিয়ে উঠলো। হঁ হঁ এইটো সবার মত। পেধান বললো – তাহলে এই আখড়া হলো তুমাদের ষোল আনার জায়গা। আর জ্যোতি হলো এই আখড়ার সেকেটারী। সব রাজি তো? হঁ গো রাজি সবাই রাজি। - সেদিন কী সব নাচন। সবুজ আবির মাখামাখি সারারাত ধরে।

গোকুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে – কাকা তুমরাতো বাপু একদিন জোট বেঁধে লড়াই করে ঐ জমির ফসল তুলেছিলে ঘরে। তার জন্যি তিনজনকে মরতেও হয়েছিল। ঐ জ্যোতির বাবা লোক এনে তুমাদেরকে গুলি করেছিল।

— হঁ সব সত্যি। তিনজনাকে মেরেই দিলেক। উদের লাশ নিয়ে মিছিল করলুম। কতো লোক – লোকের সমুদ্দর রে। আজ ও চোক বুজলে সব দেখতে পাই রে।

— সেই জমিগুলান ছেড়ে দেবে? 

— আমার বয়স তো হোনছে। ওপাড়ের ডাক শুনছি।

কাকার কথা শুনে গোকুল কেমন উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

*** 

গোকুল আর হাঁটতে পারছে না। পায়ের ব্যথাটা বেশ জানাচ্ছে। রাধার কথা শুনলে এতো কষ্ট হোত না। শোভযাত্রায় এসব মুখ গুলোকে দেখে আর হাঁটতে মন চায়না। হেমন্তের সন্ধ্যা গুটিগুটি পায়ে নেমে আসছে। গা শিরশির করছে। বোঝা যাচ্ছে শীত আসছে। মেলায় না গিয়ে গোকুল একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়ায়। লোকজন আগে চলে গেছে। সেই সুযোগে গোকুল ঘরের রাস্তা ধরে।

ঘরের দিকে মন টানছে। বেশির ভাগ লোক মেলায়। বয়স্করা ঘরেই। পাড়ার মুখেই ক্লাব ঘর। আগে মাটির ছিল। এখন পাকা। চেনা যায়না। একটা বিশাল কাট আউটে জননেত্রীর মুখ। দেখে গোকুলের শরীর রিরি করে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে ঘরের দিকে হাঁটা দেয়। রাস্তা থেকে নেমে ঘরের দিকে যায়। ঘরতো নেই।  দেওয়াল চারটে বর্ষার জলেও পড়েনি। উঠোনে দাঁড়িয়ে মনটা ভীষণ হাহাকার করে ওঠে। অন্ধকারে দেখাও যায়না। উঠোনে আগাছার জঙ্গল। তুলসী মন্দিরটা এখনো আছে। কাছে গিয়ে দেখে তুলসী গাছটা এই বর্ষার জল পেয়ে বেশ ঝাঁকালো হয়েছে। মনে পড়তেই জামার পকেট থেকে ধূপের প্যাকেটটা বের করে। গোপাল ঠাকুরের জন্য এনেছিল। দেওয়া হয়নি। সদ্ব্যবহার করার জন্য কয়েকটি কাঠি বের করে দেশালাইটা জ্বালাতেই রাস্তা থেকে পোড়ো ঘরটায় হঠাৎ আলো দেখতে পেয়ে কেউ আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, ভূত — ভূত — শব্দ শুনে গোকুল ও ঘাবড়ে যায়। কী করবে ভেবে পায়না। দেরি না করে সামনের দিকে না এসে পশ্চিমদিকের পুকুরে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পুকুর ছাড়িয়ে ধান ক্ষেতে ওঠে। ধান গাছের আড়ালে নিজেকে নিরাপদ জেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। গাঁয়ের দিক থেকে হৈ হট্টগোলের শব্দ, টর্চের আলোর ঘোরাফেরা, ছোটাছুটি আন্দাজ করে। মেলা থেকে মাইকের শব্দ ভেসে আসে। গোকুলের ঘরে তুলসীমঞ্চে তখনো ধূপকাঠিগুলি পুড়তে দেখে নানা রকম সন্দেহ হয়। কেউ বলে ভুতুড়ে কাণ্ড। কেউ বলে গোকুল এসেছিল। না না চোর এসেছিল। সেটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। চোর কেন ধূপ জ্বালবে? আর এটা গোকুলের ঘর, পালাবেই বা কেনে?  

*** 

গোকুল খানিকটা নিশ্চিন্তে মাঠের আলে বসে জামার পকেট থেকে বিড়ি বের করে ধরায়। বেশ ভালো লাগছে। 

কিছুক্ষণ আগের ভয়ংকর অবস্থাটা চিন্তা করে। খুব বেঁচে গেছে। দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেত। হেমন্তে ধানের শিস নুইয়ে পড়েছে। সোনালী সবুজ রঙ ধরেছে। অদ্ভুত একটা ধানের গন্ধের মাদকতা ছড়িয়ে পড়ছে। ঝিঁঝিঁর ডাক। ধানের শিস গোকুলের সোহাগ স্পর্শে যেন বুকে এলিয়ে পড়ছে। উদ্বেগ কেটে যাচ্ছে। এই ক্ষেতেই পূর্বপুরুষের ঘাম রক্ত মিশে আছে মাটির সাথে। গোকুলের শৈশবের স্মৃতি উন্মোচিত হতে থাকে। গোকুল ধানগুচ্ছ আঁকড়ে ধরে শুয়ে পড়ে উবুড় হয়ে। নরম ধানের গন্ধ বুকে টেনে নেয়। জননীর কোলে যেন সন্তান। স্নেহ শীতল হস্তস্পর্শে গোকুলের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কখন ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই - ঘুম ভাঙলে দেখে পূব আকাশে নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে।

উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার পরিসমাপ্তিতে গোকুল আবার যেন নিজেকে ফিরে পেল। পুরাতন দিন গুলি — কিংবা ধান ক্ষেত থেকে নিজেকে যখন সে প্রকাশ করল তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তার পরিশ্রান্ত গ্ৰাম।

 

1 Comments
  • avatar
    Joy Chatterjee

    09 August, 2025

    খুব ভালো লাগলো

Leave a reply