দেবীর আবির্ভাব

লিখেছেন:মলয় সরকার

দুর্গাপুজো। সন্ধিপুজোর অঞ্জলি শুরু হবে। মাইকে বার বার ঘোষণা হচ্ছে, আর কে কে বাকী আছেন, চলে আসুন, এটাই শেষ বারের মত অঞ্জলি। লোকে গিজগিজ করছে পুজো মণ্ডপে। সবাই ভক্তি, অভক্তি, কৌতুহল, সব মিলিয়ে মিশিয়ে হাজির মণ্ডপে। ব্রাহ্মণ তৈরী মন্ত্রপাঠ করানোর জন্য।

হঠাৎ একটি শব্দ ধপ করে। চমকে উঠল সবাই। মাঝবয়সী একটি ছেলে মাটিতে বসে পড়ে দুহাতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। আর গোঁ গোঁ করছে। 

সবাই শশব্যস্ত হয়ে পড়ল, কি হল? এমন ছন্দপতন কেন? কোথায় বাধা পড়ল, কী খুঁত হল পুজোয়!

ব্রাহ্মণের মুখ শুকিয়ে এল। এত ভক্তিভরে, নিষ্ঠায় পুজো করছেন, যদিও সার্বজনীন বারোয়ারী পুজো এটা, তবুও তাঁর দিক থেকে তো ত্রুটি হওয়ার কথা নয়।

ছেলেটি মাথা নাড়ছে আর বার বার বলছে, এত অশান্তি কেন, এত অভক্তি কেন? শান্তি জল দাও, চারিদিকে শান্তি জল দাও, আমার মাথায় শান্তি জল দাও।

সবাই মনে মনে হিসাব করতে শুরু করল, নিজের নিজের ত্রুটি আর আত্মদর্শন।

দু একজন এগিয়ে এসে, সবাইকে বোঝাতে লাগল, মা বেদী থেকে নেমে এসেছেন। ওনার ভিতরে সাক্ষাৎ দুর্গা মা রয়েছেন, তিনিই সব বলছেন। মা অসন্তুষ্ট। রক্ষা কর মা।

অমনি সবাই অঞ্জলি ছেড়ে তার সামনে দু হাত জোড় করে নিজের নিজের ত্রুটি পাপ যা যা আছে মনে মনে নিবেদন শুরু করল। আর মাঝেমাঝেই উঠতে লাগল, দেবীর জয়ধ্বনি।

কেউ কেউ তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানাতে লাগল আর ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। 

মানদা দু হাতে নিজের নাক কান মুলে বলল, হেই মা, মনে মনে মানত করেছিলাম, বৌটার বাচ্ছা হলে ভাল বেনারসী দেব। ভুল হয়েছে মা, অপরাধ নিস না। এই আমি স্বীকার করছি। সামনের মাসেই দেব।

তাই দেখে নমিতা বলল, হেই মা গো, আমারও ছেলেটা পাশ করলে, তোমাকে সোনার নথ দেব বলেছিলাম, আমিও ভুলে গেছি। অপরাধ স্বীকার করছি মা, শান্ত হও।

এই দেখে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল, অপরাধ স্বীকার করতে। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।

একটি মাঝবয়সী মহিলা, এগিয়ে এসে নিজের ছেলেকে ঠাস করে চড় মেরে বসল। সে পুজোর আসল কর্মকর্তা। সে ঘাবড়ে গেল। তার মা তখন সমানে বাক্য-আগুন ছুঁড়ছে, পুজোর আগে বলেছিলি না, পুজো বন্ধ করে দেব। তোদের কমিটির মধ্যে অশান্তি–। আমি পই পই করে বলেছিলাম, এ কথা বলতে নেই। থাম তোরা। এতকালের পুজো এভাবে বন্ধ করতে নেই। দেখলি তো এখন! মা নিজে এজন্য অসন্তুষ্ট। মা, মাগো, ছেলেটাকে ক্ষমা কোরো।

কর্তা ছেলেটি এতজনের মধ্যে হঠাৎ চড় খেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে, ব্যাপারটা সম্যক বোঝার বা এ অবস্থায় কী করা যায়, তার ভাবনা ভাবার চেষ্টা করছে।

ছেলেটি তখনও গোঁ গোঁ করছে মাটিতে বসে আর অশান্তি অশান্তি, শান্তিজল দাও ইত্যাদি বলে যাচ্ছে। হঠাৎ কী মনে করে,  ঠাকুর মশাই শান্তিজলের ঘটিটা কাছে নিয়ে যেতেই সে একটানে ঘটিটা কেড়ে নিয়ে নিজের মাথায় ঢালতে লাগল।

ঠিক এরই মধ্যে একজন কেউ ছেলেটিকে চিনতে পেরে, পাশের পাড়ায়, তার বাড়িতে খবর দেয়। 

খবর পেয়ে ছেলেটির মা দৌড়ে আসেন। ভিড় দুহাতে ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে আসেন সামনের দিকে। তার সঙ্গে আসা আর দুজন শক্তসমর্থ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তাকে তুলে নিয়ে ঘরের দিকে দৌড় লাগান। যাবার সময় বলে যান, কিছু মনে কোরো নি তোমরা। ওর মৃগী আছে তো–

সবাই হতভম্ব হয়ে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। 

 

0 Comments
Leave a reply