ছেলেধরা ও আজকের গান্ধি

লিখেছেন:অমর দে

হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে ফুটকি বলল —

- গান্ধিদা গান্ধিদা, শিগগির চলো।  তুলকালাম চলছে। সেন্টার দলবল এক জটিবুড়িকে পঞ্চাননতলায় বেঁধে মারছে। আরও মারলে বুড়ি মরেই যাবে গো।

এপর্যন্ত বলে ফুটকি ফ্যাঁচ করে কেঁদে ফেলল। প্রথম চোটে থামান না গেলে একবার শুরু করলে ফুটকি হেঁচকি তুলে  কাঁদতেই থাকবে। তখন ওকে থামায় কার সাধ্যি। তাই গান্ধি ওরফে পতিতপাবন গান্ধার, লোকের মুখে মুখে পতিতপাবন ঘুচে গিয়ে আর গান্ধারের লেজের কিছু অংশ খসে একটা  ই-কার যোগ হয়ে এখন শুধুই গান্ধি হয়েছে, ফুটকির কান্না থামাতে জোর একটা দাবড়ানি দিয়ে বলে —- অ্যাই মেলা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদবি না। কী হয়েছে তাই আগে বল।

কুসুমডিঙা গ্রামে কত কাল কত যুগ আগে যে এক ঘর গান্ধার এসে বসত শুরু করেছিল আজ আর কেউ বলতে পারবে না। তারাই শাখাপ্রশাখায় বেড়ে এখন কুসুমডিঙার চার আনা। গান্ধারগুষ্টির সকলেরই লম্বা-চওড়া, গৌর বর্ণ, শক্তপোক্ত মজবুত গড়ন। এলাকার সকলে এজন্য গান্ধারদের সমীহ করে চলে। বিশেষ করে পতিতপাবন, মানে গান্ধিকে। গান্ধারেরা বলে ও নাকি ওর  ঠাকুদাদার বাবার চেহারা পেয়েছে। ওর প্রপিতামহ নাকি দু'সের চালের ভাত খেতেন। গায়ে ছিল হাতির মতো বল। দু'হাতে দু'টো গরুর গাড়ির চাকা তুলে ফেলতেন। চব্বিশ বছরের গান্ধিরও লম্বা-চওড়া দশাসই শরীর। ছাতি আটচল্লিশ ইঞ্চি। হাত-পায়ের গুটিগুলো যেন ঝুনো নারকেল। লাঠি ঘোরায় বনবন করে। হাতে লাঠি থাকলে দশজন লোকও ওর সামনে ভেরে না।

ফুটকি সবে বারোয় পড়েছে। গান্ধির ছোট কাকার ছোট মেয়ে। নরম মন আর মিষ্টি স্বভাবের জন্য সকলে ওকে ভালোবাসে। তবে ভারি ছিচকাঁদুনে। কিন্তু গান্ধির খুব নেওটা। গান্ধি ছাড়া কেউ পারে না ওর কান্না থামাতে। গান্ধি ওর কান্না থামানোর ওষুধ জানে। গান্ধির উপর ফুটকির খুব ভরসা। স্কুলে  যায়, আবার সারা কুসুমডিঙা টো টো করে বেড়ায়। এ তল্লাটের সব খবর ওর নখদর্পণে। কুসুমডিঙার লোক ওকে আদর করে ডাকে গেজেটবুড়ি বলে। আজ ও যেমন পঞ্চাননতলার তুলকালাম ঘটনার বিবরণ দিতে এসেছে।

সেন্টা হল সন্টু মাহারা। গান্ধি শুনেছে ইদানীং ওর নাকি বড় বড় ডানা গজিয়েছে। এখন দল পাকিয়ে  চুরি- চামারি ছাড়াও অনেক কুকীর্তি করে বেড়াচ্ছে। কুসুমডিঙার মুখে কালি মাখাচ্ছে। শুনে গান্ধির মাথা গরম হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু গান্ধার বংশের কুলগুরুর কথা মনে পড়ে যাওয়ায় নিজেকে তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়েছিল। গুরুদেব গান্ধির মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন — বাবা গান্ধি, অযথা উত্তেজিত হবে না। তোমার শরীরে ভীমের শক্তি। কিন্তু বুদ্ধি হারিয়ে উত্তেজিত হলে প্রলয় ঘটে যাবে। মনে রেখো দেহের শক্তির থেকে বুদ্ধির  শক্তি  বহু গুণ বেশি। বিপদ কালে বুদ্ধির প্রয়োগ করবে। দেখবে ঈশ্বর  তোমার সহায় হবেন।

ফুটকির কথা শোনা  অবধি গান্ধির রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। তখনই একমুখ লম্বা সাদা দাড়ি আর ঘাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া পাকা চুল গুরুদেবের প্রসন্ন মুখটি চোখে ভেসে উঠতে নিজেকে ঠাণ্ডা করে ফুটকির হাত ধরে গান্ধি বলল — চল তো ফুটকি, পঞ্চাননতলায় কী চলছে দেখে আসি।

গান্ধিদাদার কথা শুনে  খুশিতে ফুটকির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কান্না থামিয়ে এবার ফুটকি হেসে বলল — চলো চলো, শিগগির চলো।  দেরী কোরো না। দেরী হলে ওরা হয়তো জটিবুড়িকে মেরেই ফেলবে।

গান্ধি লম্বা লম্বা পা ফেলে পঞ্চাননতলার দিকে এগোতে থাকে। ফুটকি গান্ধির সঙ্গে পারবে কেন। গান্ধিদাদা পঞ্চাননতলায়  যেতে রাজি হওয়ায় ওর স্ফুর্তি এখন বেড়ে গেছে। ও গান্ধির পাশে পাশে ছুটতে থাকল। 

###

পঞ্চাননতলায় পৌঁছে প্রথমে যেটা চোখে পড়ল একজন মাঝ বয়সী মহিলা পঞ্চাননতলার অশথগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দু'পা ছড়িয়ে উদভ্রান্তের মতো বসে ফ্যালফ্যাল করে পঞ্চাননতলায় জমায়েত হওয়া লোকদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথার চুল রুক্ষ। কত কাল চুলে তেল চিরুনি পড়েনি কে জানে। প্রায় জট পাকিয়ে গেছে। এজন্যই ফুটকি ওকে জটিবুড়ি বলেছে। একটা  বছর চারেকের বাচ্চা ছেলে সেই মহিলাকে জড়িয়ে ধরে ডাক ছেড়ে কাঁদছে। মহিলার পাশে পড়ে আছে কাগজকুড়ুনিদের মতো নানান হাবিজাবি জিনিসে ভর্তি একটা ঝোলা। মহিলার পরনের শাড়ি নোংরা আর জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। বাচ্চাটার গায়ে তেলচিটে গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট। মহিলার কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত মুখে জমাট বেঁধে আছে। বোঝা যাচ্ছে সেন্টারা ওকে নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে। কিন্তু ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন কেউ কিছু বলছে না, বরং দূর থেকে শুধু মজা দেখছে।

পঞ্চাননতলায় পৌঁছে গান্ধি একটা হুঙ্কার ছাড়ে — অ্যাই, কে মেরেছিস অ্যাঁ? কে গায়ে হাত তুলেছিস?

গান্ধির বাজখাই গলার আওয়াজে ভিড় কিছুটা দূরে সরে যায়। সেই সময় ভিড় থেকে  কেউ একজন বলে ওঠে — সেন্টারা রে গান্ধি। 

সেদিকে বিরক্তিভরা চোখে তাকিয়ে গান্ধি বোঝার চেষ্টা করে কথাটা কে বলল। তারপর ক্রুদ্ধ গলায় বলল — তো তখন আপনারা কী করছিলেন? মজা দেখছিলেন?  ছাড়িয়ে দিতে পারেননি? এতে যে কুসুমডিঙার বদনাম হচ্ছে সেটা বোঝেন?

গান্ধির কথায় জমায়েত নিশ্চুপ। কেউ কোনও উত্তর দেয় না। পঞ্চাননতলায় স্তব্ধতা নেমে আসে।

এবার  সেন্টা ভয়ে ভয়ে গান্ধির কাছে এসে দাঁড়ায়। গান্ধি আগেই দেখে নিয়েছে একটু দূরে ওর জনা পাঁচেক শাগরেদ দাঁড়িয়ে আছে। মিন মিন করে সেন্টা বলে — গান্ধিদা, এই বুড়ি একজন ছেলেধরা। এই বাচ্চাটাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। বাসস্ট্যান্ড থেকে ওকে ধরেছি।

- অ্যাই চোপ। একদম চোপ। এক থাপ্পড়ে তোর দাঁতগুলো খুলে নেবো। কী করে বুঝলি ও ছেলেধরা?  ছেলেধরা হোক আর যাই হোক, গায়ে হাত তুলেছিস কেন? ওকে পুলিশে দিতে পারতি। আইন নিজের হাতে নেওয়ার জন্যে এবার তো পুলিশই তোদের ধরবে।

অপরাধী মন। গান্ধির কথায় সেন্টা ভয় পায়। ঝামেলার গন্ধ পেয়ে এরমধ্যেই সেন্টার শাগরেদরা সটকে গেছে। বিপদে পড়েছে বুঝতে পেরে সেন্টা গান্ধির দু'হাত চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে — ও গান্ধিদা! আ-আমাকে পুলিশে দিও না গান্ধিদা! শুনেছি পুলিশ বেধড়ক পেঁদায়। ওরে বাবারে… মরে যাব গান্ধিদা।

- কথাটা আগে মনে ছিল না? তোর চেলাগুলো তো সব ভেগেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না বুড়িমার একটা বিহিত হয় তুই  এখান থেকে কোথাও যাবি না। অশথতলায়  বুড়িমার পাশে গিয়ে এখন চুপ করে বসে থাক। যা 

সেন্টা গান্ধির কথা মতো মাথা নিচু করে মহিলার পাশে গিয়ে বসে।

ফুটকি এতক্ষণ চুপচাপ গান্ধির পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু লক্ষ করছিল। সেন্টাকে গান্ধিদাদা ধাতানি দিচ্ছে দেখে ওর মনে খুব আনন্দ হচ্ছে। শয়তান সেন্টাকে ও দু'চোখে দেখতে পারে না।

এমন সময় হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভাব করে গান্ধি ফুটকিকে ডাকল — ফুটকি রে!

ফুটকি সঙ্গে সঙ্গে গান্ধির সামনে এসে  হাজির — কী বলছ গান্ধিদা?

- আমাদের বাড়ি থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা আনতে পারবি?

- খুব পারব। আমি জানি তোমাদের ফাস্টেড বাক্স কোথায় থাকে। এক ছুটে যাব আর নিয়ে আসব। বলেই ফুটকি ছুট লাগাল।

গান্ধি মহিলার সামনে গিয়ে বসল — ও মাসি! তোমার বাড়ি কোথায়? এই বাচ্চা ছেলেটা তোমার কে হয়? তোমার বাড়িতে আর কে কে আছে? এখন কোথা থেকে আসছ? বল, তোমার কোনও ভয় নেই।

মহিলা অবোধ চোখে গান্ধির দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কোনও কথার উত্তর দিতে পারে না। শুধু মুখে একটা অব্যক্ত শব্দ করে। গান্ধি বোঝে মহিলা প্রকৃতিস্থ নয়। মনে হয় যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। এমন মানুষ পথে-ঘাটে হামেশা দেখা যায়। ওর নিজের ঘরেই তো এমন আপনহারা একজন মানুষ ছিল। সিধুজ্যাঠা। ডাক্তার ওষুধ চিকিৎসা অনেক করা হয়েছে। এমনে এক রকম ভালোই থাকত। কোনও হাঙ্গামা হুজ্জুত করত না। শুধু ভরা পূর্ণিমার দিনগুলোতে ওকে কিছুতেই বাগে রাখা যেত না। খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছুটে খোলা ছাদে গিয়ে কেবলই চরকি পাক খেত। ছাদের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত ঘুরত বনবন করে। তখন ওর সামনে যায় কার সাধ্য । সেসব অনেক কাল আগের কিস্যা। তারপর সিধুজ্যাঠা তো একদিন ঘুমের মধ্যেই ত্রিভুবনের ওপারে চলে গেল।

মহিলার অস্থির ভাবলেশহীন চোখ দেখে গান্ধির প্রথমেই  সিধুজ্যাঠার কথা মনে এল। চাঁদে পাওয়ার দিনগুলোতে সিধুজ্যাঠার চোখদুটিও অমনই নির্বিকার অভিব্যক্তিহীন হয়ে থাকত। মহিলার কাছ থেকে কোনও প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাবে না বুঝে গান্ধি বাচ্চা ছেলেটার দিকে নজর দিল।

এর মধ্যে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ফুটকি এসে গেছে। ছুটে আসার জন্য ওর কপাল বেয়ে টপটপিয়ে ঘাম ঝরছে। পরনের  ফ্রক দিয়েই মুখ মুছে নেয় ফুটকি।

গান্ধি মহিলার কাছে গিয়ে প্রথমে তুলোতে ওষুধ লাগিয়ে ক্ষত আর মুখে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে । তারপর ক্ষতস্থানে ওষুধ দিয়ে কষে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। মহিলা কোনও বাধা দেয় না, বাধ্য মেয়ের মতো গান্ধিকে ওর কাজ করতে দেয়।

প্রাথমিক শুশ্রূষার কাজ সেরে ফার্স্ট এইড বক্স আবার ফুটকির হাতে ফেরত দিয়ে গান্ধি পাশের টিউব ওয়েলে হাত ধুয়ে ফের মহিলার কাছে আসে। বাচ্চা ছেলেটা এখন আর কাঁদছে না, তবে দু'হাতে মহিলাকে ভীতসন্ত্রস্তভাবে আঁকড়ে ধরে আছে। শুকনো মুখে মাঝে মাঝে ভয়ে ভয়ে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। নরম গলায় গান্ধি ওকে বলল — বাবু, কোনও ভয় নেই। আমি আছি না। আর কেউ তোমাদের মারবে না। তোমার খুব খিদে পেয়েছে তাই না? তারপর ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল — তোমাদের কেউ এদের জন্যে একটু খাবার এনে দিতে পারবে?

শুনে ফুটকি চনমন করে উঠে বলল — বাড়ি থেকে আমি এনে দেব গান্ধিদা?

ফুটকির কথা শেষ হবার আগেই ভিড় ঠেলে তমাল সামনে এগিয়ে এল — আমি দু’মিনিটের মধ্যে নিয়ে আসছি গান্ধিদা। যাব আর আসব।

তমাল এখন এই কুসুমডিঙার সবচেয়ে ভালো ছাত্র। পড়াশোনা ঠিক মতো চালিয়ে গেলে ও অনেক দূর যাবে। ওকে গান্ধি ভালো করেই জানে। ক্লাস নাইনে পড়ে। সন্দেহের বশে মহিলার উপর এমন নির্মম নির্যাতন ও মানতে পারেনি। সেন্টাদের দাপটে এতক্ষণ চুপ করে ছিল। কিন্তু হাওয়া পাল্টে যেতে ও আবার স্বভাবে ফিরেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তমাল দুটো বান রুটি আর  কলা এনে গান্ধির হাতে দিল। সেগুলো মহিলা আর ছেলেটার দিয়ে গান্ধি বলল — খাও। কোনও ভয় নেই। তারপর ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আবার বলল — জল, কেউ একটু খাবার জল নিয়ে এসো।

বলতে বলতে এক বোতল জল চলে এল। এরমধ্যে মজামারাদের ভিড় আরও বেড়ে গেছে। বিনিমাগনার মজা কে না দেখতে চায়। আগে ওরা একটা নিষ্ঠুর মজা দেখেছে, এখন দেখছে তার উল্টো মজা।

খাবার আর জল খেয়ে ওদের দু'জনকে এখন কিছুটা ধাতস্থ দেখাচ্ছে। তবে আতঙ্ক যে এখনও সবটা কাটেনি সেটা ওদের চোখ মুখ আর শরীরের ভাষা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে। গান্ধি এবার মোলায়েম গলায় ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করল — বাবু তোর নাম কি রে?

ছেলেটা ইতস্ততভাবে একবার গান্ধি আর একবার মহিলার মুখের তাকায়। গান্ধি না বুঝলেও ছেলেটা বোধহয় মহিলার কাছ থেকে কোনও ইশারা পেয়ে বলল — ডাহুক।

ছেলেটাকে এবার কিছুটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। ডাহুক নাম সচরাচর শোনা যায় না। অথচ বেশ মজার নাম। হেসে গান্ধি বলল — বাহ্! দারুণ নাম তো তোর।

গান্ধির কথায় ডাহুক একটু লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করল। গান্ধি আবার জিজ্ঞাসা করল — মাসি তোর কে হয়?

- দিদিমা।

- তোদের বাড়ি কোথায়?

- হুই দিকে। বলে দূরে বয়ে যাওয়া অজয় নদের দিকে আঙুল দেখাল।

গান্ধি ডাহুকের আঙুলের নির্দেশের দিকে তাকায়। সেদিকে মানুষের ঘরবাড়ি পেরিয়ে গাছেদের মাথার উপর নীল আকাশ চোখে পড়ে। কুসুমডিঙা থেকে নদী দেখা যায় না। শুধু নদীর উপর দিয়ে বয়ে আসা মোলায়েম বাতাস টের পাওয়া যায়।

- তোদের গাঁয়ের নাম কী?

ডাহুক চুপ করে থাকে।

- তোরা অনেক সকালে ঘর থেকে বেড়িয়েছিলি তাই না?

ডাহুক সম্মতিসূচকভাবে ঘাড় নাড়ে — সেই ভুরবেলা।

- কোথায় যাচ্ছিলি?

- উ তো দিদিমা জানে।

গান্ধি বোঝে এদের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছু জানা যাবে না। ভাবনায় পড়ে যায় এদের নিয়ে ও কী করবে। এদের এখন খাবার দরকার, আশ্রয় দরকার। তারপর থানাতেও একটা খবর দিতে হবে। ভাবতে ভাবতে গুরুদেব আবার মাথায় ভর করেন — মাথা খাটা গান্ধি, মাথা খাটা। মাথা খাটালেই দেখবি গরগর করে মাথায় বুদ্ধি আসছে। মাথা খাটাতে খাটাতেই মাথায় দুম করে কৈলাশ দিকপতির নাম ভেসে ওঠে। গান্ধি লাফিয়ে ওঠে — এই তো! ঠিক সময়ে ঠিক বুদ্ধি এসে গেছে। একমাত্র কৈলাশই পারে এই বিপত্তির নিষ্পত্তি করতে। ক’মাস আগে সদরে পরিচয় হয়েছিল কৈলাশের সঙ্গে। ওর ফোন নম্বরটাও সেভ করা আছে।

গান্ধি ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে ফুটকি হকচকিয়ে যায় — কী হল গান্ধিদা!

গান্ধি হাসতে হাসতে বলে — পেয়েছি রে ফুটকি, রাস্তা পেয়েছি। আর কোনও চিন্তা নাই। আপাতত এদের দু'জনকে কোথায় আশ্রয় দেওয়া যায় সেটাই ভাবছি।

ফুটকি বলল — কেন, আমাদের বাড়িতে কি জায়গার অভাব?

- না রে ফুটকি, সেজন্যে নয়। এসব কাজের জন্যে গ্রামের পঞ্চজনের একটা মতামত নিতে হবে না? তারপর সেন্টার দিকে ঘুরে বলল — তুই  মাসিকে মেরেছিস। এবার বাঁচাতে চাস তো এবার পাশ্চিত্তির কর। যতক্ষণ না পর্যন্ত মাসিকে ঘরে পাঠানো না যাচ্ছে তুই ওদের নিজের ঘরে রাখ।

সেন্টা অশথতলায় বসেই কেউ কেউ করে — আমাদের ঘরে! আমাদের ঘরে কী করে হবে গান্ধিদা? তুমি তো সবই জানো। বুড়ি মা ছাড়া করার মতো আর কেউ নাই। তার ওপর মা-টার ভারী অসুখ। ওদের সেবা কে করবে?

- কেন তুই। তুই করবি। যখন মারছিলি তখন এসব কথা মনে ছিল না?

এবার সেন্টা গান্ধির পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে — আমাকে এবারের মতো মাপ করে দাও গান্ধিদা। এমন গুখুরি কাজ আর জীবনে করব না।

- দ্যাখ, একেই বলে — ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল মারবার গোঁসাই। তবে তুই এমনি ছাড়া পাবি না। যা বলব করতে হবে।

- তুমি যা বলবে তাই করব গান্ধিদা। শুধু ওদের রাখার দায়িত্বটা দিও না।

- ঠিক আছে। মনে থাকে যেন।

দু'হাতে নিজের দু'কান ধরে সেন্টা বলে — ঠিক মনে থাকবে। সারা জীবন মনে থাকবে।

বিপদ বুঝে ভিড় এবার পাতলা হতে শুরু করেছে। যে ক'জন তখনও দাঁড়িয়ে ছিল তাদের দিকে ঘুরে গান্ধি বলল — আপনাদের মধ্যে কেউ এদের ক'দিন আশ্রয় দিতে রাজি আছেন?

গান্ধির কথায় কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করে না। কেবল এ ওর মুখ চাওয়া-চাউয়ি করতে থাকে। এরমধ্যে গান্ধি পকেট থেকে মোবাইল বের করে মাসি আর ডাহুকের কয়েকটা ছবি তুলে কৈলাশকে পাঠিয়ে দিয়ে এদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছে। গান্ধি জানে কৈলাশের হ্যাম রেডিও ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।

কেউ কিছু বলছে না দেখে তমাল আবার এগিয়ে আসে — গান্ধিদা, আমি এদের নিয়ে যাব?

গান্ধি মুগ্ধ চোখে তমালের দিকে চেয়ে থাকে। আছে, এখনও কিছু হৃদয় বেঁচে আছে। নাহলে পৃথিবীটা শ্মশান হয়ে যেত। তমালকে বুকে জড়িয়ে ধরে গান্ধি বলে — না রে ভাই, সামনে তোর পরীক্ষা। আমরা তো আছি। এখন অন্য কোনও বোঝা মাথায় নিস না। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। কুসুমডিঙার নাম তোকে উজ্জ্বল করতে হবে।

এরপর পঞ্চাননতলায় তখনও যে ক'জন লোক দাঁড়িয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে গান্ধি বলল — তাহলে আপনারা কেউ যখন রাজি নন, অনুমতি করলে আমি এদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি?

জটলার লোকেরা এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে  একসঙ্গে হ্যাঁ হ্যাঁ করে ওঠে — হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে ভালো হবে বাবা। তুমিই বরং ওদের নিয়ে যাও ।

মহিলা ঝোলা কাঁধে নিয়ে একটু সামনে ঝুঁকে হাঁটছে। ফুটকি এক হাতে জটিবুড়ির হাত অন্য হাতে ডাহুকের হাত ধরে ওদের নিয়ে যাচ্ছে গান্ধার নিবাসের দিকে। কাজটা সুষ্ঠুভাবে করতে পেরে হালকা মনে মুখে স্মিত হাসি নিয়ে ধীর পায়ে গান্ধি ওদের অনুসরণ করছে।

###

এর পরের কাহিনি সংক্ষিপ্ত। কৈলাশ আর হ্যাম রেডিও দারুণ কাজ করেছে। গান্ধি সেন্টাকে সদরে পাঠিয়েছিল কৈলাশের কাছে। তিন দিনের মাথায় কৈলাশ মহিলার দু'জন আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে কুসুমডিঙায় এসে হাজির। জানা গেল ওদের বাড়ি এখান থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে অজয় নদের ওপারে একটি গ্রামে। ডাহুক তাহলে ঠিক দিকেই আঙুল তুলে গান্ধিকে ওদের বাড়ির নিশানা দেখিয়েছিল।

 ওরা চলে যাওয়ায় ফুটকির খুব মন খারাপ। যাওয়ার সময় ফুটকি ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। এই তিন দিনেই ডাহুকের সঙ্গে ওর গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। গান্ধি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল — মন খারাপ করিস না ফুটকি। সদরে বিরাট মেলা বসেছে। সেই মেলায় তোকে ইলেকট্রিক নাগরদোলায় চড়াব।

 

0 Comments
Leave a reply