সকাল থেকে পাড়ার ক্লাবে মাইক বাজছে। কিছু একটা অনুষ্ঠান আছে রাতের দিকে। তারই ঘোষণা চলছে, মধ্যে মধ্যে গান শোনানোও চলছে। মুশকিল হলো, পিকুর কাল থেকে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু। শ্রেয়া একবার বলেছে অর্পণকে, "ব'লে দেখো না ওদের, ভলিউমটা একটু কমাতে। তোমার সঙ্গে তো কথা বলে।"
"কথা বলে ব'লেই আমার কথা শুনবে, এটা তুমি ভাবলে কী করে ? দরজা, জানলা বন্ধ করে রাখো। একটা দিন তো।"
"এর আগেও বহুবার হয়েছে, কোনওদিন তো বলিনি। পিকুর কাল পরীক্ষা বলেই বলতে বললাম।" শ্রেয়ার কথায় বিরক্ত হলো অর্পণ। বলল, "অফিস যাবার সময় আরম্ভ করলে। আর পিকু, পড়ে তো ক্লাস টুয়ে। এখনই পড়া পড়া করে মাথা খারাপ কোরো না তো।" আর কথা বাড়ায়নি শ্রেয়া। একদিনের পড়া বা না পড়ার ওপর পিকুর রেজাল্ট নির্ভর করবে না, শ্রেয়া নিজেও জানে। তবু, মন ওর বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকল।
ছেলের পরীক্ষার সময় শ্রেয়া হয় ছুটি নেয়, নয় তো 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' করে। দরজা, জানলা বন্ধ করেই শ্রেয়া ছেলেকে পড়তে বসিয়ে নিজেও ল্যাপটপ খুলে বসল। অবিশ্রান্ত মাইকের গর্জনে শ্রেয়া নিজেই জর্জরিত। ছেলেকে আর কী বোঝাবে!
দুপুরের দিকে পরিবেশ যখন কিছুটা শ্রান্ত ক্লান্ত, সেই সময় মাইক সাময়িক বিরতি পেল। শব্দ দূষণ থেকে রেহাই পেল চারপাশের মানুষজন।
শ্রেয়া এই সুযোগে ওর ঘরের জানলাটা খুলল। হোক দুপুর, একটু অক্সিজেন তো আসা দরকার। জানলাটা খোলা মাত্র পাশের খালি জমিতে চোখ গেল শ্রেয়ার। জমিটার একটা জায়গা একটু গর্ত মতো। গতকাল রাতে বিনা নোটিশে আসা বৃষ্টির কিছুটা জল এখনও রয়েছে সেখানে। আর কতগুলো চড়ুই ওই জলে আত্মসুখে স্নানে মেতেছে। একবার জলের মধ্যে ডানা ঝাপটাচ্ছে। আবার উড়ে গিয়ে শুকনো জায়গায় বসছে। কিচিরমিচির শব্দে মনের হরষে নিজেরাই মুখরিত। শ্রেয়া কান ও চোখের আরাম নিতে নিতে ভাবল, শব্দ কখনও পীড়াদায়ক, কখনও আরামদায়ক।
রাতে তারস্বরে গান চলছিল। প্রথম গান রবীন্দ্র সঙ্গীত। তারপরেই বাজার চলতি হিন্দি গান। সহযোগী নৃত্য শিল্পীদের উপস্থিতি চাক্ষুস না করেও ভয়াবহ অনুভবে ধরা দিচ্ছিল। অর্পণ মাথার বালিশটা কানে চেপে পাশ ফিরে শুয়ে বলল, "এদের জন্য একটু ঘুমোনোর উপায় নেই। সারারাত জ্বালাবে।"
পরের দিনটা শুরু হলো দিগ্বিজয়ী রথের মতো। রোদ উঠল ঝলমলে। ব্যস্ত শহর নিজের নিয়মেই অস্তিত্বের লড়াইয়ে নেমে গেল। কারোর মুখে বিরক্তির চিহ্নমাত্র নেই। সব এখন স্বাভাবিক।
দুপুরে খেতে বসে আপনমনে হাসছিল শ্রেয়া।
অর্পণের মা বললেন, "হাসছ যে শ্রেয়া। কী মনে পড়েছে?"
শ্রেয়া হাসতে হাসতেই বলল, "আমরা কত এডজাস্টেবেল দেখুন মা। কী সুন্দর সব মানিয়ে নিই!"
শাশুড়ি মা অবাক হয়ে বললেন, "কীসের কথা বলছ?"
"এই যে কাল সকাল থেকে শুরু করে রাত দুটো পর্যন্ত এত যে মাইক বাজল, কারোর কোনও ক্ষতি হলো, বলুন তো? এই অঞ্চলের একজন মানুষও মারা গেছেন? অসুস্থ হয়েছেন কেউ? একজনও না।"
অনিতাদেবী চোখ কপালে তুলে বললেন, "বালাই ষাট! এ'সব কী বলছ তুমি!"
শ্রেয়া শাশুড়িকে আশ্বস্ত করে বলল, "ভয় পাবেন না, মা। আমরা সবাই খুব ভালো আছি। বাড়তি একটা পাতা পর্যন্ত ঝরেনি গাছের।"
শাশুড়ি মা কী বুঝলেন, সে তিনিই জানেন। খানিকটা হাঁ করে শ্রেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তখনও বিকেল। রাস্তার একপাশের ফিকে হলুদ রোদের ধার দিয়ে পিকু বাবা-মায়ের সঙ্গে পিসির বাড়ি থেকে ফিরছিল। বাস থেকে নেমে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। বিকেলের আবেগি বাতাস গায় মেখে হাঁটতে মন্দ লাগছিল না ওদের। হঠাৎ একটা মোটর সাইকেল তীব্র গতিতে এমনভাবে ওদের গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল যে, পিকুকে সামলাতে গিয়ে শ্রেয়া নিজেই পড়ে গেল।
ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে অর্পণকে শ্রেয়া বলল, "কীভাবে গেল দেখলে গায়ের ওপর দিয়ে?"
ঠিক তখনই আর একটা বাইক ওদের পাশে এসে দাঁড়াল।
বাইক চালক আঙ্গুল তুলে শ্রেয়াকে বলল, "হর্ন সবাই দেয়। আপনি শুনতে পান না, সেটা বলুন।"
শ্রেয়াও বলল, "হর্ন দিলেই হলো! সরবার জন্য একটু সময়ও তো দিতে হবে। তা ছাড়া আমরা রাস্তার ধার দিয়েই যাচ্ছিলাম।"
কথায় কথা বাড়ে। রাস্তায় লোক জমতে শুরু করে। ইতোমধ্যে ওই বাইকের পিছনের আরোহী আগের বাইকের চালককে ফোন করে আসতে বলল।
দলবদ্ধ বিক্রম দেখানো সব সময়ই অতি মাত্রায় কার্যকরী হয়। এ'ক্ষেত্রেও তা'ই হলো। লক্ষ্য শ্রেয়া। এ যেন একটা জিরাফকে কব্জা করতে বেশ কয়েকটা বাঘের সমবেত আক্রমণ। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে, যে ভিড়টা জমেছিল, সেটা এবার পাতলা হতে শুরু করল। অর্পণ প্রায় হাতে পায় ধরে সে যাত্রা রক্ষা পেল।
তারপরেও ওরা, অর্পণের জামার কলার ধরে দেওয়ালে ঠেসে দাঁড় করিয়ে বলল, "সঙ্গে বাচ্চা আছে বলে ছেড়ে দিলাম। তোর বউকে বেশি বাড়তে না করিস।"
রাত ন'টার মধ্যে রাতের খাওয়া সেরে নেওয়ার অভ্যেস অম্লানবাবুর বহুদিনের। সেই মতো শ্রেয়া টেবিলে খাবার বেড়ে শ্বশুরমশাইকে ডাকতে গেল। কিন্তু আজ তিনি উঠলেন না।
শ্রেয়া ঘরের বাইরে থেকেই বলল, "খাবার দিয়েছি। খেতে আসুন বাবা।"
সাড়া না পেয়ে শ্রেয়া শ্বশুরের ঘরে পা রেখে দেখে, তিনি গম্ভীর মুখে খাটের ওপর বসে আছেন।
শ্রেয়া উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, "খাবেন না বাবা? শরীর খারাপ নাকি?"
অম্লানবাবু ভারি গলায় বললেন, "বোসো। কথা আছে।"
পরিস্থিতির জটিলতা মূর্খেও বোঝে। দাঁড়িয়ে থেকেই বলল শ্রেয়া, "বলুন বাবা,কী বলবেন।"
অম্লানবাবু শ্রেয়ার দিকে চোখ রেখে বললেন, "শোনো শ্রেয়া,ওদের সঙ্গে লাগতে যেও না। আজ আমার ছেলেটাকে যেভাবে ..."
কথাটা যেন বুকে শেলের মতো বিঁধল শ্রেয়ার।
একটু চুপ থেকে বলল, "আমি ওদের সঙ্গে লাগতে গেছি বলে আপনার মনে হলো? বাবা?"
বলার সময় গলাটা খুব সামান্য হলেও কেঁপেছিল। অম্লানবাবু বুঝলেন, চালে কোথাও ভুল হলো।
একটু নরম সুরে বললেন, "সবই জানি রে মা। কিন্তু, ওদের সঙ্গে আমরা পেরে উঠব না।"
তারপর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন, "নাহ্, রাত হয়ে গেল। চলো শ্রেয়া, খেয়ে নিই।"
অর্পণ অবশ্য সেই থেকে গম্ভীর। ভাবখানা এমন, ওর এই হেনস্থার জন্য শ্রেয়াই দায়ী। রাতে পেছন ঘুরে শুয়ে থাকে। প্রয়োজনের বাইরে একটি কথাও নয়। অফিসে বেরোনোর সময় মা'কে আসি বলে বেরিয়ে যায়। তবু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, থোড় বড়ি খাড়ার বাইরে তো নয়। জলেও আছি তেলেও আছি করে দিন ঠিকই চলে যায়।
এই ঘটনায় কিছুটা ভয় পেয়েছিল পিকু। শ্রেয়াই নানারকম গল্প বলে ওর ভয় কাটিয়ে দিয়েছে। মা'র কাছে গল্প শুনে পিকু বুঝেছে, রাক্ষস খোক্কশ আগেও ছিল, এখনও আছে। শুধু চেহারা পাল্টে গেছে।
পিকুকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়া এবং নিয়ে আসার কাজটা অম্লানবাবুই করে থাকেন। সকালে ন'টা নাগাদ নাতিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে বাজারের দিকে যান একবার তিনি। অমলবাবুর দশা ভরপেট খেয়েও কিছুই তো খাওয়া হলো না গোছের। দরকার না থাকলেও বাজার রোজ যেতেই হবে। এই নিয়ে স্ত্রী অনিতার সঙ্গে প্রায়ই লাগে। দুপুর আড়াইটা নাগাদ আর একবার ফাঁকা বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। ঠিক যুদ্ধ না, একটা প্রতিযোগিতা। ওই সময় পিকুর স্কুল ছুটি হয়। গাড়ি আসতে প্রায় তিনটে। অনিতাদেবী চান না তাঁর স্বামী দু'বার করে রোদের মধ্যে বেরোন। আর অম্লানবাবু চান না তাঁর স্ত্রী হাঁটুর ব্যাথা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাস স্ট্যান্ডে যান। শেষ বয়সের প্রেমসমরে অম্লানবাবুই যেতেন।
বেরোনোর সময় একবার আকাশের দিকে তাকালেন অম্লানবাবু। মেঘগুলো এত কাছে, যেন হাত বাড়ালে ওরাও হাতটা বাড়িয়ে দেবে। বৃষ্টি নেই, কিন্তু আকাশটা কালো করে তাঁবুর মতো ঢেকে রেখেছে। বাস স্টপে পৌঁছেই দেখলেন পিকুদের গাড়ি আসছে।
পিকু গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসতেই অম্লানবাবু বললেন, "পা চালাও দাদুভাই। আকাশের অবস্থা ভালো নয়।" কিন্তু পিকু দাঁড়িয়ে গেল।
"দাদু। ও দাদু। ওই দেখো।"
রাস্তার পাশে এক ফুল বিক্রেতাকে আঙুল দিয়ে দেখাল পিকু। কিন্তু আজই অম্লানবাবু টাকার ব্যাগ সঙ্গে আনেননি। বৃষ্টি আসতে পারে ভেবে তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে এই ভুল। এমন নয় যে পিকু যখন তখন বায়না করার ছেলে। মুশকিলে পড়লেন অম্লানবাবু। একমাত্র নাতি কয়েকটা ফুল কিনতে চাইল, আর তিনি দিতে পারছেন না!
বললেন, "দাদুভাই, তোমাকে আমি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে টাকা নিয়ে আসি। তারপর কিনে দেব। আজ টাকার ব্যাগটা আনতে ভুলে গেছি, দাদু।"
"যদি ফুল কাকু চলে যায়, তখন!" পিকু বেজার মুখে বলল।
"আচ্ছা চলো, আমি ফুল কাকুকে বলে যাচ্ছি, যেন না যায়।"
পিকু খুশি হয়ে ঘাড় নাড়ে।
দাদুর সঙ্গে গুটি গুটি পায় ফুল বিক্রেতার কাছে এসে দাঁড়াল পিকু।
অম্লানবাবু বললেন লোকটিকে, "তুমি কতক্ষণ আছো? আমি আসলে টাকার ব্যাগটা আনতে ভুলে গেছি। আমার বাড়ি এই কাছেই।"
"হ্যাঁ মেসোমশাই, আমি আছি। আরও আধ ঘণ্টা ধরুন। আপনি ঘুরে আসুন বাড়ি থেকে।"
পিকু একটা ফুলের গোছা দেখিয়ে বলল, "আমি এইটা নেব। তুমি কাউকে দিও না কিন্তু কাকু।"
লোকটি হাসতে হাসতে বলল, "আচ্ছা, তোমার যেটা খুশি নাও বাবু। সবই এক।"
পিকু দাদুর হাত ধরে ফিরে আসার সময় আরো দুবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছে, ওর পছন্দ করা ফুলগুলোর দিকে। তখনই পেছন থেকে 'আঙ্কেল' ডাকটা শুনতে পেলেন অম্লানবাবু। পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলেন, একটা ছেলে ফুল বিক্রেতার সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ডাকছে। অম্লানবাবু দাঁড়িয়ে গেলেন।
বললেন, "আমাকে?"
ছেলেটি হাত তুলে বলল, "একটু দাঁড়ান আঙ্কেল।"
একটা ফুলের তোড়া নিয়ে এসে পিকুর হাতে দিয়ে বলল, "এইটা পছন্দ তো, তোমার?"
তারপরেই অম্লানবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, "আঙ্কেল, কাল এসে ওকে টাকা দিয়ে যাবেন। আজ আর কষ্ট করে আসতে হবে না। দেখছেন তো আকাশের অবস্থা। নামল ব'লে।"
অম্লানবাবু কী বলবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
ছেলেটি আবার বলল, "অত ভাবছেন কেন আঙ্কেল? আমার নাম বাপি। আপনার ছেলের মতো তো, নাকি?"
অম্লানবাবু, নাতিকে নিয়ে ফিরে আসতে আসতে শুনতে পেলেন, "বুড়ো মানুষ। তাঁকে দু'বার করে খাটাচ্ছ। এইটুকু বিশ্বাস মানুষকে না করলে ব্যবসা করবে কী করে?"
তিনি আর পিছনে তাকাননি। বুঝতে পারছিলেন, ছেলেটি কথাগুলো ফুল বিক্রেতাকেই বলছে।
জীবন অম্লানবাবুকে শিক্ষা দিয়েছে অনেক। যেচে কেউ উপকার করতে এলে আজকাল কেমন সন্দেহ হয়। তবে, এই ছেলেটির ব্যবহার চমৎকার। হয়তো ওর পারিবারিক শিক্ষাটা ভালো। ভাবতে ভাবতেই বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। পিকু দৌড়ে গিয়ে ঠাম্মিকে ফুলগুলো দেখিয়ে কলকল করে পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা দিল, ওর মতো করে, ও যেটুকু বুঝেছে।
অম্লানবাবু তবু একটু বাদে হাঁটতে হাঁটতে টাকার ব্যাগটা নিয়ে বাস রাস্তার দিকে গেলেন।
অনিতাদেবী বারণ করেছিলেন, "আবার কেন যাচ্ছ? ছেলেটি বলল তো, কাল দিলেও হবে।"
"নাহ্, দিয়েই আসি। ছেলেটি বললেও, ফুলওয়ালা ঠিক ভরসা করতে পারেনি। ওর ব্যবসার টাকা। বাকি না রাখাই ভালো।"
অম্লানবাবুকে দেখে ফুল বিক্রেতা অবাক হয়ে বলল, "সেই আপনি এলেন মেসোমশাই! দাদা জানতে পারলে আমাকেই গাল দেবে।"
"না, না। কিচ্ছু বলবে না, ভয় পেও না। কাছেই তো বাড়ি আমার।"
অনিতাদেবী তখনও গজর গজর করে চলেছেন।
স্বামীকে ফিরতে দেখে গলা আর এক ধাপ চড়ালেন, "এত অন্ধকার করেছে, এক হাত দূরের মানুষ দেখা যায় না। তার মধ্যে তোমার না বেরোলে চলছিল না।"
অম্লানবাবু হাসতে হাসতে বললেন, "পৃথিবীতে নেই কোনও বিশুদ্ধ চাকুরি।"
"কী যে সব বলে কে জানে!"
"এ আমার কথা নয়। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন।"
শ্রেয়া অফিস থেকে ফিরে ফুলদানিতে গোলাপ সাজানো দেখে শাশুড়ি মা'কে জিজ্ঞাসা করল, "ফুল কে আনল, মা ?"
"আর বোলো না। বাসস্ট্যান্ডে ফুল বিক্রি হচ্ছে দেখে, পিকুবাবুর তো ইচ্ছা হয়েছে। এদিকে তোমার বাবা টাকা নিয়ে বেরোয়নি।"
শ্রেয়া আরো কিছু শোনার আশায় তাকিয়ে আছে দেখে অনিতাদেবী বিকেলের পুরো ঘটনাই বললেন।
শ্বশুর মশাই আবার গেছেন শুনে শ্রেয়া লজ্জিত হয়ে বলল, "পিকুটা যে কী বায়না করে না!"
"ওমা! ছেলেমানুষ, এ'টুকু বায়না তো করবেই।"
পিকু তখন বই নিয়ে বসেছিল। মা'কে ঘরে ঢুকতে দেখেই এক লাফে মায়ের কাছে।
চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, "জানো মা, ওই রাক্ষস-কাকু আজ আমাকে ফুল দিয়েছে।"
"রাক্ষস-কাকু? সেটা আবার কে?"
"সেই যে গো, ভোঁ করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। তুমি পড়ে গেলে। তোমার সঙ্গে ঝগড়া করল, মনে নেই?"
শ্রেয়ার শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হবার মতো অবস্থা। হাঁ করে শ্রেয়া পিকুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর পিকুকে বলল, "রাক্ষস-কাকু বলছ কেন?"
"বা রে! তুমিই তো তারপর গল্প বললে, রাক্ষস খোক্ষস আগেও ছিল। এখনও আছে।"
শ্রেয়া নিজের মনেই ঠোঁট নাড়ল, "তা তো আছেই।"
তারপর পিকুকে আবার বলল, "তবুও কাউকে রাক্ষস-কাকু বোলো না। শুধু কাকু বলবে।"
পিকু ঘাড় কাত করল। শ্রেয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ।
"আবার কী চায় ওরা! পিকুকে ফুল দিল। বাবা'র সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলল। আসল উদ্দেশ্যটা কী?" নতুন দুশ্চিন্তা ওকে গ্রাস করল।
শ্রেয়া কাউকেই কিছু বলল না। অর্পণকেও না।
ভেতরে ভেতরে গজরাতে লাগল, "অর্পণকে বলে কাজের কাজ তো কিছু হবে না। বরং পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে পরিস্থিতি খারাপ করে তুলবে।"
অফিসে ব'লে, কাল বাড়ি বসে কাজ করবে মনস্থির করল শ্রেয়া। আর পিকুকে ও'ই দিয়ে নিয়ে আসবে।
সকালে পিকুকে গাড়িতে তুলতে যাবার সময় কাউকেই তেমন চোখে পড়ল না শ্রেয়ার। কিন্তু ঘটনা ঘটল বিকেলে। অপেক্ষমান অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল শ্রেয়া। হঠাৎ চোখে পড়ল ছেলেটিকে। দেখেই চিনেছে। সেদিনের দ্বিতীয় বাইক চালক।
শ্রেয়াকে দেখতে পেয়ে হাসি মুখে এগিয়ে এল ছেলেটি।
বলল, "জানতাম। জানতাম। আজকে যে আপনি আসবেন ছেলেকে নিতে, আগেই জানতাম, বউদি।"
শ্রেয়া কী বলবে বুঝতে পারছে না। ইতোমধ্যে বাকি অভিভাবকরা তাকাতে শুরু করে দিয়েছে।
শ্রেয়া কিছুটা সরে গিয়ে গলা নামিয়ে বলল, "কী চাই আপনার? রোজ এই সময় আসেন কেন এখানে?"
"এই জন্য মানুষের ভালো করতে নেই মাইরি। দেখলাম, বুড়ো লোকটাকে ফুলওয়ালা টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। বিশ্বাস করুন বউদি, লোকটাকে দেখে বুকের মধ্যেটা কেমন কলল। তাই বললাম, 'আঙ্কেল, আপনাকে এখন আর আসতে হবে না। কাল দেবেন একবারে।' পরে তো শুনলাম, আঙ্কেল একটু বাদে এসেই টাকা দিয়ে গেছে।"
"সে জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। এই ধরনের উপকার আর করবেন না ভবিষ্যতে। বাবাকে বলে দিয়েছি। বাবা টাকা নিয়েই বেরোবে এর পর থেকে।"
"এই জন্য না মুখে খিস্তি আসে। আপনার ধন্যবাদ শুনতে কে এসছে? ভাবলাম, বুড়োটা দু'বার করে এল। শরীল টরিল খারাপ হলো নাকি।"
"বুড়োটা বুড়োটা করছেন কাকে?"
"তোর শ্বশুরকে রে।"
শ্রেয়া আর দাঁড়ায়নি। এতক্ষণ ছেলেটিকে শ্রেয়ার পরিচিত কেউ ভেবে বাস স্ট্যান্ডের লোকজন কৌতূহল দেখায়নি। কিন্তু ছেলেটি গলা চড়াতে, আবার সবাই তাকাতে শুরু করল।
শ্রেয়া ফিরে এলে দু'একজন জানতেও চাইল, "কী হয়েছে গো?"
তখনই দেখা যায় স্কুল বাস আসছে।
"পরে বলব" বলে শ্রেয়া পিকুকে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায়।
আসার সময় ভাবছিল, এভাবে হবে না। মেজাজ দেখালে ওরা অনেক নিচে নামবে। আমাকেও টেনে নামাবে। কিন্তু আমাদের পরিবারের পেছনে ওরা কেন লেগে আছে। সেবারের গণ্ডগোলের পরে আর তো কিছু ঘটেনি।
শরীর খারাপের কারণ দেখিয়ে শ্রেয়া আরও দু'দিন বাড়িতে থেকেই কাজ করল। কিন্তু এই দু'দিন ছেলেটাকে আর দেখা গেল না। তৃতীয় দিন থেকে অফিসে যেতেই হলো। পিকুর স্কুল থেকে ফেরার সময় হলে শ্রেয়া অফিসে বসেও ছটফট করে। বাড়িতে ফোন করে পরিস্থিতি বুঝে নিতে চায়। রাতে বাড়ি ফিরে পিকুর থেকে জেনে নেবার চেষ্টা করে নতুন কিছু ঘটেছে নাকি।
বছর খানেক পরের কথা।
শ্রেয়ার ক'দিন ধরে জ্বর। বাড়িতেই আছে। অর্পণও বেরিয়ে গেছে অফিসে।
হঠাৎ স্ট্রোক অম্লানবাবুর। অর্পণ তখন মিটিংয়ে। ফোন বন্ধ রাখতে হয়েছে। শ্রেয়া জ্বর গায়ে অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে নিজেই ছুটল হাসপাতালে শ্বশুরমশাইকে নিয়ে।
অ্যাম্বুল্যান্স হাসপাতালে পৌঁছতেই শ্রেয়া দেখল একটা বাইকও পেছন পেছন এল। বাইক চালক সেই বাপি। আর পেছনে আর একটা ছেলে। বাইক এক পাশে রেখে দৌড়ে এল ওরা।
বলল, "ভয় নেই বউদি। আমরা সব করে দিচ্ছি।"
শ্রেয়া শুধু রিসেপশনে ফর্ম ফিলাপ করেছে। বাকি সব কাজ ওরা করল। জ্বর গায়ে এসেছে, শ্রেয়ার নিজের শরীরও টলছিল। শ্রেয়াকে বসতে বলে অম্লানবাবুকে ভর্তি করানো থেকে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা সমস্ত বাপি আর ওর বন্ধু করল। মিটিং শেষ হলে শ্রেয়ার মেসেজ দেখে ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে এল অর্পণ।
অর্পণকে দেখে বাপি বলল, "ওই তো দাদা এসে গেছেন। এবার তাহলে আমরা আসি। আর এই আমার নাম্বার। কোনও দরকার হলে বলবেন দাদা। রাতে থাকতে হলেও আছি আমরা।"
যেমন ঝড়ের মতো এসেছিল, তেমনই বেরিয়ে গেল। অর্পণ শ্রেয়ার দিকে তাকাতে ও ইশারায় থামতে বলল।
বাবাকে দেখে ডাক্তারের সঙ্গে কথা ব'লে বাড়ির পথ ধরল অর্পণ আর শ্রেয়া।
অর্পণ জানতে চাইল, "কী ব্যপার, ওই ছেলেগুলো কেন? ওরাই না ..."
শ্রেয়া ক্যাব বুক করছিল।
বলল, "যেতে যেতে বলছি।"
গাড়িতে উঠে শ্রেয়া বলল, "সত্যি বলতে কী, আজ ওরা না থাকলে যে কী করতাম! গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। মাথাটাও অল্প অল্প ঘুরছে।"
অর্পণ, শ্রেয়ার গায় হাত দিয়ে বলল, "মেড নাওনি ? গা তো বেশ গরম।"
"নিয়েছি। জার্নিতে বেড়ে গেল।"
সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেই শ্রেয়া বলে গেল, "আমি যখন অ্যাম্বুল্যান্সে বাবাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, ওরা মোড়ের চায়ের দোকান থেকে দেখেছে। তারপরেই বাইক নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ফলো করে চলে এল। আমাকে কিছুই করতে দিল না। তুমি না আসা পর্যন্ত ছিল। অবাক কাণ্ড!"
"কী চায় ওরা? টাকা পয়সা?"
"এখনই এই প্রস্তাব দেওয়া ঠিক হবে না। বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরুন।"
"তুমি বেশি কথা বলতে যেও না ওদের সঙ্গে। কী উদ্দেশ্য আছে, কে জানে!"
"কথা কে বলতে যাচ্ছে? তবে জানো তো, ছেলেগুলো বোধহয় খুব খারাপ নয়।"
"বাবাহ্!" তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকাল অর্পণ শ্রেয়ার দিকে।
শ্রেয়া মাঝেমাঝে ভাবে, "কে এই বাপি? এ তো পুরো 'ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড'। একই মানুষের মধ্যে একেবারে ভিন্ন দুটো সত্তা! কে জানে, বাপি যেখানে থাকে, পরিবেশটা হয়তো ভালো নয়। কিন্তু ওর মনটা ভালো, কোনও সন্দেহ নেই। আর ভীষণ উগ্র। মতের অমিল হলে আর রক্ষে নেই। একটা ধন্যবাদ জানালেও ক্ষেপে যায়।"
বাপির ভূমিকায় যারপরনাই খুশি অম্লানবাবুও। তিনি জানেন না যে, এই সেই বাপি, যে দলবল নিয়ে তাঁর ছেলেকে দেওয়ালে ঠেসে ধরেছিল। যে তাঁর ছেলের বউ-এর সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেছিল।
শ্বশুরমশাই অসুস্থ হবার পর থেকে শ্রেয়া বাড়িতে বসেই অফিসের কাজ করে যাচ্ছে। পিকুকে আনতে গিয়ে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে শ্রেয়ার চোখ এদিক ওদিক ঘোরে। কিন্তু বাপিকে একদিনও দেখতে পায় না।
হঠাৎ একদিন পিছন থেকে 'দিদিভাই' ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ায় শ্রেয়া।
"বাপি তুমি! আজকাল দেখি না কেন? সেই যে হাসপাতালে বাবার জন্য গেলে, আর তো দেখিই না।"
বাপির যেন মুখের সেই উজ্জ্বলতা নেই।
শ্রেয়া আবার বলল, "শরীর ঠিক আছে তো?"
বাপি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, "শরীল ঠিক আছে দিদিভাই। কিন্তু ...."
শ্রেয়া আরও কিছু শোনার আশায় ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
"বোনটা মরে গেল দিদিভাই। ট্রেন ঢোকার মুখে লাইনে ঝাঁপ দিল।"
"সে কী!" আঁতকে ওঠে শ্রেয়া।
বাপি আর একটাও কথা বলতে পারল না।
শ্রেয়ার সঙ্গে বাপির সখ্য ভালো মনে নেয়নি অর্পণ। সেটাই স্বাভাবিক।
রাস্তায় দেখা হলে অর্পণকেও বলে বাপি, "দাদা, ভালো তো?"
অর্পণ কোনও সময় না শোনার ভান করে চলে যায়। কখনও অবজ্ঞার ঘাড় নাড়ে।
একদিন অর্পণ বলেই ফেলল শ্রেয়াকে, "বউদি থেকে দিদিভাই হলে কবে?
"প্রশ্নটা খুব জরুরি?"
"কোনও কিছুই জরুরি নয় এই দুনিয়ায়।"
ইঙ্গিতটা ভালো লাগেনি শ্রেয়ার।
অর্পণের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, "আবার অনেক কিছুই জরুরি। যেমন আমি তোমার মতো নির্লিপ্ত থাকতে পারি না। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করি। অসভ্যতা করলে রুখে দাঁড়াই। আবার উপকারির উপকার স্বীকার করাটাও আমার কাছে জরুরি। অকৃতজ্ঞ হতে পারি না।"
অর্পণ কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
কালীপুজোর রাত। ঢাকের শব্দ আসছিল। শ্রেয়ার ঘুম আসছিল না। বাঁকুড়ায় গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ে ওর-- "কতদিন চড়কের ঢাক শুনিনি। কতদিন শিউলি কুড়াইনি। ভাইটাকে ফোঁটাও দেওয়া হয়নি কতদিন।"
সংসার অফিস সামলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়াই হয় না শ্রেয়ার। সুতোর মতো সরু অথচ শক্ত সম্পর্কের বাঁধনটা টিকিয়ে রেখেছে হাতের ওই যন্ত্রটা। গ্রামের দুর্গাপুজো, বাড়ির লক্ষ্মীপুজো, পিতল কাঁসার পুজোর বাসন, কলার খোল দিয়ে বাবার নৌকো বানানো, তাতে মায়ের যত্নের হাতে শস্য সাজানো, মায়ের হাতের নাড়ু মোয়া সব কেমন ছবির মতো সামনে আসে শ্রেয়ার। হঠাৎ বাপির কথা মনে এল। এ বছর ভাইফোঁটায় বোনহীন বাপি। কী হয়েছিল ওর বোনের? কোন্ যন্ত্রণা ঢাকতে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিল ওইটুকু মেয়ে!
উঠে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল শ্রেয়া। অমাবস্যার অন্ধকার রাত। নিকষ কালো তমসায় দিগন্ত বিস্তৃত নক্ষত্রপুঞ্জ। চাঁদের অনুপস্থিতিতে আজ ওরা উৎসবের মেজাজে। অথচ কোনও বিশৃঙ্খলা নেই। নিজেদের আলোতেই ওরা সমুজ্জ্বল। তবু চাঁদ কোনওদিন দেখতে চাইল না ওই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নক্ষত্র রাশির প্রত্যেকে আসলে কত বড়ো! কখনও বোঝার চেষ্টা করল না, ওই তারারা কী ভীষণ আলো ছড়াতে পারে! যা তাদের একান্ত নিজের। চাঁদের মতো মানুষও এই অমোঘ সত্যটা বোঝেনা বলে পৃথিবী যতটা সুন্দর হওয়ার কথা, ততটা নয়। এই সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝেই শ্রেয়ার নিজেকে ভাগ্যবতী ব'লে মনে হলো। বিশ্বশক্তির এই অপরূপ সৃষ্টি শ্রেয়াকে বিস্ময়-বিমুগ্ধ করে তুলল।
সকালে স্নান করে বেরোতেই রাস্তায় কাদের যেন গলা পেল শ্রেয়া। অর্পণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে খবর সংগ্রহ করছিল।
ঘরে ঢুকে শ্রেয়াকে বলল, "তোমার বাপি এরেষ্ট হয়েছে।"
"বাপি? এরেষ্ট? কেন?"
"গুণধর ছেলে। কাকে যেন পিটিয়ে মেরেছে।"
খবর ছড়াতে সময় লাগল না। যে লোকটার জন্য বাপির বোন লাইনে গলা দিল, থানার বড়ো বাবুর সঙ্গে এক গাড়িতে যেতে দেখেছে বাপি তাকে। বেশ খোশ মেজাজেই গল্প করছিল দু'জনে। মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। পেছন পেছন বাইক নিয়ে ধাওয়া করেছিল বাপি। গাড়ি থেকে নামতেই লোকটার কলার ধরে টেনে এনে দু তিনটে ঘুষি মেরেছিল সজোরে। তাতেই শেষ।
বড়োবাবু ওর দিকে রিভলভর তাক করতেই হাত তুলে বলল বাপি, "আমি পালাব না। চলুন কোথায় যেতে হবে।"
তারপর মুখ থেকে এক দলা থুতু রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহর গায় ছুঁড়ে দিয়ে বলল, "কাপুরুষ!"
থানায় গিয়ে বাপির সঙ্গে দেখা করে শ্রেয়া।
লক আপের ভিতর থেকে শ্রেয়াকে দেখেই উঠে এসে বলল বাপি, "দিদিভাই তুমি!"
"আমি তোমাকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে যাব। তোমার হয়ে কেস লড়ব।"
"ক্ষেপেছ নাকি? আমি তো সত্যিই খুন করেছি। যা শাস্তি দেবে, মাথা পেতে নেব।"
"বাপি প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো।"
বাপি এবার হাসল।
অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল, "আর কী বুঝব দিদিভাই? বোনটাকে রক্ষা করতে পারিনি। কিন্তু আজ আমি যা করেছি, বেশ করেছি। কাল ভাইফোঁটা। দাদা হয়ে এটুকু যদি না করলাম!"
শ্রেয়া ফিরে আসার সময় দেখে শ্বশুরমশাই হন্তদন্ত হয়ে থানায় ঢুকছেন।
শ্রেয়াকে দেখতে পেয়ে বললেন, "দেখা হলো বাপির সঙ্গে? জামিন হবে?"
"না বাবা। বাপি জামিন নেবে না। বোনের ধর্ষণকারীকে খুন করে হাসি মুখে ও শাস্তি নেবে। ভাইফোঁটায় বোনকে এটাই ওর সেরা গিফ্ট।"
রোদটা আজ বেশ প্রখর। স্বচ্ছ নীল আকাশে এতটুকুও মেঘের চিহ্ন নেই। গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহে রাস্তা প্রায় জনমানব শূন্য। কোনও পথচারীর পায়ের শব্দ নেই। ফেরিওয়ালার হাঁকডাক নেই। সূর্য যেন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে নেমে এসেছে। ধোঁয়া ওঠা এই উষ্ণ দুপুরে পিচ গলা রাস্তায় হাঁটছে শ্বশুর আর পুত্রবধূ। সব কষ্টই কি তাহলে আপেক্ষিক?
বাপির তো শাস্তি হবেই। কিন্তু কতটা হবে সে আদালত বলবে। বাপি নিজেও জানে, ওকে জেলেই পচতে হবে নয়তো আরও বড়ো কিছু। তবু বাপির মুখে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। অম্লানবাবু আর শ্রেয়ার মুখেও কি স্মিত হাসির রেখা? কীসের জন্য এ হাসি? ওরাও কি তবে বাপির আনন্দের ভাগিদার হতে পেরেছে?
*****