ক্যান সাবঅল্টার্ণ স্পিক?

লিখেছেন:দেবাশিস সরকার

       ।।   এক  ।। 

 

— নমস্কার আইজ্ঞা। আমি জগন্নাথ  –

— পদুবি? উটা জেনে কি লাভ? কনো কাজে লাগে কি? তা বাদে ইসব পদুবিগুলান করে কি, মাইনষে মাইনষে বড় ফারাক তোয়ের করে দেয় স্যার! ধরেন ক্যানে যেখনই আমি আমার পদুবীটো বইলে দিব ত্যাখনই আপনি হিসাব কইরতে বইসব্যান, 'অ ! ই শালো বামুন লয়, কায়েত মানে লিছে। কিন্তুক, ই পদুবী কি কায়েতের বঠে? না, শালো সিডুল হব্যাক। না  টাইব লয়, আর যাই হোক কোটার মাল!' লয় কি? হঃ হঃ হঃ! সেই লেগেই আমি শুদু জগন্নাথ।

— না স্যার!  হেন্ডিকেপ জগন্নাথ লই, তেবে বোবা বঠি।

— ছি ছি হুজুর, আমনি সরকারি ওপিসার, আমনার সঙে ফাজলামি করার সাহস পাব কুথায়! পরে ঠিকেই বুঝে লিবেন ক্যানে আমি বোবা বঠি! হঃ হঃ হঃ!

— হঁ ! সেদিনকে হাসপাতালের ঘটনাটা?

— শুনেন আগে ! তারপর নায় কনো ফাঁক ভরানোর লেগে জিগাব্যান ত্যাখন। বুইল্যান? বইলছিলম কি, হেন্ডিকেপ না হলে কি হব্যাক ত্যামন ক্ষ্যামতাও নাই আমার। তবু কি হয়, নিমুরোদে যারা তারা আমার মুখ চেয়েই পিতিকার খুঁজে ! বলে, 'তুমিই ইয়ার বেবস্তা করো হে ইয়ে !' আমারও বীজধান নাই আর উয়াদেরও এঁড়ে গরু নাই ! দিন রাত ইধার উধার থিকে ডাক আইসছে আর আমি জ্যাতটা পারি যাচ্ছি ।

— ভগীরথকে? না  – ওই হাসপাতালেই পথম দেখলম। না এক পাড়ায় ঘর তো দূর, উয়ার ঘর কুথায় তাও আমি নাই  জানি ।

— বুঝাচ্ছি ! কথার মাঝে টুকব্যান নাই তাইলে। মেন রাস্তায় সামনে চারটে ফুটবল মাঠ মতন জায়গা জুড়ে শান বাঁধানো, তারপরেই ত হাসপাতালের মেন বিল্ডিংয়ের আরম্ভ, বঠে কিনা? বেশ ! শান বাঁধানো উঠানে বাঁ দিকে প্রথম যে ঘরটা হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স, ইস্টেচার, ওক্সিজেন ইসব নানা জিনিসের ইস্টোর রুম। বঠে কিনা? ইস্টোরের পাশে লুহার গেট লাগানো একটা ঘরে আবার লাল নীল নানা রঙের, নানা বাহারের সোব চারচাকার গাড়ি। বঠে ত? উখেনে ডাঁড়িয়ে ডাঁড়িয়ে দেখছিলম কি, হাজার হাজার রুগী, নার্স আর ডাকতরদের ছুটাছুটি। একদিন সকাল আটটা থেকে ঘন্টা দুয়েক ঠায় ডাঁড়িয়ে থাইকব্যান কত কি দেখব্যান, কত কি শিখব্যান স্যার !

— আমি ? আমি একটা কি যে কাজে আইছিলম, কাজ কমপিলিট কইরে চুপচাপ ডাঁড়াই ছিলম।

— কি দেখছিলাম? আমার পেচনের ঘরটা থেকে অ্যাম্বুলেন্স বেরাঁই যাচ্ছে তো সঙ্গে সঙ আরেকটা এসে ঢুইকছে। ট্রোলিও তাই ! একটা ডাকতরের গাড়ি ঢুইকছে তো আর একটা বেরাঁই যাচ্ছে। আমার মনে হয় এই রুম দুটোর লুহার গেটগুলো বিথাই লাগিয়ে পোয়সা বরবাদ করা হঁইছে ।

— কি উদ্দেশ্যে ডাঁড়িইছিলম? ই বাবা ! ইসব কি কথা? হাসপাতালটা ত সরকারি বঠে ন কি ? ত, উখেনে যদি কেউ ডাঁড়িয়ে থাকে ত তাকে কইফত দিতে হব্যাক ন কি?

— না। নাশকতা করার বেবসা আমার লয়।

— বলছি ! বইলতে দিচ্ছেন কুথায় ? এত ঘনঘন টুকলে কি – 

— কি দেইখছিলম? কত কি শিখা যায় স্যার ! যেদি আপনি জুলজুল করে শুদু দেখে যান তাথেই ! ধরেন কেনে রেশকা বা সাদা ট্যাসকি থেকে নামার পরে যে বুড়োটা বা বুড়িটা ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাইঙছে সে হচ্ছে রুগী আর তাকে ধরে ধরে সিঁড়িতে যে উঠাচ্ছে সে হয় ছেলে বা মেয়ে, যেদি তাদের মুখ ব্যাজার থাকে তাইলে বুইঝতে হব্যাক ইটা জামাই লয় ত ছেলার বউ। শিক্ষা হচ্ছে কিনা? সার কথা, গতর যদ্দিন, ভালোবাসা ভক্তি ত্যাতদিন !  ইসব শিক্ষা হাসপাতালের সিঁড়ি ছাড়া কুথায় মিলব্যাক সার !

— কথার মারপ্যাঁচ লয় স্যার ! আমরা কথা বললেই আমনাদের গাত্তজ্বালা হয় তা জানি। ল্যান, আর কি জিগাবেন? 

— অ! শুনবেন শেষ তককো? ক্যানে? সিঁড়ির সামনেটায় হসপিটালের কেমেরা ফিট করা ছিল নাই? 

— তাথে কি? ওই মন্ডল ডাকতরটাকে ত মারা হলো ডাকতরদের রুমের সামনে। উখেনেও কি সিসিটিভি ছিল নাই? 

— বেশ ! ডাঁড়িয়ে ডাঁড়িয়ে  দেখছিলম রুগী, রুগীর ঘরের লোকেদের ছুটাছুটি, চিৎকার। ছিল খাঁকি ডেরেস গায়ে রুল হাতে ফোপর দালালি করা পুলুশ, তিন চারজন চেনা লোক এক জায়গায় জড়ো হয়ে পরামশশো কইরছে দেখলেই রুল উঁচিয়ে তেড়ে যাচ্ছে সিখেনে। বইলছে, "অ্যাই একসঙ্গে এত লোক ক্যানে হে ! পাতলা হও ! ভিড় পাতলা করো জলদি !" তা বাদে গন্ধ শুঁকে ঘুরে বুলে যে কুকুরগুলান তাদের মতন ছুঁকছুঁক করা কিছু মানুষ ইয়ার উয়ার মুখ দেখে কি যে বুঝে লিচ্ছে কি জানে,  তার কাছে যাঁয়ে ফিসফিস করে বইলছে, " বেড লাইগব্যাক কি? মেঝেয় শুতে হব্যাক নাই পেসেন্টকে। বেবস্তা আছে। ডেইলি শ'টাকা লাইগব্যাক। কিমবা বেলাড টেস, বুকের ফটো, নাইত যা টেস দরকার সিটাই করাঁই দুবো কালকেই ! মাসের পর মাস অপিক্ষার কনো দরকার নাই, টেস প্রতি শ' টাকা লাইগব্যাক। দিবে ? " 

— কি বইলল্যান? মনগড়া? তাই ত বইলব্যান ! হঃ ! আমাকেও বইলেছে বই কি ! পথম পথম ইযারা আসত আমার কানের কাছে, এখন চিনে গেছে !  এক শালো ই ধান্দায় নতুন নেমেছে, সেদিনকে পস্তাব দিতে আইছিল, "তুমার কি গুরুপের বেলাড হে? ও গুরুপ কি? চলো তাইলে তিন শ টাকা পাবে।" আমি কনো জবাব করি নাই দেখে আবার আমাকে পস্তাব দিলেক, "তাইলে কিছু বিচবার মতলবে আছ কি? কিডনি বিচবে কি? চলো তাহলে হাই রেটে কইরে দুবো, আমাকে পাঁচ হাজার দিবে।"  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইসব রং তামাশাই দেখছিলম স্যার ! ডেইলি দেখি।

— সেদিনকে? অ ! আনজাদ বেলা দশটা এগারোটা নাগাদ হব্যাক, হাতে খইনি ডলছিলম, একটা পুলুশ এসে অডার   করলেক, "আমাকেও দিবে একটু? তা দাদা, মাঝে মাঝেই দেখি এখানে ডাঁড়িয়ে আছো, কারু অপিক্ষায় থাকো, ন কি কেউ ভর্তি আছে?" উয়াকে এক চিমটে খইনি দিয়ে ভাগানোর লেগে বইললম, "আইসব্যাক এখুনি, তিনচাকা নাইতো চারচাকার গাড়িতে, সামনে তাকাই থাকো হে !" কি বলবো স্যার ! বইললম আর সঙ্গে সঙ আমার মুখের কথা ফলে গেল ! ঠিক ত্যাখনই আমার বাঁদিকে রাস্তার উপর একটা অটো এসে হাসপাতালে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালেক ! অটোর খোল থেকে একটা জুয়ান মানুষ বেরাঁই ডাইভারের হাতে কিছু টাকা দিয়ে  কি একটা বলল্যাক , তাথে অটোওয়ালা দুপাশে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেক কনো একটা পস্তাবে উ রাজি লয় । ত্যাখন জুয়ানটা অটোর মধ্যে ঢুকে পাঁজাকোলা কইরে একটা বুড়ো মানুষকে বাইর করে  আনল্যাক !  তা বাদে আমরা দেখে অবাক হলম কি জুয়ানটা বুড়োটাকে কাঁধে চাপাঁয়ে সিঁড়ি উঠতে আরম্ভ করল্যাক ! আমি তো বঠেই উপস্থিত যত রুগী, পুলুশ এমনকি দালালগুলো তককো সব্বাই নিজের নিজের কাজ ফেলে হাঁ করে দেখতে লাগল্যাক !

— তার আমি কি জানবো স্যার ! ক্যানে ইসটেচার লিয়ে কেউ ছুটে এলেক নাই, সব রুগীদের বেলাতেই কি আসে? ইসব কথা হাসপাতালের কত্তাদের শুধান ক্যানে ! আমি ভাবলম, যেদি সিঁড়ি উঠবার সময় উয়ার পা হড়কাঁই যায় বা বুড়োটাকে ফেলে দেয়, তাই উয়ার পেচন পেচন দৌড়ালম।

— না, আগেই তো বইললম আমি উয়াকে কনো দিনও দেখি নাই ইয়ার আগে। উ আমাকে ডাইকব্যাক ক্যানে? তাবাদে আমার কাজটাই আপনি বুঝতে চাইছেন নাই ! নিমুরোদে যারা মুখে কুনো শব্দ করতে পারে নাই তাদের পাশে যাঁয়ে দাঁড়ানো আমার ডিবটি।

— লয়ত কি? ছিলম বই কি ! ভগীরথ উবু হয়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালের ওই হাউস ইস্টাফটার পায়ে ধরল্যাক, আমি ত্যাখনো উয়ার পেচনেই ছিলম। তবেই ত —

— তাই যদি হব্যাক স্যার, ভগীরথকে ওই জুনিয়র ডাকতরটার পা ধরতে হবে ক্যানে? ভর্তি করে লিতে কাকুতি মিনতি কইরতে বলল্যাক, আগে তো দেইখতে হব্যাক ভর্তি করা ল্যায্য কিনা ! জ্বর পা ফুলে পেইন তার ইলাজ ত আউটডোরেই - 

— কি? লে বাবা ! আগু পেছু হুঁশ থাইকব্যাক নাই ক্যানে ! আপনিই ত পেত্যেক কথার মাঝে ইটা ক্যানে, উটো কি করে হলেক ইসব জিজ্ঞাস করে করে বাগড়া দিয়ে লাইনের গাড়িকে বেলাইন কইরে দিছেন স্যার ! 

— বেশ তাইলে ঢুকবেন নাই পেত্যেক কথার মাঝে। পথম থেকেই বইলছি না হয় —

— কি? অ বাবা ! লাচতেও বইলছেন আবার বইলছেন কি ঘোমটাও মাথায় রাখতে হব্যাক। হুঁ ! বেশ ! শটেই বইলছি না  হয় ! হাসপাতালের বারান্দায় তো উঠলেক ভগীরথ। নামানোর সময় উয়ার বাপের পিঠটা ধরলম আমি। হামদের, মানে নীচের তলার লোকেদের ভাষায় ত আর থ্যাঙকু কথাটা নাই, হামদের ভাষা অত মজবুতও লয়। টুকচা হাসি নাই ত ভুরুর নাচনে আমরা তাই ইসব বুঝে লিই বাবু ! হাসপাতালে বারান্দায় বাপকে শুয়ায়ে ভগীরথ গেলেক ডাকতরদের ঘরটো কুথায় তার খোঁজে। আমি ডাঁড়িয়ে রইলম উয়ার বাপের বোডির পাশে –

— কি ? অ ! না মরা তককো বোডি বলা চলে নাই?  অ ! ত  ডাঁড়িয়ে রইলম উয়ার বাপের শরীলের পাশে। হোল? লম্বা বারান্দার ইদিক থেকে উদিক ছুটাছুটি কইরতে কইরতে ভগীরথ সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে আকুলি বিকুলি কইরছে, "অ  বাবু ! অ দিদিমুণি ! ডাকতর কন ঘরটায় বসে রেস ল্যায় দেখাঁই দ্যান ! দেখাঁই দ্যান !" কেউ কিছু না বলে পাশ কাটাই  চলে যাচ্ছে ত কেউ বইলছে, "লিজে খুঁজে লাও হে !"  

— আমি? আমি কুথায় যাব? বইললম নাই আমি উয়ার বাপের বো – ইয়া শরীলের পাশে ডাঁড়িয়ে আছি ।

— ই বাবা ! বেঁচেছিল বই কি ! উফ ! বইললাম নাই বোডি আমনাদের ভাষা ! মরে গেলে বোডি আর বেঁচে থাইকলে শরীল ইসব মারপ্যাঁচ আমি জানথম নাই।

— মরা মানুষকে লিয়ে আইসব ক্যানে ? গোঁ গোঁ করছিল আর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। জ্বরে গা পুইড়ে যাইচ্ছে , ডান পাটোয় ওই দগদগে ঘা, ফুইলে ঢোল, পায়ে রক্ত পুঁজ লাগা বেন্ডেজের উপর মাছি ভনভন কইরছিল আর আমি উবু হয়ে বইসে গলার গামছাটো খুলে মাছি তাড়াচ্ছিলম —

— না মারদাঙ্গায় কোপানো কেস লয় ! ছুটতে ছুটতে ডাক্তারকে লিয়ে আসার পর ভগীরথ জানালেক দশ বারোদিন আগে ঘরের মেঝেয় পেতে রাখা বঁটির উপোর উয়ার বাপ পা হড়কিয়ে পড়ে গেইল। পায়ের গড়াতে গভীর হয়ে বঁঠিটা বসে যায়, আর একটু হলেই দু পা ফাঁক হয়ে যেত। পাড়ার ওষুদের দ'কানের লোক এসে ইনজিশন দিয়ে গেছে তিন দিন ধরে, তবে পা ফুলা আর ব্যথার কিছু কমতি হয় নাই ! ডাকতরকে ভগীরথ য্যাখন ইসব পোরচয় দিচ্ছিল ত্যাখনই উয়ার বাপের মুখে  গ্যাজলা উঠা আরম্ভ হল স্যার ! ডাকতর ত্যাখন উয়ার নাড়ি দেখে হাসপাতালের টিকিটে খসখস করে কি লেখে কাগজটা ভগীরথকে দিয়ে বলল্যাক, "'সামনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে বাঁদিকে ওপিডি বিল্ডিং, সিখেনের নিচের তলায় এক্সরে রুম, এক্সরে করিয়ে প্লেটটা এনে আমাকে দাও, তারপর চিকিৎসা শুরু হবে।" ডাকতর বলছে আগে এক্স রে, তারপর চিকিৎছা, উদিকে রুগীর মুখে গ্যাজলা। আমারই ভয় লাগছিল স্যার !

— বলে নাই আবার ? ভগীরথ উয়ার পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করছিল বারবার, "বাবাকে ভর্তি করে ল্যান  ডাক্তারবাবু ! মানুষটাকে লিয়ে আমি এখন কুথায় দৌড়াদৌড়ি কইরব?" তাতেও ওই জুনিয়র ডাকতরটা, মন্ডল পদুবী যার, উয়ার কি দাঁত খিঁচানি !

— নয়তো কি উয়ার হয়ে সাক্ষী দিচ্ছি? ডাকেন উ শালো কে, উয়ার সামনেই বলছি না হয়  – একরকম কুকুর বেড়ালের মতন দূর দূর করে তাড়ালেক। ভগীরথের কাকুতি মিনতির পরেও বইলে উঠল্যাক, "বোকাচোদা সেই মুখ খারাপ করালি?  ছোটলোকের সঙ্গে বেশিক্ষণ ভালো ব্যভার করা চলে নাই। আমি বলার আগেই তুই বলে দিলে তোর বাপের ধনুষ্টংকার হঁইছে? তাইলে আমার কাছে লিয়ে এসেচু ক্যানে? চিকিৎসা তুইই কর !" বলে ডাকতরদের রেসরুমের দিকে হাঁটা লাগাল্যাক। ত্যাখন আমি—  

— না ! ই বাবা ! ত্যাখনই উয়াকে মারা হলেক কে বললেক? আপনার কাছে ভুল রিপোর্ট আছে স্যার ! আমি তো আগাগড়াই হাজির ছিলাম উখেনে। আমি না থাইকলে আপনারা ভগীরথের ফাঁসি দিয়ে দিবেন মনে হচ্ছে ! 

— বাঃ ! উয়াকে জেলে ভইরেছ্যান ইবার উয়ার অপরাধের পমাণ খুঁইজছ্যান বা আমাকেও ফাঁসানোর লেগে জেরার পর জেরা কইরে চলেছেন ! মতলব ত ভালো বুঝছি নাই ! 

— আচ্ছা ! আপনাদের কেমেরায় ওই ডাকতরটাকে মারার ছবিও রেকড করা আছে ? 

— কি? আমিও মারছি সে পমাণও আছে? হতেই পারে নাই ! লিয়ে আসুন ওই ভিডিও !  পোস্কার দেখা যাবেক কি ভগীরথের ঘুঁষি খেয়ে ডাকতর মন্ডল যখন মাটিতে চিত হঁয়ে পড়ে যাচ্ছে ত্যাখন এক ঝটকায় উয়ার নড়া ধরে তুলে দিচ্ছে কে? ভগীরথ মাইরছে আর আমি খাড়া কইরছি ইরকম চার-পাঁচবার হবেক মনে পইড়ছে। আমি মারছি এমন ছবি দেখাতে পারব্যান নাই স্যার ! তা যদি আছে তাইলে বুঝতে হব্যাক সেই ছবি আপনারা বানাইছেন ! 

— ক্যানে ? আপনি এখন উঠবেন ? আবার কাল ? ভালো ! কত্তার ইচ্ছায় কম্ম ! আবার কাল আইসতে হব্যাক নাকি?

— হঁ ! আমার গরজ আছে বইকি !  একটা লোক বিনা দোষে হাজতে গেছে, উয়ার জামিন না হওয়া তককো আমি ত হাল ছাড়ছি নাই স্যার !

 

     ।।  দুই  ।।

 

— নমস্কার স্যার ! ডাকতর মন্ডল আজ হাসপাতাল থেইক্যে ছাড়া পেলেক ন কি?  উ কি আজ আইসব্যাক ইখেনে? 

— লে বাবা ! আপনি পুলুশ, সইত্যিটা খুঁজে বাইর কইরব্যান আর উয়াকে জিগাস কইরব্যান নাই ইটা কেমন কথা ! ওয়ার লেগে একটা মানুষ মইরে গেলেক, একটা মানুষ জেলে আর আমাকে লিজের কাজ ফেলে ডেলি থানায় হাজিরা দিতে হইচ্ছে, ত উয়াকে জেরা কইরব্যান নাই ক্যানে? উ হামদের মতন মজুর লয় বলে? জাগগে, ভগীরথের জামিল লিতে কি শেষ তককো উকিলের কাছেই আমাকে ছুটতে হব্যাক? 

— শুনেন, ভগীরথ যেদি আমার চেনা হতো তাইলে কাইলকেই উকিল ধরে দু – পাঁচ হাজার যা লাগে খরচা করতম। আমার রজগার নাই, উকিল লাগানোর টাকা কুথায় পাব? তবে কাল রাতে দু'চারটে প্রেস টিভি চেনেলের রিপোটারের সঙে কথা হচ্ছিল —

— গুল দিচ্ছি? হাসাল্যান বাবু ! পেস, টিভি রিপোটার ত খবরের জন্য ছুঁকছুঁক কইরে ঘুরে বুলছে ইধার উধার। কাল থানা থেকে বেরানো মাত্তকই ঘিরে ধরল্যাক। আজও দেখলম উয়ারা ডাঁড়িয়ে আছে।

— কি? হঁ ! আমার ঠিকানা ত লিইছে। আইসব্যাক হয়ত ! তবে বলা যায় নাই এই কেসটা তো 'ধরসণ' বা 'পিন্সিপাল' প্যাঁদানো কেস লয় তাই থানায় রিপোর্টার পাঠাঁয়ে উয়াদের পষাব্যাক কিনা ! দেখা যাক ! কি জিগাবেন জিগান ! কাল কত দূর তককো শুইনেছিলেন ? 

— অ ! সেই ধনুষ্টংকারের কথা শুনে ডাকতর খেপে গেলেক ত্যাতদূর বইলেছিলম ত?  হঁ ! বলেন ত স্যার, ইটা কি ডাকতরের উচিত? রুগী বা তার ঘরের কেউ না হয় রোগ লিয়ে মোড়লিই কইরেছে, তাই বলে কি ডাকতর রুগী না দেখে উঠে যেতে পারে? বলেন? 

— ক্যানে ধইরব নাই স্যার ! হাসপাতালে আমার পয়সা লাগছে নাই বলে? ঠিক আছে ধরলাম নাই, আমি তাই ডাক্তারের সামনে যাঁয়ে হাত জোড় করে বইললম, "ডাকতরবাবু ! ওই মুখে গাঁজলা উঠা মানুষটাকে লিয়ে এই বারো, চোদ্দখানা  সিঁড়ি নামানো, তারপর আবার অতটা হেঁটে উল্টো দিকের বিল্ডিংয়ের অতগুলো সিঁড়ি উঠানো আবার নামানো সম্ভব কি? উয়াকে ভত্তি করে লিয়ে সব টেস্ট করান নাই তো একটা ইস্টেচার দিয়ার বেবস্তা কইরে দেন !" বলেন ত স্যার, এই কাকুতি মিনতির জবাবে ডাকতর যেদি ভেংচি কাটে তাইলে কি মাথার ঠিক থাকে ? 

— সেই লেগেই ত ত্যাখন বইললম স্যার, যদি সত্যিটাই বাইর কইরব্যান তাইলে উ শালোকেই  ডাকেন ! একতরফা শুনে কি হব্যাক? কেউ কি নিজের দোষের কথা কবুল করে?

— বেশ ! শুনেন তাইলে ! আমার মিনতির জবাবে ভেংচি কেটে বইললল্যাক, "ভত্তি করে ল্যান !  মামার বাড়ি  ! মূলে মাগ নাই তার আবার ফুলশইয্যা ! শয়ে শয়ে রুগী জেনারেল ওয়ার্ডে মাটিতে শুয়ে আছে ! বেড কোথায় পাব ? ইনডোর আর আউটডোর পেশেন্ট বুঝ হে গান্ডু ? পেশেন্ট রেশকায় চেপে ঘর থেকে যাতায়াত করতে পারবেক কিনা এক্স রে প্লেট দেখে বুঝি আগে ! যদি বটিতে হাড় ফাঁক হয়ে গেছে তাইলে না হয় — "  

— না। ইয়াতে না হয় দোষ ধরছি নাই। খিস্তি করা কি দূর ছাই করাটা সরকারি হাসপাতালের ডাকতরদের ওধিকারের মধ্যে পড়ে, লয় কি? আমি তাই বললম, ইসটেচারওয়ালাকে বলে দ্যান স্যার ! আমাদের কথায় ত আর উয়ারা রুগী বইব্যাক নাই ! না হলে একটা ট্রোলি। আকাশের অবস্থাটা ভালো লয়, আঁধার করে এসেছে, যে কনো সময় নামাল্যাক বলে ! ট্রোলি কুথা পাব তাও যেদি বইলে দ্যান, আমরাই ঠেলে ঠেলে এক্স রে রুমে লিয়ে  —

— কি? আবার টুকছেন স্যার ! ই পজ্জন্ত গোলমাল আছে কথায় বইললাম? ইখেনের ডাকতররা মুখ খারাপ করেই ! শুনেছি নাকি সাউথের ডাকতররা ভদ্দরলোক হয় ! উয়ারা নাকি সনমান দিয়ে রুগীদের সঙে কথা বলে ! সত্যি স্যার ?

— ক্যানে? ই কেস্‌টার সঙে উ পশনোটার কনো সম্পক্ক থাইকব্যাক নাই ক্যানে? যদি ওই মন্ডল ডাকতর ভালো ব্যবহার করত তাইলে কি ভগীরথের হাজতে যেতে হত? সাউথে ন কি বুদ্ধিমান ইস্টুডেন্টরা ডাকতর হয়। ইখেনে নে ত হয় কোটা থাইকতে হব্যাক, নাই ত বাপের পয়সা  

— আমার নরম ভঙ্গিতেও ডাকতর ভেঙচি কেটে বললে, "ট্রলি তো আর কথা বইলতে পারেনা, আমি ইখানে রইয়েছি লিয়ে যাও আমাকে। লিজে খুঁজে নাও কোথায় আছে। জেনারেল ওয়ার্ডটোর উল্টো দিকের বিল্ডিং এর আশেপাশে ওর বয়কে ১০ ২০ টাকা বকশিশ দিবে। সবঅই কি বইলে দিতে হব্যাক আমাকে? জলদি যাও।"  

 

       ।।    তিন  ।।

 

— ত্যাখন বইলেছিলম কি স্যার, যে হাসপাতালে সিঁড়ির মুখে সামান্য ডাঁড়িয়ে থাকলেও কত কি শিখা যায় ? ইখেনে যেই আমনি টাকা ফেলব্যান ওমনি ওই শালার ডাকতর থেকে ঝাড়ুদার পজ্জন্ত আপনার পঁদের গু তককো যত্ন করে পোস্কার করে দিব্যাক ! যেই দেখব্যাক আমনি ভগীরথ বা আমার মতন হাভাতে ঘরের লোক তেমনি আপনার মুখে থুতু দিয়ে চলে যাব্যাক ! 

— বলছি স্যার বলছি ! ট্রলি পাওয়া তো সম্ভব লয় তাই যেদি একখানা ইস্টেচার পাওয়া যায় সেই লেগে ভগীরথ হাসপাতালের পেছনের বিল্ডিংয়ে গেলেক। একটা ট্রলি পড়ে আছে দেখে নিজেই ঠেলে লিয়ে আইসছিল। সঙ্গে সঙ দুজন পিয়ন হাঁ হাঁ করে ছুটে এসে আটকাইনছে ! টলিতে করে নাকি অইন্য পেসেন্ট এসেছে উয়াদের আবার বেডে ফিরাঁই  লিয়ে যাবার পর তবে টলিতে অইন্য পেসেন্ট লিয়া হব্যাক ! তার আগে  লয়। 

— এঁ ? তুমার তাড়া আছে ? তাইলে 'ফ্যালো করে মাখো তেল ' হঃ হঃ হঃ !

— কি বলচেন স্যার ! ভগীরথ কবুল করেছিল বইকি ! দশ, বিশ ক্যানে, ভগীরথ শ' টাকা পজ্জন্ত উঠেছিল ! বলে, অপিক্ষা কইরতে হব্যাক পুরনো রুগীকে বেডে পোঁহুচানো তককো।

— ই ছাড়া আর কনো উপায় কি ছিল স্যার ! ভগীরথ জ্যাখন আমার কাছে এসে ট্রলিঅয়ালাদের খচরামির কথা বইলতে লাগল্যাক তার আগে থেকেই উয়ার বাপের বোডি  –  ইয়া শরীলটা কঠিন হতে আরম্ভ কইরেছে ! ইদিকে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে এক ফোঁটা ওষুদও তো যায় নাই শরীলে, লয় কি ? আর দেরি করা চলে কি, তাই কাঁধে করে নিয়ে যেতে হব্যাক। আমিও গেলাম উয়ার পেচন পেচন। এদিকে গোদের উপর বিষফোঁড়া, মেঘটাও ঘন আঁধার কইরে চারধার ঘিরে ধইরেছে স্যার !

— না স্যার মিথ্যা বইললে মুখে প'কা পড়ব্যাক, এক্সরে ঘরের লোকেরা সঙ্গে সঙ এক্সে রে করে দিলেক। আমাদের দুজনের কাকুতি মিনতি শুনে নাকি রুগীর মুখে গাঁজলা উঠা দেখে, তা বইলতে লারব। ট্রলিতে দুটো পেশেনকে ফেলে রেখে আগে আমাদের পেশেনকে ম্যাশিনে তুলল্যাক। আমাদের টুকচা দাঁড়াতে হলেক। প্লেটটা শুকনো হতে খামে পুরে তবে আমাদের হাতে দিল্যাক। ভগীরথের কাঁধে উয়ার বাপ, তার পেচন পেচন আমি পেলেট হাতে বারান্দায় এসে দেখি, হাঁই বাপ ! মেঘ ভেঙ্গে বিষ্টি পড়ছে গো ! যেতে হব্যাক এখন সিকি মাইল দূরে যিখেন থিকে আইসেছিলম। 

— ইটা কি বলচেন স্যার ! পেলেট হাতে কেউ বিষ্টির মধ্যে নামে? পেলেট ভিজার গল্প ত অনেক পরের কথা ! তাও ভিজেছে কুথায়? আমার সাইড ব্যাগের ভিতরে ঢুকালাম প্লেট। পুরোটা ত ঢুকে নাই, টুকচু বেরাঁই ছিলেক। ঝিরঝিরা বিষ্টির মধ্যে নামতে ওই জায়গাটার কাগজটা অল্প  ভিজে গেইল ! তাও তো ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে নামি নাই। 

— হ্যাঁ ! ইটা আপনি ঠিকেই শুইনেছ্যান। আমরা তিনজনেই অল্প অল্প ভিজে গেইলম। 

— হঁ ! মানছি  আপনার কথা, রুগীকে কিংবা পেলেট ভিজানো উচিত হয় নাই। তবে ভেবে দ্যাখেন স্যার ! রুগীটা কাঁধে লিয়ে কতক্ষণ পায়চারি করা যায় ! তা বাদে দাঁত খিঁচুনি হতে হতে বোডি শক্ত হতে আরম্ভ করেছে ! ইদিকে কাঁধ টনটন কইরছে তবুও ওই পায়ের ধুলোর উপর একটা রোগীকে নামাতে হব্যাক ! উদিকে এক্স-রে প্লেট না দেখে ওষুদ ইনজেকশন দিবেক নাই, ভত্তি করা ত অনেক পরের পশনো ! তাই দাঁতে দাঁত চিপে কাঁধের  ব্যথা সহ্য কইরছিল ভগীরথ আর আমি ঠাকুরকে ডাকছিলাম যাতে বিষ্টিটা ধরে যায় ! 

— ছাতা কুথায় পাবেন? আমার ত কনো কালেই ছিল নি, আর দাঁতখিঁচুনি আরম্ভ হওয়া বাপকে লিয়ে হাসপাতালে আসার আগে কেউ ছাতা লিয়ে আসে শুনিও নাই ! 

— ইয়ার চাইতে শটে আর বইলতে লারব ! ইবার আর মারধোর বা পুলুশের পরোয়া না করে ভগীরথের বাপকে সোজা লিয়ে এসে ডাক্তারের ঘরের দরজার সামনে বারান্দায় শুয়ালম। ঘরের ভিতরটায় ত্যাখন পাঁচ ছজন ডাকতর চা খাচ্ছে আর হাসি মশকরা কইরছে ! 

— দেখে মাথা গরম হব্যাক যে কোন মাইনষেরই ! শালা, বাইরে রুগী আর রুগীর ঘরের লোকেরা খাবি খাচ্ছে আর ইয়ারা হাসি মশকরায় মত্ত  –

— না স্যার ! যারে দেখতে লারি তার চলন বাঁকা ক্যানে হব্যাক? ধরে ল্যান, শ্মশানে কাউকে পুড়ানো হচ্ছে , সে আপনার চিনা লয়, ঠিক আছে? আপনি উখেনে মননিং ওয়াক কইরতে গ্যাছেন, হল? ইবার আপনি চিতার পাশ দিয়ে বেড়াবার সময় 'হাম তুম এক কামরেমে বনদো' গান গাইতে পারব্যান? 

— হ্যাঁ ! বলচি – উখেনে নামানো মাত্তকই হাসি, মশকরা, চায়ের কাপ ফেলে উয়ারা ছুটে এলেক –  ইখেনে কি? ইখেনে লয়, ইমারজেন্সিতে যাও, ইসব ধমকানি। ভগীরথ সব বলাতে সেই মন্ডল পদুবীওয়ালা ডাকতরটার খোঁজ আরম্ভ হল্যাক। 

— ডাকতরের নামটা আমি কি করে জানব স্যার ? আপনি শটে বলতে বললেন নাই ? তাই অনেকটা আগিয়ে বলছিলম। পথমে পেলেটের তলায় রাখা ওই ডাকতরটার হাতের লেখায় হাসপাতালের যে টিকিটটা ছিল সিটা দেখে সব ডাকতর মন্ডল ডাকতরের খোঁজ শুরু করলেক । 

— না না ! সঙ্গে সঙ কুথায় এলেক? তা দশ পনের মিনিট তো হব্যাকই ! কুথায় ছিল কে জানে ! তবে দেখলম মেজাজ গরম হয়েই আছে উয়ার। পেলেটটা দিলম উয়ার হাতে। সামান্য ভিজা ভাব ছিল হয়তো ! অবাক কান্ড ! করলেক কি, পেলেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেক, "শুয়ার ! হাসপাতালের ডাকতরের সঙে ফাজলামি কইরছিস? নাকি মাল ফাল টেনে এসেছিস?" কি বইলব স্যার, আমি দাঁতে দাঁত চেপে সজ্জি করলম। ভগীরথ দুহাত জড়ো করে কাঁদতে কাঁদতে বলল্যাক, "ইচ্ছা করে ভিজাই নাই ডাক্তারবাবু ! যেটুকু জল লেগেছিল রুমাল দিয়ে মুছে দিইছি। আপনি বাবাকে দ্যাখেন, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল একটু আগেও, এখন মনে লিছে কি আর জ্বর নাই , ওষুদ – পত্তর কিছু পরে নাই মুখে — "

— কি মনে হইচে, ডাকতর মাটিতে পড়ে থাকা রুগীর দিকে তাকালেক একবার, তারপর উবু হয়ে বইসে নাড়ি দেখলেক,  তারপর ভুরু কুঁচকিয়ে ডান হাতে নাড়ি দেখলেক, তারপর ধড়ফড় করে গলায় ঝুলানো ইস্টেথো ভগীরথের বাপের বুকের ইখেনে সিখেনে ঠেকাল্যাক ক'বার। আবার বাঁ হাতটা তুলে লিয়ে নাড়ি টিপল্যাক, তা বাদে উঠে ডাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে বললেক, "শেষ ! অনেক আগেই হাসপাতালে আনা উচিত ছিল ! " ভগীরথ হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললেক, "শালা  ! তোর লেগেই আমার বাবা মরে গেলেক ! অনেক আগেই আইন্যেছিলম, তুই শালা ত্যাখনই ভর্তি করে যদি ওষুদ ইনজিশন দিতিস, তাইলে বাবা আমার এমন বেঘোরে মরত নাই ! " ডাকতরের কি ত্যাখন ভগীরথকে পাল্টা মেজাজ দেখানো উচিত ছিল স্যার? 

— বাব্বা ! সব বইলেছে আর ইটা বলে নাই ? ডাকতর আঙুল তুলে চোখ লাল করে ভগীরথকে বলল্যাক, "রাসকেল ! চোপ ! পুলিশ ডেকে তোর বাঁদরামি ঘুচিয়ে দেবো কি ? চুপচাপ বাড়ি যা !" ইটা বলার দরকার কি ছিল স্যার ? 

— না। মারা বইলতে সেরকম প্ল্যান করে মারা হঁয়েছে কি বলচেন? রাগের মাথায় অস্থানে কুস্তানে লেগে গেলে অজ্ঞান হয়ে যায় কেউ কেউ, বাঁধানো বারান্দায় পড়ে যাঁয়ে মাথা ফেটে ডাকতরটার রক্তারক্তি হয় ক্যানে — তাই ভগীরথ ঘুঁষি মারছিল আর আমি ডাকতর মন্ডলকে ধরে ধরে তুলছিলম। তার ব্যাখ্যা আপনারা করলেন উল্টো ! 

— বাঃ ! ভগীরথ ত এখন হাজতে। উয়ার বাপের বোডিটা এখন কুথায়? 

— অ ! মরগে – মানে ঠান্ডাঘরে? বেশ ! মরগ থেকে ওই যখন বোডি ছাড়াব্যাক, ত্যাখন কি পোয়সা কড়ি দিতে হব্যাক  নাকি ? 

— না – সেসব লিয়ে আমার মাথাব্যথা কি থাকব্যাক ! যা বলার উ – ই বলব্যাক 

— কি ? ধুরো ! আপনি প্যাঁদা কথা বইলছ্যান ! ভগীরথ আবার বোবা হলেক কুথা থেকে? মন্ডল ডাকতরটাকেই ত হাতজোড় করে কত কাকুতি মিনতি করলেক ! হ্যাঁ ! বুজেছি ! উ এখন বোবা হঁয়েছে  ! হঃ হঃ হঃ ! আমি যে হিসাবে বোবা বঠি উ ও সেরকম বোবা হঁয়েছে এখন ! কথা বলেও কি লাভ আছে? আমাদের কথা শুনব্যাক সেরকম কান ই তোয়ের হল নাই আজ তককো !

— সে কি ! ই সামাইন্য প্যাঁচটাও বুইলেন নাই? ই বাবা ! এত বড় সরকারি ওপিসার আমনি !  ঠিক আছে ! পরে বুঝাবো কনো একদিন। ভগীরথের জামিনের দিনে ত আইসতে হব্যাকই ! তা, আর কিছু জিগাব্যান কি আজ? বেশ ! আমি তাইলে এখন উঠি সার ? 

— মানে? বুইলম নাই  ! ওই ডাক্তারটাকে ভগীরথ খুনের চেষ্টা কইরেছিল ? ডাকতর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে ত্যাখন কোটে শুনানি হব্যাক? ত্যাখন ভগীরথের যাবজ্জীবন হব্যাক ? তাই?  বাঃ! দারুণ ! যাবজ্জীবন ক্যানে, ফাঁসিই দ্যান না হয় ! নিচু গুরুপের লোক হঁয়ে উঁচু গুরুপের গায়ে হাত ! কম সাহস ! তা স্যার ! আমার অপরাধ টা কি? আমি ক্যানে ঘর যেতে পাব নাই ?

— কি? হায় ভগবান ! ভগীরথ আর আমি একই দোষে দুষী? উ কইরেছে খুনের চেষ্টা আর আমি উয়াকে সাহাইয্য কইরেছি? বাঃ ! ভালোই গল্পটা বেঁধেছেন বাবু ! আর ডাক্তারটা যে ভগীরথের বাপকে খুন করল্যাক উ কি বেকসুর খালাস হঁয়ে যাব্যাক? 

— খুন লয় ত কি? জ্বরে আর ধনুষ্টংকারে ভুগতে থাকা রুগীটাকে সঙ্গে সঙ ভর্তি করে যেদি ওষুদ ইঞ্জিশন দিয়া হতো তাইলে বেঁচেও যেতে হয়ত!  ওই মন্ডল ডাকতরটার কত্তব্য কি ছিল? 

— অ ! তাই? কাহানিটা আপনারা এভাবেই ফেঁদেচ্যান ! বেশ ! আপনাদের কথায় প্ল্যান করে মরা মানুষটাকে হাসপাতালে এনে আমরা হুজজোতি করেছি ! বেশ ! তাই হলো না হয় ! তাহালে ওই ডাকতর মন্ডল উ কি বকাচদা বঠে ? মরা মানুষটাকে এক্সরে করতে পাঠাল্যাক ! আর যারা এক্সরে করছিল তারাও কি বকাচদা যে মরা মানুষকে ম্যাশিনে শুয়াল্যাক? হাঃ হাঃ হাঃ ! শুনেন স্যার ! আপনাদের এই গল্পটায় ফাঁক আছে। ভরাট কইরে ল্যান ! আমি ত্যাতক্ষণে বাইরে বসে একটা বিড়ি খাঁয়ে আসি। তবে হ্যাঁ ! ইয়ার পরথেকে আমিও আর কথা বলতে লারব স্যার। আমিও তো বোবা হঁয়েচি। 

— দেখা যাক যারা আসছে তাদের কথাবাত্রা আপনাদের পছন্দ হয় কিনা ! 

— আছে স্যার আছে ! চোরেরও বাটপাড় আছে আবার বাপেরও ঠাকুদ্দা আছে ! কাল উয়াদের সবাই বইলেছে উয়ারা আইসছে ইখেনে। উয়ারা আপনাদের কানে একটা ম্যাশিন লাগাঁই দিব্যাক ! নাইলে ত আমাদের কনো কথাই আমনাদের কানে যাব্যাক নাই ! ভগীরথ তাই বোবা এখন, আমিও যা বুজছি আমারও বোবা সাজাই ল্যায্য !  ম্যাশিনটা লাগানো হোক, তখন ভগীরথ বা আমার সব কথা আমনারা মন দিয়ে শুনবেন ! টুকচা অপিক্ষা করেন আজকে ! 

 

 

0 Comments
Leave a reply