আজ সকাল থেকেই আকাশ যেন ধূসর রঙে মুখ ঢেকেছে। নিস্তেজ একগুঁয়ে সূর্যটা প্রায় সারাদিন আচ্ছাদিত রয়েছে জাগতিক ধূসর পর্দার অন্তরালে, আবার কখনো কখনো সূর্যি মামা আকাশের ধূসর রঙকে সরিয়ে তার হলদে রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রায় সারাটা দিন ধরেই চলছে সূর্য-আকাশের নানান রঙের খেলা। আর তারি মাঝে উত্তুরে বাতাস ঢেলে দিচ্ছে তার কনকনে জার। এই সমস্ত রঙ্গের মাঝে আমাদের এসে বসতে হলো ছাদে। এই মুড়ির মতো মিয়ানো রোদ কী আমাদের গায়ে এসে লাগে! অথচ ঠাঁয় বসে থাকতে হবে ছাদে। আসলে কি বলত ভাই, আগেকার দিনে তো দুগ্গা পুজো যেতে না যেতেই শীত জাঁকিয়ে ধরত। আর এখন অগ্রাহয়ণ মাস পার করে দিয়েও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আর একটা সময় ছিল, উত্তুরের বাতাস জানান দিয়ে যেত হেমন্ত আসছে। আর এখন সব নিম্নচাপের বাতাস। আজ বঙ্গোপসাগরে এই নিম্নচাপ, তো কাল ওই নিম্নচাপ। এত নিম্নচাপের জন্য যখন আকাশ মুখ ভার করে, আর রোদ ম্রিয়মাণ হয়ে পরে তখন দোষ হয় আমাদের। আমাদের কে ছাদে বসিয়েছে বলে আজ আর রোদ উঠবে না। বলি আজকাল ক'টা বাড়ির লোকজন বাড়িতে 'বড়ি' দেয়। সবই তো বাজার থেকে প্যাকেট করা 'বড়ি' নিয়ে আসে। আর আগের একটা দিন ছিল মা-ঠাকুমারা সারারাত ডাল ভিজিয়ে পরের দিন সেই ডাল শিলে বেঁটে ছাদে কাপড়, কুলো বা জাল পেতে বসাত। আর এখন তো কেউ বড়ি দিতে জানে না, যদিও বা কেউ দেয় তা মিক্সিতে বেঁটে থালায় করে বসিয়ে দিয়ে যায়। ভাই তোর নাকটা একটু তোল নেমে যাচ্ছে যে। ধুর মিক্সিতে ডাল বাটলে কি আর বড়ির নাক ভালো হয় তা তুমি কলাই ডালের সাথে যতই চালকুমড়ো মেশাও।
আমার শৈশব কেটেছিল একান্নবর্তী পরিবারে। শৈশবের দিনগুলোর দিকে তাকালে চোখের উপর ভেসে ওঠে কুয়াশাচ্ছাদিত মাঘী ভোরে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের মেয়েরা ডালের গামলা আর শিল-নোড়া নিয়ে বসে পড়ত। তখনকার দিনের বাড়িগুলিতে থাকত বিশালাকৃতির উঠোন, আর সেখানে বসেই চলত বড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি পর্ব। নিকানো মেঝের উপর বসে বসে একমনে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে পিতলের গামলাকৃতি বড় বাটিতে বড়ি বাটা ফেটাচ্ছেন। ওঁদের মুখেই শুনেছিলাম ফেটানো যত ভাল হবে, বড়ি নাকি তত নরম, হালকা ও ভাজলে মুচমুচে হবে। এই বড়ি তৈরির প্রস্তুতি নিয়ে আগের দিন রাত্রে দেখতাম ঘরে হইহই পড়ে যেত। তখন মিক্সির তেমন প্রচলন ছিল না ছোট শহরে কিংবা গঞ্জে, যেমনটা এখন দেখি প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যে প্রতিটা সচ্ছল পরিবারেই মিক্সির সহজলভ্যতা। কিন্তু তখন দেখতাম মা ও ঠাকুমা আগের দিন দুপুর থেকে বড় বড় বালতিতে ভিজিয়ে রাখতেন খোসা ছড়ানো মাসকলাই বা বিউলির ডাল। আবার এর পেছনেও কিছু স্মৃতি কিছু অস্পষ্ট দৃশ্যপট চিত্রের মতো গেঁথে রয়েছে হৃদয়ে। ঠাকুরদা কে দেখতাম কলাই এর ডাল কিনে নিয়ে আসতে আর ঠাকুমা জাঁতি নিয়ে বসে সেই ডাল ভাঙতেন। দুটো সিমেন্টের চাকতির উপরের অংশটির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিদ্রে একটা ছোট্ট ডাং ঢোকানো থাকে, তার আগে ওই ছিদ্র দিয়েই দু-তিন মুঠো ডাল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ডাং দিয়ে চাকতি যত ঘোরানো হবে, ঘর্ষণের ফলে বড় দানাগুলি যেমন ভাঙে তেমনি খোসারও ঘটে স্খলন। তারপর রাতে সকলের খাওয়াদাওয়ার পর মা-পিসিদের দেখতাম সেই ডাল বালতি করে ভিজিয়ে রাখতে। সকাল হতে না হতেই বাড়ির মেয়েরা বসে পড়ত শিল-নোড়া নিয়ে, চলত ডাল বাটার পর্ব। এরপর চিলেকোঠা থেকে কুলো আর জালগুলিকে বের করে একটা ন্যাকড়াকে সর্ষের তেলে ভিজিয়ে ঘষা হতো সেই কুলোয়। তারপর চলত বড়ি দেওয়া। বড়ি দেওয়া শেষ হলে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে নিয়মিত রোদে দেওয়া হত কুলোগুলোকে। আর বাড়ির ছোটদের ওপর দায়িত্ব পড়ত বড়িগুলোকে ছাতার, শালিক, কাক, হনুমানের হাত থেকে বাঁচানোর। শুকিয়ে গেলে আপনা আপনি খসে পড়ে বড়িগুলো। তখন জারে ভরে রেখে দেওয়া হয় সংগ্রহে। আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে মনের মণিকোঠায় রেখে দেওয়াই সার সেইসব স্মৃতিগুলো, সেই জারগুলো আজ ফাঁকা পড়ে থাকে, চিলেকোঠার কোন নিকষে যে ঠাঁই পেয়েছে কুলোগুলো কে জানে!
প্রজন্মের অগ্রগতির সঙ্গে-সঙ্গে দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়ার হারও ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঠাকুমাও এ সংসার থেকে চলে গেছেন প্রায় দশ বছর হলো আর একান্নবর্তী পরিবার আজ ক্ষুদ্র পরিবারে পরিণত হয়েছে। জেঠিমা-কাকিমা-মায়েরা সবাই আজ নিজের নিজের সংসারে ব্যস্ত, তাদের মাথায় ভুল করেও এসে হাজির হয় না বড়ি দেওয়ার কথা। মাকে যদি বলি বড়ি দিতে তৎক্ষণাৎ বলে দেন "অত ঝামেলা বাপু আর পারব না"। অথচ এই মা-ই একদিন ঠাকুমা-পিসিদের সাথে কত মজা করেই বড়ি দিত। আসলে সম্পর্কেরা আজ এতই সীমিত হয়ে গেছে যে নিজেদের ইচ্ছা শক্তিগুলোই হারিয়ে গেছে। অগত্যা বড়িরা আজ দোকানের সাজানো গোছানো প্যাকেটে এসেই হাজির হয়। তাতে অবশ্য পেট ভরে কিন্তু মন আর ভরে না। দুপুরের খাবারে বড়ি পাতে পড়তেই মনে পড়ে যায় ঠাকুমার মুখে শোনা বিভিন্ন বড়ির নামের কথা—ফুলবড়ি, ভাজাবড়ি, মুসুর ডালের বড়ি, গয়না বড়ি ইত্যাদি। বড়ি বাঙালির হাতে তৈরি একান্ত নিজস্ব ঘরোয়া খাদ্য উপকরণ। অন্যদিকে বড়ি প্রস্তুতি লোকশিল্পও বটে, যার উৎপত্তিস্থল ও সময়কাল সঠিকভাবে জানা দুরূহ। সংস্কৃত বটিকা শব্দ (যার অর্থ বিশেষ পদার্থ থেকে প্রস্তুত ক্ষুদ্রাকৃতি, গোলাকার কোনও বস্তু) থেকে বড়া ও পরে পরিবর্তিত হয়ে বড়ি শব্দটি এসেছে। প্রান্তিক বাংলার সর্বত্র এটি সমাদৃত, ভেজে খালিমুখে কিংবা চচ্চড়ি, শুক্তো, ডাঁটা, পোস্ত ইত্যাদি নিরামিষ পদে যেমন বড়ির ব্যবহার রয়েছে, তেমনই চিংড়ি, মাছ ইত্যাদি বহু আমিষ পদও বড়ি সহযোগে অত্যন্ত সুস্বাদু। মূলত শীতের মরসুমে বড়ি দেওয়ার অধিক প্রচলন রয়েছে।
অঞ্চলভেদে বড়ির বিবিধ প্রভেদ লক্ষ করা যায়一
১) ফুলবড়ি
রাঢ় অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে ফুলবড়ি নামে খুব ছোট ছোট এক ধরনের বড়ি হয় যা মসুর বা খেসারির ডাল থেকে তৈরি। ফুলবড়ি ভেজে শাকে দিয়ে বা টক বা অম্ল রান্না করে খাওয়া বহুলপ্রচলিত। ঠাকুমাকে দেখতাম ফুলবড়ি, কাঁচাকলা দিয়ে মাছের ঝোল রান্না করতে।
২) ভাজাবড়ি
ভাজাবড়ি সাধারণত কলাই ডাল দিয়েই প্রস্তুত করা হয়। ফুলবড়ির থেকে আকারে ছোট হলেও একই উপকরণ দিয়ে ভাজাবড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে।
৩) মুসুর ডালের বড়ি
ছোট থেকেই দেখে আসতাম বাড়িতে বেশ মুসুর ডালের বড়ি দিয়ে ভিজে ভাত খেতে। এক সময় এই খাবারটি আমারও ভীষণ প্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বড়ি বছরের যে কোন সময়ই দেওয়া যায়। মাকে দেখেছি মসুর ডাল রাতে ভিজিয়ে রেখে সকালে বেটে বড়ি দিতে। সমস্ত বড়ির ক্ষেত্রেই মিশ্রণটি ভাল করে ফেটাতে হয়, যাতে ভিতরে ফাঁপ ভাল হয়। তার পর মিশ্রণটিকে একটা থালার উপর সম্পূর্ণ হাতের কায়দায় ছোট ছোট শঙ্কু আকৃতির রূপ দিয়ে বসিয়ে দিতে। দিন দুই তিন দিন টানা রোদে শুকিয়ে সে বড়ি শুকনো মুখবন্ধ পাত্রে রাখা হয়। এভাবে পরবর্তী কয়েকমাস এমনকী এক বছর পর্যন্ত বড়ি রেখে দেওয়া যায়।
৪) মশলাবড়ি
অন্যান্য বড়িতে আলাদা করে কোনও মশলা ব্যবহৃত না হলেও, মশলা বড়ি বিভিন্ন রকমের মশলা সহযোগে তৈরি হয়। বিউলি ডাল বাটার সঙ্গে পরিমাণ মতো আদাবাটা ও নুন মেশানো হয়। শুকনোলঙ্কা, জিরে, পাঁচফোড়ন আধভাঙা করে এর সঙ্গে মেশানো হয়। কেউ কেউ থেঁতো করা চালকুমড়োও মেশান। পূর্ব বাংলায় এই কুমড়ো বড়ি খুবই জনপ্রিয়। মিশ্রণটিতে কয়েক ফোঁটা হিং মেশালে বড়ির স্বাদ আরও খোলতাই হয়। এই বড়ি ঝোল, ঝাল, শুক্তোতে খাওয়া যায়।
৫) গহনাবড়ি বা নকশাবড়ি
গহনা বা নকশাবড়ি বড়ির মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। খোসা ছাড়ানো বিউলি ডাল সকালে ভিজিয়ে রেখে বিকেলে ভাল করে ধুয়ে নিতে হয়। লক্ষ রাখা হয় যে ধোওয়ার পর ডালে যেন কোনও রকম নোংরা না থাকে। পরদিন সকালে শিলনোড়া বা মিক্সিতে এই ভেজানো ডাল এমনভাবে মিহি করে বাটা হয় যেন সান্দ্রভাব বজায় থাকে কিন্তু জল বেশি হয়ে খুব পাতলা না হয়ে যায়। পরিমাণ মতো নুন মিশিয়ে মিশ্রণটিকে একটি গভীর পাত্রে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ফেটানো হয়। ফেটানো হয়ে গেলে মিশ্রণটি ফোমের মতো দেখায়। তারপর একটি মোটা কাপড়ের টুকরো নিয়ে তার মাঝখানে একটি ছোট্ট ফুটো করে চোঙা বা নজ়ল লাগিয়ে দিতে হয়। এই কাপড়ের মধ্যে ডালের মিশ্রণটি অল্প অল্প নিয়ে (অনেকটা জিলিপি বানানোর পদ্ধতিতে) পোস্ত বিছানো থালায় সম্পূর্ণ হাতের কেরামতিতে নকশা বড়ি দেওয়া হয়। নাম থেকেই অনুমেয়, এই বড়ির সঙ্গে বিভিন্ন কল্কা নকশা বা ডিজ়াইন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। অনেকটা আলপনা দেওয়ার মতো, পোস্ত বিছানো থালায় নকশা বানিয়ে তারপর সকালের হালকা রোদে শুকোতে দেওয়া হয়। কেউ কেউ পোস্তর বদলে তিলও ব্যবহার করেন, তবে তা বেশিদিন রাখা যায় না, গন্ধ হয়ে যায়। বেশি কড়া রোদে শুকোতে দিলে বড়ি ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হালকা রোদে বড়ির ওপরটা শুকিয়ে গেলে খুন্তি দিয়ে উলটে দিতে হয় যাতে নীচের অংশটাও ভাল করে শুকিয়ে যায়। সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে এই বড়ি বিস্কুটের থেকেও হাল্কা ও ভঙ্গুর হয়, তাই অতি সাবধানে কাগজের স্তর দিয়ে টিন বা যে-কোনও মুখবন্ধ পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। ছাঁকা তেলে ভেজে গোটা-গোটা পড়লে পাতে, আহা স্বর্গ সুখ তাতে! ভাতের সঙ্গে এই বড়ি অত্যন্ত উপাদেয়। এছাড়া মেদিনীপুরে চায়ের সাথে ‘টা’ হিসেবে এই বড়ি খুব জনপ্রিয়।
নানাবিধ বড়ির মধ্যে গহনাবড়ি বিশেষ কৃতিত্ব ও স্বীকৃতির দাবি রাখে, যার সৃষ্টি অবিভক্ত মেদিনীপুর, মূলত অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরে। কারণ গহনাবড়ি তৈরিতে যেমন লাগে অজস্র উপকরণ, তেমনই প্রয়োজন নিপুণ হাত আর সৃষ্টিশীল মন। সূক্ষ্ম কাপড়ের মাধ্যমে গহনার আদলে তৈরি এই বড়ি বাঙালি শিল্পকলার বিস্ময়। এই বড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের নিজস্ব সৃষ্টি, অন্য কোথাও গহনা বড়ি বা নকশা বড়ির বিশেষ চল নেই।
বাংলা সাহিত্যে, ইতিহাসে, প্রাচীন লোককথার আনাচেকানাচে, ভোজনবিলাসী বাঙালির মননে-চেতনায়, শীতের খাদ্যতালিকায় পাতে ভাজা কিংবা তরকারিতে স্থানাতিক্রমে বড়ির পরাক্রম চাক্ষুষ করা যায়। কিন্তু আধুনিক প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এর স্বাদ গন্ধের সঙ্গে কতখানি পরিচিত হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ইতিহাস জানা তো দূরের কথা।