বিশ্ব রাজনীতির দক্ষিণায়ন

লিখেছেন:প্রণব দে


বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে এসেছি প্রায় দুই যুগ হতে চললো। এই যে একবিংশ শতাব্দী, এটা যে অনেকদিক থেকেই পূর্ববর্তী শতাব্দী থেকে পৃথক হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটা এই তেইশ বছরের অভিজ্ঞতায় বেশ স্পষ্ট। ফেলে আসা শতাব্দীর পুরোটাই নির্মাণ ও ভাঙনের শব্দে পরিপূর্ণ— বিশ্বযুদ্ধ, উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ, পারমাণবিক ধ্বংসলীলার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ। ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের সংঘাতে বিশ্ব ছিল উত্তাল। এই সংঘাতের চরম নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, এমন ভাবনা অবিজ্ঞোচিত হলেও, বিগত শতাব্দীর শেষ দশকে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পশ্চাদ্‌গমন, আদিম ধনতন্ত্রের পুনরাবির্ভাবের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। ধনতান্ত্রিক মুক্ত অর্থনীতির বিস্তারের সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উত্থান ঘটেছে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তির, যে শক্তি সমূহের লক্ষ্য ফ্যাসিবাদী শাসনের, নিদেন স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রতিষ্ঠা।


বিশ্ব এখন ধনতান্ত্রিক শক্তিসমূহের করায়ত্ত। বিংশ শতাব্দীতে বিকল্প সমাজব্যবস্থার এবং রাষ্ট্রের যে চ্যালেঞ্জ ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার সামনে ছিল, তা অন্তর্হিত হওয়ায়, পুঁজিবাদ এখন বেপরোয়া, বেলাগাম। বিগত শতাব্দীর নব্বই দশকের যে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি, তা বিশ্ব অর্থনীতিকে গ্রাস করতে পারতো না, যদি বিকল্পের এই চ্যালেঞ্জ পৃথিবীতে বজায় থাকতো। নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দৌলতে যে বিশ্বায়ন ঘটেছে, তার সংক্ষিপ্ত চিত্রায়ন পাওয়া যায় ব্রাজিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপিকা পলা স্যান্ড্রিন-এর (Paula Sandrin) বর্ণনায়— 


“উন্নত দেশগুলি থেকে সস্তা শ্রমের দেশগুলিতে শিল্পসংস্থা সমূহের পুনর্বাসনের কারণে বিশ্বায়ন বেকারত্ব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। ভোগবাদ ও প্রতিযোগিতার নয়া উদারনৈতিক মতাদর্শ এবং ব্যয়সঙ্কোচ, বেসরকারিকরণ, কর্পোরেট বাণিজ্য ও আর্থিক বেনিয়ন্ত্রণ সমন্বিত নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি এবং তৎসহ শ্রমিক ইউনিয়নগুলির দুর্বল হওয়ার ফলস্বরূপ পুঁজির কেন্দ্রীভবন বৃদ্ধি হয়েছে, আবাসনের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, কল্যাণমূলক খাতে খরচ ছাঁটাই হয়েছে, মজুরির অপরিবর্তনশীলতা, কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে এবং বেড়েছে বেকারত্ব। সবকিছু মিলে বেড়েছে বৈষম্য, ক্ষমতাহীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকারের ক্ষেত্রে বঞ্চনা ও অসন্তোষ। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি তখন এই অসন্তোষকে ব্যবহার করে জনসমাবেশ ঘটায়।” ( The Rise of Right-Wing Populism in Europe: A Psychoanalytical Contribution)


এটা ঘটনা, বিশ্বায়নের অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট পুঁজির অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। কিন্তু পুঁজির বিপুল সমৃদ্ধি শুধু উন্নত দেশগুলিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। যে দেশগুলিকে ‘তৃতীয় দুনিয়া’ হিসাবে চিহ্নিত করা হতো, সেই দেশগুলিতেও, বিশেষত এশিয়ায়, ধনতন্ত্রের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। ১৯৯০ সালে ভারতে নরসীমা রাও- মনমোহন সিং জুটি যখন নয়া অর্থনীতি প্রবর্তন করেন, তখন বিলিয়নেয়ারের তালিকায় একজন ভারতীয়েরও নাম ছিল না। (ভারতীয় বংশোদ্ভূত এস পি হিন্দুজা বিলিয়নেয়ার হলেও ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন)। চীনেও সেই সময়ে বিলিয়নেয়ারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এখন ভারতে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ১৬৯, চীনে ৪৯৫। ধনীদের পীঠস্থান হিসাবে আমেরিকার পরে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান চীনের, ভারত তৃতীয় স্থানে। এরই সঙ্গে ঘটেছে ডিজিটাল টেকনোলজির বিস্ময়কর অগ্রগতি। বলা বাহুল্য, বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির এই অভ্যুত্থান দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলির শক্তিবৃদ্ধিতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। 


কর্পোরেট পুঁজির অবাধ বিকাশের জন্য প্রয়োজন ছিল মুনাফা অর্জনের পথে যাবতীয় অন্তরায় এবং প্রতিবন্ধকতার অপসারণ। সেই উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক চাপানো কাঠামোগত সংস্কারের সুপারিশ ও শর্তগুলির রূপায়ণে উন্নত দেশগুলি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার দেশগুলির উপর চাপ দিতে শুরু করে। এর জন্যে প্রয়োজন ছিল সেই দেশগুলিতে কট্টর ধনতন্ত্রবাদী রাজনৈতিক দলের শাসন-ক্ষমতা দখল। সোভিয়েত দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার পর, বিশ্বে একাধিপত্য স্থাপনে মরিয়া হয়ে উঠেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের অধিকাংশ শাসক সম্প্রদায়কে নিজ তাঁবে আনার প্রচেষ্টায় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক— সবরকম প্রচেষ্টাই নিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। মিথ্যে অজুহাতে ইরাক ধ্বংস করে এবং ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনকে হত্যা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝিয়ে দিয়েছিল, প্রতিস্পর্ধা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ্য করবে না। কয়েকবছর বাদে লিবিয়ার স্বাধীনচেতা প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ গদ্দাফিও মার্কিন আক্রমণের শিকার হন। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সরকার উত্থান-পতনের ঘটনাতে বরাবর মার্কিনী হস্তক্ষেপ ঘটেছে, একবিংশ শতাব্দীতেও তার থেকে বিচ্যুতি ঘটেনি।



কিন্তু প্রতিস্পর্ধার প্রকাশ ঘটেছিল অন্যভাবে, বলা যায় বিকৃত পথে। ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘টুইন টাওয়ার’ ভবন অভিনব পথে ধ্বংস করে ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী। প্রতিশোধ স্পৃহায় মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সোভিয়েত রাশিয়ার আগ্রাসন রুখতে যে মুজাহিদিন বাহিনী মার্কিনী পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠেছিল, ইতিহাসের গতিপথে তারাই স্রষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। প্রখ্যাত মার্কিন চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কির বিশ্লেষণে—


“বিন লাদেনের নেটওয়ার্ক সম্বন্ধে সিআইএ-র থেকে ভালো কেউ জানে না, কারণ সেটা গড়ে তোলার কাজে তারাই ছিল প্রধান সাহায্যকারী। প্রেসিডেন্ট কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেবগনিউ ব্রেজেজিনস্কিকে যদি বিশ্বাস করা যায়, তাহলে বলতে হয় এই নেটওয়ার্ক ১৯৭৯ সালে গড়ে উঠতে শুরু করে। হয়তো বড়াই করেই তিনি দাবি করেছিলেন— ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে, রাশিয়ানদের "আফগান ফাঁদে" (একটা মনে রাখার মতো শব্দবন্ধ) ফেলার জন্য, তিনি আফগানিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুজাহিদিনদের গোপনে সাহায্য করার জন্য উস্কানি দিয়েছিলেন। ছয় মাস বাদে আফগান সরকারকে সমর্থন করার জন্য সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে রাশিয়ানদের ‘আফগান ফাঁদে’ পা দেওয়ার জন্য তিনি বেশ গর্বিত। ফলাফল তো আমরা জানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, পাকিস্তান, ফ্রান্সের গোয়েন্দা বাহিনী, সৌদি আরবের অর্থবল এবং ইজরায়েলের সহযোগিতায় সম্ভবত এক লক্ষ বা তারও বেশি ভাড়াটে সৈনিক জড়ো করে এক বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। এই সৈনিকদের নির্বাচিত করা হয়েছিল তাদের জ্ঞানত গোঁড়া ইসলামপন্থী তথা ইসলামী মৌলবাদীদের সবথেকে বেশি জঙ্গি গোষ্ঠিগুলি থেকে। সব জায়গা থেকে নির্বাচন করা হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশই আফগানিস্তানের ছিল না। তাদের আফগান বলা হয়, কিন্তু লাদেনের মতো তারাও বাইরে থেকে এসেছিল।
খুব শীঘ্রই বিন লাদেন যোগদান করছিলেন। তিনি অর্থ জোগানের নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সিআইএ, পাকিস্তান, মিশর এবং অন্যান্য শক্তি তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, সশস্ত্র করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে সংগঠিত করেছিল। এবং তারা তা পালন করেছিল। তারা রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তারা রাশিয়ার ভূখণ্ডে সন্ত্রাস চালিয়েছিল।…
১৯৮৯ সালের মধ্যে, তারা আফগানিস্তানে তাদের ধর্মযুদ্ধে সফল হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবে স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা মাত্র, বিন লাদেন এবং তাঁর সহযোগীরা ঘোষণা করে যে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আমেরিকার এই ভূমিকা আফগানিস্তানে রাশিয়ার দখলদারির সঙ্গে তুলনীয় এবং তাদের বন্দুকের নল আমেরিকানদের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। যেমনটা ঘটেছিল লেবাননে ১৯৮৩ সালে, যখন মার্কিনী সামরিক ফৌজ সেখানে উপস্থিত হয়েছিল।” (The United States is a Leading Terrorist State: An Interview with Noam Chomsky by David Barsamian, Monthly Review, Nov 01, 2001)  


মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনী আগ্রাসন, ইরাক আক্রমণ এবং সামগ্রিকভাবে আরব দুনিয়ায় ইওরো-মার্কিন ধনী দেশগুলির আধিপত্যের প্রচেষ্টা ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে পশ্চিমী দুনিয়ার দিকে ধাবিত করে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় স্বৈরতান্ত্রিক উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলিও ইসলাম বিরোধিতাকে তাদের এজেন্ডা করে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সামরিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার ফলে, দেশটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে ইওরোপের দেশগুলিতে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল সংখ্যক অভিবাসন উগ্র দক্ষিণপন্থীদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। 



এক দশক অতিক্রান্ত হতে না হতেই, বিশ্বায়নের সমস্ত চাকচিক্য, ঔজ্জ্বল্য মলিন হতে শুরু করে। ‘এশীয় বাঘেদের’ গর্জন গোঙানিতে পরিবর্তিত হয়। পশ্চিমী দুনিয়ার উন্নত দেশগুলিতেও অর্থনৈতিক মন্দা বিস্তার লাভ করে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড সংখ্যক ব্যাঙ্কের পতন হয়। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় কোনোরকমে পরিত্রাণ পেলেও, আগ্রাসী পুঁজিবাদ আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে ওঠে। পুঁজির আগ্রাসনের অর্থ গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের অবক্ষয়। তাই আগ্রাসী পুঁজির সহযোগী হয়ে ওঠে আগ্রাসী রাজনৈতিক শক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ‘ফরেন পলিসি’র বিশ্লেষণ অনুযায়ী—


‘২০০০ থেকে ২০১০ পর্ব জুড়ে বিশ্ব যখন আল-কায়দা, ইসলামিক স্টেট এবং অন্যান্য ইসলামী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী নিয়ে ব্যস্ত, অন্যদিকে তখন বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী চরমপন্থারও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।… ইওরোপের অনেক দেশে দক্ষিণপন্থী মতাদর্শ এবং গোষ্ঠী অপরিচিত না হলেও, ইসলামিক দেশগুলি থেকে মুসলমান জনতার পরিযান ইওরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটায়। এই অভিবাসনের প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের অতি-দক্ষিণপন্থী ভাবধারা উদ্গার দ্বিতীয় দশকে মূল রাজনৈতিক ধারায় দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটায়।’ (Foreign Policy, Far-Right Extremism Is a Global Problem And it is time to treat it like one, by Heather Ashby, January 15, 2021) 


রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থানের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইওরোপে মার্কিন সামরিক শক্তি রুশ সামরিক শক্তির প্রতিদ্বন্দিতার মুখোমুখি হতে শুরু করে। উভয় পক্ষের মদতেই, অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিতে, স্বৈরাচারী শাসকদের ক্ষমতা দখলের পথ সুগম হয়। লাতিন আমেরিকাকে তো ‘আমেরিকার পশ্চাৎপ্রাঙ্গন’ (America's backyard) বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাদাগিরি সেই অঞ্চলে বরাবরই গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানে বাধা দিয়ে এসেছে এবং স্বৈরাচারী শাসকদের ক্ষমতাসীন হতে সাহায্য করেছে। পৃথিবীর অন্যতম কুখ্যাত একনায়কতন্ত্রী শাসকদের লাতিন আমেরিকা প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু বর্তমান শতাব্দীর গোড়া থেকে, যখন বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে কট্টর দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হচ্ছে, লাতিন আমেরিকায় গণ-আন্দোলনের বিস্তারের ফলে একের পর এক দেশগুলিতে বামপন্থীরা ক্ষমতা দখল করে চলেছে। ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর ফিরে বামপন্থীদের ক্ষমতা দখলের নজির লাতিন আমেরিকাতেই দেখা গেছে। এতৎসত্ত্বেও, কট্টর দক্ষিণপন্থীরা হাল ছেড়ে দিয়েছে বা তাদের শক্তি হ্রাস হয়েছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ ঘটেনি। ব্রাজিলে ২০২২ সালের নির্বাচনে লুলা এবং বলসোনারোর প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ১.৮০ শতাংশ। লুলা প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হওয়ার পরেও বলসোনারো সমর্থকরা রাষ্ট্রপতি ভবন সহ অন্যান্য সরকারি ভবন আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল।


খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালের নির্বাচনে জো বিডেন-এর নিকট পরাজিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল ভবন আক্রমণও প্রমাণ করেছিল, ক্ষমতা ধরে রাখতে তারা কতটা মরিয়া। জো বিডেন পঞ্চাশ শতাংশ ভোটের গণ্ডি পেরোলেও ট্রাম্পের প্রাপ্ত ভোট নেহাৎ কম ছিল না, প্রায় ৪৭ শতাংশ। 


ইওরোপে কোথাও কোথাও নয়া-ফ্যাসিবাদী দল মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে। জার্মানিতে এএফডি (Alternative for Germany), স্পেনে ভক্স (Vox) পার্টি, অস্ট্রিয়ায় এফপিও (Freedom Party of Austria), হাঙ্গেরিতে ফিডসেজ্‌ (Hungarian Civic Alliance), ইউক্রেনে আজভ ব্রিগেড (Azov Brigade) ইত্যাদি অতি-দক্ষিণপন্থী / নাজিবাদী দল স্ব স্ব দেশের জাতীয় রাজনীতিতে বেশ ভালো জায়গা করে নিয়েছে। রাশিয়া, বেলারুশ, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স সহ ইওরোপের বিভিন্ন দেশে একনায়কতন্ত্রী শাসকরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। এশিয়ায় ভারত, থাইল্যাণ্ড, ফিলিপিনসে স্বৈরাচারী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রেখেছে। তুরস্কে ইসলামী রাষ্ট্রনায়ক এর্ডোগানের তৃতীয়বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ একনায়কতন্ত্রের পথ সুগম করলো। মায়ানমারে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ বাদে, বিশ্বে এখন উগ্র দক্ষিণপন্থী, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী শক্তিসমূহেরই আধিপত্য। অন্যদিকে ইরান, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে ইসলামিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে সেখানকার জনসমাজ অতিষ্ঠ।



নয়া-উদারনীতির প্রাথমিক স্তরে আমজনতার সামনে নিয়ন্ত্রণমুক্ত অর্থনীতির এক উজ্জ্বল পটচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু আশাহত হতে মানুষের বেশি সময় লাগলো না। “জীবনধারণের মানের অবনমন, শ্রেণীগত সংহতির অবক্ষয়, প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলির তরফে প্রতিক্রিয়ার অভাব এবং বিচারবিবেচনাহীন প্রযুক্তিতন্ত্রের মাধ্যমে জীবিকা ‘নিয়ন্ত্রণের’ প্রকোপে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবন জেরবার হয়ে উঠেছে।”— মন্তব্য করেছেন লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিকসের ফেলো অর্থনীতিবিদ জেরম রুশ (ROAR Magazine, June 29, 2016)। তিনি আরও যোগ করেছেন এরই পরিণতিতে ইংলণ্ডের ব্রেক্সিট— Brexit was first and foremost a political statement by the dispossessed and disempowered. 


শ্রমজীবী মানুষের ওপর সঙ্কটের সমস্ত বোঝাটা চাপিয়ে দিয়ে পুঁজিবাদ সঙ্কটমুক্তির রাস্তা খোঁজে। ব্যয়সংকোচের নামে কল্যাণমূলক ব্যবস্থাগুলি প্রত্যাহার করা হয়, ছাঁটাই ও লে-অফের প্রাদুর্ভাব ঘটে, বেতন-মজুরি হ্রাস পায়, পেনশন সহ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলির উপর কোপ পড়ে, সরকারি সম্পত্তি বেসরকারিকরণের হার দ্রুত বাড়তে থাকে, জল-জঙ্গল-জমির উপর নির্ভরশীল মানুষ ক্রমবর্ধমান হারে জীবিকাচ্যুত, স্থানচ্যুত হয়। মানুষ যখন পরিত্রাণের রাস্তা খুঁজে পায় না, সহজেই তারা ফ্যাসিবাদের অথবা অতি-দক্ষিণপন্থীদের শিকার হয়। ফ্যাসিবাদ কিংবা অতি-দক্ষিণপন্থা সঙ্কটমুক্তির রাস্তা দেখায় না। মানুষের বিক্ষোভকে চালিত করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে, অভিবাসীদের / পরিযায়ীদের বিরুদ্ধে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে এবিষয়ে কোনো পার্থক্য নেই। 


সাধারণভাবে, লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ বাদ দিলে, বিশ্বের প্রায় সর্বত্র অতি-দক্ষিণপন্থী ও ফ্যাসিবাদীদের প্রতিপক্ষ এখন দক্ষিণপন্থীরাই। বামপন্থীরা চ্যালেঞ্জ নিতে পারছে না, কারণ, পলা স্যান্ড্রিনের ভাষায় “দক্ষিণ এবং বামপন্থীদের মধ্যে পার্থক্য এখন ন্যূনতম”। বামপন্থীরা “নয়া-উদারনীতিকে কতকগুলি অর্ত্থনৈতিক নীতির সমাহার হিসাবে কেবল গ্রহণ করেনি বরং যৌক্তিক হিসাবে মানে, যার শেষ কথা হচ্ছে, বিশ্বায়ন অপরিবর্তনীয় এবং এর কোনো বিকল্প নেই।” কথাটা যে কত বড়ো সত্য, সেটা আমাদের দেশের বামপন্থীদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সংসদে বিরোধী পক্ষ হিসাবে বামপন্থীরা কর্পোরেট পুঁজিকে সুবিধাদানের বিরোধিতা করলেও, কর্পোরেট পুঁজি লগ্নীর স্বার্থে জল-জমি-জঙ্গল থেকে মানুষকে উৎখাত করতে বামপন্থী সরকারগুলির কিন্তু বাধে না। লাতিন আমেরিকা ব্যতিক্রম কারণ সেখানে “বামমার্গী সরকারগুলি নব্য উদারনীতি প্রত্যাখ্যান করে বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় এসেছে।” (Deciphering samba politics in Brazil, Peter Ronald Desouza, The Hindu, October 24, 2022) 


এই লড়াইটা কঠিন। কারণ বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্র না ভেঙে, পুরাতন রাষ্ট্রব্যবস্থার পুলিশ থেকে বিচারব্যবস্থা সহ সমস্ত প্রতিষ্ঠান অক্ষুণ্ণ রেখে, শ্রমিক শ্রেণীর সরকার কায়েম না করে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সংগ্রামের সীমাবদ্ধতা থাকবেই। 


প্রতিষ্ঠিত দলগুলির উপর মানুষের তাই আস্থা কমছে— সে দক্ষিণপন্থী হোক বা বামপন্থী। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের বিদ্রোহ-বিক্ষোভ এখনও পর্যন্ত অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত। আরব দুনিয়ায় ‘আরব বসন্ত’ বা মার্কিন মুলুকে ‘অকুপাই আন্দোলন’, ভারতবর্ষে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে বিস্থাপন-বিরোধী আন্দোলন বা পরবর্তী কালে এনআরসি - সিএএ - এনপিআর বিরোধী আন্দোলন, ইরানে হিজাব-বিরোধী আন্দোলন, ফ্রান্সে সাম্প্রতিক কালে সরকারের পেনশন ও শ্রমনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন — উদাহরণ না বাড়িয়ে বলা যায়, ইদানীংকালের প্রায় সবকয়টি গণ-আন্দোলন দলীয়-নিয়ন্ত্রণহীন আন্দোলনের নজির। 


সহায়-সম্বল-অধিকার— নীচুতলার মানুষ হারাচ্ছে সবকিছুই। সবহারাদের ক্ষোভ-বেদনা-ক্রোধ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো মাঝে মাঝে বিস্ফোরিতও হচ্ছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে সমাজবিপ্লবের যে বিশ্ববীক্ষা নিয়ে সামাজিক আন্দোলনগুলি পরিচালিত হচ্ছিল, বর্তমান পর্যায়ের আন্দোলনগুলিতে সেই দিশা অনুপস্থিত। বামপন্থী দলগুলির অনুরূপ দিশা নেই বলেই, সামাজিক আন্দোলনগুলিতে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নির্মাণের ক্ষেত্রে তারা অর্থপূর্ণ ভূমিকা নিতে ব্যর্থ। 

 

0 Comments
Leave a reply