শত শত মৃত ‘প্রাণ’ আছে পাশে পাশে,
মানবতা মরে ভূত দানবসকাশে…
কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে ভোপালের রাজা ভোজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছতে মোটামুটি সাড়ে ছ’ঘণ্টা লেগে যায়। সেখান থেকে গান্ধীনগর, এয়ারপোর্ট রোড, লালঘাটি হয়ে আরিফনগর। ভোপাল এয়ারপোর্ট থেকে আধ ঘণ্টার রাস্তা। সেই পথশেষ যেন এক অনন্ত ক্ষতর বধ্যভূমিতে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এখনও বাতাস ভারী আর্তনাদ আর হাহাকারে। শুধু মানব নয়, মানবতার মৃ্ত্যুর কটু গন্ধ এখনও লেপ্টে রয়েছে মরা কারখানার বাতাসে। চার দশক পড়ে পড়ে মরচে ধরা লোহার ফটকের ওপারে নিদারুণ অভিঘাতে ফেলে রাখা দুঃসহ সব স্মৃতি। সেই ১৯৮৪-র ২ ডিসেম্বর থেকে এখনও পর্যন্ত ঘা শুকোয়নি। বরং বড্ড দগদগে। সেই আরিফনগরের বিপুল এলাকা জুড়ে থাকা পাঁচিল ঘেরা ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড চত্বর। বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম মারাত্মক শিল্প বিপর্যয়। ভোপাল গ্যাস লিক দুর্ঘটনার স্মৃতি বইছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কারখানা চত্বর সংলগ্ন ও আশপাশের ঘন জনবসতির বাতাস ঘটনার রাতে ঢেকে গিয়েছিল বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাসে। তারই প্রভাবে তছনছ হয়ে যায় প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের জীবন। বেসরকারি হিসেবে ঘটনার প্রথম সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা প্রায় আট হাজার। কারখানা কর্তৃপক্ষের হিসেবে, ঘটনার রাতে মৃত্যু হয়েছিল তিন হাজারের কিছু বেশি।
ভোপালের পরিত্যক্ত কারখানা (ছবি -উইকিপিডিয়া)
আরিফনগরে কান পাতলে আজও শোনা যায়, লাভের টোপ গিলে এখানে শুরু থেকেই কারখানা কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার নিয়ম ভেঙেই চলতেন। এখন সেখানে একগাদা জঙ্গল। কারখানাটি পরিত্যক্ত। টানা একতলা ভবনগুলোকে দেখলে মনে হয়, ভূতেদের আস্তানা। এই ভবনগুলো ছিল বিভিন্ন অফিসঘর। কিছুটা দূরে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা প্ল্যান্টের দানবাকৃতি যন্ত্রাংশের কঙ্কাল। ঝোপ আর কাঁটাগাছের ঝাড়ে ভর্তি চারপাশ। বিরাট সব লোহার যান্ত্রিক কাঠামো, এক সময়কার কর্মীদের ব্যস্ততার সাক্ষী। দৈত্যাকার রিঅ্যাক্টর ট্যাঙ্ক জং পড়ে ঝামা হয়ে গেছে। মাথার কাছে পৌঁছনোর সিঁড়িগুলো বিপজ্জনক, এই বুঝি ভেঙে পড়বে নীচে। কিছুটা দূরে পাশেই পড়ে সেই মারণ ট্যাঙ্ক। যেটি থেকে সেই অভিশপ্ত রাতে লিক করে মিথাইল আইসোসায়ানেট। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ট্যাঙ্কের মাথায় আজও আছে রেগুলেটরের অবশেষ। এখনও ওই চত্বরে মাঝে মাঝেই পাওয়া যায় বেশ ঝাঁঝালো গন্ধ। এখনও কি গ্যাস বেরোয়?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। ভোপাল গ্যাস দুর্গতদের ওপর করোনা প্রতিষেধক কোভ্যাক্সিনের মহড়া বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়েছিল সেখানকার চারটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ভোপালে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও দাবি তোলে তারা। চিঠি দেয় তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধনকেও। এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির সদস্যদের দাবি ছিল, গ্যাস দুর্গতদের উপর কোভ্যাক্সিন প্রয়োগের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রতিষেধক নেওয়ার দশ দিন পরেই একজনের মৃত্যু হয়। অনেকেরই জটিল শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসকেরা মনে করেছিলেন, বিষক্রিয়াই মৃত্যুর কারণ। তবে ভারত বায়োটেক দাবি করে, এই মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিষেধক প্রয়োগের কোনও সম্পর্ক নেই। ওই সংগঠনগুলি দাবি করে, প্রতিষেধক প্রয়োগের পরে কারও মৃত্যু হলে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মোদী ও হর্ষবর্ধনকে পাঠানো চিঠিতে সই করে ভোপাল গ্যাস পীড়িত মহিলা পুরুষ সংঘর্ষ মোর্চা, ভোপাল গ্রুপ ফর ইনফরমেশন অ্যান্ড অ্যাকশন, চিলড্রেন এগেনস্ট ডাও কার্বাইডের মতো সংগঠনগুলি। অর্থাৎ আরিফনগরের আশপাশের মানুষ এখনও নিরাপদ নয়।
কারখানায় ঢোকার পথে এখনও দেখা যায় সেই সাইরেন টাওয়ার। যার মাথার আলো আর শব্দ ছড়াত বিপদবার্তা। বিশেষ সময়ে সতর্ক করতে গোড়ায় এই সাইরেন ঘন ঘন বাজত। ফলে অভিযোগ জমছিল কারখানা নিয়ে। কর্তৃপক্ষ তাই বন্ধ করে দেন সাইরেন। ১৯৬৯ সালে কীটনাশক, ব্যাটারি প্রভৃতির উৎপাদন শুরু করে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের এই কারখানা। গোড়া থেকেই কারখানার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৭৬ সালে স্থানীয় দু’টি সংগঠন কারখানা চত্বরে গ্যাস লিকের অভিযোগ করে। ১৯৮১ সালে মেরামতির কাজে পাইপে নেমে বিষাক্ত ফসজেন গ্যাসে ঝলসে মৃত্যু হয় আশরফ খান নামে এক শ্রমিকের। গুরুতর জখম হন দু’জন। ১৯৮২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে ঘটে পর পর দুর্ঘটনা। ফসজেন লিক করে ২৫ জন শ্রমিক অসুস্থ হন। ফের অক্টোবরে মিথাইল আইসোসায়ানেট লিক থামাতে গিয়ে গুরুতর জখম হন সুপারভাইজার-সহ তিন কর্মী এবং শতাধিক বাসিন্দা। ১৯৮৪-র গ্যাস লিক দুর্ঘটনার আগে থেকেই কর্তৃপক্ষের অসতর্কতার চিহ্ন জমছিল জমে থাকা রাসায়নিক বর্জ্যে। কারখানার বাইরের জলাশয়ের রাসায়নিক বর্জ্য ও চত্বরের ৩২ একর জায়গা জুড়ে ১৯৭৭ সালে তৈরি ‘সোলার পন্ডে’ পরিবেশের ক্ষতিকর বর্জ্য ফেলা হত। আজও প্রতি বর্ষায় এ সব ভেসে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে রাসায়নিক দূষণ। যার প্রভাবে বহু বছর ধরেই বিষাক্ত এখানকার ভূগর্ভস্থ জল ও পরিবেশ।
কিন্তু আরিফনগরের বাতাসে কীসের গন্ধ? কিছু না কিছু কেমিক্যাল সাবস্টেন্স হাওয়ায় ঘুরছে। মাটির নীচে কি কোনও কন্টেনার আছে, যেখান থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে? নাকি উৎস অন্য কিছু? পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দাবি, অতি বিষাক্ত কার্সিনোজেনিক উদ্বায়ী গ্যাস এই মিথাইল আইসোসায়ানেট। ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার পরে এখনও ওই সব অঞ্চলে বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি রয়েছে। যে কারণে কোভ্যাক্সিন প্রয়োগের সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। এমআইসি বিয়োজিত হলে সেই বিয়োজিত যৌগ আবার অক্সিজেন ও জলের সঙ্গে বিক্রিয়ায় অন্য কোনও পদার্থ তৈরি করে। যার কিছু মাটির ওপর লেগে থাকে। আর কিছু পদার্থ মাটির ভিতরে ঢুকে বহুদিন ধরে রাসায়নিক গ্যাস নিষ্ক্রমণ করে। ক্রমাগত ক্রিয়া-বিক্রিয়া দুই-তিন প্রজন্ম ধরে চলতে পারে। অর্থাৎ, এখনও বিপদ মাথায় নিয়েই আরিফনগর ও তার সংলগ্ন এলাকার দিনযাপন। সেই ‘গ্যাস কাণ্ডের’ মিথ এলাকায় ছড়ানো হয় আজও। গত চার দশক ধরে হাওয়ায় ঘোরা এমন মিথ শুনেই ক্ষতিগ্রস্তেরা খালি ঝোলা নিয়ে বিষে বাস করে চলেছেন।
তখন কতই বা বয়স ছিল, মাত্র বাইশ। উনিশশো চুরাশির দোসরা ডিসেম্বরের সেই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় শরীর ফুঁড়ে যে প্রবেশ করবে উদ্বায়ী বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট, কে জানত। দেবী রামও বোঝেনি। যখন চোখজ্বালার সঙ্গে কাশি ও শ্বাসকষ্ট শুরু হল, তখন হুট করেই বয়স অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। না, হাজার হাজার মৃত্যুমিছিলে তার নাম লেখা হয়নি ঠিকই, তবে জীবনের অপার আনন্দ তখনই থমকে গিয়েছিল।
প্ল্যান্টের অনুপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং অ্যালার্ম সিস্টেমের ব্যর্থতা এক গভীর বিপদ ডেকে আনে আরিফনগর তথা ভোপালের আটপৌরে জীবনে। অফিসিয়াল রেকর্ডে বলা হয়, এমআইসি - এই প্ল্যান্টে একটি শীতল এজেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত জলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছিল যার ফলে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাস পরবর্তীতে ছশো দশ নম্বর ট্যাঙ্কের উপর চাপ সৃষ্টি করে। চাপ ধরে রাখতে না পেরে ট্যাঙ্কটি প্রায় চল্লিশ টন এমআইসি ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা ভোপাল শহরকে গ্রাস করে। তিন ডিসেম্বর সকালে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছন চিত্র সাংবাদিক রঘু রাই। তাঁর ক্যামেরা ধরে রাখে এই মর্মান্তিক আখ্যান। রঘুর লেন্স পরবর্তীতে তাঁকে দুনিয়াখ্যাত করে তোলে। রঘুর কথায়, “আমরা সকাল ৭টার ফ্লাইট নিয়েছিলাম এবং সকাল ৯টার মধ্যে সাইটে পৌঁছে যাই। রাস্তায় মৃত প্রাণী, ফুলে যাওয়া পশু, গরু, মোষ, কুকুরের সারি। যেন কেউ শহরে রাসায়নিক বোমা মেরেছে। হাসপাতালে পৌঁছে আমরা দেখি, অগুনতি অসুস্থ পুরুষ-মহিলা আর শিশুকে আনা হচ্ছে। একপাশে অনেকগুলি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। নয় এগারোয় প্রায় দু’হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। প্রতিটি পরিবারকে প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিন্তু ভোপাল গ্যাস-দুর্গতরা তার সিকিভাগও পায়নি। আমার তোলা ভোপালের ছবি নিয়ে একাধিক প্রদর্শনী করেছি এবং সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করে গেছি। তার পরে অসহায় পরিবারগুলোকে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তবে তা ট্র্যাজেডি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট নয়।”
রঘু রাইয়ের ক্যামেরায় ‘বুরিয়াল অফ আননোন চাইল্ড’ যে হাহাকারের গল্প বুনে দিয়েছিল, গোটা দুনিয়ার বুকে পাষাণের মতো ভারী হয়ে চেপে বসিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়ঙ্কর শিল্পদূষণের মর্মান্তিক মর্মবেদনা, ভোপালের দেবী রামও সেই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়নি একবিন্দু। তবুও তো একটা সংসার হয়েছিল, স্ত্রী-মেয়ের ভালবাসা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, প্রায় আটত্রিশটা বছর। রঘু রাইয়ের ওই ছবিটা ঝুপড়ির এক কোণে অনাদরে পড়ে থাকলেও, কখনও ওই ছবির গায়ে ধুলো জমেনি। সাদা-কালো ছবিটার দিকে তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিত দেবী। মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জীবনকে ভালবাসতে ইচ্ছে করত। আপনজনের সান্নিধ্যে বাঁচতে চাইত, আঁকড়ে ধরতে চাইত স্ত্রীর প্রেম, মেয়ের ভালবাসা। দিন-আনা দিন-খাওয়া নিতান্তই আটপৌরে সংসারের চারপাশে রঙিন হয়ে উঠতে চাইত ভবিষ্যতের আলো, এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিতে চাইত আঁধারের নিকষ ভয়াবহতা। এভাবেই বেঁচেছে দেবী রাম। শরীরের কষ্ট মনে পৌঁছতে দেয়নি। বলা ভাল, স্ত্রী-মেয়ের ভালবাসা তার শরীর-মনে সুখের ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছিল।
চল্লিশ বছর আগে সেই রাত অনেক কিছু পাল্টে দিলেও দেবী রামের বেঁচে থাকার আর্তি কেড়ে নিতে পারেনি। সবুজে মোড়া শহর, প্রাকৃতিক হ্রদের নগরী, নবাব-বেগমদের শাসন করা ভোপালের নান্দনিক পরিচয় কেড়ে নিলেও দেবী রামের জীবনকে মৃত্যুর চৌকাঠে পৌঁছে দিতে পারেনি। মনে পড়ত তার সেই রাতের কথা, দুঃসহ অভিঘাতের কথা। শরীরে মারণ ক্যানসার বাসা বাঁধলেও দেবী রামের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কাছে বারবার হার মানতে হয়েছে কর্কট রোগকে। কিন্তু রেলমন্ত্রীর বুলডোজারের কাছে হেরে গেছে দেবী রামের বেঁচে থাকার যুদ্ধ, ক্ষতিপূরণ আদায়ের আন্দোলন।
ভোপালের জনবসতির মধ্যেই ইউনিয়ন কার্বাইডের রাসায়নিক কারখানা। তৈরি ও সঞ্চিত হত বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট। চুরাশির দোসরা ডিসেম্বর রাতে সি প্ল্যান্টে সঞ্চিত মিথাইল আইসোসায়ানেটের ছশো দশ নম্বর ট্যাঙ্কে কোনওভাবে জল মিশে যায়। তাপদায়ী বিষক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস। ভয়ঙ্কর তাপ ও চাপে ট্যাঙ্ক খুলে প্রায় চল্লিশ মেট্রিক টন মারণ মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। চোখজ্বালা, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও স্কিনের সমস্যায় আক্রান্ত হয় প্রায় সাড়ে আট লক্ষ জনবসতির ভোপালের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। বাতাসে মিথাইল আইসোসায়ানেটের শূন্য দশমিক চার পার্ট পার মিলিয়নের উপস্থিতিই বিপজ্জনক। তা একুশ পিপিএমে পৌঁছলে মৃত্যু অনিবার্য। ভোপালে এর মাত্রা পৌঁছেছিল তারও কয়েক গুণ বেশি। তাই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অসহনীয় কষ্ট নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে প্রায় তিন হাজার মানুষ। সরকারি তথ্য বলছে, মৃতের সংখ্যা তিন হাজার সাতশো সাতাশি, শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ লক্ষ আটান্ন হাজার দুশো পঁচিশ। তার মধ্যে স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার তিন হাজার নশো। তবে দুর্গতদের পক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি, মৃতের সংখ্যা প্রায় পনেরো হাজার। মারণ গ্যাস থেকে রেহাই পায়নি গর্ভস্থ সন্তানও। গর্ভাবস্থায় শতকরা তেতাল্লিশ জন নারীর সন্তান মারা যায়, ঘটে গর্ভপাতও। জন্মের এক মাসের মধ্যে মারা যায় শতকরা চোদ্দটি শিশু। প্রকৃতি ও পরিবেশকে অবহেলা করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির দম্ভকে এ ভাবেই দুমড়ে মুচড়ে দেয় ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা। আসলে সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটেছে বায়ুদূষণ।
উনিশশো বাহাত্তর থেকে চেষ্টার পর রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে উনিশশো চুয়াত্তরের পাঁচই জুন পালিত হয় প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস। কিন্তু তার দশ বছরের মাথায় ঘটে যায় বৃহত্তম শিল্প বিপর্যয়। ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বায়ুদূষণ ও শিল্পদূষণের ভয়াবহতা। বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় সত্তর লক্ষ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে। এর জন্য ফুসফুসের রোগে প্রাণ হারায় প্রায় আঠারো লক্ষ, হৃদরোগে চব্বিশ লক্ষ, স্ট্রোকে প্রায় চোদ্দ লক্ষ মানুষ। সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে অ্যালঝাইমার্স রোগের সঙ্গে বায়ুদূষণের মারাত্মক প্রভাবের কথা। না, দেবী রাম এর কোনওটাতেই মারা যায়নি। ক্যানসারও কাড়েনি তার প্রাণ। এতগুলো বছর যুঝেছে। কিন্তু আর না। অন্নুনগরে রেলের জমি অধিগ্রহণের নামে বুলডোজারের বর্বরতা দেবী রামের শরীরে দেগে দিয়েছে তীব্র কষাঘাত। যে কষ মৃত্যুর চেয়েও গভীরতর ক্ষত তৈরি করেছে। অশ্বিনী বৈষ্ণবের বুলডোজার শাসনে চোখের নিমেষে ধুলো হয়ে গেছে তিনশো ছেচল্লিশটি ঝুপড়ি। যার একটাতেই সুখী গৃহকোণ গড়ে তিলে তিলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে টিকে ছিল দেবী রাম। ছাদ হারানোর অভিঘাত যে কত তীব্র হতে পারে, দেবী রামের মৃত্যু প্রমাণ করে দিয়ে গেছে। ফুসফুস ক্ষইছিলই, ঝুপড়ি উচ্ছেদের ধুলো মারাত্মক থাবা বসিয়ে দেয় দেবী রামের পাঁজরে। হাসপাতালে ভর্তির পর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। আয়ুষ্মান ভারত কার্ডে পাঁচ লক্ষ টাকার বিনামূল্যে চিকিৎসা। কিন্তু কোথায় কী? হাসপাতালের বিলের অঙ্ক যত চওড়া হয়েছে, দেবী রামের স্ত্রী-মেয়ের অসহায়তা ততই তীব্র হয়েছে। একদিকে ছাদহীন অনন্ত উঠোন, অন্যদিকে খালি পেটে দিশেহারা জীবন। দুবেলা দুমুঠোও তখন যেন বিলাসিতা। না, রাজ্য সরকার এগিয়ে আসেনি।
‘‘প্রায় চল্লিশ বছর বেঁচেছি, লড়াই করেছি, আর পারছি না। এবার চলে যেতে চাই’’। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে স্ত্রীকে এই কয়েকটা কথাই বলতে পেরেছিল দেবী রাম। স্ত্রী-মেয়ের অসহায় ঘরকন্নার ছবিটা দেবী রামের কাছে ‘বুরিয়াল অফ আননোন চাইল্ড’-এর থেকেও যে মর্মভেদী।
ভোপালকে বলা হয় লেকের শহর। ভারতের সতেরোতম জনাকীর্ণ এই শহর মধ্যপ্রদেশের রাজধানী। লোককাহিনী বলে, ধারানগরের রাজা ভুজা একাদশ শতকে এই নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। রাজার নামানুসারে ভোপাল পরিচিত ছিল ‘ভুজপাল’ হিসেবে। ধীরে ধীরে কালের বিবর্তনে তা হয়ে যায় ভোপাল। যদিও এটি লোককাহিনীর মত; সুনির্দিষ্ট কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এর স্বপক্ষে পাওয়া যায়নি। তবে আধুনিক ভোপালের প্রতিষ্ঠাতা মোঘল সেনাবাহিনীর আফগান যোদ্ধা দাস্ত মোহাম্মদ খান। তাঁকে বলা হয় ভোপালের প্রথম নবাব। ১৭০৮ সালে তিনি বেরাসিয়া এস্টেট লিজ নেন; সঙ্গে আরও কতগুলো এলাকা যুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমানের তিলোত্তমা ভোপাল নগরীকে। এখানেই শেষ নয় ভোপালের ইতিহাসের পাতা। বিগত শতাব্দীর শেষভাগে এসে ভোপালের ইতিহাস রচিত হয় এক করুণ গতানুশোচনায়। নিদ্রাচ্ছন্ন এক জনপদের সহস্র নিরীহ অধিবাসীকে মধ্যরাতের গহীন আঁধারে মেরে ফেলা হয় অবহেলা ও অজ্ঞতার বিষ দিয়ে। ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৪; ৭০ একর জমির উপর নির্মিত ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডে রাতের পালার কাজ শুরু হয়েছে। ভোপালের প্রায় ন’লক্ষ বাসিন্দা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা সময়কে নিয়ে যাচ্ছে আঁধার রাতের আরও গভীরে। ঠিক সেসময় একটা অদ্ভুত শব্দ কারখানার এক অপারেটরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মিথাইল আইসোসায়ানেট ইউনিটের ই৬১০ নম্বর ট্যাঙ্কের ভেতর চাপ বাড়তে থাকে। চাপ বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে তা বিপদসীমার উপরে চলে যায়। অপারেটর জানতেন, অত্যধিক তাপ ও চাপে মিথাইল আইসোসায়ানেট তরল থেকে গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হবে, আর তখন তা ট্যাঙ্ক থেকে বের হওয়ার সম্ভাবনাও বহুগুণে বেড়ে যাবে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটি তাঁর ঊর্ধ্বতনকে জানান। সবাই ছুটে আসে ই৬১০-এর সামনে। কিন্তু পরিস্থিতি ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ট্যাঙ্কটি এতটাই গরম হয়ে ওঠে যে এর আশেপাশে কেউ ভিড়তে পারছিল না। হতোদ্যম শ্রমিকেরা তাপ কমাতে প্ল্যান্টের গায়ে আরও জল ছুড়ে দেয়। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়। মিথাইল আইসোসায়ানেট জলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে প্রতি কিলোগ্রামে তিন হাজার ক্যালোরির উপর তাপ তৈরি করে। সঙ্গে তৈরি হয় অত্যধিক মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড। উনচল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্ফুটনাঙ্কের এই বিষাক্ত পদার্থ মুহূর্তের মধ্যে ট্যাঙ্কের ২৫০ ডিগ্রির পরিবেশে চলে আসে। প্রচণ্ড চাপে গ্যাসে পরিণত হওয়া মিথাইল আইসোসায়ানেট সেফটি ভালভ অতিক্রম করে ৭০ ফিটের এক লম্বা পাইপলাইনে ঢুকে পড়ে। এই পাইপলাইনের শেষ প্রান্তে যুক্ত ছিল গ্যাস স্ক্র্যাবার। এখানে মূলত কস্টিক সোডা দিয়ে মিথাইল আইসোসায়ানেটকে ক্ষতিকর নয় এমন পদার্থে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু এদিন হয়ত মৃত্যু পরোয়ানা নিয়েই এসেছিল ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের ট্যাঙ্ক ই৬১০। আর সে কারণেই গ্যাস স্ক্র্যাবারটিও সেই রাতে কাজ করেনি। সংস্কারের জন্য এটিকে বন্ধ রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্ল্যান্টের পাঁচটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার সব কটি সেই রাতে অকেজো হয়ে পড়েছিল। ভোপালের কুয়াশামাখা বাতাসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণসংহারী বিষাক্ত গ্যাস। ঘণ্টায় ১২ কিলোমিটার গতিতে বয়ে চলা বাতাসে ভর করে মৃত্যুদূতের ন্যায় হাজির হয় দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে বাস করা ঘুমন্ত ভোপালবাসীর ঘরে ঘরে। ঘুমন্ত মানুষগুলো একযোগে জেগে ওঠে। প্রতিটি ঘর ধোঁয়াচ্ছন্ন। শিশুরা গলা চেপে ধরে অবিরাম কাশছে, অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় চোখ, গলা, কণ্ঠনালী পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কেউবা পেট চেপে ধরে বসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ ঘরের বাইরে আসার আপ্রাণ চেষ্টায় রত। কেউ পারছে, তো কেউ চৌকাঠ পর্যন্ত যেতে না যেতেই লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। কাশির শব্দ আর ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারার অজানা কষ্টে বিদীর্ণ হয়ে ওঠে মধ্যপ্রদেশের ভোপাল। নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেনও ছিল না সে রাতের বাতাসে। রাস্তার ধারে পড়ে ছিল কাঁথা মুড়ি দেওয়া শত শত লাশ। চোখে ভয় আর মুখে ফেনা নিয়ে সবার আগে মারা যাওয়া এই গৃহহীনদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ছিন্নমূল পথশিশু।
ঘিঞ্জি বস্তিগুলোতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে অজানার দিকে। বাঁচতে হবে তাকে; কিন্তু সেই বাঁচার পথ কোথায়! দৌড়তে দৌড়তে হাঁপিয়ে ওঠা মা জানে না, তার কোলে থাকা আদরের ধন অনেক আগেই মারা গেছে। কান্নাভেজা চোখে একরাশ বিদগ্ধ জ্বালা নিয়ে ছোট্ট শিশুটি মৃত্যুর প্রহর গুনছে পাশেই সদ্য লাশ হয়ে যাওয়া মা-বাবার পাশে। মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে পদদলিত হয়ে মারা যাওয়া শিশুটি ছিল সেই রাতের ‘ভাগ্যবান’; কারণ গ্যাসের ভয়ানক বিষাক্ততা ছোঁয়ার আগেই সে চলে গেছে না-ফেরার দেশে। ভোপাল স্টেশনে রাত ১.১০-এ হাজির হওয়া লক্ষ্ণৌ-মুম্বই এক্সপ্রেস বিভীষিকার ঘন সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। ‘ডমিনোস এফেক্ট’-এর মতো সারি সারি লাশ পড়ছিল ভোপালের রাস্তায়, বাড়িতে, গাড়িতে, রেলস্টেশনে, সর্বত্র। মিথাইল আইসোসায়ানেটের বিষাক্ত থাবা কতটা ভয়ানক ছিল সেটা চিন্তা করাও অনেকের কাছে দুরূহ ঠেকবে। একটি আট কর্মঘণ্টার কারখানায় মিথাইল আইসোসায়ানেটের নিরাপদ মাত্রা ০.০২ পিপিএম। ০.৪ পিপিএমের উপস্থিতিতেই যেখানে কফ, বুকে ব্যথা, অ্যাজমা, ত্বকের ক্ষতি থেকে শুরু করে চোখ, নাক আর গলা জ্বালা-পোড়া করতে পারে, সেখানে ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির মিথাইল আইসোসায়ানেটের পিপিএম ছিল ২৭! যা আদর্শ মানের তুলনায় প্রায় ১,৪০০ গুণ বেশি। ভোপালের সরকারি হামিদিয়া হাসপাতালে বস্তায় বস্তায় রাখা হয়েছিল মৃতদের মাথার খুলি আর হাড়গোড়। হয়ত কোনওদিন দেখাও হয়নি, হয়ত হয়নি কথা; কিন্তু দুর্ভাগ্যের ফেরে সেদিন তারাই পাশাপাশি থেকে রচনা করেছিল এক বিয়োগান্তক গাথা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, বিষাক্ত গ্যাস মৃতদেহের মাথায় ভয়ানক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সারি সারি শিশুর নিথর দেহ দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে পাথরের মতো কঠিন হৃদয়ও। সদ্য বিপত্নীক হওয়া লোকটি কোলে করে নিয়ে যায় তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর নিথর লাশ। মৃত সন্তানের কপালে স্নেহের পরশ বুলিয়ে তাকে শেষ বিদায় দেন হতভাগ্য পিতামাতা। জীবন সায়াহ্নে সবাইকে হারিয়ে একদম একা হয়ে যান গরিব বৃদ্ধা। ভোপাল অনাথ করে দিয়ে যায় শত শত শিশুকে, সন্তানহারা মায়ের মর্মন্তুদ কান্নায় তৈরি হয় ইতিহাসের এক ধূসর অ্যালবাম। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান মানুষের অপলক দৃষ্টি সৃষ্টি করে এক অব্যক্ত বেদনা। লাশের সৎকার করতে হিমশিম খেয়ে যায় বেঁচে থাকা স্বজন ও প্রশাসন। সাদা কাফনে মোড়ানো সারি সারি লাশগুলোকে বাধ্য হয়ে একসঙ্গে কবর দেওয়া হয়। শ্মশানে একসঙ্গে পোড়ানো হয় শত শত লাশ। অমরচাঁদ আজমেরার মতো সমাজসেবীদের দিনে প্রায় দু’হাজারের মতো লাশের সৎকার করতে হয়েছিল।
১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড। ভারতজুড়ে ছিল কোম্পনির ১৪টির মতো প্ল্যান্ট। ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড একটি যৌথ কোম্পানি যার ৫০.৯% শেয়ার ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের এবং বাকি ৪৯.১% ভাগের বন্টন ছিল বিভিন্ন ভারতীয় বিনিয়োগকারীর মধ্যে। খোদ ভারত সরকারও ছিল এই লঘিষ্ঠ ভাগের ভেতর। ইউসিআইএল মূলত তৈরি করত বিভিন্ন কীটনাশক, কার্বন পণ্য, প্লাস্টিক ও ওয়েল্ডিংয়ের যন্ত্রপাতি। ১৯৬৬ সালে ইউসিআইএল ও ভারত সরকারের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৬৯ সালে তারা ভোপালে একটি কীটনাশক প্ল্যান্ট তৈরি করে। ভারত সরকার তাদেরকে বছরে ৫ হাজার টন সেভিন উৎপাদনের লাইসেন্স দেয়। খোদ নিজেদের নিয়োগ করা উপদেষ্টাদের কথা অগ্রাহ্য করে ১৯৭৯ সাল থেকে কর্তৃপক্ষ ভোপালে তাদের কীটনাশক প্ল্যান্টেই এই বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেটের উৎপাদন ও সংরক্ষণ শুরু করে। কর্তৃপক্ষ এই বলে আশ্বস্ত করে যে, এই প্ল্যান্টটি একটা চকোলেট ফ্যাক্টরির মতোই ‘নিরীহ’। দুশ্চিন্তা করার কোনও কারণই নেই! অথচ যে গ্রাউন্ডে এই কীটনাশক প্ল্যান্ট বসানো হয়েছিল সেই জায়গাটি ছিল হালকা ধরনের শিল্পকারখানা আর সাধারণ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য উপযোগী। এর আশেপাশে ছিল ওরিজা, জয়প্রকাশ নগর আর চোলার বস্তি। কোনওভাবেই কীটনাশক প্ল্যান্টের মতো বিপজ্জনক শিল্পের জন্য আদর্শ ছিল না কারখানাটি। কিন্তু তারপরও সেটা হয়। এক জটিল, বিপজ্জনক প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটল ভোপালের মাটিতে। কিন্তু ঝামেলা বাধল আশির দশকে ভারতজুড়ে শুরু হওয়া দুর্ভিক্ষ নিয়ে। একদিকে দুর্ভিক্ষ, অপরদিকে ফসল না হওয়া ক্রমাগত বাড়তে থাকা ঋণের বোঝায় জর্জরিত কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে তোলে। ফলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে কীটনাশক উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। ১৯৮৪ সালে ইউসিআইএলের সেভিন উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশে নেমে আসে। ফলে সে বছরের জুলাই মাসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ইউসিআইএলের ভোপাল প্ল্যান্ট বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কিনবে কে ক্ষতির মুখে থাকা কীটনাশক কারখানাটি? ফলে ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষ কারখানাটি অন্য কোনও উন্নয়নশীল দেশে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে কারখানাটির সেফটি ইকুইপমেন্ট আর তার পরিচালনা পদ্ধতি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার স্ট্যান্ডার্ড মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হতে থাকে। এটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয় বলে অধিকাংশের ধারণা। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার নিরাপত্তা মানদণ্ডের এই নিম্নগামিতার বিষয়টি জানার পরও উদাসীনতার পরিচয় দেয়। পদে পদে ছিল অনিয়ম, শৈথিল্য আর কৃপণতা। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪, এই চার বছরের ভেতর প্ল্যান্টের কর্মী সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। মেইনটেন্যান্স সুপারভাইজারের পদটি অবলুপ্ত করে ফেলায় কারখানায় এই পদের কেউ ছিল না। কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালার সময় ৬ মাস থেকে কমিয়ে করা হয় মাত্র ১৫ দিন! খরচ কমাতে ১৯৮৩ সালে কারখানার ম্যানেজিং ডিরেক্টর জগন্নাথ মুকুন্দ ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দুশো দক্ষ শ্রমিক ও টেকনিশিয়ানকে অবসরে পাঠান। তার পরের বছর শীতে ঘনিয়ে আসে ভয়ানক রাত।
ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের তৎকালীন সিইও ওয়ারেন অ্যান্ডারসন ৭ ডিসেম্বর ভারতে এলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু গ্রেফতারের ঘণ্টা ছয়েকের ভেতর মাত্র ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে জামিনে ছাড়াও পেয়ে তিনি পালিয়ে যান। ওয়ারেন আর কখনই ভারতে ফিরে আসেননি। তাঁকে ভারতে এনে বিচারের মুখোমুখি করারও কোনও গ্রহণযোগ্য সদিচ্ছা লক্ষ্য করা যায়নি কোনও আমলের কোনও সরকারের মধ্যে! তবে ১৯৯২ সালের এপ্রিলে তাঁকে পলাতক আসামি ঘোষণা করে ভারতের আদালত। মার্কিন সরকারও তাদের এই কুলাঙ্গার নাগরিকেরই পক্ষ নেয়। তাদের বক্তব্য, যেহেতু এই দুর্ঘটনা ভারতে হয়েছে, সেহেতু তারা কিছু করতে পারবে না! ১৯৮৯ সালে ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশন ভারত সরকারকে ৪৭০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। কিন্তু সেই অর্থের কতটুকুই বা কাজে লেগেছে সৎভাবে, সঠিকভাবে? ভুক্তভোগী প্রত্যেকে মাসিক ২০০ টাকা করে পেতেন। কিন্তু এই যৎসামান্য অর্থ তাদের অসামান্য কষ্টকে লাঘব করার জন্যে যথেষ্ট ছিল কি? ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির প্রায় ২৬ বছর পরে ২০১০ সালের জুন মাসে ভারতের আদালত চুড়ান্ত রায় দেয়। দুর্ঘটনার সময় কর্মরত আটজন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে। এদের সবাই ছিল ভারতীয়। তাদের সবাইকে দু’বছর করে কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ততদিনে সত্তরের কোঠায় চলে যাওয়া এই আসামিরা জামিন নিয়ে বের হয়ে যায়। এই রায়ের সবচেয়ে আশ্চর্যের দিক ছিল ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে কোনও চার্জশিট দায়ের না করা এবং তাঁকে কোনও শাস্তির আওতায় না আনা। অ্যান্ডারসন ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ফ্লোরিডায় মারা যান।
চল্লিশ বছর আগের সেই অমানিশা আজও কাটেনি ভোপালের ঘরে ঘরে, পথে-ঘাটে। মায়ের জঠর থেকেই শারীরিক ও মানসিক বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্ম নেয় অনেক শিশু। ক্যানসারের মতো মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে অগণিত মানুষ। ভোপালের শহরতলিতে স্বামীহারা মহিলাদের জন্য বিধবা কলোনিতে ঢুঁ মেরেছিলাম। শ্বাসকষ্ট, ক্ষুধামান্দ, জ্বরজারি আজ আলো-হাওয়ার মতোই ভোপালবাসীর নিত্যসঙ্গী। অপরিকল্পিত শিল্পায়নের করাল গ্রাসে পতিত হওয়ার এক ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি।