ভারতের সাধিকাগণ

লিখেছেন:সুতপা সোহহং

আধ্যাত্মিকতার দেশ ভারতে যুগে যুগে বহু সাধকের জন্ম হয়েছে। তাঁরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে তাদের সাধনা ও জ্ঞানের বাণী দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়; আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়েও অন্যান্য দেশের থেকে ভারতকে আলাদা ও এক বিশেষ স্থানে উপনীত করেছেন। পুরুষ সাধকদের সাথে তাল মিলিয়ে নারী সাধকরাও সেই বৈদিক যুগ থেকে আধ্যাত্মিকতার পথে হেঁটেছেন। যেমন ব্রহ্মবাদিনী গার্গী, মৈত্রেয়ী, লীলাবতী এবং অনুসূয়ার মত মহান নারীরা ব্রহ্ম জ্ঞান ও বেদ উপনিষদের আলোচনা করেছেন। এরপর মধ্যযুগেও এসে দেখা যায় প্রচুর সংখ্যক নারী সাধক যেমন মীরাবাই, আক্কা মহাদেবী প্রমুখ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আবির্ভূত হয়ে ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্ম ও সমাজের সংস্কার করছেন। আবার আধুনিক যুগে আনন্দময়ী মা, মা সারদা প্রমুখ সেই ধারাকেই অব্যাহত রেখেছেন।  

 

সারদা দেবী (ছবি - উইকিপিডিয়া) 

 

গার্গী: 

বৈদিক যুগে নারী সাধকদের মধ্যে গার্গী ভাচকনভি ছিলেন একজন প্রাচীন ভারতীয় ঋষি ও দার্শনিক যিনি বৈদিক সাহিত্যে একজন মহান ব্রহ্মজ্ঞানী ও বেদের ব্যাখ্যাকার হিসেবে সম্মানিত হন। তিনি অল্প বয়স থেকেই বৈদিক সাহিত্য ও বৈদিক দর্শনে আগ্রহী ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী গার্গী অল্প বয়সেই চারটি বেদের জটিল দর্শনে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। 

আক্কা মহাদেবী: 

মধ্যযুগে ভারতের নানা প্রান্তে ভক্তি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। তেমনই কর্ণাটকের শিবসরণের আন্দোলন তার দর্শন এবং বীরশৈব ধর্মের সাথে মিলিত হয়ে পরিণত হয়েছিল একটি বিশেষ ও বিশাল আন্দোলনে। এই বীরশৈব আন্দোলনের ষাটটি সুপরিচিত রহস্যবাদীদের মধ্যে বেশিরভাগই পুরুষ ছিলেন, আক্কা মহাদেবী (মহাদেবীয়াক্কা নামেও পরিচিত) নারী সাধক হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিলেন । তাঁকে কন্নড় সাহিত্যের প্রাথমিক কবিও বলা হয়। তিনি লিঙ্গায়ত শৈব সম্প্রদায়ের ছিলেন। সম্ভবত ১১৩০ খ্রিস্টাব্দে উডুতাডি-তে (কর্নাটকের শিবমোগা জেলার একটি গ্রাম) একটি ধর্মপ্রাণ শৈব দম্পতির একমাত্র সন্তান হিসাবে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ঈশ্বর কান্নামল্লিকার্জুনকে (শিবের একটি অবতার) তাঁর স্বামী হিসেবে মনে করতেন এবং ভক্তির 'মধুরভাব' এ ভালোবাসতেন। তার ৪৩০টি বচন এবং মন্ত্রগোপ্যা ও যোগঙ্গাত্রিবিধ নামে দুটি ছোট লেখাকে কন্নড় সাহিত্যে তার পরিচিত অবদান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মহাদেবী কোনও পোশাক পরিধান করতে অস্বীকার করেছিলেন বলে কথিত আছে। তাঁর বিশাল চুল দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে রাখতেন। তিনি সম্ভবত ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিরোধান করেন (ভক্তদের মতে ভগবান শিবের সাথে একত্রিত হয়েছিলেন)। 

লাল দেদ : 

লাল দেদ ছিলেন ১৪ শতকের কাশ্মীরি শৈব সাধক এবং রহস্যবাদী।  তিনি মা লালা বা যোগিনী লালা বা লালেশ্বরী নামেও পরিচিত। লালেশ্বরীর জন্ম হয়েছিল ১৩০১ এবং ১৩২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাশ্মীরের সেম্পোর বা পান্দ্রেনথানের কাছে।‌ তিনি ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন খুব শিবভক্ত। সেসময়ের বিখ্যাত সিদ্ধপুরুষ শ্রীকান্তের শিষ্য হওয়ার জন্য তিনি ২৪-২৬ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। জ্ঞানলাভের পর নারীর লজ্জা, পোষাকও ত্যাগ করেছিলেন।  মোট ২৮৫টি কবিতা, যা বখ নামে পরিচিত, লালেশ্বরী রচনা করেছিলেন, যেগুলোর প্রত্যেকটিই আকারে সংক্ষিপ্ত কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞানে ভরপুর। তিনি ১৩৭৩-১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে এর মধ্যে মারা গিয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়। 

মীরাবাই :

মীরাবাই ছিলেন ঈশ্বরের প্রতি নিঃস্বার্থ প্রেম ও ভক্তির প্রতীক। তিনি অতিন্দ্রীয়বাদী সংগীতশিল্পী ও সহজিয়া কৃষ্ণ-ভক্ত। তিনি বারোশো থেকে তেরোশো ভজন রচনা করেছিলেন যা ছিল ভক্তিবাদী ধারায় রচিত এবং প্রত্যেকটিই ছিল কৃষ্ণের প্রতি তাঁর প্রেম প্রকাশের মাধ্যম। তিনি ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে অধুনা ভারতের রাজস্থান রাজ্যের একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কথিত আছে যে মীরা যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়সী, তার মা শ্রীকৃষ্ণকে মীরার বর বলে পরিচয় করিয়ে দেন। ছোট্ট মীরার সংশয়হীন মন সেই থেকে কৃষ্ণকেই তার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে। এরপর শৈশবেই চিতোর-রাজ রানা সঙ্গের জ্যেষ্ঠ পুত্র ভোজ রাজের সাথে মীরার বিয়ে হয়। কিন্তু মীরা সেই বিয়েকে কখনোই প্রকৃত বিয়ে মনে করতেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি উপলব্ধি করলেন যে পার্থিব ভালবাসা-প্রেম-আবেগ সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। একমাত্র শাশ্বত সত্য হলো ঈশ্বরের প্রতি প্রেম। রাজস্থানের অলিতে গলিতে কৃষ্ণভজন গাইতে গাইতে নেচে বেড়াতেন। শেষের বছরগুলোতে সন্ন্যাসিনী হয়ে গুজরাটের দ্বারকায় মীরাকে দেখা গিয়েছিল।  তিনি ১৫৪৭ সালে নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন। তাঁর রচিত ভজনগুলো এখনো ভক্তিগীতি হিসাবে ভারতের সর্বত্র ব্যবহৃত হয়।

অন্ডাল:

অন্ডাল বা কোথাই বা নাচিয়ার বা গোদাদেবী ছিলেন দক্ষিণ ভারতের বারোজন হিন্দু বৈষ্ণব কবি-সন্ত বা আলভারের মধ্যে একমাত্র মহিলা আলভার। তাঁকে দেবী ভূদেবীর অবতার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কথিত আছে পিতা অন্ডালকে শ্রীরঙ্গমের রঙ্গনাথস্বামী মন্দিরে নিয়ে যান এবং বিশ্বাস করা হয় যে বিষ্ণুর শোয়ানো ভঙ্গিতে থাকা অবতার রঙ্গনাথস্বামী অন্ডালকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি পরে মূর্তির সাথে মিশে গিয়েছিলেন। তিনি তামিল সাহিত্যের দুটো বিখ্যাত সৃষ্টি তিরুপ্পাভাই (৩০টি শ্লোক) এবং নাচিয়ার তিরুমোই (১৪৩টি শ্লোক) লেখেন যা এখনও মার্গাইয়ের শীতের উৎসব মরসুমে ভক্তরা আবৃত্তি করে। 

জানাবাই:

জানাবাই ছিলেন একজন মারাঠি আধ্যাত্মিক কবি, যিনি বিষ্ণুর অবতার বিট্ঠলের ভক্ত ছিলেন। সম্ভবত ১৩ শতকের সপ্তম বা অষ্টম দশকে মহারাষ্ট্রের এক নিম্নবর্ণ মাতঙ্গ দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা তাকে পন্ধরপুরে নিয়ে যান। জানাবাই  শৈশবকাল থেকেই  দামাশেতের (নামদেবের পিতা) বাড়িতে দাসী হিসেবে কাজ করতেন। তিনি বিট্ঠলের ভালোবাসা পাওয়ার আকুতি নিয়ে অভঙ্গ (অঙ্গ) ফর্মের অনেক উচ্চ মানের ধর্মীয় শ্লোক রচনা করেছিলেন। তিনি প্রায় ৩০০টি অভঙ্গের রচয়িতা। শোনা যায় যেদিন নামদেবজী তিরোধান করেন সেদিন জানাবাইও বিট্ঠলের নাম নিতে নিতে পন্ধরপুরের বিট্ঠল মন্দিরের সামনে অদৃশ্য হন এবং বিট্ঠলের সাথে মিশে যান।

 

আনন্দময়ী মা (ছবি - উইকিপিডিয়া) 

আনন্দময়ী মা:

আনন্দময়ী মা ছিলেন একজন হিন্দু আধ্যাত্মিক সাধিকা যিনি চিরআনন্দের মূর্ত প্রতীক বা আনন্দ স্বরুপ। তিনি "মানুষ কালী", অর্থাৎ 'জীবন্ত কালী' নামে পরিচিত ছিলেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন।‌ ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে দৈবশক্তির লক্ষণ দেখা দেয়। তখন থেকেই হরি নামকীর্তন শুনে আত্মহারা হতেন। তিনি সিদ্ধেশ্বরীতে কালীমন্দির (১৯২৬) প্রতিষ্ঠা করে ধর্মকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। এই মন্দিরেই একদিন দিব্যভাবে মাতোয়ারা হয়ে নির্মলা আনন্দময়ী মূর্তিতে প্রকাশিত হন এবং তখন থেকেই তাঁর নাম হয় আনন্দময়ী মা। তাঁর একটি বিশেষ কীর্তি হলো প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান নৈমিষারণ্যের পুনর্জাগরণ ঘটানো। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ আগস্ট তিনি দেহত্যাগ করেন।

সারদাদেবী: 

সারদাদেবী ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করা এক হিন্দু মহিলা সাধক যিনি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের স্ত্রী ও সাধনসঙ্গিনী।  সারদামণির জন্ম ২২ ডিসেম্বর ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটীতে। ছোটো থেকেই সারদামণির‌ মাঝে মাঝে দিব্য অভিজ্ঞতা হত।  ১৮৫৯ সালে পাঁচ বছর বয়সেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে সারদামণির বিয়ে হয়। তিনি উপলব্ধি করেন যে শ্রীরামকৃষ্ণ সত্যিই এক মহান আধ্যাত্মিক গুরু। এইসময় সারদা দেবী ও দিব্য মাতৃকাকে অভিন্ন জ্ঞান করে শ্রীরামকৃষ্ণ ষোড়শী পূজার আয়োজন করেন। কালীর আসনে বসিয়ে পুষ্প ও উপাচার দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পূজা করেন তাকে। সারদা দেবীকেও তিনি দেবীর অবতার বলে মনে করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং ভক্ত ও শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তারা যেন শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা দেবীকে ভিন্ন সত্তা না ভাবে। ১৯২০ সালের ২০ জুলাই কলকাতার উদ্বোধন ভবনে তার প্রয়াণ ঘটে।

ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও তার সাধন পদ্ধতির ইতিহাসে নারী সাধকদের আধ্যাত্মিক ঘটনাবলী ভক্তিযোগের জীবন্ত প্রমাণ। এই মহিলা সাধকরা তাদের অটল ভক্তি, গভীর প্রজ্ঞা এবং নিঃস্বার্থ সহানুভূতির মাধ্যমে, জাতির আধ্যাত্মিক দৃশ্যপটে একটি অমোঘ ছাপ রেখে গেছেন‌।

 

0 Comments
Leave a reply