জাতীয়তাবাদ থেকে জাতিকে ভিন্ন করে দেখা অত্যন্ত জরুরি। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, জাতি সৃষ্টি হয়েছে সত্যের জোরে, কিন্তু জাতীয়তাবাদ সত্য নয়। জাতীয়তাবাদ তা জাতি, ধর্ম, ভাষা বা রাষ্ট্র যাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠুক, তার পেছনে অন্য জাতি, অন্য ধর্ম, অন্য ভাষা বা অন্য রাষ্ট্রকে তুচ্ছ, অবজ্ঞা, উপেক্ষা, ঘৃণা বা গ্রাস করার ভাবনা নিহিত। জাতি 'অপর' নিরপেক্ষ থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয়তাবাদ 'অপর' এর সঙ্গে বিভেদটিকে প্রকট না করলে তার অস্তিত্বই ধোপে টেকে না। এক জাতি আরেক জাতির সঙ্গে মিলনের সম্পর্ক তৈরি করতে পারলেও, এক জাতীয়তাবাদ আরেক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে কখনোই মিলতে পারে না। যখন কোনো জাতি মনে করে সে বঞ্চিত বা শোষিত কিংবা যখন কোনো জাতির মনে অন্য জাতিকে শোষণ বা শাসন করার ইচ্ছা তৈরি হয় উভয়ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদের জন্ম হতে পারে। পশ্চিমী জাতীয়তাবাদ যদি দ্বিতীয়টির উদাহরণ হয়, তাহলে ভারত থেকে পাকিস্তানের, পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জন্ম প্রথমটির উদাহরণ। ইতিহাস থেকে আমরা শিখতে পারি, পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য সফল হলেও, পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কারণ জাতীয়তাবাদ শোষণ কিংবা বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করলেও, উন্নত দেশ বা জাতির সর্বজনীন গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না।
ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার ইতিহাস অন্তত বাঙালির অজানা নয়। আমরা ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ বাংলাদেশের ভাষাভিত্তিক সংগ্রাম দেখেছি। ১৯৫৬ তে বাংলা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পুরুলিয়া জেলার বঙ্গভুক্তির লড়াই দেখেছি। ১৯৬১ তে আসাম-বরাক উপত্যকায় বাঙালিদের ভাষার জন্য শহিদ হতে দেখেছি। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত ভাবেই কিছুদূর সদর্থক। এবং সে কারণেই বাঙালিকে তার ভাষাগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের জন্য নিজের রাষ্ট্রের শাসকের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। কেন হয়েছে ? কারণ প্রতিটি ক্ষেত্রে শাসক ছিল অন্য একটি ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নিতো, যদি আসাম সরকার বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইতো, যদি বিহার গভর্নমেন্ট বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করে দিতে অপ্রস্তুত না থাকতো, তাহলে এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম কি আদৌ হতো? ইতিহাসের এই অভিজ্ঞতা থেকে বাঙালির শিক্ষা কী হওয়া উচিত ? জাতীয়তাবাদের প্রতি ঘৃণা নাকি জাতীয়তাবাদ থেকে জাতিকে দূরে সরিয়ে রাখার শিক্ষা নেওয়া? একটি জাতিকে তার স্বদেশেই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য লড়তে হয়, সেখানে ভিন্ন একটি জাতি কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ চালু আছে বলেই। জাতীয়তাবাদ না থাকলে কখনোই কোনো জাতিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পেতে বেগ পেতে হয় না। অর্থাৎ একটি জাতীয়তাবাদের জন্ম আসলে অনেকগুলো জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রেক্ষাপট নিশ্চিত করা।
মাতৃভাষার প্রতি মানুষের অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিজস্ব মাতৃভাষার সঠিক ইতিহাস ও ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তন জানা থাকলে ভাষা কেন্দ্রিক মৌলবাদী মানসিকতার জন্ম হয় না। গোরা নিজের জন্ম পরিচয় জানতো না বলেই 'হিন্দুত্ব' নিয়ে তার ওইরকম একরোখা, ভয়ঙ্কর আত্মম্ভরী অবস্থান তৈরি হয়েছিল। যে মুহূর্তে সে নিজের জন্ম পরিচয় জানতে পারে, তার মানসিক পরিবর্তন হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে ভারতীয়ত্বের প্রকৃত স্বরূপ। ইংরেজির মতো বাংলাও পরনির্ভরশীল একটি নবীন ভাষা। দেওয়া-নেওয়ার সংস্কৃতি তার রক্তের গভীরে। হাজার বারোশ বছর আগে ভাষাটির জন্ম। আর্যদের প্রমিত উপভাষা যাতে শিষ্টজনেরা কথা বলতেন তাঁকে পাণিনি বলেন 'ভাষা' এবং বাকি সমস্ত উপভাষাগুলোকে বলা হয়, 'অপভাষা'। এই অপভাষা গুচ্ছের একটি মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশ থেকে অবহট্ট থেকে বাংলা, আসাম ও উড়িয়ার জন্ম। ভাষা আসলে একগুচ্ছ উপভাষার সমষ্টি। কোন উপভাষাগুলোকে একই ভাষার অন্তর্গত ধরা হবে, সেটি ঠিক হয়, না শিখেও দুটি উপভাষার মানুষ পরস্পরের ভাষা কতটা বুঝতে পারছেন এবং তাঁরা একে অপরের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে নিজদের এক মনে করছেন কি না। যে কারণে একসময় অনেক পণ্ডিত উড়িয়া বা অসমীয়াকে বাংলা ভাষা মনে করতেন। সে কথা বাদ দিলেও বাংলা ভাষার বৃহত্তর ভূগোলের উপভাষাগুলোর মানুষদের একে অপরের ভাষা বোঝা-না-বোঝা, বা নিজেদেকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে ভিন্ন ভাবা নিয়ে সমীক্ষা চালানো যেতে পারে। সিলেট বা নোয়াখালির যে বাংলা তা পুরুলিয়ার বা বাঁকুড়ার বাংলা ভাষী কতটা বুঝতে পারবেন, কিংবা কোলকাতা ও ঢাকা শহরের মানুষেরা এঁদের ভাষাটা কতটা বুঝতে পারেন ? যদি বলি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক একতার কথা, তাহলেও সমীক্ষা করে দেখতে হবে, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গভু্ক্তিতে সামিল হওয়া পুরুলিয়ার কতজন মানুষ নিজেদের বঙ্গ রাজনীতি ও সংস্কৃতির অংশ মনে করতে চান নাকি বিহারের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গেই তাঁদের মানসিক যোগ বেশি। ইতিহাস বলছে, আন্দোলন চলাকালীন প্রচুর মানুষ কিন্তু বিহারে থাকার পক্ষেও ছিলেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের কতজন মানুষ এখনও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মিকতা অনুভব করেন, তার সমীক্ষাও নেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ যাকে আমরা বাংলা ভাষা ( আত্মিকভাবে যুক্ত মনে করা উপভাষার সমষ্টি) মনে করি, তার ভূগোলে মারাত্মক বৈচিত্র্য আছে, এবং জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তারা সবাই যে কোলকাতা বা ঢাকা কেন্দ্রিক ভাষা জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করবে না, এটা বুঝে নেওয়াও জরুরি। এমনকি ভাষাগত জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে বাংলা ভাষাটাই যে আরও বহু টুকরো হয়ে যাবে না তাই বা কে বলতে পারে ?
জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার প্রশ্নে যেমন আত্ম অহংকার থাকে, তেমনি নিজেদের বঞ্চিত ভাবার কারণেও জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। ভারতে অন্য রাজ্যে বাঙালি বঞ্চিত হচ্ছে, বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষেরা কর্মক্ষেত্রে উপেক্ষিত, অবহেলিত বা লাঞ্ছিত হচ্ছে, তাই বাংলায় ভাষাভিত্তিক একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি, এমন বক্তব্যে বেশ একটা শিহরণ তৈরি হতে পারে। হিন্দি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতার অর্থ কখনো বাংলা জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলা হতে পারে না। এটা একধরনের ধর্মীয় উগ্রবাদের মতোই, বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে হিন্দুরা বিপদে আছে বলে ভারতে হিন্দুত্ববাদ গড়ে তোলার মতো। আমি যদি মনে করি অন্য কোনো জাতীয়তাবাদ আমার জাতির অধিকার হনন করছে তাহলে আমাকে সেই জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করতে হবে, কিন্তু বিকল্প একটা জাতীয়তাবাদ গড়ে তুললে আমার দ্বারা কি অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? পশ্চিমবঙ্গে বাংলা যাদের মাতৃভাষা নয় এমন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা কি বাংলা জাতীয়তাবাদের চাপে বিপন্ন হতে পারে না? পুরুলিয়াতে যখন বাংলা ভুক্তির আন্দোলন চলে তখন ওই অংশের কুর্মী, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি ভাষাভাষী মানুষদের ভাষাগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কতটা রক্ষিত হয়েছিল? বাংলাদেশে চাকমা, গারো, হাজং, পাংখোয়া এদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কি রক্ষিত হয়েছে? অন্য ভাষা বাদ দিলাম, কোলকাতা কিংবা ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলা উপভাষা অন্যান্য উপভাষাগুলোর উপর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেনি? পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে প্রমিত উপভাষা বাদ দিয়ে বাকি উপভাষাগুলোকে 'অপভাষা' বলেছিলেন। আধুনিক অনেক ব্যাকরণেই মান্য চলিত বাদ দিয়ে অন্য উপভাষাকে ইতর জনের ভাষা বলে শ্রেণিবিভজান করা হয়েছিল। এও আসলে ভাষা কেন্দ্রিক ক্ষমতার কলোনিয়াল মনোভাব। যাঁরা কোলকাতার মান্য চলিত ভাষায় কথা বলেন না, তাঁদের পশ্চিমবাংলার মান্য সরকারি বাংলার শিক্ষা, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন করে ভাষা শিখতে হয়। পুরুলিয়ার একটি শিশুকে কোলকাতার বাংলায় তাঁর সৃজনশীল ভাবনা প্রকাশের ভাষাগত বাধা কতটা অতিক্রম করতে হয় তার অভিজ্ঞতা না থাকলেই কেউ কোলকাতা কেন্দ্রিক ভাষা জাতীয়তাবাদের অংশ হিসেবে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া বা মালদা, দিনাজপুরকে শরিক ভাবতে পারেন। এই ব্যবধান স্বীকার করলে বলতে হয়, ভাষাগত দূরত্বের কারণেই অন্যন্য উপভাষার মানুষের প্রতিভার বিকাশে এক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হয়। শিশুকে জন্মের থেকে অন্যের ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে বাধ্য করিয়ে কখনোই তার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। এই অপূর্ণতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষগুলোকে সারাজীবন বহন করতে হয়। বাংলা ভাষার বিস্তীর্ণ ভূগোল ও সেখানে প্রচলিত ভিন্নতর বাংলা উপভাষা জনিত সমস্যা তুলে এনে আমি বলতে চাই না, এই কারণেই বাংলার অনেক উপভাষার মান্য চলিত থেকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া জরুরি। এমনভাবে ভাঙতে থাকলে ভাঙন যে শেষ হবার নয়, সেই সংকটকেই আমি তুলে ধরতে চাইছি। বরং ভাষাগত কারণে একটি জাতি বা উপভাষার লোকেদের বঞ্চনার দিকটি কীভাবে এড়ানো যায় তার সঠিক মীমাংসা দরকার।
জাতির বঞ্চনার প্রশ্নে জাতীয়তাবাদ গড়ে না তুলে জাতির অধিকার আদায়ে ব্যক্তির দাবিকে এগিয়ে দেওয়া জরুরি। জাতীয়তাবাদ ব্যক্তির দাবিকে উপেক্ষা করে বলেই সে অপর জাতি শুধু নয়, নিজের জাতির কোনো ব্যক্তির বিপরীত ভাবনার কদর করে না। যে কারণে ভাষা বা রাষ্ট্র কিংবা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে স্বজাতি, ধর্ম কিংবা স্বদেশের মুক্ত চিন্তার মানুষকেও বিরোধিতা করে শাস্তি পেতে হয়েছে। বাংলাদেশে তসলিমা নিজে মুসলিম হলেও তাঁর মুসলিম মৌলবাদ বিরোধী অবস্থান নিজের জাতির মানুষ সহ্য করেননি। ভারতে হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতায় হিন্দু কোনো ব্যক্তিকেও একইভাবে শাস্তি পেতে হতেই পারে। একই ঘটনা ঘটবে ভাষা ও রাষ্ট্রবাদেও। ইতিহাসের নির্মম প্যারাডক্স হলো, জাতি বা ভাষাগত অধিকারের দাবি নিয়ে একটা জাতি অন্য জাতির থেকে রাজনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হলে বা স্বাধীনতা আদায় করলেও, ভাষা বা জাতিগত কারণেই সেই জাতির প্রতিটি মানুষের মুক্তি ঘটেনি, শোষণের অবসান হয়নি। ভাষাগত কারণে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ বা বঙ্গভুক্তি হওয়া পুরুলিয়ার মানুষ কি সকলেই সমানাধিকার পেয়েছে ? কেউ কি এমন দাবি করতে পারবে, ভাষাভিত্তিক তীব্র জাতীয়তাবাদী একটি জাতির একজন নাগরিক আর একজনকে ভাষাগত একাত্মতার কারণে কখনো শোষণ করবে না? ইংরেজ বঙ্গভঙ্গ করতে চাইলে যাঁরা ভাষার দাবিতে এর বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ধর্মভিত্তিক ভারত ভাগের সময় বাংলা ভাগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এই আশ্চর্য প্যারাডক্স কেন? ভাষা কেন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে যেতে পারলো না? ধর্মই বা কেন ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে এক হতে পারলো না? এর প্রকৃত উত্তর হলো, ক্ষমতা দখলের অভীপ্সা। ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ ও ১৯৪৭ এ দেশভাগের পক্ষে ও বিপক্ষে যাঁরা সক্রিয় আন্দোলন করেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কোন ভাগ কোন দিকে গেলে এঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা কেমন প্রভাবিত হতে পারে, সেই হিসেব-নিকেশ অনুযায়ী এঁদের অবস্থান অদলবদল হচ্ছিল। সাধারণ মানুষ দেশভাগের যন্ত্রণাটাই পেয়েছেন, তার কোনো সুফল তাঁরা পাননি।। ফলত, যে কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের স্বার্থপূরণের রাজনৈতিক কৌশল হয়ে দাঁড়ায় এই অভিজ্ঞতাও ঐতিহাসিক সত্য। ফলত, সাধারণ মানুষের শোষণের অবসানে কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সার্বিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে না। এর মূল কারণ হচ্ছে, ব্যক্তির দুঃখ, কষ্ট, ভাবনার কদর জাতীয়তাবাদে নেই। এটি আসলে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের তৈরি করা 'বাদ' মাত্র, যা তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। একবার ক্ষমতা তাঁদের হাতে এসে গেলে তাঁরা নিজেরাই স্বজাতি, স্বভাষার, স্বধর্মের মানুষকেই শোষণ করতে শুরু করে।
তাহলে শোষণের অবসান কীভাবে হবে ? জাতি বা ভাষা বা ধর্মের দাবিগুলোর কী হবে ? শোষণ একটি আদিম প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তি পূরণে শোষকেরা ভিন্ন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নেয়। সে কৌশল কখনো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, কখনো রাষ্ট্রবাদ, কখনো ভাষা ভিত্তিক বিভাজনের নীতিকে কাজে লাগানো হয়। যে কারণে সারা পৃথিবী এক ধর্মের, এক ভাষার, এক জাতির, এক রাষ্ট্রের হয়ে গেলেও শোষণ থাকবে। কারণ শোষণের মূল জাতি, ধর্ম, ভাষা বা রাষ্ট্রীয় বিভিন্নতা নয়, শোষণের মূল হলো, মানুষের ভিতরে ক্ষমতা প্রবৃত্তি। বাংলাদেশের তাত্ত্বিক বক্তা মানস চৌধুরী যে কারণে সল্লিমুল্লাহ খানকে বলেন, সারা বাংলাদেশটা বাংলা সাইনবোর্ডে ভরিয়ে দিলেও কি শোষণের অবসান ঘটবে ? না ঘটবে না। অতএব যখনই আমাদের কাছে এমন প্রস্তাব আসবে যে ভাষা, ধর্ম বা রাষ্ট্র বাদের প্রশ্নে আমরা শোষণ মুক্ত হতে পারি, পত্রপাঠ সে প্রস্তাব নাকচ করা উচিত। শোষণের অনেকটা হ্রাস হতে পারে, যদি আমরা ব্যক্তি মানুষের অধিকারে জোর দিতে পারি। কে বাঙাল, কে ঘটি, কে বহিরাগত কে ভূমিপুত্র, কে হিন্দু কে মুসলিম, কে ব্রাহ্মণ কে শূদ্র, কে শিয়া কে সুন্নি এরকম শত সহস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডিতে বিভক্ত না করে আমরা যদি কে অত্যাচারি আর কে অত্যাচারিত এই দুভাগে মানুষকে চিহ্নিত করতে পারি, তাহলেই বোধহয় ন্যায়ের অনেকটা কাছাকাছি আমরা যেতে পারি। মানুষ আগে জাতি হয়েছে, তারপরে ব্যক্তি। জাতি থেকে ব্যক্তিতে উত্তরণ ঘটা জরুরি, ব্যক্তির পুনরায় জাতিতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ এই ব্যক্তি মানুষের আন্তর্জাতিক পরিচয় খুঁজতে চেয়েছেন। শেষ এই কথাটি বলেই এ লেখা শেষ করবো, ওরা এরকম আমাদের সাথে করছে, আমরা যদি নিজেদের ঐক্য ও স্বার্থ খেয়াল না করি, তাহলে আমাদের কী হবে, এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হলো, ওরা যেরকম করছে ওরকম আমরাও করলে, উভয়েই একদিন আরও অজস্র ভাগে বিভক্ত হতে থাকবো, অথচ আমাদের কারোরই বড়ো কোনো মঙ্গল হবে না। অপরের সঙ্গে সংঘাতের সম্পর্কে না গিয়েও নিজের ভাষা, জাতি, ধর্মের ঐতিহ্য, স্বাতন্ত্র্য, মৌলিকত্ব কীভাবে রক্ষা করা যায় সে ভাবনা ভাবাই গভীর চিন্তার লক্ষণ। আমাদের যে জাতীয়তাবাদের যুক্তি দিতে হয়, এটিই আমাদের কাছে দুর্ভাগ্যজনক। সে দেওয়ার কারণটি অন্যের আমাদের উপরে শোষণের কারণে হোক, কিংবা আমাদের অন্যের উপর শোষণের ইচ্ছে থেকে।
* বক্তব্য লেখকের নিজস্ব