সেই বত্রিশ বছর আগে সুকুমারের সাথে বিয়ে হয়ে সংসার বেঁধেছিল আসানসোলের লাল পাঁচিলে ঘেরা এই রেল কলোনীর কোয়ার্টারে। সুরমা তো সেই থেকে এই কোয়ার্টার আর তার চারপাশের রেলের মানুষগুলোকেই নিজের করে পেয়েছে। হাতে গুনে বলতে পারবে ক'বার ও বাপের বাড়ি গেছে। আশেপাশের কোয়ার্টারে মানুষগুলোর কেউ ছিল মায়ের মতো, কেউ বান্ধবী, কেউ জা কিংবা দেওর। সুখ দুঃখ সব ওদের সাথেই ভাগ করে নিয়েছে।
সুকুমার আসানসোল স্টেশনের স্টেশন মাষ্টার। সুরমার বাবাও রেলেই চাকরি করতেন। তাই রেলে চাকরি করা পাত্র পেয়ে মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই সুরমার বিয়ে দিয়ে দেন। সেদিন নতুন বউ হয়ে আসা থেকে আজ কতো বছর কতো মানুষের সাথে পরিচয় এই চার দেওয়ালের মধ্যে। কতোজন চাকরি নিয়ে এলো, কেউ বা রিটায়ার করে চলে গেল। একসাথে সিনেমা দেখা, পিকনিক, কারো মেয়ের বিয়ে, বাচ্চার অন্নপ্রাশন, জন্মদিন। কারো বা চলে যাবার আগে মন খারাপে কান্নাকাটি সব কিছুর সাক্ষী থেকেছে সুরমা। কখনো বিরাট আনন্দ অনুষ্ঠানে হইচই, কখনও বা বিষাদে একে অপরকে স্বান্তনা দিয়ে কেটে গেছে এতোগুলো বছর। এবার ওদের যাবার পালা। সুকুমার রিটায়ার করেছে মাস ছয়েক হলো, কোয়ার্টার ছাড়তে হবে। সোনারপুরে ফ্ল্যাট কিনেছে ওরা। সব আস্তে আস্তে ওখানে পাঠানো চলছে, নতুন জিনিসপত্র দিয়ে সুন্দর গুছিয়েছে ফ্ল্যাটটিকে। কিন্তু সুরমাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। সে যে কিছুতেই পুরোপুরি এখান থেকে যেতে নারাজ। আজকাল যেন ও বড় অবুঝ হয়ে গেছে। চুপ করে থাকে, কিছুই বুঝতে চায় না। বোঝানোর অনেক চেষ্টা করে দেখেছে সুকুমার। ও যেন কেমন অসংলগ্ন কথা বলে। এই লাল বাড়িটা তিলতিল করে সাজিয়েছে ও নিজের হাতে। সামনের বাগানের পরিচর্যা করা ফুল গাছ এসব তো ওর, ও কেন যাবে এসব ফেলে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, ওর মানিক বাবলা যে ওই চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে শুয়ে আছে । ওকে ওখানে রেখে মা হয়ে সুরমা কী করে আসানসোল ছেড়ে কোলকাতায় রওনা দেবে? আশেপাশের কোয়ার্টারের সবাই আসে, ওকে বোঝায়। কিন্তু ও নাছোড় হয়ে বসে আছে। এই মানুষগুলো তো ওকে বাবলার চলে যাওয়ার দিন প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছিলো। ও তো ওদের কাছেই নিজের কষ্টটা বোঝাতে পারতো। আজ ওরাও কেমন পর হয়ে গেছে। শুধুই যাবার কথা বলে। সুরমা এখন কাউকে আর বিশ্বাস করতে চায় না।
এই তো, কদিনই বা হয়েছে? বাবলার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। বাড়ি ফিরেই ব্যাট হাতে খেলতে ছুটেছিল মাঠে। দৌড়ে লাইনটা পার হবার সময় চার নম্বর লাইনে এক্সপ্রেস ট্রেনটা ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলেছিল ওকে। আর তো ফেরা হয়নি ওর। প্ল্যাটফর্মে শুয়েছিল তো বাবলা। তারপর হসপিটাল, শ্মশান। সব শেষ। ওই ভয়ঙ্কর সময়টা ওদের স্বামী স্ত্রীকে বাকি কোয়ার্টারের সকলে ভীষণভাবে আগলে রেখেছিল। ওদের কষ্টে প্রতিটা ঘর কেঁদেছিল। ছোট্ট বিল্টুকে সুরমার কোলে তুলে দিতে দ্বিধা করেনি পল্লবী, আসানসোল স্টেশনের টিকিটচেকার বিজয়ের স্ত্রী।
অথচ আজ যেন কেউ পাশে নেই। সবাই যেন বিদায়ের জন্য মনে মনে প্রস্তুত। সুরমা কিছুতেই বোঝাতে পারছে না, গত বত্রিশটা বছর এই ছিল ওর জগৎ, এর বাইরে ও কিছু চেনে না, কিছু জানে না। ওর বাবলাও যে থেকে গেছে এই কলোনীর আকাশে বাতাসে। ওর মা ডাক শুনতে পায় সুরমা কান পাতলেই। ও এই ঘর ছেড়ে যেতে পারবে না। ছেলেকে ফেলে কলকাতায় যাবে কী করে?
*
দেখতে দেখতে যাবার দিন এসে গেল। কাল সকালে গাড়ি আসবে। আসানসোলের সমস্ত পুরোনো কলিগ, নতুন জয়েন করা কর্মচারীদের সাথে সৌজন্য দেখা সাক্ষাৎ বিকেলের দিকে সেরে এসেছে সুকুমার। আশেপাশের সবাই কতো উপহার মিষ্টি যে দিয়ে গেছে, গাড়ির ডিকিতে সব ধরলে হয়। সুরমা গোঁজ হয়ে হাঁটু মুড়ে খাটের ওপর বসে বিড়বিড় করে অনেক কথা বলে চলেছে। ওর বান্ধবীরা ওকে জড়িয়ে কতো কান্নাকাটি করছে সেদিকে বিশেষ হুঁশ নেই। সবাই বোঝাচ্ছে, কথা দিয়েছে কলকাতায় দেখা করতে যাবে ওর সাথে। সুকুমার বেশ চিন্তিত ওকে কাল সামলিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে। রেল হাসপাতালের ডাক্তার অরুনণোদয় কে সুরমা খুব বিশ্বাস করে, ভালোও বাসে খুব। বাবলা চলে যাবার পরপরই ও হাসপাতালে জয়েন করেছিল। সুরমা বাবলার ভাগের ভালোবাসা উজার করে দিয়েছিল ওই জুনিয়ার ডাক্তারকে। সে কথা দিয়েছে কাল যাবে ওদের সাথে। ছুটি নিয়েছে তিন দিনের জন্য। এটাই বড় ভরসা সুকুমারের। সব গুছিয়ে মিটিয়ে রাত প্রায় দেড়টা। সুরমা কাত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হালকা একটা ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে ওকে সন্ধ্যেবেলা। সুকুমার ঘড়িতে অ্যালার্ম লাগিয়ে, অরুণোদয়ের মোবাইলে বেরোনোর সময়টা মেসেজ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।
হঠাৎ চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় সুকুমারের। কে যেন ওর নাম করেই ডাকছে। একটু খেয়াল হতেই বুঝতে পারে স্টেশনের ঝাড়ুদার বিমলদার গলা।
"সুকুমারদা, তাড়াতাড়ি বাইরে আসুন। সর্বনাশ হয়ে গেছে। দাদা ও দাদা।"
সুকুমার ধড়মড় করে উঠে বসে খাটের ওপর। পাশে সুরমা নেই। এক মুহূর্তে মনটা হু হু করে ওঠে। ছুটে বেরিয়ে আসে বাইরে।
বিমলদা হাঁফাচ্ছে। - "দাদা, ভোরবেলা রোজকার মতো স্টেশনে ঝাড় দিচ্ছিলাম। হটাৎ দেখি বৌদি চার নম্বর লাইন ধরে ছুটছে। বাবলা খোকাবাবুর নাম করে ডাকছে আর ছুটছে। তখনই তো ডাউন মোঘলসরাই এক্সপ্রেস ওই লাইনে আসছিল। আমি চিৎকার করে বৌদিকে অনেক সাবধান করলাম। কোন কথা শুনলো না বৌদি।"
সুকুমারের কানে কেউ যেন গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে। কথাগুলো সব ভাবনা চিন্তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।
"বিমলদা তুমি পারলে না?" - অস্ফুটে বলে ওঠে সুকুমার। চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।
বিমলদা বলে যায় হড়বড় করে, "না না দাদা, যখন দেখলাম বৌদি আমার কোন কথা শুনছে না, আমিও পিছনে ছুটতে থাকি। অনেক কষ্টে হাতে ধরে লাইন থেকে টেনে পাশে সরাতে পেরেছি। কিন্তু খোয়ায় পড়ে বৌদি অজ্ঞান হয়ে গেছে। মাথায়, হাতে, পায়ে চোটও পেয়েছে অনেক। নতুন স্টেশন মাষ্টারবাবু হাসপাতালে ফোন করে বৌদিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। আপনি একটু তাড়াতাড়ি চলুন।"
সুকুমার মানিব্যাগ আর মোবাইলটা নিয়ে বিমলদার স্কুটিতে চেপে হাসপাতালে রওনা দেয়। এখনও আশা আছে তবে। ওকে বাঁচাতেই হবে। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে না সুকুমার। ও সেদিন ছেলেকে ফেরাতে পারেনি। সেদিন তো ট্রেনটা তিন নম্বরের বদলে চার দিয়ে ছুটেছিল ওরই ইশারায়। বারবার নিজে অ্যানাউন্স করেছিল, "চার নম্বর লাইন দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে। কেউ লাইন পারাপার করবেন না। চার নম্বর প্লাটফর্মের কাছ থেকে সবাই সরে দাঁড়াবেন"। তবুও অঘটনটা সেদিন ঘটেই গেছিল ওরই ছেলের সাথে। আর আজ শেষ বিদায়ের আগে এই আসানসোলে সুরমাকেও রেখে যেতে হবে ওকে?
সারা কলোনীতে খবর ছড়িয়ে গেছে। সবাই প্রায় ছুটে এসেছে হাসপাতালে। এখনও ডাক্তার কিছু জানায়নি। সবাই উদ্বিগ্ন। সুকুমারের পাশে তার হাতটা ধরে বসে আছেন বিমলদা।
ডাক্তার অরুণোদয় বেরিয়ে আসেন। ইশারা করে কেবিনে যেতে বলেন সুকুমারকে। সুকুমার ঢুকতেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে সুরমা। হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ। লাল রক্তের ছাপ সাদা ব্যান্ডেজে। সুকুমার জড়িয়ে ধরে সুরমাকে।
"তুমি আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছিলে?" সুরমা আঁকড়ে ধরে সুকুমারকে। অঝোরে কাঁদতে থাকে।
"আমাকে কলকাতায় নিয়ে চলো, আমি এখানে থাকবো না। আমি তোমার কাছে ভালো হয়ে থাকবো, আর এমন করবো না। ট্রেনের হুইসেল থেকে অনেক অনেক দূরে আমাকে নিয়ে চলো তুমি। ওই শব্দ আর শুনতে চাই না। চলো আমরা কলকাতায় যাই। এখান থেকে দূরে।"
সবাই যে দেখা করতে এসেছে সুরমার সঙ্গে, কিন্তু ও আর ফিরে তাকাতে চায় না। এই আসানসোলের সব দুঃস্বপ্ন ভুলতে চায় ও। চোখ নীচের দিকে, মাথা নীচু। সুকুমার আর অরুণোদয়ের কাঁধে ভর দিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠে সুরমা। কলোনীর সকলের চোখে তখন জল। জানলায় বসা সুরমার উদ্দেশ্যে সবাই হাত নাড়ছে। সুরমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর চোখ স্হির ওই নীল আকাশের দিকে। ও ফিরে যাচ্ছে স্বামীর সাথে যার হাত ধরে ও এসেছিল এক নতুন শহরে। আজ ফিরে যাচ্ছে নতুন এক জীবনে যেখানে ওরা একে অপরের অবলম্বন, সঙ্গী। আসা আর যাওয়া - মাঝে পড়ে থাকে হাহাকার ভরা ধূ ধূ প্রান্তর।