মূল ইংরাজি থেকে অনুবাদ - অপূর্ব দাশগুপ্ত
অনেক সময় মনে হয় আমরা বামন যুগে বাস করছি। চারপাশে বালখিল্যদের কোলাহল, অহঙ্কার এবং বিদ্বেষের অন্ত নেই, কিন্তু কোথায় সেই উল্লম্ব মানুষ, বীর্য এবং করুণা, জ্ঞান এবং বিবেকিতা, কল্পনা ও কর্মিষ্ঠতার সমন্বয়ে যে সমৃদ্ধ। মানুষের মধ্যে আত্মসৃজনের যে অফুরন্ত সম্ভবনা বিদ্যমান, কোথায় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ? ……
সৌভাগ্যবশত উনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে বঙ্গদেশে এমন কিছু স্ত্রী-পুরুষ দেখা দিয়েছিলেন যাঁদের চিন্তা ও ক্রিয়াকর্মের ফলে বঙ্গে মনুষ্যত্বের নবজাগরণ ঘটে। রামমোহনে এই নবজাগরণের সূচনা, বিদ্যাসাগর স্বয়ং এ স্মরণীয় ইতিহাসের একজন প্রধান পুরুষ। তাদের সঙ্গী এবং অনুসারক হয়েছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি। বঙ্গীয় নবজাগরণের অন্তিমপর্বের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্রনাথ রায়।
-শিবনারায়ণ রায়
এই বিপ্লবী দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর জীবন-কাহিনীর কিছু অংশ (১৯১৫-১৯২৩) লিখে যেতে পেরেছিলেন। The Radical Humanist এবং অন্য কয়েকটি পত্রিকায় লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। মানমেন্দ্রনাথের সহধর্মিনী এলেন রায় লেখাগুলি সম্পাদনা করে পুস্তক আকারে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন। বই প্রকাশিত হয় কিন্তু এলেন তা দেখে যেতে পারেননি। পুরগামী পত্রিকায় রায়ের মূল ইংরেজী থেকে তাঁর স্মৃতিকথার প্রথম অধ্যায়ের অনুবাদ প্রকাশিত হল। - অপূর্ব দশগুপ্ত
এ শতকের প্রথম পর্বে স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় সিকি শতাব্দী পূর্বে, পরাধীনতা থেকে মুক্তির অন্য আরও একটি আকর্ষক সম্ভবনার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। সেই পন্থা দুঃসাহসিক নিষ্ফল এক অভিযানের দিকে এদেশের যুব-সমাজকে ঠেলে দিয়েছিল।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বাধলে, ভারত থেকে বহিষ্কৃত বিপ্লবীদের কাছে জার্মানি ছিল আশার আলোর মতো। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে তারা সে দেশে ছুটে যেতেন। সে বছরের শেষ দিকে আমাদের কাছে খবর পৌঁছলো যে বার্লিনের ‘ভারতীয় রিভোলিউশনারি কমিটি’ জার্মান সরকারের কাছ থেকে ভারতে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও অর্থের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এই সংবাদ ভারত-ভূমিতে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল, যার আঁচ এমন কি ব্রিটিশ সেনাদলের ভেতর ভারতীয় সেনাদেরও ছুঁয়ে গিয়েছিল। বিপ্লব দরজায় কড়া নাড়ছে, অথচ বাস্তবে ঠিক কী যে হতে চলেছে সে সম্পর্কে আমাদের সুনির্দিষ্ট কোন ধারনাই ছিল না তখন। তা না থাক, তবু বিপ্লব তো এসে গেছে। এদিকে কাল্পনিক লক্ষ্যবস্তু হাতের নাগালে এসে গেছে দেখে বিভিন্ন গোপন বিপ্লবী দলগুলি তাদের চিরাচরিত কুল-বৈরিতা গুটিয়ে নিয়ে এলো। আয়োজিত গুপ্ত সভাগুলি আসন্ন বিপ্লবের জন্যে গড়ে তুললো একটি ‘সাধারণ কর্মী-বাহিনী’, যতীন মুখার্জি হলেন তার কমান্ডার-ইন-চিফ।
প্রারম্ভিক খরচ জোগাড় করার যে ভার আমার উপর পড়েছিল, পরিকল্পনা অনুসারে তা দ্রুতই সুসম্পন্ন হয়ে গেল। এরপরের সমস্যা, কী করে প্রতিশ্রুত অস্ত্র দেশে নিয়ে আসা যায়। জার্মানি থেকে সরাসরি অস্ত্র দেশে নিয়ে আসার প্রশ্ন ওঠে না। জার্মানিরা ভারতের কাছাকাছি কোন একটা নিরপেক্ষ দেশে অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছে দিক, এমন প্রস্তাব নিয়ে একজন প্রতিনিধি বার্লিনে রওনা হয়ে গেলেন। আমদের পছন্দের জায়গা ছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিস।
১৯১৪ সালের শেষ দিকে আমি জাভায় রওনা হয়ে গেলাম, আমার প্রথম বিদেশ সফর। খুব বেশি নয়, তবে কিছু টাকা নিয়ে আমি ফিরে এলাম। কিন্তু জাহাজ ভরা অভিপ্রেত গোলা-বারুদের দেখা পাওয়া গেল না, বুনো হাঁসের পেছনে ছোটার মতোই হয়ে দাঁড়ালো ব্যাপারটা। অস্ত্র আর পৌঁছালো না এ দেশে এবং বোঝা গেল যে পুরো পরিকল্পনাটিই ছিল ধাপ্পা। প্রকৃতপক্ষে এক প্রতারণা।
কিন্তু আমাদের যৌবনোদ্ধত উন্মাদনা, হঠকারী আশাবাদে আস্থা এবং সর্বোপরি জার্মানির ভারতের মুক্তি-আন্দোলনে দায়বদ্ধতার প্রতি আমাদের বিশ্বাস সহজে প্রশমিত হবার নয়। পুনর্বার প্রচেষ্টা নেবার সিদ্ধান্ত হল, নতুন আর একটি পরিকল্পনা গৃহীত হল এবং ১৯১৫ সালের প্রথমদিকে ‘গোল্ডেন ফ্লিস’ এর খোঁজে আমি আবার ভারত ছাড়লাম। আমাদের প্রেয় বিশ্বাস ছিল এই বহুমূল্য জাহাজটি প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে কোথাও ভেসে রয়েছে, আর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম অস্ত্র-বোঝাই এই জাহাজ না নিয়ে আর দেশে ফিরবো না। বাস্তবে যা হল ১৬ বছরের পূর্বে আমি আর দেশে ফিরিনি।
এই ১৬ বছরের অভিজ্ঞতার পূর্ণ বিবরণ কোনদিন হয়ত বলবো। সে গল্প লেখা হবে কোন এক ব্যক্তি মানুষের আত্মজীবনী বর্ণনার তাগিদে নয়, সে সময়কার ইতিহাস নথিবদ্ধ করার প্রয়োজনে। বর্তমান লেখায় আমি শুধু স্মরণ করে দেখবো কেমন করে এম.এন.রায়ের জন্ম হল। যদি ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে সে কাহিনী কোনদিন বলে উঠতে পারি তবে তা ৩০ বছর পূর্বে অকপট এক যুবকের বুনো হাঁসের পেছনে ছোটার কাহিনী বর্ণনা হবে না, তা হবে অন্য আর এক মানুষের চোখে দেখা অভিজ্ঞতার নথি।
জলপথে হাতিয়ার আনার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে বিকল্প পরিকল্পনা অনুসারে স্থলপথে চীন দেশের ভেতর দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসার জন্য আমি দ্বিতীয়বার বিদেশে যাত্রা করলাম। কিছুদিন আগে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘এবর’ (Abor) জনজাতির মানুষদের মধ্যে বিদ্রোহ দানা বেধেছিল, ঠিক হয়েছিল এই অঞ্চলের ভিতর দিয়েই অস্ত্র আনা হবে। আমি যখন বিদেশে পাড়ি দিলাম তখন আমাদের অন্য কমরেডরা, যোগ্য নেতৃত্বের পরিচালনায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে রওনা হয়ে গেল। তাঁদের উদ্দেশ্য হল ‘এবর’ এবং তাদের প্রতিবেশী জনজাতিদের আরেকবার বিদ্রোহে প্ররোচিত করা এবং অবশ্যই সশস্ত্র বিদ্রোহে প্ররোচিত করা।
তার আগে জলপথ দিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে সাহায্য নিয়ে আসার আরেকটি প্রচেষ্টা আমি নিয়েছিলাম। সুমাত্রার দক্ষিণ উপকূলে যে জার্মান জাহাজগুলি নোঙর ফেলেছিল সেগুলি নিয়ে আন্দামান দ্বীপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দামানকে মুক্ত করা, বন্দিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া এবং মুক্তি সেনাদল নিয়ে উড়িষ্যা উপকূলে এসে পৌঁছনো, এই ছিল পরিকল্পনা। জার্মান যুদ্ধ-জাহাজগুলি বিপুলাকার হয়, এই বিপুলাকায় জাহাজগুলিও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। প্রতিটি জাহাজেই গোলা-বারুদ মজুত ছিল। জাহাজগুলি পারিচালনায় নানা শ্রেণির মাল্লা নিযুক্ত ছিল। তাদের অন্তরন শিবির (Internment Camp) থেকে চম্পট দিতে হত, জাহাজ ছিনিয়ে নিয়ে ভেসে পড়তে হত জলে। অল্প পরিমাণ মাল্লা জাহাজে রাখা হত যাতে প্রতিটি জাহাজে প্রয়োজনে বাষ্পের জোগান দেওয়া সম্ভব হয় আর চীনা চোরা-চালানকারীরা যাতে জাহাজগুলিতে শত শত রাইফেল, অন্যান্য ছোট খাটো অস্ত্রশস্ত্র এবং পর্যাপ্ত গোলা-বারুদ দিয়ে ঠেসে দিতে পারে। কিন্তু এত বড়ো ঝুঁকি নিতে জার্মানরা প্রস্তুত ছিল না, কাজেই এই পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হল না। একেবারে শেষমুহূর্তে অস্ত্রের জন্য বরাদ্দ অর্থ এসে পৌঁছাল না এবং যেদিন পরিকল্পনা রূপায়ণের চরম আদেশ ঘোষিত হবার কথা সেদিন জার্মান কনস্যুল জেলারেল আশ্চর্যজনক ভাবে উধাও হয়ে গেল। তবে আমি তাদের কাছ থেকে বেশ মোটা রকমের অর্থ আদায় করতে পেরেছিলাম। আমাদের এবর উপজাতিদের নিয়ে অভিযানের জন্য সেই অর্থ ভারতে পাঠিয়ে দিলাম।
তারপর, নিদারুণ বিরক্তি নিয়ে এবং একবুক আশা নিয়ে আমি জাপানে এলাম। একই পরিকল্পনা নিয়ে রাসবিহারী বোসও তখন সেখানে। কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য হলাম যে রাসবিহারী এরকম একটা মত পোষণ করছেন যে আমাদের ভারতবর্ষকে মুক্ত করার পরিকল্পনা একমাত্র সফল হবে তখনই, যখন আরও বৃহত্তর মিশনটি বাস্তবায়িত হবে, অর্থাৎ জাপান সাদা চামড়ার কবল থেকে এশিয়াকে মুক্ত করবে। তখনো পর্যন্ত আমি ঘোর জাতীয়তাবাদী এবং জাতিগত সংহতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু কী করে ভুলি জাপান ব্রিটিশ-মিত্র। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামে তাদের উপর কি করে আস্থা রাখা যায়? আমার কূটনৈতিক জ্ঞানের অভাব লক্ষ্য করে রাসবিহারী উদারভাবে হাসলেন, জাপান আঁতান্ত (Entente Power) গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে আসলে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। যদি জাপানে ভারতীয় বিপ্লবীরা নিগৃহীতও হন তবু জাপানকে বেকায়দায় ফেলা যাবে না। আমাদের উচিত হবে এশিয়ার নেতৃত্ব যে দেশ দিচ্ছে তার উপর বিশ্বাস রাখা এবং নিজেদের সুযোগের অপেক্ষায় প্রস্তুত রাখা।
এই তত্ত্ব বেশ চিত্তাকর্ষক শোনায় ঠিকই কিন্তু এর উপরে বিশ্বাস রাখা যায়না। সুরক্ষিত এবং আরামপ্রদ্র রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা মিললে অপেক্ষা করা হয়ত যেতে পারে, আস্থা রাখা যেতে পারে সন্দেহজনক জাপানি কূটনীতির ওপর, কিন্তু আমরা কী করে ইন্দো-চীন সীমান্তের উপজাতি-এলাকায় অত্যন্ত অরক্ষিত এবং কষ্টদায়ক অবস্থায় থাকা আমাদের কমরেডদের বিপদের মুখে রেখে নির্লিপ্ত থাকতে পারি? তাছাড়া,রাসবিহারী যে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছিলেন আমার তা ছিল না।
চীনের নানকিং-এ যে অভ্যুত্থান হয়েছিল ইতিহাসে তা দ্বিতীয় চীন বিপ্লব বলে পরিচিত। ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে এই বিদ্রোহ সাধনে ব্যর্থ হয়ে সান ইয়াৎ-সেন তখন জাপানে ছিলেন। আমি নিজের বুদ্ধির উপর নির্ভর করে এই চৈনিক জাতীয়তাবাদী নেতার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আরও ভারিক্কি চালে জাপানের এশিয়াকে মুক্ত করার তত্ত্বটি আমাকে ব্যাখ্যা করে শোনালেন। তিনি আমাকে ধৈর্য ধরতে বললেন, স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন হতেও বললেন। দেশে থাকতে চীনের এই মহান নেতার কথা আমরা অনেক শুনেছি, তাঁকে অবতার ভেবে নায়কের বেদিতে বসিয়ে পূজো করেছি। কিন্তু যখন মুখোমুখি হলাম তখন তাঁর সামনে হাঁটুগেড়ে বসতে আমার বাঁধলো। নায়ক-ভজনার চর্চিত সংস্কারের বিরুদ্ধে দেখা দিল সমবিশ্বাসী কমরেডদের প্রতি আমার আনুগত্য। ততটা সচেতনভাবে নয়, কিন্তু একজন দেশজ জন্ম-ধর্মাদ্রোহীর চ্যালেঞ্জও হয়ত আমার মধ্যে ছিল। সেই স্কুল জীবন থেকেই সহজে কিছু মেনে নেওয়া এবং প্রচলিত মতের বিরোধীতা করার প্রবণতা তো আমার ছিলই; কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।
সান-ইয়াৎ-সেন জাপানের পৃষ্ঠপোষকতায় এশিয়ার মুক্তির মিশনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল জাপান তার নিজের স্বার্থেই এশিয়ার দেশগুলির ইউরোপের অধীনতা থেকে মুক্তির প্রচেষ্টাকে মদত দেবে। জাপানের পরে তার বিশ্বাস ছিল আমেরিকার ওপর। আসলে তাঁর বিশ্বাস খ্রিস্টধর্মের প্রতি। স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্য এশিয়াবাসীর উচিৎ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করা। আমি তখন বয়সে এতই নবীন যে এইসব যুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিযুক্তি দিতে যাইনি। সাদা চামড়ার মানুষদের বিরুদ্ধে এশিয়ার মানুষদের ঐক্য, এই সাধারণ ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে সাহায্যের আবেদন করেছিলাম।
এশিয়ার জাতীয়তাবাদের এই নবী যখন ব্রিটেনের বিরূদ্ধে ভারতের সংগ্রামকে সমর্থন করতে অস্বীকার করলেন তখন এশীয়-জাতি ঐক্যের তত্ত্বে আমার বিশ্বাস নিদারুণ ভাবে ভেঙে পড়ল। তার যুক্তিজাল একেবারে সুযোগসন্ধানীর মত। হংকং এ বসে তিনি দক্ষিণ চীনে অপারেশন চালান, তাই ব্রিটেনের বিরুদ্ধে তিনি কিছু করতে পারছেন না। তাঁর নিজের দেশ চীনকেও তিনি জাপানের ইচ্ছার অধীনে সমর্পন করতে চান। আগে জাপানিরা ইউরোপের শক্তিগুলিকে দেশ ছাড়া করুক, তারপর না হয় জাতি ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে চীন ও জাপান নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে নেবে, এটাই ছিল তাঁর বক্তব্য। তাঁর এই বক্তব্য আমার জাতীয়তাবাদী মননকে নাড়া দিলেও সাধারণ বুদ্ধিতে শ্রুতিকটু লেগেছিল। আর যখন এই সম্ভবনাময় পন্থা আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে শুনলাম, তখন রুষ্ট হওয়া ছাড়া আমার গত্যান্তর ছিল না। জাপান পশ্চিমী শক্তিগুলিকে বিতাড়িত করার পর প্রথমে চীন স্বাধীন হবে এবং তারপর ভারতের সুযোগ আসবে। ততদিন আমরা না কি ধৈর্য্য ধরে বসে থাকবো।
এই সময়, ১৯১৫ সালের শেষাশেষি ইউয়ান শি-কাই (Yuan Shi-kai) নিজে সম্রাট হবার আশায় রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ভারত ও বার্মা সীমান্ত লাগোয়া ইউনান (Yunan) ও সিচুয়ান (Szechuan) প্রদেশ ইউয়ান শি-কাই-এর এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছিল। এই বিদ্রোহ তৃতীয় চীন বিপ্লব বলে পরিচিত। আমি ধরে নিয়েছিলাম যে এই বিপ্লবের অনুপ্রেরণার যোগান দিচ্ছেন চীনের এই নির্বাসিত নেতা। আমি তাঁকে এ প্রস্তাব দিলাম যে ইউনান ও সিচুয়ান প্রদেশ থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র সীমান্তের ওপারে আমাদের দেশের মানুষের হাতে তুলে দিলে যৌথ স্বাধীনতা সংগ্রামে দু দেশের জনসাধারণের মধ্যে একটা কার্যকর মৈত্রিবন্ধন তৈরি হতে পারে। সান ইয়াৎ-সেন বললেন, আমি যেন চীনে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূতের কাছে, বিদ্রোহীদের সমস্ত অস্ত্র কিনে নেবার জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রস্তাব রাখি। যদি এই পরিমান টাকা হাতে আসে তবে সান-ইয়াৎ নিশ্চিত ভাবে ইউয়ান শি-কাই এর সমর্থকদের কিনে নিতে পারবেন আর এই ভাবে তাঁর পতন ঘটাবেন। এই ভাবেই তৃতীয় বিপ্লব সার্থক হয়ে উঠবে। তারপর বাড়তি হয়ে যাওয়া সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সীমান্তের ওপারে তিনি আমার হাতে তুলে দেবেন। ঠিক হল আমি কালবিলম্ব না করে জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করতে পিকিং-এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবো। আমি যদি সফল হই, সেক্ষেত্রে আমার কাছ থেকে সফলতার খবর পেলে তিনি তাঁর গুপ্তচরকে আমাদের চুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে ইউনান (Yunan) পাঠিয়ে দেবেন। এরপর মহামূল্য জাহাজ বাহিত মালের দায়িত্ব আমি পাবো, তাঁর আগে সাংহাই শহরে সান ইয়াৎ-সেনের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে লেনদেন সারতে হবে। তিনি এই রৌপ্য-বুলেটের বিনিময়ে ইউয়ান শি-কাই এর বিরুদ্ধে তাঁর অবমাননাকর কার্যক্রম শুরু করবেন।
এই জমকালো পরিকল্পনা আমার বিপদ-সঙ্কুল অভিযানের স্পৃহাকে বেশ স্পর্শ করলো। শেষ পর্যন্ত, আশা করা চলে দু’এক মাসের মধ্যেই, একটা সেনাদল প্রস্তুত করার মতো গোলা-বারুদ নিয়ে সীমান্তে হাজির হবার স্বপ্ন আমার পূর্ণ হবে। আমার দিক থেকে এই পরিকল্পনা এতোই বিশ্বাসযোগ্য ছিল যে সান ইয়াৎ-সেনের দিক থেকে এটা যে কতটা কল্পনাশ্রয়ী আমি তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলাম। এর বহু বছর পর, চীনের আধুনিক ইতিহাস এবং এ-দেশের নানা বিপ্লব প্রচেষ্টা সম্পর্কে জ্ঞানবৃদ্ধি হবার পর আমি জেনেছিলাম যে সান ইয়াৎ-সেন তৃতীয় বিপ্লবের সফলতা চাননি, কেননা বিপ্লব প্রচেষ্টার নেতা, ইউনান-এর গভর্নর, ছিলেন প্রসিদ্ধ উদারনৈতিক রাজনীতিজ্ঞ-দার্শনিক লিয়ান চি-চাও (Lian Chih-Chao) এর মতাদর্শে বিশ্বাসী। সেটা অন্য আর এক গল্প। সে গল্প আমি বিস্তারিতভাবে আমার ‘রিভোলিউশন অ্যান্ড কাউন্টার রেভোলিউশন ইন চায়না’ বইটিতে লিখেছি।
আমাকে জাপান ছেড়ে যেতে হবে এবং যেতে হবে চীনেই। নাগাসাকিতে যেদিন আমি নেমেছিলাম, সেদিন থেকেই আমাকে তীক্ষ্ণ নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। টোকিওর একজনের ঠিকানা আমার কাছে ছিল। কথা ছিল সে আমাকে রাসবিহারীর সাথে দেখা করিয়ে দেবে। চক্রীসুলভ অনেক প্যাঁচ পয়জারের পর বেশ কিছুদিন বাদে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ সমস্ত কিছু জানতো। পুলিশ প্রধান আমার জাপানে আসার কারণের খোঁজ খবর নিতে যখন হোটেলে এসেছিলেন, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমি আমার বন্ধু রাসবিহারীর সঙ্গে দেখা করেছি কি না? আমি অস্বীকার করায় জাপানি পুলিশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হালকা ঔদ্ধত্যে তিনি হেসেছিলেন। কিছুদিন পর রাসবিহারীর গুপ্ত খবর-বাহক আমাকে জানায় যে ২৪ ঘন্টার নোটিশে আমাকে জাপান ছেড়ে যেতে বলা হবে, সুতরাং আমি যেন অতি সত্বর জাপান ত্যাগ করি। সাংহাইয়ের বহিঃসমর্পণ আইন এড়াবার জন্যেও আমার পালানো প্রয়োজন। পালাতে তো আমি চাই, কিন্তু কী ভাবে? রাসবিহারীর উপরমহলে অনেক জানাশোনা কিন্তু তিনি আমাকে কোন সাহায্য করলেন না, উপদেশও দিলেন না।
জাপানে আমার আর কিছু করার ছিল না। এরমধ্যে আমি ড. সান-ইয়াৎ-সেনের সঙ্গে দেখা করেছি এবং তার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছি। আমাকে যে করেই হোক চীনে যেতেই হবে। তাহলে আর বিলম্ব কেন? আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম যে ভূমি পথে কোরিয়ার মধ্যে দিয়ে চীন পৌঁছাবো। শিকারি কুকুর প্রতিম জাপানি গোয়েন্দাদের চোখে ধূলো দেওয়া সহজ ছিল না। পরদিন বিকেলে শহরের সবচেয়ে বড়ো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলাম। সেখানে বিদেশীদেরও ঢোকার মুখে জুতো ছেড়ে কাপড়ের জুতো পরে নিতে হয়। এই সাত-তলা সুরম্য প্রাসাদের সিঁড়ি, বারান্দা এবং হলগুলি নিষ্কলুষ কার্পেট দিয়ে মোরা। এই ঝকঝকে ম্যাট যাতে রাস্তার ময়লায় কলুষিত না হয় তাই এই ব্যবস্থা। আমি জুতো ফেরত নিতে আর ফিরে এলাম না, অন্য একটা দরজা দিয়ে বেড়িয়ে সোজা পৌঁছলাম রেল স্টেশনে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে শিমনোসেকি (Shimonoseki) থেকে আসা ট্রেন ছেড়ে দিল। আমার ধারণা হল, আমি আমার অনুসরণকারী চারজন গোয়েন্দাকে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি। তাদের মুখের বাঁকা হাসি আমার স্নায়ুগুলিকে বড়ই পীড়িত করছিল। পরদিন খুব ভোরে পুসান (Pusan) নদী পার হয়ে মুকডেন (Mukden) থেকে সিওল (Seoul) এর সরাসরি টিকিট কেটে ট্রেনে উঠেছিলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল সিওলের প্রধান সড়কটি এড়িয়ে যাওয়া। চেমুলপো (Chimoolpo) বন্দর থেকে ইয়েলো সাগর পার হয়ে সানহাইকওয়ান (Shanghikwan) বা তিয়েনসিন (Tientsin) পৌঁছানো। শেষোক্ত স্থানটি ছিল আমার লক্ষ্যস্থল। রাসবিহারী আমাকে বলেছিলেন যে গদর পার্টির একজন নামকরা নেতা জার্মানদের আনুকূল্যে এখানে আছেন। জাপানিদের চোখে ধূলো দেবার ব্যাপারে আরো নিশ্চিত হবার জন্যে আমি আমার যাত্রাপথের মানচিত্রে আরেকটু পরিবর্তন করলাম। আমি সানহাইকওয়ান পর্যন্ত টিকিট কেটেছিলাম, কিন্তু ডাইরেন (Dairen) এ গোপনে নেমে পড়ে মুকডেনের ট্রেন ধরলাম, তারপর সেখান থেকে ধরলাম পিকিংএর ট্রেন। শীতের মরশুমের মাঝামাঝি ইয়েলো সাগর পাড়ি দেওয়া খুব আরামদায়ক ছিল না। জাপানি এই মালবাহী জাহাজের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল খুবই করুণ। পিকিং এর ট্রেনে উঠে আমি এই ভেবে নিশ্চিন্ত হলাম যে আমাকে আর কেউ অনুসরণ করছে না।
যদিও আমার পিকিং অব্দি টিকিট কাটা ছিল কিন্তু আমি সানহাইকওয়ানে নেমে পড়লাম। সে রাত্রি ওখানেই কাটিয়ে পরদিন তিয়েনসিন যাবার লোকাল ট্রেন ধরলাম। প্লাটফর্মে নামতেই একজন ব্রিটিশ, যুদ্ধ-পূর্ববর্তী টিপিক্যাল ঔপনিবেশিক কন্ঠে আলাপ শুরু করলেন, ‘শুভ সন্ধ্যা মিঃ হোয়াইট..’ (এই নামেই আমি জাপানে ছিলাম)। তিনি যেন অন্য কারো সঙ্গে কথা বলছেন এমন ভান করে আমি পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি আমার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন এবং খুবই মধুর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার গন্তব্যের পথে রওনা হওয়ার আগে কয়েক মিনিটের জন্যে আমার সঙ্গে একটু আসতে হলে কি তুমি কিছু মনে করবে?’ আমি জানতে চাইলাম, ‘কোথায় এবং কেন যাবো?’ তিনি বললেন, ‘আমি ব্রিটিশ পুলিশ-চিফ।’ আমি জানতাম যে রেল স্টেশন রাশিয়ানদের অধীনে রয়ছে। সামনের রাস্তার ওপারে জার্মানদের অঞ্চল। আমি শেষবারের মতো মরিয়া চেষ্টা করলাম, ‘আমি দীর্ঘ যাত্রার পর খুব ক্লান্ত বোধ করছি তাই এখন আমি একটা ভাল হোটেলে যেতে চাই। তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে আমি ব্রিটিশ-অধীনস্থ অঞ্চলে নেই।’ তিনি তখন উপযাচকের মতো বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি জানি আমার কি করতে হবে, আমি বেশিক্ষণ আপনাকে আটকে রাখবোনা, এখন আমার সঙ্গে চলুন।’ আমরা বাইরের পথে এলাম, সেখানে একটা মোটর গাড়ি অপেক্ষা করছিল।
থানায় এনে তিনি আমাকে কিছু মামুলি প্রশ্ন করে শেষে বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে আজ রাতটা আপনাকে এখানেই কাটাতে হবে। আমরা যথাসম্ভব আপনাকে আরামে রাখার ব্যবস্থা করবো'। অ্যাসটর হোটেলে (Hotel Astor) আপনার রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। আমরা জাপান থেকে কিছু খবরের প্রত্যাশায় আছি।’ হেরে গেছি বুঝতে পেরে ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘কি করে জানলেন আমি আসছি?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘জাপানি পুলিশ খুবই তৎপর, শুভ রাত্রি।’ তিনি চলে গেলেন আর আমি রয়ে গেলাম দৃঢ় লৌহ গরাদের ভেতর। দুজন বন্দুকধারী আমার পাহারায় দরজায় রইল, তারা দুজনেই শিখ। কিছুক্ষণ পরে এদের পরিবর্তে এলো দু-জন ইংরেজ শান্ত্রী।
এইভাবে বন্দি হয়ে থাকার অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। তাই অস্বাভাবিক মনে হলেও এই অবস্থায় বেশ কয়েক ঘন্টা আমি ঘুমিয়ে নিতে পারি। সকাল হলে এলো প্রাতরাশ এবং তারপর পুলিশ চিফ। ‘তুমি কনস্যুলেটে যাবার জন্য প্রস্তুত তো?’ ‘নিশ্চয়ই’, আমি কথা না বাড়িয়ে তাকে অনুসরণ করলাম। গাড়িতে তিনি আমাকে বললেন আমাকে কনস্যুলার কোর্টে পেশ করা হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘কোন অভিযোগে?’ তিনি কাঁধ ঝাকিয়ে উত্তর দিলেন, ‘আমরা রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি।’ কনস্যুলেট জেনারেল একজন অভিজাত বৃদ্ধ। বিষাদগ্রস্ত চেহারার তিনি সুউচ্চ চেয়ারে বসে রয়েছেন। দেখে মনে হচ্ছিল তিনি বেশ বিরক্ত এবং যকৃতের গন্ডগোলে ভুগছেন। তবে তিনি সহানুভূতির সঙ্গে নরম সুরে আমার সঙ্গে কথা বললেন, কেন আমি জাপান গিয়েছিলাম, কেনইবা আমি কুখ্যাত বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর গুপ্ত এজেন্টের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আমার কেমন, এইসব। ছদ্ম অনুশোচনায় আমি বলি, ‘পড়াশুনো করতে আমি ইংল্যান্ড যাচ্ছিলাম, যুদ্ধ বেধে গেল, আমার যাওয়া হলনা। কিন্তু শিক্ষালাভের জন্য বিদেশে যেতে আমি বড়োই উদগ্রীব ছিলাম। জাপানে গিয়ে আমি ঝামেলায় জড়িয়ে গেলাম। জাহাজে আমার সহযাত্রীরা আমাকে টোকিয়োর একটা ঠিকানা দেয়। কোন প্রয়োজনে এর সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। আমি তাদের ভাষা জানতাম না। ভেবেছিলাম একজন ভারতীয় বিদেশে আমার কাজে লাগতে পারে। কিন্তু দেখলাম ভুল করেছি, আমার পেছনে পুলিশ লেগে গেল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, ঠিক করলাম দেশে ফিরে যাবো। কিন্তু ইচ্ছে হল দেশে ফেরার পথে পৃথিবীর কিছুটা অন্তত দেখে যাই। এইভাবে চীনে আসা। এখন আমি আর কোথাও যেতে চাই না। সোজা দেশে ফিরতে চাই।’
কনস্যুল জেনারেল আমার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, বোধহয় বিশ্বাসও করলেন। আমার কথা শেষ হলে তিনি চিফের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন ‘জাপান থেকে আর কোন খবর পেয়েছেন আপনি?’ ক্রূর উত্তর শোনা গেল, 'না স্যার, তবে যে কোন মুহূর্তে চলে আসবে।' ব্রিটিশ ন্যায়পরায়ণতার চেতনা আমাকে রক্ষা করলো। ‘তুমি এই যুবককে অনির্দিষ্ট কালের জন্য লক-আপে রেখে দিতে পারনা’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি বেশ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছো, এখানে কোন হোটেলে দিন কয়েক থেকে যাও, তারপর ইন্ডিয়া ফিরে যেও। আর এ অঞ্চলে প্রচুর বিপ্লবী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের থেকে দূরে থেকো।’ তার বলার সুরটা ছিল পিতৃসুলভ শাসনের সুর। আমি যথাসম্ভব অনুতপ্ত ও বশংবদের ভান করলাম, কিন্তু একটি শয়তানি বুদ্ধিও আঁটতে ছাড়লাম না। বললাম, ‘কনস্যুল জেনারেল কি দয়া করে আমাকে একটা পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, নির্বিঘ্নে যাতে করে আমি চলে যেতে পারি’। পুলিশকর্তা আমার ধৃষ্টতায় রাগে জ্বলে উঠলেন। বৃদ্ধ ভদ্রমানুষটি এবার একটু আড়ষ্ট হয়ে পড়লেন, 'না তা আমি পারি না। তুমি যে ব্রিটিশ প্রজা সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই।' আমি কিছু ভেবে বলার পূর্বেই আমার ভেতরের প্রত্যুক্তি-পটু মানুষটি শাণিত প্রশ্ন করে বসলো, ‘আমি ব্রিটিশ নাগরিক না হলে আপনার পুলিশ আমাকে বন্দি করে আটকে রাখলো কী করে?’ প্রবীণ মানুষটিকে দৃশ্যতই বিচলিত দেখালো। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে তিনি বললেন, 'এগুলি আইনের জটিল প্রশ্ন।' তিনি তার সহজাত ন্যায় বিচারে স্থির থাকলেন, বিচার না করে কোন মানুষকে আটক রাখা যাবে না। ‘অভিযোগের স্বপক্ষে আরো প্রমান পাওয়া না যাওয়া পর্যন্ত অভিভুক্তকে মুক্তি দেওয়া হল।’ পুলিশকে তিনি এই আদেশ দিলেন।
স্বভাবতই পুলিশ-কর্তা অগ্নিশর্মা। বাইরে এসে, আমি শুললাম তিনি বিড়বিড় করছেন, ‘বোকা বুড়ো’। তারপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এবার কোথায় যেতে চাও’। বলি, ‘একটা ভালো হোটেলে।’ ‘এখানে একটাই ভালো হোটেল আছে', এইকথা বলে কাষ্ঠহেসে জুড়ে দিলেন, 'তবে তা ব্রিটিশ এলাকায়।’ নিস্পৃহ চাতুরিতে বললাম, ‘সেখানেই যেতে চাই। আমি তো ব্রিটিশ নাগরিক।’ তিনি একটা রিক্সো ডেকে বলে দিলেন, ‘একে এসটোরিয়া হোটেলে নিয়ে যাও।’ হোটেলটি বেশ ভালো। ভালো করে স্নান আর খাওয়া খুব প্রয়োজন ছিল আমার। এরপরে, সবচেয়ে প্রথমে আমার এ শহরের একটা ম্যাপ প্রয়োজন। বিকেলে একটা রিক্সো নিয়ে বের হয়ে শহরের চীন অধ্যুষিত অঞ্চলে গেলাম। শহরের ছোট নদীর কাছাকাছি একটা বিশেষ স্থানে আমার যাবার পরিকল্পনা ছিল। নদীর ওপারেই জার্মান-অঞ্চল। কিন্তু অন্য দুটি রিক্সো আমার পিছু নিয়েছিল। অন্ধকার নেমে আসছিল। আমি ঢুকে পড়লাম একটা বড়সড় দোকানে এবং ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগলাম বহুক্ষণ ধরে, এতটাই বহুক্ষণ যে আমার অভিভাবকেরা বিরক্ত হয়ে কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে ঢুকলো। আমি পাশের দরজা দিয়ে একটা সরু গলিতে এলাম, কয়েক কদম দূরেই নদীর ঘাট। নির্বিঘ্নেই সেখানে পৌঁছলাম, কিন্তু ওপারে যেতে ফেরি-বোট চড়তে হবে। ভাড়া দিতে হচ্ছে চীনে পয়সায়, আমার কাছে তা নেই। আমি মাঝির হাতে গুঁজে দিলাম কিছু রূপা। সে এক গাল হেসে অন্য যাত্রীদের জন্য আর অপেক্ষা না করেই, নৌকো ঠেলে দিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি নিরাপদ। পরের দিনই দেখা করলাম জার্মান কনস্যুলেটের সঙ্গে।
আমাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল কেননা জার্মানির ভারতে সশস্ত্র অভ্যুথথানের প্রতিশ্রুতির মধ্যে সততা ছিলো না। তাছাড়া, হয়তো তা ব্যর্থ হতোই কেননা যে অদ্ভুত হিসেবনিকেশ সান ইয়াৎ-সেন করেছিলেন, আমার অংশটা সুসম্পন্ন হলেও, তৃতীয় চীন-বিপ্লবের নেতৃত্বের কাছে সেটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হতো তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু এ মুহূর্তে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল, জার্মান রাষ্ট্রদূত মনে করলেন পরিকল্পনাটি ভেবে দেখার মতো।
ইতিমধ্যে ড্রাগন অঙ্কিত সিংহাসনে বসবার পূর্বেই ইউয়ান শি-কাই এর মৃত্যু হল এবং সেইসঙ্গে চীনে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আর কোন সম্ভবনা রইলো না। তৃতীয় চীন বিপ্লবের গল্পও অর্থহীন হয়ে গেল। গুরুত্ব বেড়ে গেল আমার বাড়তি অস্ত্রশস্ত্রগুলির কেনার পরিকল্পনার। জার্মানদের কাছে প্রথম যখন অর্থ চাইলাম তারা আমাদের পরিকল্পনার ত্রুটির দিকটা দেখালো। তারা বললো, সুদূর ইউনানে যে মানুষটির কাছে হাতিয়ার মজুত আছে বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগই নেই, সাংহাইতে সান ইয়াৎকে অর্থ দিলেই সে কেন আমাকে অস্ত্র দিয়ে দেবে? এরকম পরিকল্পনার কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। চীনের প্রবীণ নেতার সততার প্রতি যে সাহেবটি সেদিন সন্দিগ্ধ হয়েছিলেন তার এ হেন মনোভাবের কারণে আমি সে দিন রুষ্ট হয়েছিলাম। যাইহোক, আমি ভাবলাম এতো পরিমান অর্থব্যয় করতে তাদের যে দ্বিধা তা কাটাতে হলে আমাকে পরিকল্পনার ত্রুটি দূর করতে হবে। সুতরাং আমাকে আরো অনেক পথ পরিভ্রমণ করতে হল, ঝুঁকিপূর্ণ পরিভ্রমণ। শেষে ইউয়ানের সেই নেতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারলাম।
হ্যাংকাও শহরে ইউয়ানের নেতার স্বীকৃত অনুচরের সঙ্গে জার্মান-কনস্যুলের উপস্থিতিতে একটা পাকাপোক্ত চুক্তি করে আমি পিকিং-এ ফিরে এলাম। এরকম চুক্তি হল যে, মাঝখানে কোন দালাল থাকবেনা। জার্মানরা যদি মনে করে তবে যার হাতে অস্ত্র আছে তার হাতেই সরাসরি অর্থ তুলে দেবে। আর সেই ব্যক্তি অর্থপ্রাপ্তির পর অস্ত্র সীমান্তের ওপাড়ে আসামের উত্তর-পূর্ব কোণে উপজাতি এলাকায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নেবে। বলা হলো বেশ কয়েক হাজার সৈন্যদলকে সমরসজ্জায় তৈরি করে দেবার মতো যথেষ্ঠ অস্ত্রের ব্যবস্থা হবে। এছাড়াও একটা আলাদা সম্ভাব্য চুক্তিতে বলা হল বাড়তি টাকা দিলে, ভারতীয় বিপ্লবীদের যথেষ্ট পরিমানে অস্ত্রশস্ত্রের যোগান তিব্বতের সীমান্তে চেংডু (Chengtu) নামক শহরে দেওয়া হবে। সাদিয়া দিয়ে সেখানে যাবার মতো একটা রাস্তা রয়েছে।
১৯১৬ সালের প্রারম্ভে ব্রিটিশ শক্তিকে রক্ষা করার মতো কোন সামরিক বাহিনী এদেশে ছিল না। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে থাকা কঙ্কালসার সামরিক বাহিনীর ভারতীয় অফিসারেরা গণ অভ্যুত্থানে যোগ দিতেই আগ্রহী ছিল। ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি এদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলেছিলাম। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্যে সময়টা ছিল একেবারে যথাযথ। এরকম চূড়ান্ত সময়ে জার্মানরা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হলো। আমি বুঝলাম তারা আমাদের কখনই বড় রকমের সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল না। জার্মান রাষ্ট্রদূত মেনে নিলেন যে সর্বশেষ পরিকল্পনা ছিল খুবই বিশ্বাসযোগ্য এবং যুদ্ধনীতির নিরিখেও কোন ভুল নেই। কিন্তু তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন যে, এতো বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে তিনি অপরাগ। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম মানব এবং প্রাসঙ্গিক উপাদান মিলিয়ে ইউরোপের একটা যুদ্ধ জয়ে আপনাদের কত ব্যয় হয়? অশ্বেত-চামড়ার একজন যুবকের কাছ থেকে সম্ভ্রান্ত জার্মান যুবক এমন ঔদ্ধত্য আশা করেননি। ইনি আমাকে রাগিয়ে দিলেন এইকথা বলে যে, যে কথা তুমি বলছো তার মানে তুমি জানো না। উত্তরে বললাম, আমি শুধু এটুকুই জানি যে ভারত ব্রিটিশদের হাতছাড়া হলে তারা যুদ্ধে পরাজিত হতে বাধ্য। মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার, নিষ্পত্তিমূলক এই যুদ্ধ জয়ের চেয়েও দামি? অবশ্য জার্মানদের স্বার্থের জন্যে ভারতে আমি যুদ্ধ করবো না। এখানেই বিষয়টি মিটে গেল। রাষ্ট্রদূত দৃশ্যতই বেশ বিস্মিত হলেন এবং আমাকে ঠান্ডা করতে উদ্যোগী হলেন। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন, সময় নষ্ট না করে এখুনি বার্লিনে যাত্রা করতে এবং সেখানে জার্মান যুদ্ধ-সম্রাট এবং তার অনুচরদের কাছে পরিকল্পনাটি মেলে ধরতে। বিদায়কালে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ংম্যান তুমি কি সত্যি বিশ্বাস করো যে বিদেশী সাহায্য এবং পরামর্শ ছাড়া তোমরা দেশ শাসন করতে পারবে? আমি উত্তর করি, এরকম ভাবছো না তো যে ভবিষ্যতে আমাদের দেশকে শাসন করবে বলেই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করতে যাচ্ছো তোমরা? এবার তিনি তার দুশ্চিন্তাকে হেসে উড়িয়ে দিলেন, আমার সৌভাগ্য প্রার্থনা করলেন এবং আর একটা প্রশ্নও করলেন, এখন যে যুবকের সঙ্গে আমার দেখা হল তেমন যুবক ভারতবর্ষে আর কতজন আছে? আন্তরিক নম্রতায় উত্তর করেছিলাম, ভারতের এক বৃহৎ বিপ্লবী দলের আমি একজন একাকী সৈনিক-প্রতিনিধি মাত্র।
* আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই জীবনচরিতে উল্লেখিত স্থানগুলির মধ্যে অধিকাংশেরই নামের কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে এবং এই রচনার মৌলিকতা রক্ষার উদ্দেশ্যে স্থানগুলির নাম অপরিবর্তিত রাখা হল। অর্থাৎ এক্ষেত্রে মানবেন্দ্রনাথ রায় যে নাম ব্যবহার করেছেন, আমি সেই নামই এখানে উল্লেখ করেছি। জায়গাগুলির বর্তমান নাম ব্যবহার করা হয় নি।