বর্ধমান, ১৯৭৪, এপ্রিল।
এখানে সকলে বলে সদরঘাট। বর্ধমান থেকে ধুলো উড়িয়ে বাসের দল এসে থামে সদরঘাটে। শীতের শেষে নদীর এক প্রান্ত দিয়ে অলস জলের ধারা বয়ে যায়। বাস থেকে নেমে হুড়োহুড়ি করে মানুষেরা খেয়া নৌকায় গিয়ে ওঠে।ওপারে দক্ষিণ দামোদরের নানা স্থানে যাবার জন্য অপেক্ষমান বাসগুলি দাঁড়িয়ে থাকে। যাত্রীরা নৌকো থেকে নেমে বাসগুলিতে গিয়ে ওঠে। বসে গিয়ে বাসের সিটে, যারা সিট পায়।বাকিরা বাসের মাথাতে উঠে যায়। তাদের বাসের পেছনের মই দিয়ে উঠবার উৎসাহ ও তৎপরতা দেখে মনে হয় সেটিই আরোহীদের অধিক প্রিয় স্থান। অর্চি কিছুক্ষণ এই সব দৃশ্যে চোখ বোলায়, এইসব দৃশ্যগুলি তার চোখের সামনে সৃষ্টি হয় ঠিকই, তবে অর্চির মনে তার জোরালো কোন প্রভাব পড়ে না। দৃশ্যগুলির ওপর চোখ বুলিয়ে সে আনমনে চলে যায় নদীর বাম দিক ধরে, বালু ভেঙে জনহীন চরের দিকে।কাঁটা ঝোপে আচ্ছন্ন সেই চর। ঝোপের মাঝখান দিয়ে ক্ষীণ পথ আঁকা-বাঁকা চলে। বেশি দূরে যেতে সাহস হয় না, অন্ধকার ধীরে ধীরে নামে, তাছাড়া কঙ্কাল-করোটি ছড়িয়ে থাকে চারপাশে। গরিবদের নাকি স্বজনের মৃত দেহ পূর্ণ দাহ করার ক্ষমতা নেই এ অঞ্চলে। এতো কাঠ তারা পাবে কোথায়? সন্ধ্যা গাঢ়তর হয়ে আসে, ভালো লাগে না তার, তবু আরো বিষাদ কুড়িয়ে নিতেই যেন অর্চি রোজ সেখানে যায়, শেষে ফিরে আসে এক বুক আচ্ছন্নতা নিয়ে। সদরঘাটে ফিরে এসে সে দেখে লম্ফ জ্বেলে চপ, ফুলুরি, পেঁয়াজী ভাজে দোকানি। গন্ধে অর্চির বৈকালিক ক্ষিদে পায়।
বর্ধমানে আসার পর থেকে অর্চির মনে আর কোন আনন্দ অবশিষ্ট ছিল না। একটি পুরু এবং স্থায়ী বিষন্নতার চাদরে যেন সে ঢাকা পড়ে আছে। একেবারে জন্ম থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত যে বাসভূমিতে সে এতদিন কাটিয়ে এসেছে, সে পরিমণ্ডল থেকে সে এখন বিচ্ছিন্ন। তবু সেই ফেলে আসা বাড়ির জন্য, বাড়ির নিভৃত কক্ষগুলির জন্য, বাড়ির দরজা জানালার উড়ন্ত পর্দাগুলির জন্য, পোষা কুকুরটির জন্য, তাদের চা বাগানের দিগন্ত জোড়া সবুজের সমারোহের জন্য, বাড়ির পাশেই সমস্ত পাখিদের আশ্রয়স্থল বিপুলাকায় নাগকেশর গাছটির জন্য তার মন ব্যথিত হয়ে থাকে। আরো মন খারাপ করে বন্ধুদের জন্য আর তার জন্য, যার হাতে সে তার এই ক্ষুদ্র জীবনের সমস্ত কিছু জমা রেখে এসেছে।
কিশোরকালে অন্তরলোকের প্রগাঢ় ভাঙা-গড়ার সঙ্গে পরিচিত হয় সকলেই, কিন্তু বড়ো হয়ে সে কথা আর কেউ মনে রাখে না। কৈশোরের ভেতরের জগতের সঙ্গে বাইরের জগতের মিল খাওয়াবার অনিবার্য মরনন্তুদ প্রচেষ্টাকে প্রাপ্তবয়স্কদের মনে হয় ছেলেমানুষী, বয়ঃসসন্ধির পাগলামি। সুতরাং অর্চির অভিভাবকেরা কেউই তার মানসিক বিষাদকে গুরুত্ব দেয় না। কৈশোর কালে যে ভয়ংকর ঝড়-ঝঞ্ঝার পরিস্থিতি অতিক্রম করতে হয়, তার প্রতি যেন বড়োদের কোন দায় নেই। অর্চির এই বিষন্নতার পিছনে তার অভিভাবকেরা অন্য এক কারণের সন্ধান করে, যার পেছনে সত্যতা একেবারে যে নেই তা বললে ভুল হয়।
বর্ধমানে আসার পর, বিশেষ করে বিকেলের দিকে অর্চির নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। তখনো গ্যাস আসেনি গৃহস্থলির রান্নাঘরে। শেষ বিকেলে, সন্ধ্যার মুখে, উনোনগুলিকে ধরিয়ে বাড়ির বাইরে, বারান্দায়, উঠোনে এনে রাখা হয়। গুল ভরা উনুনগুলি উদগিরণ করে প্রবল ধোঁয়া। একেই বিকেলগুলো বিষন্নতার গর্ভগৃহ, তার উপর এই দমবন্ধ করা বাতাস তাকে স্বস্তি দিত না।
অর্চি সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে এসেছে মধুঝরা সুগন্ধী সন্ধ্যা। প্রতি ঋতুতেই। বিশেষ করে বর্ষামুখর সন্ধ্যাগুলির গভীরতর মাধুরী ছিল। সুগন্ধ ভেসে আসত নানা ফুল থেকে, বর্ষাস্নাত কদমের, কামিনীর। ভেজা ঘাসের থেকে, ঝোপঝাড় থেকেও বাতাসে ফিরত তাদের মদির নিজস্ব গন্ধ।
এখন এখানে এসে সন্ধ্যা হলেই সে জনপদ থেকে পালিয়ে আসে শহরের শেষে দামোদর নদীর পাড়ে। সদরঘাটে।
হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই অর্চিকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, একরকম জোর করেই। মাস তিনেক পর রেজাল্ট বের হবে। অর্চি ভালো করেই জানে তার রেজাল্ট ভালো হবে না। জীবন যে এক সুমধুর কল্পলোক নয় অর্চি সেকথা বুঝে উঠতে শেখেনি অদ্যাবধি। তদুপরি শৈশব থেকেই তার ছিল ভালোবাসা পাবার এক জোরালো আকাঙ্ক্ষা; ভালোবাসা সে পায়নি এমন নয়, তবু। কৈশোরকাল থেকেই সে চায় এক অনির্বচনীয় সোহাগ যা সহজে মেলে না, এবং যার খোঁজ পেতে গেলে পৃথিবীর সীমারেখা বুঝি অতিক্রম করে যেতে হয়। এমন ভালোবাসার সন্ধান, তার ধারণা, সে শেষমেশ পেয়েছে আরশিদির কাছে, সেই মোহাচ্ছন্ন ভালোবাসা বুকে আগলে সে এখানের দিনগুলি কাটিয়ে দিচ্ছে। আসলে দিনগুলি সে কোনক্রমে পার করে দেয়।
ভাবপ্রবণতা একটি দোষ বটে, তবু কোন শিশু যদি তা জন্মের সঙ্গে বহন করে আনে, আর কিশোরবেলাতেও যদি সে তা বহন করে চলে, তবে তাকে কি দোষ দেওয়া চলে? সে যদি, তদুপরি এক অপরূপ সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে লালিত হয় এবং বাড়ির বড়দের যদি এই বদভ্যাস না থাকে যে দিবারাত্রি বাল্যকাল থেকে ক্রমাগত বুঝিয়ে দেওয়া যে বাপু পৃথিবীতে এসেছো ঝেড়ে স্কুলের বইগুলি মুখস্ত করতে, আগডুম-বাগডুম ভাবনার জগতে পদচারণা করার জন্য নয়, তবে শিশুটির ভাবপ্রবণতা চিরস্থায়ী হবার উপক্রম হয়।
অর্চির দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য কে বলতে পারে, যে এই পরিস্থিতিতে তাকে বড়ো হতে হয়েছিল। ভাবপ্রবণতা তাই অর্চির স্থায়ী হয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই তার এক বদ্ধমূল ধারণা যে অন্য ভাই বোনদের তুলনায় সে তার বাবা-মায়ের ততটা প্রিয় নয়। একবার, অর্চি তখন কতটুকুই বা, তখন একদিন তারই নিকটাত্মীয়রা অর্চিকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছিল।
এক তুতো দিদি বলেছিল,
- তোর ভাই বোনদের গায়ের রং এতো ফর্সা আর তুই কালো কেন জানিস?
এই প্রশ্ন বালকটিকে অবাক করে দেয়। সে কি বলবে, সে জানে না, তাই চুপ করে থাকে।
- আসলে তুই এদের আপন ভাই নোস। তারপর যোগ করেছিল, একবার ডিমা নদীর পাড়ে তোকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। কাঁদছিলি তো, তাই দয়া করে তোর মা তোকে বাড়ি নিয়ে আসে। আসলে তুই মদেশিয়াদের বাচ্চা।
দাদা ও বোনের আপন নয় সে? এই কথাটাই অর্চিকে আঘাত করে বেশি। মদেশিয়া বাচ্চারা কেন অনাদরের পাত্র সেটুকু বোঝার মত সামাজ-বোধ তখন তার হয়নি। সে শুধু জানে চা-বাগানের আদিবাসী কুলিদের বলা হয় মদেশিয়া। তাদের গাত্রবর্ন কালো আর অত্যন্ত অবহেলায়, মাটির ঘরে, বাড়ির আঙিনায়, পথের ধুলায় তারা বড়ো হয়।
বলাবাহুল্য যে এসবই ছিল বড়দের অর্চিকে খেপিয়ে তোলার খেলা। কিন্তু সে এ খেলাকে খেলা বলে ধরে নিতে পারে না। বরং তার ছোট্ট বুকে দুঃখের সানাই বেজে ওঠে, শ্বাস তার রুদ্ধ হয়ে আসে। এই কাল্পনিক গল্প তার মনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। এই গল্প যখন তার মাথায় ক্রমাগত পীড়ন করছে, তখন একদিন সে তার মাকে একলা পেয়ে গেল। যৌথ পরিবারে মাকে একলা পাওয়াও বেশ দূরহ। মমতা বারান্দার চেয়ারে বসে উলের সোয়েটার বুনছিলেন সংসারের কাজের অবসরে,অর্চির বোন তিতিরের জন্য। অর্চির মায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে-
- মা ওরা যা বলছিল, সত্যি?
তার মা শুধু মৃদু হাসেন। আসলে মমতা পুত্রের সদ্য প্রাপ্ত আঘাতের গভীরতা বুঝতে পারেন না। অর্চির প্রয়োজন ছিল মায়ের স্পর্শের, আশ্বাসের। প্রকৃতির কোন অদৃশ্য ইঙ্গিতে সে যে কেন এমন দুর্বল, ভীরু এবং দুঃখবাদী হয়ে উঠেছিল তা কে বলতে পারে! অর্চি সেদিন তার মাকে বলতে চেয়েছিল তুমিও তো উপস্থিত ছিলে সেখানে মা, তবে চুপ করে ছিলে কেন? কিন্তু সে কথা সে মাকে বলতে পারে না, মনের ভিতর তার সব কথা জট পাকিয়ে যায়। বানানো গল্পটির অধো অন্ধকার সত্যতা মনের ভেতর রেখে সে বড়ো হতে থাকে।
ডুয়ার্স, ১৯৭১, জানুয়ারি।
অর্চির জন্ম স্বাধীনতার দশ বছর বাদে। এটা তার সৌভাগ্য বলতে হয়, দেশ স্বাধীন হবার পূর্বে জন্মালে দাদু ঠাকুমা সহ তাকেও তার সমগ্র পরিবারের দেশভাগ ও দেশ ত্যাগজনিত দুঃসহ শারীরিক ও মানসিক বেদনার অংশীদার হতে হত। বরিশাল থেকে ডুয়ার্স, পরিবারটির এই দীর্ঘ যাত্রা তো দীর্ঘই ছিল না শুধু, আসলে এ তো সাগর থেকে পাহাড়ে নির্বাসন। নতুন করে আবার সব গড়ে তোলা। এই মহা ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে অর্চির বাবা সুনীল বৃহত্তর পরিবারটির প্রতি কর্তব্যকে জীবনের ধ্রুবতারা ধরে নিয়েছিলেন। এই দায়িত্বকে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এসেছেন। ভাইদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া, বোনকে বিয়ে দেওয়ার মত কাজগুলি তার কাছে প্রধান হয়ে উঠেছিল। সন্তান স্নেহ ছিল না কি তার? ছিল অবশ্যই। কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ ছিল আপাতদৃষ্টিতে ক্ষীণ। সুনীলের কোলে কোন শিশু, এমন দৃশ্য কখনো কেউ দেখেনি। পরিস্থিতি তাকে সন্তানদের প্রতি, অর্চির প্রতি অতিমাত্রায় মনোযোগী করে তুলতে পারেনি। আর যৌথ পরিবারে সেটাকে দেখা হত পরিবারের প্রধানের নিরপেক্ষতার ঘাটতি হিসেবে। অর্চি তাই বাবার তুলনায় কাকাদের প্রশ্রয় পেয়েছে বেশি। আর ছিলেন ঠাকুমা, অর্চি ছিল তার নয়নের মনি।
যখন স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র অর্চি, একদিন ডুয়ার্সে শীত পড়েছে গভীর। ভোর বেলা বাথরুম যাবার প্রয়োজন গুরুতর হলেও অর্চি লেপ ছাড়তে চায় না। ঘরের মধ্যে বাথরুম নেই। দরজা খুলে বাইরে এলেই হাজারো বাতাস শিস দিয়ে শীতের ছোবল মারে, সমবেত নাগিনীদের মত। তার উপর, বিছানা ছেড়ে নেমে যদি পায়ের কাছে চটি গরহাজির, তো সিমেন্টের মেঝেতে পা রাখা অসম্ভব। সেখানে পেতে রাখা যেন আর এক বিছানা, বরফের তৈরি। ঠাকুমা, মা উঠে পড়েন ভোর ভোর, বাবা কাকারা সকাল ৭ টায় অফিস যাবেন, চা খেয়ে। সমবেত ভাবে বড়োরা, দাদা ও তাকে ডাকতে থাকে,
- ওরে ওঠ, ওঠ, পড়থে বয়।
তাদের বোন এখনও ছোট, ডাকাডাকি থেকে তার রেহাই আছে।
অর্চি আর অর্জুন উঠে মমতার সামনে অঞ্জলি দেবার মত করে বাম হাত মেলে ধরে। মমতা কৌটো ঝাকিয়ে সাদা মাজন তাদের হাতে দেন। মুখ ধুয়ে দু ভাই রান্না ঘরে চলে আসে, একটা ছোট উঠোন পার হয়ে। সেখানে কাঠের উনোন জ্বলছে। কাঠের উনোন একবার জ্বলে উঠলে শীতকালে সে বস্তুটি বড়ই আরামদায়ক। দুই ভাই চুলার পাশ ঘেঁষে বসে চা খায়।
স্কুলে তারা যায় অতঃপর। কিন্তু কোনো ক্লাসে অর্চির মন লাগে না। ইতিহাস ভূগোল অংক এইসব যারা পড়াতে আসেন তাদের কোনো প্রস্তাবনাতেই সে রসের সন্ধান পায় না।পরিবেশন ও গ্রহনের সুর পথের মাঝে কোথাও এসে পথভ্রষ্ট হয়, মেলবার আগেই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কার এ ত্রুটি? শিক্ষকের না ছাত্রের কে বলতে পারে।
একদিন সংস্কৃত স্যার তাদের ক্লাসের সবাইকে দাঁড় করিয়ে পড়া ধরতে থাকেন। তারই এক বেঞ্চের সাথী অলোক ও অশোক, স্যার এর প্রশ্নের যথাযত উত্তর দেয়।
- অর্চিষ্মান দাঁড়াও, মুনি শব্দের তৃতীয়ার বহুবচন কী?
সে যথারীতি নিরুত্তর, মাথা নিচু করে থাকে। 'ব্যাকরণ কৌমুদি' বইটি সে কোন দিন খুলে দেখেছে কিনা সন্দেহ।
- একেবারে পড়াশুনো করিস না। কী তোর সমস্যা? কেন পড়া করে আসিস না কোনদিন, বল? স্যার যেন নিজেই বড্ড দুঃখ পান অর্চির রোজকার এই ব্যর্থতায়, পড়াশুনোয় অমনোযোগিতায়।
অর্চির দৃষ্টি ডেস্কের দিকে। উত্তরে সে থাকে মৌন।কিন্তু আজ অর্চি মনে মনে ঠিক করে আজ তাকে বলতে হবে, সেই কথা, কেন সে পড়া তৈরি করতে উৎসাহ পায় না, যে কথা সে কোনদিন স্যারদের বলে উঠতে পারেনি।
স্যার এর জানতে চাওয়ার মধ্যে আন্তরিকতা ছিল, অর্চিকে তা ছুঁয়ে যায়। তাছাড়া, এই স্যার মানুষ খুব ভালো। মৃদুভাষী। বেত থাকে না তার হাতে। অর্চি আজ সাহস পায় স্যারকে মনের কথাটি খুলে বলতে। বলে, স্যার আমি বুঝতে পারিনা আসলে এসব পড়ে কী হবে।
স্যার শব্দরূপ ধাতুরূপ মুখস্ত করান, এগুলি যে বাক্যসৃষ্টির মূল মন্ত্র এবং এই মন্ত্র মনে গাথা না হলে যে বাক্য গঠন করা অসাধ্য হবে একথা কেউ তাকে বুঝিয়ে বলে নি, অথবা বলে থাকলেও সে মনোযোগ দেয়নি। অন্যকথা ভেবেছে সে সময়ে।
সে সময়ে চলছিল নকশালবাড়ির অন্দোলন, এ শিক্ষা ব্যাবস্থাটি যে ধনী ও শাসককুলের স্বার্থকেই সমাজের সকল শ্রেণির উপর চাপিয়ে দেয়, এ ব্যাপারে তারা সে সময়ে নিশ্চিত ছিল। অর্চির চেয়ে অন্তত বছর কয়েকের বড় দাদারা এসব বলে থাকে, তারা এইসব তত্ত্ব হয়ত বোঝে, না বুঝলেও বিশ্বাস করে গভীর ভাবে। অর্চি শুনেছে এসব কথা, কিন্তু স্যারকে সে এই অর্থে কথাগুলি বলেনি। সে বলতে চায়নি যে এসব পড়ে কী হবে, সমাজ যদি থাকে অপরিবর্তিত। এসব কথা বলবার মত বোধ ও ব্যক্তিত্ব তার তৈরি হয়নি। কিন্তু স্যার বুঝলেন ভুল। বললেন, এতই যখন বুঝেছ, তোমাকে আমার প্রশ্ন করাই ভুল হয়েছে। বস তুমি।
অথচ অর্চির পড়ায় মনোযোগ নেই একথা বলা ঠিক হবেনা। অর্চিদের বাড়িতে একটি বড়সড় বই এর আলমারি ছিল। সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই আগে থেকেই ছিল সাজানো, পুরোনো কিছু পত্রিকাও বাঁধিয়ে রাখা ছিল, ছিল কিছু ইংরেজি নভেল, আর ছিল রামায়ণ ও মহাভারত। সে সময়ে উপহার হিসেবে বই দেবার চল ছিল। কাকাদের বিয়ে উপলক্ষে সে আলমারিতে যুক্ত হল আরো অনেক বই। এই বইগুলি বেশিরভাগ ছিল আধুনিক গল্প উপন্যাস আর কবিতার বই। রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্রের গল্প উপন্যাসগুলো, কিছু বুঝে কিছু না বুঝে, সে বেশ অল্পবয়সেই পড়ে ফেলেছিল। পরে আসা বইগুলি সে পড়তে শুরু করেছে ইদানিং। এই বইগুলি সে প্রায় বাহ্য জ্ঞান হারিয়ে পড়ে।
অর্চি আর তার দাদা অর্জুন প্রতিবারের মত এবারও সাদামাঠা রেজাল্ট করে পরের ক্লাসে ওঠে। একটু বকাঝকা খাবার পর দুজনেই আবার নিজস্ব আবর্তে পাক খেতে শুরু করে দিয়েছিল। এমন সময় এল বর্ধমান থেকে একটি ইনল্যান্ড। অর্চির ছোটকাকা প্রিয়নাথ লিখেছে অর্চির বাবা ও মাকে।
তারপর থেকে বাড়ির পরিবেশটা পাল্টে যায়। বড়রা ঘন ঘন সভা করে। অর্চি এলে মিটিং যায় থেমে। কোনদিন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে অর্চি শোনে, ঠাকুমা বলছেন, পোলাডারে রাইখ্যা যাওন ঠিক হইবে। না, সুনীল। অর্চির মাকে বলেন ,মমতা, ওরে লইয়া যাও।
পরে ধীরে ধীরে অর্চির কাছে সবই পরিষ্কার হয়ে যায়। দাদা যেহেতু উঁচু ক্লাসে উঠলো, তার পড়াশুনায় আর অবহেলা করা চলে না। তাই ছোটকাকা প্রস্তাব দিয়েছে যে বৌদি যেন অর্জুনকে নিয়ে তার কাছে চলে আসেন। তিতির ছোট। সে মাকে ছেড়ে থাকবে কী করে? তাই সেও যাবে। প্রিয়নাথ কলেজে একটা বড়সর কোয়ার্টার পেয়েছে। সেখানে এ ক'জনের থাকার অসুবিধা হবে না।
এর কিছুদিন পরে অর্চিকে ঠাকুমা ও কাকিমাদের জিম্মায় রেখে মমতা দাদা ও বোনকে নিয়ে বর্ধমানে ছোট কাকা প্রিয়নাথের বাড়িতে চলে যায়, দাদার পড়াশুনো সেখানেই ভালো হবে এরকম এক পারিবারিক সিদ্ধান্তের জেরে। অর্চির তখন ক্লাস সেভেন। মা দাদা ও বোন চলে যাবার পর অর্চি তার হৃদয়ের কোমল এক তন্ত্রীতে তীক্ষ্ণ এক তপ্ত শলাকার প্রবেশ টের পেত। তার বাবা অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ঠাকুমা, কাকা-কাকিমারা কেউ তাকে কম ভালোবাসেন না। কিন্তু তখন থেকে অর্চির বিচ্ছিন্নতাবোধ তীব্রতর হতে থাকে। মায়ের বিছানা, ড্রেসিং টেবিল, পুরাতন ফেলে যাওয়া শাড়ি, মায়ের স্মৃতি জড়িত সবকিছু তাকে নিয়ত কাঁদায়।
আগে, স্কুল থেকে ফিরে মাঠে খেলতে যাবার আগে তারা দুই ভাই এক দফা খেলে নিত তাদের কোয়ার্টারের বিশাল বারান্দায়।বারান্দায় শেষ প্রান্তের গুন চিহ্ন আঁকা রেলিংয়ের এক অংশ হত তাদের উইকেট। দুই ভাইয়ের ক্রিকেট সেখানে জমে উঠত খুব। আর বিবাদও। অর্জুন আউট হলেও অর্চি কে ব্যাট দিতে চাইতো না। অর্চি বলত, ক্লিন বোল্ড করেছি দাদা ব্যাট দে। এখন এই বিকেল গুলিতে বড্ড একা লাগে অর্চির।
একদিন, যাচ্ছি যাচ্ছি করেও শীত একেবারে চলে যায়নি, দিগন্ত রাঙিয়ে সূর্য তার শেষ আলোর সম্পদ শেড-ট্রি আর চা গাছের উপর ঢেলে দিচ্ছে, অর্চি মাঠে এসে দেখে সব যেন খাঁখাঁ করছে চারদিকে, মাঠের একরাশ শূন্যতার মাঝে ভলি-বলের নেট পরিহাসের মত দাঁড়িয়ে আছে। এমনটা তো হয় না, এ সময় মাঠে খেলা জমে ওঠে। ছেলেরা খেলে, মেয়েরা বেড়ায়। অর্চি তখন দেখতে পায় মাঠের পাশে পড়ে থাকা মস্ত গাছের গুড়ির উপরে বসে রয়েছে আরশিদি। আরশিদি তাকে ডাকে, সূরজ আয় এদিকে।
অর্চির অকারণে রাগ হয়। কাছে গিয়ে বলে,
- তুমি আমাকে সূরজ বলে ডাক কেন?
- কেন? তোর পুরো নাম কি?
- অর্চিষ্মান। অর্চিষ্মান সেনগুপ্ত।
- তাহলে ? অর্চিষ্মান তো সূর্য। তাই তুই সূরজ।
আরশি বলে,
- সবাই তো থানার মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছে। তুই যাসনি কেন?
- আমি তো জানি না। আমাকে তো ডাকেনি কেউ।
আরশির কানে অর্চির গলা একটু ভারি শোনায়।
আরশি অর্চির চেয়ে এক ক্লাস উপরে পড়ে। ক্লাস নাইন। এখন সে শাড়ি পরে স্কুলে যায়। হঠাৎ যেন সে বড় হয়ে গিয়েছে। আরশির পড়াশুনোর মাথা ভারি ভালো বরাবর। বিজ্ঞানে তার আগ্রহ। ক্লাস নাইন উঠে বিজ্ঞান শাখা সে বেছে নিয়েছে নিজের ইচ্ছায়। ভারী মায়া মাখানো তার মুখখানি। তার চোখে শান্ত এক দৃষ্টি রয়েছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে অর্চির অনেকবার মনে হয় যেন রাতের বেলা চন্দ্রমল্লিকার বনে বুঝি জ্যোৎস্না পড়েছে। আজ আরশিদি তার কালো চুলের এক কোণে গুঁজে রেখেছে একটি কাঠগোলাপ। ফুলের সাদা পাপড়ির মাঝে আবছা গোলাপী আভা। তারই ছায়া যেন এসে পড়েছে আরশির কপোলে।মুগ্ধ হয় অর্চি। জিজ্ঞেস করে, তুমি গেলে না মাঠে?
- দূর আমার ফুটবল ভালো লাগে না। তোর খুব মন খারাপ হল তাই নারে সূরজ? এই বলে সে অর্চিকে পাশে বসতে বলে। তার মুখখানি চিবুক ধরে উচু করে তুলে ধরে বলে, তোর মুখ আজকাল এতো শুকনো দেখায় কেন রে?
সে যেন অর্চির সমবয়সী নয়, যেন অর্চি তার স্নেহের পাত্র।
অর্চির চোখে প্রায় জল এসে পড়ে।এই মুহুর্তটাতে আরশি যেন তাকে চিরকালের জন্য কিনে নেয়।
অর্চিকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে আরশি। আর সকলের থেকে অর্চি আলাদা। একটু এলোমেলো, স্বপ্নালু সে, নিজেকে কোথাও প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বন্ধুদের সঙ্গে কলহে সে বরাবর বিজিত। ফুটবল টিমে কী করে যেন শেষমেশ সে বাদ পরে যায়। ক্লাবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময়ে সে থাকে পলাতক হয়ে। তার কণ্ঠে গান আছে কিনা তার খোঁজ কেউ কী নিয়েছে কোনোদিন? আরশি ভাবে, ওর মা বর্ধমানে চলে যাবার পর অর্চি আরো মনমরা হয়ে পড়েছে। বড় মায়া পড়ে যায় অর্চির মুখখানি দেখলে।
- পেয়ারা খাবি?
এইকথা বলে আরশি ম্যাজিকের মত কোথা থেকে যেন কচি কলাপাতা রঙের গোলাকার একটা পেয়ারা অর্চির হাতে দেয়, বলে খেয়ে দেখ কি মিষ্টি। আমাদের গাছের।
ডুয়ার্স, ১৯৭১, নভেম্বর।
মনুষ্যজাতির সকলকেই যে একই নিয়মে চলতে হবে এরকম বাধ্যবাধকতা কোথাও কী লেখা আছে। লেখাপড়া, চাকরি খুঁজে নেওয়া, সংসার গড়া এবং অবশেষে অবসর জীবন শান্তিতে অশান্তিতে কাটাবার মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনধারার বাঁধাধরা ছক সকলকেই যদি অতিক্রম করতে হয়, সেটা ন্যায্য হয় না। কিন্তু জীবনটাকে নিজের খেয়াল খুশিতে কাটাবার জন্য প্রয়োজন হয় অসামান্য প্রতিভা,সাহস অথবা পারিবারিক বিত্তের। অর্চির এদুটির কোনটিরই মালিকানা ছিল না। অতএব তার উচিত ছিল ভালোভাবে স্কুলের পড়াশুনো করা। ভালো ভাবে পাস করে ক্লাসে ওঠা। তবু সে যে তা করেনি তার মূল কারণ হল কোন বিষয়েই অভিভাবক অথবা শিক্ষকেরা কেউ তার মধ্যে উৎসাহ জাগিয়ে তুলতে পারেনি। অমনোযোগিতার কারণে একতরফা বকা সে খেয়েছে, কিন্তু চৈতন্য তার ফেরেনি। তবু ভালো হাতের লেখা আর মনে রাখার জোরে সে মোটামুটি ভাবে ক্লাসগুলো অতিক্রম করে গেছে এ যাবৎ, তেমন পড়াশুনো না করেই।
এদিকে তাদের এই ক্ষুদ্র চা বাগানের পরিসরের বাইরেও যে এক মহা পৃথিবী রয়েছে তার অস্তিত্ব ও আহ্বান কোনটাই সে অনুভব করে না। এই ছোট্ট পরিধির মধ্যে, সবুজ বন ও বনের লতা পাতা, তাদের বাসস্থানগুলির অলিগলির মধ্যে বিচরণ করে, স্কুল ও ক্লাবের লাইব্রেরী থেকে সংগৃহীত অ্যাডভেঞ্চারের বইগুলি পড়ে তার দিন কেটে যায়। ইদানিং সে নির্বিচারে পড়ে বাংলা উপন্যাস, সাহেবদের লাইব্রেরী থেকে তার বাবার আনা ইংরেজি নভেল। তার অল্পই সে বোঝে, বাকি অনেকটাই বোঝে না। কিন্তু এইসব বই থেকে নর নারীর সম্পর্কের মাধুর্য তাকে ইদানিং প্রবল আকর্ষণ করে। স্কুলের পিছনের বেঞ্চে বসা বন্ধুদের থেকে পাওয়া কুৎসিত বইগুলির ছবি ও নর-নারীর শরীর সম্পর্কে বর্ণনা তাকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে সাময়িক উত্তেজিত করলেও আসলে এ বিষয়ের অস্পষ্টতা ও গোপনীয়তায় সে কিছুটা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সদ্য পড়া, কিছুটা বোঝা কিছুটা না বোঝা, অমিত এবং লাবণ্যের মধ্যে কথোপকথনগুলি তাকে মুগ্ধ করে রাখে। নর নারীর আদর্শ সম্পর্ক রূপে এটাকেই সে দেখতে ভালোবাসে।
পুজো চলে গেল গতমাসে। আবার স্কুল খুলেছে।পুজো চলে গেলে মণ্ডপ পড়ে থাকে একা। হঠাৎ যেন যুদ্ধে পরাজিত, অপসারিত নৃপতির আবাসের মত মণ্ডপ পরে থাকে, অবহেলায়। যেন তার সমস্ত সম্পদ লুঠ করে নিয়ে গেছে লুটেরার দল।
আরশি আজ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। বেলা ১১টা। তাদের বাড়িতে ঢুকে কোন ঘরেই সে আরশিদিকে খুঁজে পায়না। শেষে বারান্দা অতিক্রম করে শেষ ঘরটিতে অর্চি আরশির মায়ের সন্ধান পায়। তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। শরীর তার ভাল নেই। অর্চি নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে -
- কাকিমা আরশিদি কোথায়?
কাকিমা বলেন, অর্চি? ডুমুরের ফুল হয়েছিস আজকাল। দেখতে পাইনা তোকে। আগে উলের ডিজাইন তুলতে তোদের বাড়ি কতই তো যেতাম। এখন তোর মা নেই, আর যাওয়াও হয় না। পায়ে ব্যথা বাড়ি থেকেও বের হই না।
- হ্যাঁ কাকিমা। আরশিদি কোথায়?
- রান্না ঘরে দেখ, আজ ও রান্না করবে বলল।
অর্চি উঠোন পার হয়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখে কাঠের উনানের সামনে জলচৌকি পেতে আরশিদি রান্না করছে আর অদূরে আরশির প্রিয় বাদামি রঙের বিড়ালটি একান্ত অনুগত ভঙ্গিতে থাবা গেড়ে বসে আছে।
অর্চিকে দেখে আরশি বলে, পিড়ি টেনে বোস, একটু বসতে হবে কিন্তু। এখনও একটু সময় লাগবে।
- কিসের সময়?
- মাংস সেদ্ধ হবার।
- তুমি আমাকে দিয়ে মাংস টেস্ট করাবে বলে ডাকলে?
- তা কেন? গল্প করবো। অন্য কথাও আছে।
অর্চি একান্ত অনুগত ভঙ্গিতে পিড়ি পেতে বসে। থাবা গেড়ে না বসলেও, জোরআসন করে বসবার ভঙ্গিতে বাদামি বিড়ালটির সঙ্গে তার আনুগত্যের মিল ধরা পড়ে।
আঁচ কমাবার জন্যে আরশি উনান থেকে জ্বলন্ত লাকড়িগুলিকে কিছুটা বাইরে টেনে এনেছে। সেই আঁচে তার মুখটি দেখাচ্ছে রাঙা, উনানের আগুন যেন প্রবল উদ্দীপনায় আরশির মুখে নিজের রূপ পরীক্ষা করে দেখতে চায়। মুখ ছাড়াও খুন্তি ধরা আরশির ডান হাতের সোনার চুড়ির উপর পড়েছে আগুনের ছায়া, উজ্জ্বল জ্বলন্ত ছায়া। অর্চির মনে হয়,আরশিদির ললাট ও কানের দুই পাশ দিয়ে তাপের প্রভাবে সৃষ্ট অশ্রুবিন্দুর মত মুক্তাগুলি এই বুঝি মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়! তার আশঙ্কার অবসান ঘটাতেই যেন আরশি জামার হাতায় মুখ মুছে নেয়। তবু ভাল, মুক্তা বিন্দুগুলোকে আর মাটি হতে হয় না। জামার হাতাতেই তা জমা থাকে!
আরশি কৃষ্ণ বর্ণের লোহার কড়াইতে বেশ করে মাংস নেড়ে নিয়ে বলে, পড়াশুনো নাকি করছিস না একদম?
- এই তোমার কথা?
আরশির নিকট হতে কী কথা অর্চি শুনতে চায় কে জানে। আরশি কী বলবে যে সূরজ তুই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। সবচেয়ে প্রিয়। তোর সঙ্গে রোজ একটিবার দেখা না হলে দিনটা আমার মাটি হয়ে যায়! এই সব কথা কী স্বাভাবিক বাক্যালাপে বলা চলে? যতক্ষণ না শরীর ও মনের একটা অস্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ পৌঁছায়? কিন্তু কিশোর বেলা এরকমই এক অস্বাভাবিক বেলা, যেখানে প্রলাপ বকতে চাওয়াই কথোপকথন। কিন্তু অর্চির চেয়ে অনেক পরিপক্ব আরশি, হৃদয়ের মধ্যে পাগলামি ও স্নেহপ্রবণতার ফারাক সে জানে। সে বলে -
- কাল দাদার কাছে বন্ধুরা এসেছিল। সবাই তো আমাদের স্কুলের স্যার। বলছিল তুই নাকি এবার কোনক্রমে উতরে গেছিস।
অর্চি জিজ্ঞেস করে, সমীরণ স্যার এসেছিলেন?
- না আসেন নি। কিন্তু তোর লেখা পড়ার এ রকম অবস্থা কেন?
- বাংলা স্যার কিছু বলেন নি?
- বলেছেন। বললেন, 'তোমার জীবনের লক্ষ্য' রচনায় তুই নাকি লিখেছিস, জীবনের কোন লক্ষ্য থাকা অবান্তর। কেননা, জীবন কাহাকে কোন দিকে টানিয়া লইয়া যাইবে তাহা জীবনই জানে।
- কী লিখেছি আমার মনে নেই।
আরশি বলে, স্যারের কিন্তু মনে আছে। দাদাকে তিনি বললেন, তোদের বাগানের এই ছেলেটা নিজেকে কার্ল মার্কস ভাবে নাকি? তবু বাংলাতে নাকি তোর রেজাল্ট একটু পদের।
অর্চি মাথা নিচু করে বসে থাকে। মাংসের সুগন্ধ, এমন কি আরশির উপস্থিতিতেও তার অনুষ্ণতা কাটে না। খারাপ ফলাফলের জন্য ততটা নয়, আরশিদি রাগ করেছে, দুঃখ পেয়েছে তার কারণে, এতেই তার মন খারাপ হয় বেশি।
আরশি বলে, কী রে রাগ হল? বলতে বলতে সে একটা কাঁসার মাঝারি বাটিতে মাংস হাতা দিয়ে তোলে। তারপর চামচে করে এক টুকরো মাংস নিয়ে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে বাটি-চামচ সহ অর্চির কাছে এনে বলে, আয় তোকে খাইয়ে দিই। অর্চি তেমনি গোঁজ হয়ে বসে থাকে। আরশি মুখে বলে নে, আর রাগ করতে হবে না, তারপর হাতের চামচ সে অর্চির মুখের কাছে নিয়ে যায়।
খাওয়া শেষ হলে অর্চি বলে, আরশিদি তোমাকে আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয়।
- বল না।
- বলতে পারি না যে, বলার সময় কিছু মনে পড়ে না।
আরশি হেসে বলে, তাহলে যা মনে হয় লিখিস।লিখে দিয়ে যাস, কী তোর বলার কথা পড়ে জেনে নেবো।
সেদিন যাবার আগে আরশি অর্চির হাতে একটি নীল রঙের সুতোয় বোনা ফিতে বেধে দেয়, বলে, আমি রইলাম তোর সঙ্গে। তারপর হেসে বললে, পড়ায় মন না দিলে, এ কিন্তু আমার হয়ে তোকে পড়ার কথা মনে করিয়ে দেবে।
সেই দিন চা বাগানের উপর রাত্রি নেমেছে। অন্ধকারে আকাশে কিছু তারা আর দেউলিয়া এক চাঁদ সামান্য আলো বিকিরণ করছে। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর। অর্চি জানলা দিয়ে দেখে তাদের বাগানের ভুট্টা ক্ষেতের মধ্যে সারি সারি জ্বলজ্বলে গোলাকার, তীক্ষ্ণ আলোর মারবেলের মাপের হীরার টুকরো যেন ঘোর তমসায় ঘুরপাক খাচ্ছে। শিয়ালেরা ভুট্টা খেতে এসেছে। তাদের পায়ের খস খস শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতার ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে। বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্চি তখন কাগজ কলম নিয়ে বসে, লেখে, 'আমার আরশিদি' ।
'আর কারো তুমি নও' কথাটা সে লেখে না, মনের মধ্যে রেখে দেয়। চিঠি সে শুরু করে এই ভাবে - 'তুমি দার্জিলিং বোটানিক্যাল গার্ডেনের মত সুন্দর।'
তুলনা দেবার জন্য তাদের চা বাগানের চারদিকে কী সৌন্দর্যের অভাব ঘটেছে? কিন্তু অর্চির মনে হয়, এখানকার সৌন্দর্যের বিপুলত্ব ও পরিক্ষিপ্ততার সঙ্গে আরশিদির সৌষ্ঠবের কোন মিল নেই। দার্জিলিংয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে যে সুরুচি রুয়েছে, যেমন সে বাগানটি ফিটফাট, তার সঙ্গে বরং মিল পাওয়া যায় আরশিদির। ঘোর কালো রঙের পানসি ফুলের সারি সারি যে বিস্তার অর্চি সেখানে দেখেছে এবং তাদের মধ্য দিয়ে যে সংকীর্ণ মাটির শূন্য রেখা চলে গেছে তা আরশিদির চুলের সিথির মতোই তার চোখে লেগেছিল।
জীবনানন্দ থেকে ধার নিয়ে সে লেখে, 'তোমার মুখের রূপ যেন রক্ত নয় মাংস নয় কামনা নয়', লেখে, তুমি দারুচিনি দ্বীপের মত। তার কল্পনায় আরশি যে কতটা অপার্থিব তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সে যেন হিমশিম খেয়ে যায়। স্বর্ণোজ্জ্বল আরশি ভুল করে কিভাবে এই পৃথিবীর মাটিতে পা রেখেছে, সেই বিস্ময়ের কথাও সে অনেক করে লেখে।
'আরো বড় বিস্ময় কী জানো, আমরা এতো জায়গা থাকতে দুজনেই এক জায়গাতে জন্মালাম কী ভাবে! যদি তা না হত তবে কোনদিন তোমাকে দেখতেই পেতাম না, বলো। তুমিও দেখতে না আমাকে।' সে আরো লেখে - 'একদিন কী স্বপ্ন দেখেছিলাম জানো, দেখলাম একটি রথে, পুষ্পক রথের মতোই যার জাঁকজমক, তাতে করে আমরা দুজনে চলেছি মহাশূন্যের পথ বেয়ে। আমাদের পথের ঊর্দ্ধে, কত নভস্থিত উজ্জ্বল বস্তু, ধূমকেতু, গ্রহ, তারা, চাঁদ। আমরা দুজনে অতিক্রম করে চলেছি যোজন যোজন পথ। নিচে পরে থাকে কত পাহাড়ের সারি, অরণ্যানি, মরুভূমি, জনপথ।'
চিঠিটা সে পরদিন আরশিদিকে দিয়ে আসে। আরশি তাদের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসেছিল। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে বলে, বাপরে বেশ স্বাস্থ্যবান চিঠি।
তার দীর্ঘ কাব্যিক চিঠির উত্তর আরশি দিয়েছে তিনদিন পরে তিন চার লাইনে, তিনবার চাইবার পর। লিখেছে, 'এতটা ভালোবাসিস আমাকে? বড্ড রোম্যান্টিক তুই। চিরদিন এমনি করে ভালবাসবি তো? তবে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য্য অনেকটা বানানে। ভুলকে ভুল করে ভূল নিখিস না।' শেষে সাবধান করে লিখেছে, 'এমনি করে খোলা চিঠি দিতে নেই। বইয়ের মলাটে ঢুকিয়ে দিবি, যেমন আমি দিলাম।'
ক্রমশ