অর্চিষ্মান - তৃতীয় পর্ব

লিখেছেন:অপূর্ব দাশগুপ্ত

ডুয়ার্স, ১৯৭০

 

ছোট থেকে অর্চি রাত্রে ঘুমাতো তার ঠাকুমার সঙ্গে। চারুবালা যেন তার পরিবারের সকলকে, বিশেষ করে তার নাতি নাতনিদের, স্নেহ দিতেই পৃথিবীতে এসেছেন। অনেক বড় হয়েও অর্চি ঠাকুমাকে কখনো ভুলতে পারেনি। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন তার উপরে কোনদিন অর্চি রাগ করতেও পারেনি, এমন পক্ষপাত তাঁর স্নেহে। অন্য ভাই বোনেরা অর্চিকে বলতো ঠাকুমা তো প্রথমে তোর, তারপর আমাদের।

ছোট্ট বেলায় সে ঠাকুমাকে  জড়িয়ে শুয়ে থাকত প্রথম রাতে। চারুবালার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। অনেকটাই পাকা, তবু কিছু কালো চুলের শীর্ণ রেখা সেই পলকা চুলের মধ্যে টিকে থাকে, যেন উত্তরবঙ্গের শীতের নদী, সাদা বালি আর নুড়ির মধ্যে কোনমতে টিকে থাকা কালো জল-রেখা, আর সেখান থেকে ভেসে আসত নারকোল তেলের সুবাস। তার  সাদা শাড়ির মধ্যে মুখ গুঁজলে পাওয়া যেত পবিত্রতার গন্ধ। কাপড়ে দেওয়া নীল, মাড় আর স্নেহের মিশেলে এ ঘ্রাণ সৃষ্টি হয়।

অর্চিদের রান্না ঘরটি ছিল মূল বাড়ির থেকে একটু ফারাক রেখে, ছোট্ট একটা উঠোন পেরিয়ে। রান্না ঘরের আবার দুটি ভাগ। তার একটি চারুবালার জন্য। বিধবা চারুবলার আলাদা নিরামিষ রান্নার ব্যবস্থা। ঠাকুমা সেখানে পিঁড়ি পেতে বসে কাঠের উনোনে রান্না করতেন। তার রান্না থেকে ওঠা সুবাস ছিল ক্ষিদে উদ্রেককারী। ফুটন্ত কালোনোনিয়া চালের সুবাস বাতাসে ভাসত। ঠাকুমা যখন খেতে বসতেন, তার পাশে গিয়ে প্রায়ই বসে পরত অর্চি।

- আমার পেরসাদ খাইবা?

- আমি আজ তোমার সঙ্গেই খাবো ঠাকুমা।

পরে অর্চি ঠাকুমাকে আবার ডাকে,

- ঠাকুমা?

- বলো নসু 

- সেই শুয়োর শিকারের  ছড়াটা বলো না।

- একই ছড়া রোজ শুনথে ইচ্ছা হয় তোর?

গল্প একই। বনে গিয়ে শিকার করা হয়েছে এক শুকর। রান্না হয়েছে, এবার চেখে দেখার পালা। গল্প এক কিন্তু ঠাকুমার গল্প বলার সুর তবু যে পুরোনো হয় না। ঠাকুমা শুরু করেন,

- আরে ডাইক্যা আনো দেবু বাবুরে চাইখ্যা দেখুক বাডি রে, কোন বনে তোর গাধী রে?

- না না কাকা না, আমার নাম বলো ঠাকুমা।

ঠাকুমা আবার বলেন,

- ডাইক্যা আনো অর্চি বাবুরে চাইখ্যা দেখুক বাডি রে।

- ঠাকুমা তুমি বাটি কে বাডি বলো কেন?

- এ আমাদের দেশের উচ্চারণ, অহন কী আর জিহবা পাল্টাইবে?

- ঠাকুমা তোমরা যেদিন গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিলে সে দিনের কথা আবার বলো না।

এও তো বহু বার শোনা কথা। সদর দরোজায় তালা দিয়ে পোটলা পুটলি নিয়ে সেই 'ইস্টিমারে' ওঠার গল্প। উঠোনে পরে রইলো ডাই করা মুসুরির ডাল। দুয়ার বন্ধ করে মারা হল তালা।

তাদের গ্রামে দাঙ্গা লাগেনি কোন, তবু আশঙ্কায় উদ্বেগে ত্রাস-তাড়িত আরো কিছু পরিবারের মত অর্চির ঠাকুরদার পরিবারও দেশ ছাড়তে উদ্যোগী হয়েছে। হয়তো পরিবারটি অন্তত আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতো, কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেল ছোট একটা ঘটনা।

চারুবালার সেজ পুত্রটি করত শরীর চর্চা। বছর পনেরোর ছেলেটি সুযোগ পেলেই দেখে নিতে চাইত শরীরে কতটা শক্তি তার জমা হল। পূর্ব বাংলার নানা স্থান থেকে সে সময় দাঙ্গার খবর আসছে। পূর্ব বঙ্গ ছেড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের তখন পালিয়ে আসার পালা। একটা চাপা উত্তেজনা হিন্দু মুসলমানের মধ্যে, মনে তাদের বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। উৎকণ্ঠায় বেশি করে ভুগছে উচ্চ বর্ণের হিন্দু সমাজ। দেশ ছেড়ে যাবার অনিবার্যতা তারা টের পাচ্ছে বেশি করে।

লোভ, দ্বেষ, হননেচ্ছা ইত্যাদির মত বিষ সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের মনে জমা থাকে, যেমন নাকি থাকে প্রেম প্রীতি ভালোবাসার মত মঙ্গলকর দিকগুলো। যখন যেখানে যারা শক্তির অধিকারী তারা সেখানে অত্যাচারীর ভূমিকা নেয়। আবার এরই মধ্যে শক্তিধরেদের কেউ কেউ রেখে যায় উদারতার চিহ্ন। এমনি জটিল আর ভয় আর আধোবিশ্বাস অবিশ্বাসে মেশা সেদিনের পূর্ব বঙ্গের হিন্দু বাঙালি সমাজ।

চারুবালার স্বামীর কাছে প্রতিবেশী মুসলমানদের কয়েকজন মানুষ যেমন এসে বলে, কেন বাড়ি ঘর ছেড়ে যাবেন। তারা আশ্বাস দেয় আমরাতো আছি। আবার আরেকদল ভাবে এই মানুষগুলি দেশ ত্যাগ করলে এই বসত বাড়িগুলি, এই জায়গা জমির দখল তাদের হাতে আসবে। তারা নানা ভাবে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করতে চায়।

তো একদিন এরকম দুঃসময়ে চারুবালার সেই ডাকাবুকো ছেলেটি দুটি মুসলমান ছেলেকে দু চার ওজনদার ঘুষি ও মোক্ষম কোন প্যাঁচ লাগিয়ে মাটি ধরিয়ে দেয়। ছেলেগুলি তাঁদের বাগানের বেড়া ভেঙে ঢুকে তাদের আখ কেটে নিচ্ছিলো। এতো সাহস এদের কবে হল। এই ভাবনাতে অবাক হয়েই ঘটনাটা যেন সে ঘটিয়ে ফেলে। বিকেলে দল বাড়িয়ে ছেলেগুলি ফিরে এসে ভানুর খোঁজ করে।

- ওরে বাইরে বাইর করেন।

সে ছেলে বাড়িতে ছিলো না। সে বন্ধুর বাড়ি তাস খেলতে গিয়েছিল। বাড়ির একজন সেই খবর তাদের জানাতে তারা ভোঁতা কিছু নোংরা গালাগালি সহ বলে যায়, তারা ফিরে আসবে আবার এবং তখন তার তাস খেলা তারা পোঙ্গায় ঢুকিয়ে দেবে। 

প্রতিবেশী গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা ব্যাপারটা তখনকার মত মিটিয়ে দিলেও অর্চির দাদু সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন আর নয়, এবার পাততাড়ি গোটাতে হবে।

এসব গল্প অর্চি জানে, কাকার ঝাড়পিটের অংশটা সে কল্পনায় একবার দেখে নেয়, কিন্তু অর্চি শুনতে চায় সেই অংশটা, যেখানে রওনা হবার আগের মুহূর্তেও ঠাকুমাদের পরিবার ভাবছে অবস্থা একটু ভালো হলেই তারা আবার দেশে ফিরবে। অথচ ঠাকুমাদের পোষা কুকুর দুটি, কালু আর লালু, তারা টের পায় যে এটাই পরিবারটির শেষ যাত্রা। সেই অসহায় বোধহীন কুকুরদুটি স্টিমার ছাড়তেই জলে ঝাঁপিয়ে পরে। যতদূর পারে প্রাণপনে সাঁতার কেটে আসতে চায়। তাদের দিকে তাকিয়ে অর্চির কাকাদের চক্ষু দুটি জলে ভরে ওঠে। তারা তখন নেহাতই নাবালক তবু তারা দেশ ভাগের কথা কিছু কিছু বোঝে। কিন্তু কুকুর দুটো কী করে টের পায়? এর আগেও তো সকলে স্টিমার যাত্রা করেছে। কই তারা তো জলে লাফিয়ে পড়েনি। 

- ও ঠাকুমা তুমি কাঁন্দো নাই ওদের লইগ্যা?

অর্চি ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলে যখন মাঝে মাঝে দেশের ভাষা আপনা থেকে বলে ফেলে।

- ওরে আমার নসু, কুকুরদের তরে আমার কাঁন্দনের অবস্থা আছে তহন। পোটলা পুটলি, পোলা মাইয়া, তোর দাদুরে লইয়া বইসা আছি। বুকের ভিতর শিল নোড়ায় বাটনা বাটে। তবে হ, দেখছিলাম তারা আর স্রোতের সঙ্গে পাইরা উঠতেছে না, হ্যাসে ফিইরা যাইতেছে।

এ পারে এসে কলকাতায় সপরিবারে কিছুদিন পানিহাটি অঞ্চলে মামার বাড়িতে কাটিয়ে অর্চির বাবার এক পিসেমশাইয়ের বদান্যতায় ডুয়ার্সের চা বাগানে চাকরি হয়,অন্য দুই ভাই কিছুদিন পরে ওই চা বাগানেই ঢুকে পড়ে।

চা বাগানের বৃহৎ কোয়ার্টার, সবজি বাগান, গরু হাঁস মুরগী, সস্তায় রেশন, বিনা পয়সায় ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদির জোর বিরাট পরিবারটিকে বাঁচিয়ে দেয়। সুনীল ও তার দুই ভাই একই কোয়ার্টারে থাকতে শুরু করে। চাকরি সূত্রে তাদের আলাদা কোয়ার্টার পাবার কথা তবু তারা একই সঙ্গে থাকে। তাছাড়া তখনো অর্চির মেঝকা ও সেঝকার বিয়ে হয়নি। অন্য দুই ভাই ডুয়ার্সের অন্য চা বাগানে চাকরিতে ঢুকে পরেছিল। সুনীলদের বাবা এদেশে এসে বেশিদিন বাঁচেননি। চারুবালা থাকেন সুনীল ও তার অন্য দুই পুত্রকে নিয়ে, সুনীলের কোয়ার্টারে। বাকি পুত্রদ্বয় ছুটির দিনে মায়ের কাছে আসে। সকলে একবাক্যে সে সময়ে বলতো যে সেনগুপ্তরা হল আদর্শ যৌথ পরিবারের উদাহরণ। তবে সব ভাইকেই অল্প বয়সে চাকরিতে ঢুকে যেতে হওয়ায়, লেখাপড়া সকলে ভালোভাবে শেষ করতে পারে না। একমাত্র অর্চির ছোটকাকা যিনি কিনা সে সময়ে ছিলেন নিতান্তই ছোট তিনি স্কুলের গণ্ডি পার হলে, তাকে কলকাতায় কলেজে পাঠানো হয়। সকল ভাই এর উচ্চ শিক্ষিত হবার ইচ্ছা যেন তার মধ্যে দিয়েই পূর্ণ হবে।

দুই কাকাই তখন অবিবাহিত। কাকিমারা তখনো আসেন নি। অর্চির মা ঠাকুমা সারাদিন গৃহকর্মে ব্যস্ত। সুনীল ছিলেন অফিস পাগল মানুষ। অর্চি কাকা পিসিদের আদর পেয়েছিল অধিক। ছোটবেলাটি দিব্যি কাটিয়েছিল যৌথ এই পরিবারে।

 

বাগানি দুইদিন হল বাড়ি ফেরেনি। সেই শুক্রবার সে বেরিয়েছিল সকাল বেলা, বিকেলেও সে ফেরেনি। আজও ফিরলো না। চারুবালা চিন্তিত। তিনি শুক্রবার রাত থেকেই বার বার বলছেন,

- ও দেবু, ও ভানু, বাগানির একবার খোঁজ নে তোরা। ফেরে নাই কাল থিয়া।

সুনীলকে তিনি এইসব অনুরোধ করেন না। বড় ছেলে, ঘরে বাইরে তার অনেক দায়িত্ব। আর ছোট ভাইরা থাকতে এইসব কাজ সে করবে কেন?

রবিবার দেবুর সাইকেল, জুতো, জামা-প্যান্ট ইত্যাদির যত্ন করার দিন। সে সৌখিন মানুষ। তার সাইকেলটি উঠোনে বের করে বেশ করে মুছছিল সে। তার বর্ণ গৌর। মুখশ্রীও সুন্দর। কোঁকড়া চুল ব্যাকব্রাশ করা। অর্চি কাকার সহকারী হিসেবে পাশে পাশে ছিল। সাইকেলের চেনে, ব্রেকে দেবার তেল, শুকনো কাপড় ইত্যাদি কাকাকে এগিয়ে দিচ্ছিল।

এমন সময় চরুবালা আর একবার গোয়াল ঘরটা ঘুরে এলেন। বাগানি ফেরেনি। দেবুকে উঠোনে নিশ্চিন্তে সাইকেল মুছতে দেখে তিনি বললেন,

- ঘরে বইয়া রইছ। বাগানিরে খুজবে কেডায় ?

দেবু ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সুতরাং লেবার চড়াতে হয় তাকে। ফলে খুব সরল উচ্চারণে মাঝেমাঝেই তার মুখ দিয়ে অপভাষা নির্গত হয়। অর্চির বেশ মজা লাগে। মায়ের কানে যাতে না যায় এমনি নিচু স্বরে দেবু বলে,

- এইরে পোঙা মারসে।

তারপর গলা তুলে বলে,

- যাইতেছি মা এহনি।

দেবু জানে বাগানি কোথায় আছে। এই বজ্জাত গরুটার মাঠের ঘাস কিছুতে পছন্দ না, তার ঘাস খেতে ঢুকতে হবে চা বাগানে। এ কারণেই তার নাম হয়েছে বাগানি। চা বাগানে ঢোকার অপরাধে তাকে খোঁয়াড়ে পোরা হয়েছে। চৌকিদার দেবুকে নিজেই খবর দিয়েছিল,

- দেবুবাবু আপকা গাই কো খোঁয়াড় ভেজ দিয়া। বাগান মে ঘুসা থা।

দেবু তার নিজস্ব হিন্দিতে বলে,

- হামকো বাম্বু দেকর, ফির হামকোই খবর দেতা হ্যায় বুরবক! ফির সে বকশিস ভি মাঙ্গেগা কেয়া? বরিয়া খবর কে লিয়ে?

দেবুবাবুর কথা বার্তার তরিখা সকলেই জানে। কথার মধ্যে থাকে স্ল্যাং আর কৌতুক, কেউ এতে রাগ করে না। তাছাড়া বেইজ্জতি কথা বললেও বাবুদের মুখের উপর কিছু বলা চলে না কুলিদের। চৌকিদার বলে, সে নয়, মোহন চকিদার বাবুর গরুকে খোঁয়াড়ে দিয়েছে।

সুতরাং সাইকেল সাফ স্থগিত রেখে দেবু বলে,

- চল অর্চি বাগানি কে লইয়া আসি।

এখন যে স্কুলে পড়ে অর্চি দেবুকেও দেশ থেকে আসার পর সেখানেই ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু দেবু ভাবত কবে সে রোজগারে ঢুকবে। বি.এ. পর্যন্ত যাবার তার ধৈর্য্যছিল না। দাদার পাশে তাকে শীঘ্র দাঁড়াতে হবে। সংসারের প্রয়োজন সে টের পেত।

এদিকে পড়াশুনোর চেয়ে শয়তানী বুদ্ধিতে তার পারদর্শিতার কথা ছাত্রদের থেকে মাষ্টারমশাই পর্যন্ত সকলেই অবগত ছিলেন। ওপার বাংলা থেকে এপারে এসে সে কিছুদিন ছিল পানিহাটি অঞ্চলে, সেখানেই সে তার চমৎকার দেখিয়ে এসেছে ইতিমধ্যে। স্কুলের মাষ্টারমশাইরা নাকি দেবুর সহপাঠীদের সাবধান করে দিতেন, ওর পাল্লায় পরিস না, ও কলকাইত্তা পোলা, তার উপর আগে থাকত বরিশালে।

তো টেস্ট পরীক্ষার আগে দেবু টের পায় যে পরীক্ষার খাতায় কষার মত কোন অংক সে আয়ত্ব করেনি। অন্য বিষয় তাও ম্যানেজ হয়ে যাবে। কিন্তু অংকের কী হবে? সে সময় তার এক স্যাঙাত জুটেছিল। এই স্যাঙাত কার্তিককে নিয়ে প্রেসের মালিককে ভজিয়ে ভাজিয়ে পরীক্ষার দুদিন আগে অংকের প্রশ্নপত্র বাগিয়ে এনেছিল! অংকেই ছিল তার ভয়। তবে শেষ দুদিনে দেবু ও কার্তিক সব অংক মুখস্ত করে ফেলে। কী করে যেন হেড মাষ্টারমশাই ব্যাপারটা জেনে ফেলেন। পরীক্ষার দিন ক্লাসে ঢুকে তিনি প্রশ্নপত্র বিলি না করে বোর্ডে প্রশ্ন লিখতে থাকেন। নতুন সব অঙ্ক। দেবু ও কার্তিক বিপাকে পড়ে যায়। কিন্তু দেবু দমবার পাত্র নয়। সে উঠে দাঁড়িয়ে পরীক্ষার্থী বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে তোরা ছাপানো প্রশ্ন ছাড়া পরীক্ষা দিবি না। মাষ্টারমশাইকেও সে একই কথা বলে।

- স্যার আমাদের ছাপানো প্রশ্ন দ্যান।

তারপর সে অমোঘ অস্ত্রটি নিক্ষেপ করে,

- আমরা কি ফি দি নাই।

ফি দেওয়া স্বত্ত্বেও ছাপানো প্রশ্ন নেই কেন। স্যার কে কোন ভাবেই টলাতে না পেরে সেদিন দেবু সকলকে আহ্বান জানায়,

- চল আমরা বাইরাইয়া যাই।

কিন্তু কার্তিক ছাড়া তার ডাকে আর কেউ সাড়া না দেওয়ায়, তারা দুজনেই সেদিন ওয়াক আউট করেছিল।

 

স্কুলের গণ্ডি  পার হয়েই দেবু চা বাগানে ঢুকে পরে।

সেদিন গরু খুঁজতে কাকা ভাইপো সাইকেল নিয়ে পথে নামে। সাইকেল চলে নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে। চালক দেবু। কেরিয়ারে অর্চি। টায়ার আর নুড়ি পাথরের ঘর্ষণে একটা চর চর শব্দ ওঠে। সাইকেল চলে অনায়াসে। চালকের যেন কোন পরিশ্রম নেই। সাইকেলটি খুবই যত্নে রাখে দেবু। এই নর্টন সাইকেলটা নিয়ে তার খুব গর্ব। এটি তার প্রাণ।

- দ্যাখ কেমন ঝিম ধরসে সাইকেলডা।

অকারণে দেবু বেলটা একবার বাজিয়ে দেয়।

- তোর সাইকেলটার অবস্থা তো খগেন।

- চলতে চায় না মেঝকা। বার বার চেন পরে যায়। আর কি উঁচু। আমি সাইকেলের সিট্ থেকে মাটিতে পা ঠেকাতে পারি না মেঝকা। নেমে পরতে হয়।

- এক কাম কর। কাইল অনিলের দোকানে দিয়া আসিস সাইকেলডা। যা যা ঠিক করনের করথে কইবি। আমি টাকা দিমুহানে? দাদার কাছে টাকা চাওনের কাম নাই।

তারপর কী ভেবে বলে,

- থাউক দরকার নাই। আমারটাই নিয়া যাস কাইল থিক্যা।

অর্চি একথা বিশ্বাস করতে চায় না। প্রাণের সাইকেল মেঝকা তাকে স্কুলে নিয়ে যেতে দেবে। সে বলে,

- আর তুমি কি নিয়া ফ্যাক্টরি যাইবা?

- আমি হাইট্যা যামু। তুই নিয়া যাস সাইকেল। যত্নে রাখবি। কাউরে দিবি না। আর  হঠাৎ কইরা জোরে ব্রেক কষবি না।

গরু খোঁয়াড় থেকে ছাড়িয়ে মেঝকা বাগানীর গলায় দড়ি পরিয়ে টেনে নিয়ে চলে। সামনে চলে অর্চি। সবুজ ঝকঝকে সাইকেলটি সে ঠেলে নিয়ে যায়। চা বাগান যেখানে শেষ, তারপরে শুরু শুকনো শক্ত মাটির অঞ্চল। কাঁটা গাছের জংগল চারদিকে, মধুফুলের ঝোপ। বিকেলের ছায়া নামছে। সূর্য শেষ কমলা রোদের ঝাঁপি উল্টে আজকের মত কাজ গুটিয়ে নিচ্ছে।

সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে পেছন থেকে দেবু অর্চিকে দেখতে দেখতে ভাবে, অর্জী তিতির আর বৌদি বর্ধমানে যাবার পর ছেলেটা কেমন মন মরা হয়ে থাকে। একটু রোগা হয়েছে নাকি? লেহাপড়ায় তো মন নাই, দিনরাত্রি পড়ে গল্পের বই। তার মনে বড়ো মায়া জাগে ছেলেটার জন্য।

- অর্চি তুই সাইকেল নিয়া চইল্যা যা। পথ তো চেনস। মায় রে লুচি ভাজতে ক, বিকাল হইয়া গেল, এখন আর ভাত খায়নের কাম নাই। ক’ গিয়া আমি আইতাছি বাগানীরে লইয়া। গিয়া খবর দে হারামিটারে পাওয়া গেছে।

অর্চি কিছুক্ষণ মেঝকার প্রস্তাব বিবেচনা করে, সাইকেলটা চালাতে তার হাত পা নিসপিস করে! কিন্তু মুখে বলে,

- না মেঝকা  আমি তোমার একলগে যামু।

- ক্রমশ 

 

2 Comments
  • avatar
    SAMIRENDRA NATH PANDE

    16 April, 2024

    ভালো হচ্ছে - এগিয়ে চলুক - বাঙাল ভাষা ভালোই রপ্ত আছে এখনও দেখছি

  • avatar
    স্বপন পাড়িয়া

    12 May, 2024

    ভাষা ও স্বপ্নময়তার বুনোট এত মসৃন যে গল্প ছিপখান- তিনদাঁড় এর মতো তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে । পড়তে গিয়ে থামা যায় না। তিনটে পর্বেই এটা মনে হয়েছে। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a reply