অর্চিষ্মান - দ্বিতীয় পর্ব

লিখেছেন:অপূর্ব দাশগুপ্ত

বর্ধমান, ১৯৭৪

  

বীরহাটা থেকে জি.টি. রোড সোজা চলে যায় কলকাতার উদ্দেশ্যে। বাঁকা নদীর উপর দিয়ে ব্রিজ হয়ে আরেকটি রাস্তা গেছে দামোদর নদীর দিকে, সেটা সদরঘাট রোড। সদরঘাট পৌঁছোনোর কিছুটা আগে বড়ের মোড়। এই মোড় থেকে ডানদিকে কিছুটা হাঁটলেই অর্চির কাকা প্রিয়নাথের ভাড়া বাড়ি। তিনি কলেজে ইতিহাস পড়ান। কলেজ তার শহরের বাইরে রায়নার পথে, কলেজে যেতে তাকে বাসে যাতায়াত করতে হয়। পথে পড়ে সদরঘাট। এখানে দামোদরের উপর ব্রিজ নেই। যে শীর্ণ জলধারাটুকু বালির উপর প্রায় স্রোতহীন অবস্থায় পড়ে থাকে, তা পার হতে নৌকোর ব্যবস্থা। জলের এপাড়ে বর্ধমান শহরের দিকেও বাস দাঁড়িয়ে থাকে, যা কিনা যাত্রীদের নিয়ে যাবে বর্ধমান শহরের কেন্দ্রে, ’কার্জন-গেট’ অব্দি। নদী পেরিয়ে এসে, এই কার্জন-গেটগামী বাস ধরে প্রিয়নাথ বিকেলে বাড়ি ফেরেন। কোনো কোনো দিন আবার হেঁটেও ফেরেন।

অনেক দিন এমন হয় কলেজ ফেরতা প্রিয়নাথের সঙ্গে অর্চির দেখা হয়ে যায় সদরঘাটে। পাতলা রোগা কালো মানুষটি, চোখে চশমা। পাশ থেকে অনেক সময় মানিক বন্দ্যোপধ্যায়ের মত দেখায় তাঁকে। হাতে কালো রঙের ফোলিও ব্যাগ। প্রিয়নাথই হয়ত দেখতে পান বালির উপর দিয়ে অন্যমনস্ক অর্চি হেঁটে হেঁটে আসছে। তিনি বোঝেন ছেলেটার মন বসছে না নতুন পরিবেশে। কিন্তু  দুর্বলতা প্রদর্শন তার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাছাড়া অর্চিকে বেড়িয়ে আসতে হবে তার মায়াময় অতীত থেকে; অতীত জগত, অতীত সম্পর্কগুলি থেকে। দাদা অনেক ভরসা করে তার কাছে পাঠিয়েছেন ছেলেকে। তার কর্তব্য অর্চিকে বাস্তবের সঙ্গে সন্ধি করিয়ে দেওয়া। তিনি হাতছানি দিয়ে অর্চিকে ডাকেন, চল একসঙ্গে ফিরি। অর্চি সংকুচিত হয়ে কাকার সঙ্গে হাঁটে।

সন্ধ্যা নামছে। লম্ফ আর হ্যারিকেন জ্বলে উঠছে রাস্তার চপ, ফুলুরি, বেগুনি, মিষ্টি, মুদির ছোট ছোট দোকানগুলিতে। রাস্তায়, ঝোপঝাড়ে, দোকানের মাটির দেওয়ালে কে যেন এঁকেছে আলো আঁধারের অপটু আলপনা। পেছনে নৌকাগুলিতেও জ্বলে উঠছে আলো, আলোর ছায়া পড়ছে দামোদরের কালো জলে। বালি কিছুটা ভেঙে রাস্তায় উঠতে হবে। সদর ঘাটের এপার থেকে বাড়ি ফিরতে আজ আর বাস ধরেন না প্রিয়নাথ। তিনি অর্চির সঙ্গে কথা বলবেন, তাই হেঁটে ফিরবেন আজ।

- ‘এক্সাস্পারেটিং এসে’ বইটা নামিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। পড়েছিস দুপুরে?

- শুরু করেছিলাম, কিন্তু ভালো বুঝতে পারছি না। রেখে দিয়েছি।

কাকা হাসেন। বলেন, শ্লেষের সুরে নয়, মজা করেই বলেন,

- এ তো তোর সুজন বাবুর উপন্যাস নয়, ওমলেট খেতে খেতে লেখা। এসব বই ধরে পড়তে হয়।

অর্চি সুজন বাবুর কবিতা উপন্যাস খুব পছন্দ করে। কিন্তু প্রিয়নাথ, শুধু প্রিয়নাথ নয়, প্রিয়নাথের বন্ধুদেরও অপছন্দের লেখক সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়। তারা বলেন, তিনি প্রতিক্রিয়াশীল লেখক। একদিন অর্চি জলখাবার খেয়ে সুজন বাবুর একটি উপন্যাসে মগ্ন হয়েছিল বিছানায় আধসোয়া হয়ে। কাকা কলেজে বের হবার আগে অর্চির বিছানায় একটি বই রেখে বলেছিলেন, যেটা পড়ছিস শেষ করে এই বইটা পড়বি আজ। অর্চি দেখেছিল বইটির নাম ‘ইস্পাত’। লেখক, নিকোলাই অস্ত্রয়ভস্কি। আত্মমগ্ন হয়েই বইটা পড়েছিল অর্চি সেদিন। মুগ্ধ হয়ে ভেবেছিল এতো আত্মবলিদান, এতো নিয়মানুবর্তিতা  বিপ্লবীদের মধ্যে থাকে। তার বন্ধু প্রীতমেরও ছিল?

কাকার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে অর্চি বলে, আমি আজ অন্য একটা বই পড়েছি তোমার আলমারি থেকে নামিয়ে।

- কি বই?

- ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি।’

- কাকাবাবুর লেখা।

- মুজফ্‌ফর আহমেদের লেখা দেখলাম।

- উনিই কাকাবাবু।

দুপুরবেলাগুলি অর্চির এখানে কাটে দীর্ঘকায় এক সাপের নির্জন রাস্তা অলসগতিতে পার হবার মত করে। প্রিয়নাথ কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাবার পর দুপুর একটার মধ্যে খাওয়া মিটিয়ে কাকিমা বিশ্রাম করেন বা সেলাই করেন তার ঘরে। এ বাড়িতে মোট তিনটি ঘর। অর্চি যে ঘরটিতে থাকে সেটি অন্য ঘরগুলির তুলনায় ছোট। একটি জানালা রয়েছে সেই ঘরে। বর্ধমানের এক অখ্যাত পাড়ার দুপুর সেই জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি মেরে অর্চিকে দেখে। জানালার ওপারে মাটির অপ্রসস্থ রাস্তা চলে গেছে কালী বাড়ির দিকে। গলির বাম দিকে পান বাবুদের বিরাট তিন-তলা বাগান ঘেরা বাড়িটি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রৌদ্রে পোড়ে সারাদিন। অর্চি শুনেছে পানদের গ্রামে অগাধ জমিজমা। কাকার বন্ধু ও সহকর্মী তপোব্রত একদিন অর্চিকে বলেছিল, বর্ধমানে তুই এদের পাবি। এদের যত বেশি এগ্রিকালচার, ততটা কম কালচার।

এখানে সূর্য যথেচ্ছ রৌদ্র ঢালতে থাকে চতুর্দিকে। তাদের ডুয়ার্স এসময় বর্ষায় স্নিগ্ধ। জুলাই মাস তবু বর্ষার দেখা নেই এখানে। এরকম ঠা ঠা রোদ আর গরম সে আজন্ম দেখেনি। দুটি নিতান্ত বালক প্রায় রোজই বাড়ির অভিবাবকদের ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় এসে খেলা করে। কিন্তু ওদের চাপা কন্ঠস্বর নিস্তব্ধতাকে ভাঙতে পারে না। নির্জনতাকেও না। ওরা ছাড়া আর কেউ নেই কোথাও, রাস্তায় কিংবা বারান্দায়।

খাকি প্যান্ট শার্ট পরা একটি মানুষ রোজই সাইকেল চালিয়ে এই দ্বৈপ্রহরিক নিদাঘ অস্বীকার করে জানালার সামনে দিয়ে চলে যায়। তার আসার প্রতীক্ষায় বসে থাকে অর্চি। যেদিন চিঠি থাকে, সে ক্রিং ক্রিং করে দুবার বেল বাজিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে চিঠি ঢুকিয়ে দিয়ে যায়, মুখে বলে, চিঠিটা নিন। ওঘর থেকে কাকিমা বা অর্চি এসে মেঝে থেকে চিঠি কুড়িয়ে নেয়। ইনল্যান্ড বা পোস্টকার্ডে, কখনো কখনো খামে চিঠি আসে। মা লেখেন, সমীরণ স্যার লেখেন, পলাশ লেখে। লেখে না কেবল আরশি দি। লিখতে পারে না। লিখতে বারণ। অর্চিও লেখে না তাকে। সে ও লিখতে পারে না। পলাশের চিঠি সে অধীর আগ্রহে পড়ে। অর্চির বিহনে কেমন ফাঁকা লাগছে তার, সে কথা সে লেখে। চা বাগানের সকলের খবর দেয়। আরশিরও। একদিন সে লেখে, আজ বিকেলে আরশির সঙ্গে দেখা হল। কলেজ থেকে ফিরছিল। বাস থেকে নেমে আমাদের চা বাগানে ঢোকার দ্বিতীয় পথ ধরে। আজ তার সঙ্গে কেউ ছিল না। সঙ্গে কেউ থাকলে তোর কথা তো জিজ্ঞেস করে না। আজ তোর খোঁজ নিল। তোর চিঠি পেয়েছি কি না। আমি বলেছি, অর্চি প্রতি চিঠিতে তোর খোঁজ নেয়। আজ ওর মুখটা খুব শুকনো দেখালো। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আরশি কেমন আছিস তুই। বলেছে ঠিক আছি। চিঠি পড়ে সে চুপ করে বসে থাকে, নিজেকে বোঝায় আর তো কটা মাস। আরশি বলে নয়, ডুয়ার্সের পথ, ঘাট, গাছ পালা, নদী, চা-বাগান, বন্ধুরা সবাই ওকে ডাকে। সমবেত এই আহ্বানগুলি তাকে উতলা করে। সে ভাবে, পুজোয় সে বাড়ি ফিরবে। এ কটা মাস তাকে কাটিয়ে দিতে হবে।

কাকার বসার ঘরের দুটি আলমারি বই-এ ঠাসা। পাষানভারের মত সময়গুলির বিরদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে এগুলিকে কাজে লাগানো ছাড়া অর্চির অন্য তেমন কোন উপায় নেই। আর একটি সহায় তার আছে। একটি ছোট ট্রানজিস্টার। আলমারির বইগুলি থেকে সে বেছে বেছে বই পড়ে। গল্প-উপন্যাস বেশি। কাকা মাঝে মাঝে  বলে দেন এটা পড়বি। সেগুলি বেশিরভাগ ইতিহাস বা প্রবন্ধ। মুজফ্‌ফর আহমেদের বইটা উনিই পড়তে বলেছিলেন। এখন বোধ হয় বিস্মৃত হয়েছেন।

পথ হাঁটতে হাঁটতে কালী মন্দির এসে গেলে তারা দুজনে সদরঘাট ছেড়ে বাঁ দিকে মাটির পথটা ধরে। এই পথ তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবে। অর্চি একসময়য় বলে, কুট্টিকাকা, এই বইতে একজনের কথা উনি লিখছেন, এম.এন.রায়। এনার নাম আমি এই প্রথম জানলাম।

প্রিয়নাথ চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন, উনি আর কয়েকজনের সঙ্গে প্রবাসে এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওনাকে পরে বহিষ্কার করা হয়েছিল। রেনিগেড।   

এর কিছুদিন পরে সদরঘাট থেকে সন্ধ্যা পার করে একদিন অর্চি বাড়ি ফিরে দেখে বাড়ির পরিবেশ একেবারে অন্যরকম। কোন ঘরে আলো জ্বলেনি। অন্যদিন ঘরগুলি টিউব লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে, আজ এমন কেন? অর্চিদের চা বাগানের কোয়ার্টারেও বিজলি বাতি ছিল, কিন্তু ছিল না টিউব লাইট। সিলিং থেকে ঝোলা বাল্বগুলি জোরালো আলো দিতে পারতো না। টিমটিমে আলোয় অভ্যস্ত সে, তাই এখানে ছোটকাকার বাড়িতে এসে এই বেশি আলোয় অস্বস্তি বোধ করতো প্রথম দিকে। অর্চি বসবার ঘরে কাউকে দেখতে পেলো না। ভিতরের বারান্দায় গিয়ে দেখলো তার কাকা সিঁড়িতে দুই হাতে মুখ ডুবিয়ে বসে রয়েছে। পাশের ঘরের খাটে কাকিমা চুপ করে বসে আছেন। অর্চি জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে  কাকিমা? 

কাকিমা উত্তর দেন, 

- হরেকৃষ্ণ কোঙার আজ মারা গেছেন।


 

ডুয়ার্স, ১৯৭১

  

মানুষের বুকের ভেতরটায় স্তরে স্তরে বিভিন্ন জল ভরা পাত্র রাখা থাকে। তাদের উপর যখন কোন মাহেন্দ্রক্ষণে ছড়ির আঘাত এসে পরে তখন এক একটি পাত্র এক এক রকম ছন্দময় সুর সৃষ্টি করতে থাকে। মানুষের অন্তরটা যেন একটি জলতরঙ্গ। কখন যে কোন মানুষের অন্তরের কোন পাত্রটিতে আঘাত পড়বে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। ভাগ্যে অবিশ্বাসী মানুষেরও তাই ভাগ্যকে না মেনে অনেক সময় কোন উপায় থাকে না। এই আঘাত মানুষকে জাগিয়ে তোলে। সে মানুষ বড়ই হতভাগ্য যার অন্তরের সুর-বাঁধা তারাগুলি স্পর্শের অভাবে অব্যক্ত থেকে যায়।

অর্চির মর্মদেশের একটি সুর ভরা তার যেমন আরশির কোমল স্পর্শে বেজে উঠেছিল, ঠিক তেমনি তার দুয়েকজন বন্ধুর সংস্পর্শ তার মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল বিবিধ জিজ্ঞাসা - মানুষ সম্পর্কে, মানুষের একসঙ্গে বসবাস করার ফলে সৃষ্ট জটিল সম্পর্কগুলোর সম্পর্কে।

প্রীতম ছিল অর্চির থেকে দু-এক বছরের বড়ো। চরিত্রে একরোখা, আকৃতিতে দীর্ঘ, বর্ণে গৌর সেই ছেলে। বয়সে বড় হলেও অর্চি তাকে নাম ধরেই ডাকে। অর্চিদের সঙ্গে বড় হতে হতে একসময় সে ক্রমেই বন্ধুদের থেকে আলাদা হতে থাকে। বিকেলে ফুটবল মাঠে তাকে আর দেখা যায় না; সামনে তার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা, বরাবর ভাল রেজাল্ট করা ছেলেটি ইদানিং আর ক্লাস করে না, কোথায় যায় কী করে কেউ তা ভালোভাবে জানে না। এমনকি অনেকদিন এমনও হয় যে সে রাত্রে বাড়ি ফেরে না। তার বাবা মা ছেলেকে নিয়ে ভয়ানক চিন্তিত। কী যে সে করে, কাদের সঙ্গে সে মিশছে তার হদিস সুলুক পাওয়া যায় না।

একদিন রাত হয়েছে অনেক। অর্চিদের কোয়ার্টারে সবচেয়ে কোণের ঘরটি অর্চির। ঘরে শুয়ে শুয়ে অর্চি ‘ঝিলে জঙ্গলে’ নামের একটি বই পড়ছিল টেবিল লাইট জ্বেলে। এসব বই সে পড়ে অনেক সময়ই। পড়তে পড়তে সে বই এর প্রধান চরিত্রের থেকে কোন এক অপ্রধান চরিত্র তার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। আহা, কেন এই চরিত্রটিকে লেখক আরো একটু গুরুত্ব দিলেন না! যেমন এই বইটিতে শেখর নায়ক নয়, নায়কের বন্ধু। অভিযানে তার সহকারী। সে বীরত্ব দেখায় না, অথচ প্রতিটি বিপদের সামনে সে বন্ধুর পাশে নীরবে থাকে। আফ্রিকার জঙ্গলে প্রাণঘাতী বিপদের সম্মুখীন এখন দুই বন্ধু। অর্চি আশা করে এবারের বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে শেখর একটা বড় ভূমিকা নিক। অর্চি যখন বইয়ের পাতায় নিমগ্ন তখন তার জানালায় দু তিনবার টোকা পড়ে। প্রীতমের চাপা গলার ডাক সে শুনতে পায়  -

- অর্চি বাইরে আয় একবার।

বাড়ির সকলে ঘুমোচ্ছে। সদর দরজা খোলার প্রশ্ন নেই। অর্চিদের এই ঘরটির জানালাতে কোন শিক নেই। সে নিঃশব্দে জানলা খোলে।

- একবার বাইরে আয়। টর্চ থাকলে নিয়ে আসিস।

অর্চি টর্চ সহ জানলা গলে বাইরে এলে, প্রীতম অর্চিদের বাগান পেরিয়ে ঘাস জমির দিকে হাঁটে। টর্চ জ্বালে না সাবধানতা বশত। অর্চি নানা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে তাকে অনুসরণ করে। প্রীতম ঘাসজমিতে এসে শিমুল গাছটির নিচে পাতা কাঠের বেঞ্চে বসে। আকাশে ক্ষীণ চাঁদ দুর্বল জ্যোৎস্না ফেলেছে। প্রীতমের সাদা শার্টটি ছাড়া আবছায়ায় আর কিছু তেমন ঠাহর হয় না। বেঞ্চে বসে প্রীতম বলে - 

- অর্চি আমার মুখে আলো ফেলে দেখ তো একবার।

অর্চি কোন প্রশ্ন না করে প্রীতমের মুখে টর্চের আলো ফেলে চমকে ওঠে। প্রীতমের সমস্ত মুখ রক্তে মাখা। কপালের আঘাতটা গভীর। নাক ও ঠোঁটের কষ দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে এসে শুকিয়ে আছে। সাদা জামা ভিজে আছে চাপ চাপ রক্তে।

- কী হয়েছে প্রীতম? কী ভাবে হল? কারা? 

- ওরা আজ অ্যাটাক করেছিল হ্যামিল্টনে। আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।

- কারা?

- বলব পরে। এখন তো এই মুখ নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারবো না।

- তাহলে?

- আমি তোর সঙ্গে শুয়ে থাকবো আজ। ভোর ভোর বেরিয়ে যাবো।

- কিন্তু ওষুধ লাগবে তো? কপাল থেকে রক্ত পরছে এখনো।

- ভোজালি টা বোধ হয় উল্টো চালিয়েছিল, বুঝলি অর্চি।

অর্চি বলে,

- কী করিস বলতো তুই? কোথায় কোথায় থাকিস! জ্যাঠিমা রোজ আমাকে জিজ্ঞেস করে।

প্রীতম হাসে, বলে

- চল, শুয়ে পড়ি।

- আর ওষুধ?

 প্রীতম আবার হাসে। বলে, লাগবে না। রতন দা ছুরি খেয়ে মাটিতে পরে গিয়েছিল, উঠে জঙ্গলের দিকে দৌঁড়েছিল, বুঝলি। তাকে চিন্তিত দেখায়। বোধহয়,রতনদার জন্য।

- প্রীতম চল হাসপাতালে যাই।

- জানাজানি হলে বিপদ বাড়বে অর্চি।

- কেউ জানবে না। আয়, ওঠ।

অর্চিদের বাড়ির উল্টো দিকেই চা বাগানের হাসপাতাল। ছোট ইউনিট। প্রসব ও ছোট খাটো চিকিৎসার ব্যবস্থা এখানে রয়েছে। বেড রয়েছে জনা ২০/২৫ রোগীর। এতো রাত্রে হাসপাতাল শুনশান। হাসপাতালের কাঠের গেটের ওপারে লন। শীতকাল। মালি ফুটিয়েছে অজস্র পিটুনিয়া, পপি, জিনিয়া। ডানদিকে বিরাটাকায় দেবদারু। কত পাখি এখন সেখানে ঘুমিয়ে। খুঁটির উপর তারে ঝুলছে বাল্ব। তার স্তিমিত আলোয় এইসব দৃশ্য প্রকাশিত হচ্ছে ওদের চোখের সামনে। গেট খুলে তারা ভিতরে পাথর বিছানো পথে পা রাখে। 

- কার কাছে যাবি বলত? প্রীতম জিজ্ঞেস করে।

অর্চি কথা না বলে মূল বিল্ডিং ঘুরে হাসপাতালের পেছন দিকে চলে আসে। সেখানে নার্সদের তিন চারটে কোয়ার্টার। একটা কোয়ার্টেরের দরজায় এসে সে কড়া নাড়ে। 

- জুলিয়ান পিসি, জুলিয়ান পিসি দরজা খোলো।

ডাকাডাকিতে জুলিয়ান দরজা খোলে। ঘরের ভেতর থেকেই জ্বালিয়ে দেয় বারান্দার লাইট। বাইরে এসে প্রীতম ও অর্চি কে দেখে জুলিয়ান নার্স অবাক হয়। বলে, 

- এতো রাতে? ক্যায়া হলোক।

প্রীতমের মুখ দেখে সে চমকে ওঠে।

- এতো রাত্রে কোথায় মারপিট করেছো তোমরা, আগে সে কথা বলো।

- মারপিট নয়, অর্চি বলে, প্রীতম সাইকেল নিয়ে পাথরের রাস্তায় পড়ে গেছে পিসি।

- বুরবক মত সমঝো মুঝে অর্চি। শিবেন বাবু কা মালুম হ্যায়?

অর্চি আবার এক গল্প বানায়। প্রীতম নাইট শো দেখে ফিরছিল হ্যামিল্টনের থেকে। কিছু লোক তাকে ধরে পিটেছে আর ওর সাইকেল টাকা সব নিয়ে গেছে। প্রীতম নুড়ি বিছনো পথে মুখ থুবড়ে পরে গেছে। অর্চি বলে,

- শিবেন  জ্যাঠা জানলে খুব বকবে পিসি। তুমি একটা ব্যাবস্থা কর। জুলিয়ানের সন্দেহ দূর না হলেও সে এবার আর কোনো আপত্তি তোলে না।

প্রীতম অর্চির উপস্থিত বুদ্ধি ও অনৃত ভাষণের তারিফ করে মনে মনে। যে অর্চিকে সে জানে, জানতো এতদিন, সে তো এমন নয়। এই গুণ সে অর্জন করল কবে, কোথা থেকে? অর্চি নিজেও তার আচরণে কম মুগ্ধ হয়নি। প্রীতমের শুশ্রূষার দরকার, এই বোধ থেকেই সে কথাগুলি চালিয়ে যায়। তাকে এসব শিখতে হয়নি। প্রীতমের বিপদে কে যেন তার হয়ে ভেতর থেকে কথা বলে চলেছে।

জুলিয়ান বলে দাওয়াইখানার চাবি তো আমার কাছে থাকে না। তোরা ভেতরে আয়।

প্রীতম একটা বেতের চেয়ারে বসে। অর্চি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জুলিয়ান স্টোভ জ্বেলে জল গরম করে। টেবিলে একটি এস আকারের পাত্রে গরম জল ঢালে। তুলো ভেজায়। কাঁচি দিয়ে তুলোটা ধরে। প্রীতমের মুখখানি গরম জলে ভেজানো তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলে প্রথমে। তারপর একটা কাঠিতে তুলো পেঁচিয়ে ধরে লাল রঙের তরল ওষুধে ভিজিয়ে নিয়ে প্রীতমের সামনে দাঁড়ায়। প্রীতম মুখটা কঠিন করে প্রস্তুত হয়। অর্চি চোখ বন্ধ করে ফেলে।

জুলিয়ান বলে, কাল এসে একটা ইনজেকশন নিয়ে যাবি।

রাত্রে অর্চির পাশে শুয়ে প্রীতম বলে, তোকে নিয়ে যাবো একজায়গায়, যাবি তো? তুই জিজ্ঞেস করছিলি না আমি কি করি, কোথায় যাই? বলবো তোকে।

(ক্রমশ... ) 

 

3 Comments
Leave a reply