একটি মহিষের গাড়ি বেশ দ্রুত গতিতে রাস্তা দিয়ে আসছে। যে দুটি মহিষ গাড়ি টানছে তারা আজ কিছু অশান্ত, পা দুটি তাদের ছন্দে নেই, মদেশিয়া গাড়োয়ানের বেতের আঘাতে তারা গাড়িটিকে নির্দেশ মত টেনে নিতে আজ অসম্মত। কাল সকাল থেকে মানুষ ও পশুদুটির বিশ্রাম নেই, তেমন ভালোভাবে খেতে পায়নি তারা। তবু গাড়ি-চালক খালি পেটেই হাড়িয়া পান করেছে কিছুটা। বহুদূরের বনাঞ্চল থেকে তারা কালো রঙের এই বিশেষ মাটি এনেছে গাড়ি করে। ঠাকুর গড়ার মাটি। বেতের আঘাতে এদিক ওদিক চলে যায় মহিষদুটি, চালকের কথা শোনে না মোটে। মদেশিয়া চালকটি অশ্রাব্য গাল পাড়ে পশু দুটিকে। অঞ্চল কাঁপিয়ে লোকটি চিৎকার করে বলে, চোদনো কেহেরামনে, সঙ্গে বেতের বাড়ি। মদেশিয়ারা মহিষকে বলে কারা। গালাগালির সুরে তা গিয়ে দাঁড়ায় ‘কেহেরা,’ ‘মনে’ হল বহুবচন।
অর্চিরা ক্লাবের সিঁড়িতে বসে আছে। আশ্বিন মাস আসছে, পুজোর আর মাস খানেক দেরি। মন্ডপের সামনে মাটি পড়া মানেই, পুজোর ঘন্টা পড়ে গেল। আনন্দ শিরশির করে তাদের শরীরে। পুজো মানে যে কতকিছু তাদের কাছে, এখন এই বয়সসন্ধিতে। কেমন এক আনন্দদীপ জ্বলে থাকে তাদের বুকের ভেতরে। চোখের বাইরে যা কিছু, এই সবুজ মাঠ, বেড়া ঘেরা বাগান, চা গাছ, লতা পাতা, আকাশ, সবকিছু স-অ-ব-কি-ছু-ই বুকের ভেতরের আলোয় স্বপ্নের আলোছায়ায় মাখামাখি হয়ে যায়। দূরে ঐ চা বাগান ছাড়িয়ে, বড় বড় গাছগুলির পেছনে, আকাশের প্রান্তসীমায় যে রহস্যে মাখা ঢেউ খেলানো কখনও নীল, কখনও সবুজ পাহাড়ের দল, তার সঙ্গে যেন কিসের মিল রয়েছে। যেন এরা তাদের স্কুলেরই সহপাঠী মেয়েরা। বৃষ্টিশেষে যে রোদ ওঠে, আনারস বনে কত রঙের ফড়িং ওড়ে, একধারে জলের স্রোত বইছে, পাশে আনারস ক্ষেত, তারই উপরে পড়েছে কমলা রোদ্দুর, কী যে মায়া ছড়ায় তারা, রুশ ছবির বই এর মত।
মহিষের গাড়ির পেছনে ওরা ছুটে যায় - অর্চি, তপন, স্বপন, পলাশ। মহিষদুটির গলায় যে ঘন্টাধ্বনি বাজছিল, তা মন্ডপের সামনে কলতলার পাশে এসে থেমে যায়। প্রথমেই তারা কিছু মাটি হাতে নেয়। এগুলিকে ওরা গোল্লা পাকিয়ে মার্বেল বানাবে, পুতুল বানাবে। রোদে রাখলে এই মাটি শক্ত হয়ে যায়। মাটি পড়েছে মানেই কাল পরশুর মধ্যে কোচবিহার থেকে মূর্তি গড়ার কারিগরেরা চলে আসবে, তাঁদের থাকার জায়গা হবে ক্লাবে, ওখানেই তারা রান্না করে খাবেন। আর দিনভর কাজ করবেন। অর্চিরা সময় পেলেই মন্ডপে গিয়ে বসে থাকবে, খড়, সুতলি দড়ি, বাতা দিয়ে নগ্ন মূর্তিগুলি তৈরি করে তারা চলে যাবে, আবার ফিরবে, মাটির কাজ করতে।
মহিষদুটিকে ছাড়া হয়ছে। কাঁধ থেকে বাঁক নেমে গেছে। এখনো তাদের চোখ দুটি রক্তবর্ণ। শনিশ্চর গাড়োয়ান কল থেকে আচলা ভরে জল খেয়ে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসেছে। গাড়ি থেকে মাটি নামানোর জন্যে আরেকজন মজুর আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। সে একমনে তার কাজ করছে।
পুজোর আগে অর্চিদের মনে প্রবল উত্তেজনা জাগে। অন্যদিকে বড়দের মধ্যেও আরেক উত্তেজনা। বড়দের, কুলি-বাবু নির্বিশেষে, একটি শব্দবন্ধকে নিয়ে উত্তেজনা --- ‘বোনাস’। এইসময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, লাল এবং সাদা, নিয়ম করে আন্দোলনে নামে। নেতারা আসেন চা বাগানে। শুক্রবারে কুলিদের সাপ্তাহিক তলব, সে দিন বাজার বসে। তরি-তরকারি, চাল-গম, খোলা না ছাড়ানো বাদাম, ছোলা ভাজা, কাঠি আইসক্রিমের বাক্স, এ সবের আয়োজন। হ্যামিল্টনগঞ্জ থেকে আসে খেলনা আর সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস, হাতা খুন্তি, হাড়ি কড়াই, এ ছাড়াও কাঁচের মার্বেল, লাট্টু, ছুড়ি, কাঁচি, রঙিন প্লাস্টিকের ফ্রেমে মোড়া আয়না, খেলনা পিস্তল। এইতো কয়েক বছর আগেও অর্চিরা এই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। ছুড়ি কিনতে ইচ্ছে হত, বা কামান গাড়ি। পয়সা হত তাদের অন্তরায়, ঠাকুরমা যে পয়সা দিত, সে দিয়ে বাদাম ভাজা বা কাঠি খেয়ে হাতে আর কিছু থাকতো না। বাড়িতে বড়রা বলতেন আইসক্রিম খাবি না, ওতে রঙ দেওয়া থাকে আর ড্রেনের জল দিয়ে বানায়, তবু অর্চিরা সেটাই লুকিয়ে খেত। সাদা রঙের একটা আইসক্রিম মিলতো, অর্চিরা সেটাই কিনত, ভাবত রঙ এতে মেলাবার সুযোগ হয়নি। বাজার হতে একটু দূরে ফাঁকা কোন জায়গায় কাটা হত শুয়োর, লেবাররা ছিল তার ক্রেতা। বাবুরা কিনতেন দেশি মুরগী গোটা গোটা। বাজারের থেকে আরো দূরে, লেবার লাইনের দিকে মদেশিয়া মেয়েরা বসতো ঝকঝকে করে মাজা অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি, অথবা মাটির হাড়িতে হাড়িয়া নিয়ে। আজ হাড়িয়ার অনেক বিক্রি, বেহিসাবি হাড়িয়া পান করে অনেকেই পড়ে থাকবে রাস্তার ধারে, আজ তাদের পকেটে হপ্তা ঢুকেছে। দু একজন কাবুলিওয়ালা রয়েছে বাজারে। বিরাট চেহারা তাদের, পাগড়ি- কুর্তা-চাপকান সহ বেশ সুদর্শন তারা। তাদের নিজেদের বসার জন্য বর্গাকৃতি একটা চৌকি পাতা আছে। তারা শ্রমিকদের বেছে বেছে পাকড়াও করছে। বলছে, রুপেয়? এ হপ্তায় কিছু হবে না শুনলে কাবুলীরা বলে, ঠিক হায় স্রিফ সুদ নিকালো, তারা হাসিমুখে শুধু সুদটুকু চায়, আসল পেতে তাদের আগ্রহ কম। তাদের ব্যবহারে কোন ভিলেনি নেই। অর্চিদের তারা ভালোও বাসে, ভাঙা বাংলায় বলে খোকাবাবু এদিকে এসো। বাবুদের দেখলে তারা সেলাম জানায়। মজুরদের পিঠে হাত দিয়ে পাওনা চায়।
একটু দূর থেকে দেখলে বাজার যেন জল রঙে আঁকা ছবি। কমলা নীল হলুদ রঙের প্লাস্টিক বাঁধা মাথায়, নিচে পসরা সাজানো, বিভিন্ন রঙের শাড়ি পরে মদেশিয়া নেপালী মেয়েরা হাঁটাচলা করছে। একটি ষাঁড় কোথা থেকে জুটে গেছে, সে তার পাওনা কলা বা সবজি চাইছে। কেউ তাকে দূর দূর করছে, কেউ দয়া করে কিছু দিচ্ছে তাকে।
পুজো এসেছে বলে আজ বাজারে উপস্থিত আছেন চা বাগানের বাইরে থেকে আসা নেতারা। পুজো এসেছে তাই বোনাস নিয়ে বাজার গরম। মজুরদের ঘাম-রক্ত নিয়ে স্লোগান ভাসে বাতাসে। ভাসিয়ে দেয় নেতারা। শ্রমিকদের থেকে কোন নেতা নেই, নেতারা আসেন গঞ্জ আর টাউন থেকে। তারা বাঙালি বাবু। নেপালি দুয়েকজন নেতা থাকলেও মদেশিয়া একজনও নেই। আজ শুক্রবারের হাটে কংগ্রেস দলের মিটিং। নেতারা টুলের পাশে দাঁড়াবে, সাদা কুর্তা পাজামা পরে রবিবাবু নামের বাঙালি লিডার এসেছেন। মঞ্চ বলতে তেমন কিছু নেই, একটা টুল পাতা, বক্তা নেতা টুলে উঠে বক্তৃতা করবেন। অন্য মাঝারি নেতারা দাঁড়াবেন আসেপাশে, রবিবাবু শ্রমিকদের খুন পসিনার মূল্যের বিনিময়ে চা উৎপাদন নিয়ে উচ্চগ্রামে কথা বলছেন। তিনি বলছেন, এতো পরিশ্রমের পরে কী ও কতটুকু মজুরি পায় শ্রমিকেরা। এবার মালিকরা যদি ২০ পার্সেন্ট বোনাস না দেয় তবে এমন লড়াই হবে যে চা পাতা তোলা এবং কারখানার মেশিন সব থেমে যাবে। শ্রমিকেরা শোনে সামনের ঘাস জমিতে বসে। যুবকেরা উত্তেজিত হয়, হাততালি দেয়, বৃদ্ধ অভিজ্ঞরা যন্ত্রবৎ শোনে।
অর্চিদের চা বাগানে কংগ্রেস দলের প্রভাব বেশি, তাবলে লাল পার্টি যে একেবারে নেই তা নয়। আজ লাল পার্টিও মিটিং করছে, বাজার থেকে একটু দূরে। তফাত এটুকুই যে লালপার্টির নেতা আরো আক্রমণাত্মক। তার আক্রমণের তীর শুধু মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে নয়, সরকারের বিরুদ্ধেও। শান্তিবাবু আগামী সংগ্রামের তীব্রতর অশান্তির দিনগুলি সম্পর্কে মালিক ও সরকারকে সাবধান করে দিচ্ছেন। লালদলের মিটিংএ শ্রমিক সমাগম কম হলেও, উত্তেজনা অনেক বেশি। বক্তৃতার সঙ্গে শ্রমিকেরা ঘনঘন করতালি দিচ্ছে, স্লোগান তুলছে।
এদিকে তো মদেশিয়া মহিষের গাড়ির চালক বসে ছিল খুঁটিতে হেলান দিয়ে। দেখা গেল তার কোমরে একটা বাঁশিও গোঁজা আছে। সে বাঁশিটা কোমর থেকে বের করে যত্নে মুছে নিয়ে ঠোঁটে লাগালো, ফুঁ দিল তাতে। কোন সুর উঠেছে কি ওঠেনি, লাল চোখের একটি মহিষ হঠাৎ খেপে গেল। ল্যাজ তুলে, মাথাটা নিচে নামিয়ে সে সোজা দৌড়ে গিয়ে চার্জ করল গাড়োয়ানকে। মাথা দিয়ে গুতিয়ে তাকে জমিতে ফেলে দিল, তারপর তাকে ঘষে নিয়ে গেল ফুট তিনেক। পশুটির সিংটি ছিল ‘ৎ’ আকারের তাই সেটা শনিশ্চরের বুকে বেধেনি। আসেপাশের বাড়িতে মালিরা কাজ করছিল, গাড়ি থেকে মাটি খালাসরত লেবারটিও ছিল, হৈ চৈ শুনে সকলেই ছুটে এসে লাঠি, কোদাল হাতে হৈ হৈ করে পশুটিকে হটিয়ে দিল। তাড়া খেয়ে সে সামনের পা জোড়া করে একবার ডান দিক একবার বাঁ দিকে ফেলে ছুটতে লাগলো মাঠে। তার সঙ্গীটিও। ইতিমধ্যে কোয়ার্টারগুলি থেকে মেয়েরা বেরিয়ে এসেছিল। পলাশের মা বললেন আজ মাটি পড়ল, আজই এমন অঘটন, পুজো এবার ভালো ভাবে কাটলে হয়। শনিশ্চরকে নিয়ে যাওয়া হল চা বাগানের হাসপাতালে।
অর্চিদের চোখের সামনে ঘটে গেল এই দুর্ঘটনা, প্রথমে তারা পিছু হটেছিল। পরে তারাও ছুটেছিল গাড়োয়ানকে উদ্ধার করতে। কিন্তু এ ঘটনা অর্চির মনে কি জানি কেন এক দুর্ভাবনার জন্ম দিল। পলাশের মায়ের কথা, পুজো এবার ভাল কাটলে হয়, এ কথাটি সে ভুলতে পারছিল না। মানুষের মন অতি বিচিত্র এক বিষয়। অনেক সময় অনেক মানুষ আগে থেকেই মন্দ কোন ঘটনার আশঙ্কা করতে পারে আবার ভাল কোন সংবাদ বা ঘটনার আগমনের বার্তা টের পেয়ে যায়। অর্চি অন্য বন্ধুদের চেয়ে একটু বেশি মনের কারবারি। তার মনে ব্যাখ্যাহীন অনেক রকমের চেতনা, পুর্বানুমান কাজ করে। কাউকে সে বলে না কিন্তু অনেক ঘটনার সাক্ষী থাকতে থাকতে সে যেন অনুভব করতে পারে যে এ ঘটনা সে আগে কোথাও দেখেছে, অথবা সে আগে থেকেই যেন জানতো যে এমনটি ঘটবে। কয়েকটা দিন অর্চি একটু অন্যমনস্ক হয়ে রইল। তারপর এ ঘটনার ছায়া তার মন থেকে মুছে গেল ধীরে ধীরে।