অর্চিষ্মান - সপ্তম পর্ব

লিখেছেন:অপূর্ব দাশগুপ্ত

শ্যামা নৃত্য-নাট্যের মহড়া শুরু হয়ে গেছেে জোর কদমে। এ যেন পূজার আয়োজন। মাস খানেক আগে থেকেই যেমন পুজোর রঙ লেগে যায় অর্চিদের মনে, মন্ডপের সামনে মহিষের গাড়িতে করে যেদিন ঠাকুর তৈরির মাটি এসে স্তূপাকৃত হয়, - তেমনিই শুরুর লগ্ন থেকে ধাপে ধাপে শ্যামা নৃত্য-নাট্যের প্রস্তুতি অর্চিদের মনে গভীর সুন্দরের এক অনুভূতি প্রোথিত করে দিতে থাকে। এই নৃত্য-নাট্যে যারা কলাকুশলী তাদের কারোরই নৃত্য-প্রশিক্ষণ নেই। একমাত্র সোনালি, সে শান্তিনিকেতনে পড়ছে, সে সকলকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিচ্ছে। আর সকলের মাথার উপর তো শরদিন্দুদা আছেন। তিনি নিজে বজ্রসেনের গানগুলি তো গাইছেনই, উঠে এসে প্রয়োজনের নাচও দেখিয়ে দেন, বকা ঝকা করেন। এই রাখী এতো আঢ়ষ্ট কেন, আরে রবীন্দ্র-নৃত্যের মধ্যে একটা মুক্তির ব্যাপার আছে, বাধন ছেঁড়ার ব্যাপার। তুই কোথায় নাচের ছন্দে গানকে ছাড়িয়ে যাবি তা তো নয়। এই আরশি তুই মুখটাকে এমনি ভাবলেশহীন করে রেখেছিস কেন রে? গানের কথার সঙ্গে মুখ ও শরীরের ভাবের মিল কোথায় তোর? অভিনয় আনতে হবে নাচে। যখন বজ্রসেন সম্পর্কে তুই বলছিস ‘মহেন্দ্র নিন্দিত কান্তি, উন্নত দর্শন’ তখন তোকে বোঝাতে হবে বজ্রসেনের বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথা শুধু তুই বলছিস না, তাঁর অন্তরের সৌন্দর্যের কথাও এখানে তুই বলছিস।

স্টেজে নাচের মহরা হয়, অর্চিরা সকলে বসে থাকে স্টেজের বাইরে, চেয়ারে। শ্যামার কাহিনী, সংগীত, গানগুলির বাণী তাঁদের আচ্ছন্ন করে রাখে। শরদিন্দুদা প্রথমের দিকে একবার শ্যামা নৃত্যনাট্যের কাহিনী ও তাৎপর্য সকলকে বুঝিয়ে ছিলেন। উত্তীয়ের জন্যে তাঁদের মন দ্রব হয়ে ওঠে। বজ্রসেনকে তারা মহৎ ভাবতে পারে না, বরং তাকে তারা সমালোচনাই করে, সেই সঙ্গে অর্চি এই প্রথম সোনালি, আরশিদের শরীরের বিচিত্র ভঙ্গিতে যে সৌন্দর্যের  সৃষ্টি হয়, তার আস্বাদ গ্রহণ করে। বড় অদ্ভুত সেই অনুভূতি। তার মধ্যে এই অনুভূতি কবিতার জন্ম দেয়। তাঁদের চা বাগানের ও আশেপাশের প্রকৃতির রূপ ও গন্ধের সঙ্গে নারী দেহের স্বতন্ত্র ভঙ্গিমা মিলেমিশে, নাচেরই মত ছন্দে তার হৃদয়ে কিছু বাক্যের সৃষ্টি হয়, সেগুলি সে লিখে ফেলে।

মুখার্জি সাহেবও মহরায় নিত্য উপস্থিত থাকেন। উনি গাইছেন, উত্তীয়ের গানগুলি। অর্চিদের সঙ্গে তার বেশ সখ্যতা হয়ে গেছে। তার সুন্দর চেহারা আর ব্যক্তিত্ব সকলকে সহজেই আকর্ষণ করে। তাছাড়া তিনি কোলকাতার নামজাদা কলেজে হস্টেলে থেকে পড়েছেন। নানা বিষয়ে খোঁজ খবর রাখেন। তাঁর শহুরে হাব-ভাব অর্চিদের মনে একটু হীনমন্যতার সৃষ্টি করে। তাঁর কথা বলার ধরণেও বিশেষত্ব আছে। তাঁর ভাবনা চিন্তাও অন্য রকম। অর্চিদের চা বাগানের একটি ছেলে, সে কবি। তাঁর নামও খুব হয়েছে। কলকাতার সেরা পত্রিকায় লেখেন তিনি। অর্চি একদিন গর্ব করে তাঁর কথা মুখার্জি সাহেবকে বলে। শুনে তিনি বলেছিলেন, আরে ওকে চিনি, আগে মন্দ লিখতো না, এখন তো সব ভুষি মাল ছড়াচ্ছে। তারপর যোগ করেছিলেন, বিকিয়ে দিইয়েছে না, নিজেকে বাজারি পত্রিকায়। অর্চির কথাটা ভালো লাগে নি। সে তাই একদিন আরশিকে ঘটনাটা বলে। শুনেটুনে আরশি বলে,

- তোরাই তো লোকটাকে মাথায় তুলিস, খাজা গান গায়…….

- কেন? ভালোই তো গাইছে উত্তীয়র গান, অর্চি বলে।

- দূর দূর সাহেব বলে সকলে তেল দেয়, বুঝিস না। চালবাজ একটা।

চা বাগানের বাবুদের জীবন কোন একটা বড়ো উৎসবের পর আবার নিস্তরঙ্গ হয়ে পড়ে।  উৎসবের রেশ থেকে যায় মনে আর জীবনযাত্রা আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সকাল ৭টায় বাবুরা বেড়িয়ে পড়েন অফিসের উদ্দেশ্যে। ১০টা নাগাদ মাষ্টারমশাই সাইকেল চেপে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। মদেশিয়া ও নেপালী মেয়েরা টুকড়ি পিঠে কাজে যায়। পুরুষ শ্রমিকেরা ঝুরনি কোদাল নিয়ে কেউ চা ঝোপের জঙ্গল সাফাই  এর কাজে ঢোকে, কেউ বা যায় গুদামে, যেখানে চা তৈরী হয়। বিরাট এক পরিবারের বোঝা টেনে ক্লান্ত কোন বাবুর স্ত্রী আরেক বাড়িতে আসেন, আঁচলের আড়াল থেকে একটি ছোট শিশি বের করে সলজ্জ্ব মুখে বলেন, এক শিশি তেল দিতে পারবে, কাল বা, পরশু ফেরত দিয়ে যাবো। বয়স্ক মালিরা এসে বাবুদের বাড়ির বাগানে কোদাল দিয়ে একমনে মাটি কোপায়। দুপুরের দিকে মাইঝিরা তাঁদের গোটা কয় রুটি ও গুড় বা তরকারি দেয়, আর মালিদের জন্য নির্দিষ্ট কাঁসার গেলাসে তাঁদের চা দেওয়া হয়। ঘুঘুর ডাকে দুপুরের নিস্তব্ধতা আরও প্রগাঢ় হয়ে ওঠে, ওটুকু খেয়েই আবার তারা কাজ করে, বিকেলের ছায়া পড়লে তারা ঘরে ফেরে। রবীন্দ্র-জয়ন্তীর পর সন্ধ্যায় আর নিয়মিত ক্লাব ঘর খোলা হয় না, আলো জ্বলে না, ক্লাব ঘরটি একা দাঁড়িয়ে থাকে নিমগ্ন জ্যোৎস্নায়, যেন পুজা শেষের মন্ডপ। অর্চি আর তার বন্ধুরা পড়াশুনোয় মন দেয়। অর্চিকে আরশি বলে যে বিষয়গুলি তোর ভালো লাগে না বলিস, সেগুলি বেশি করে পড় অর্চি, শুধু ইংরেজী বাংলা নিয়ে থাকলে হবে। সংস্কৃততে অনেক মার্কস ওঠে কিন্তু। আরশি বিজ্ঞানের ছাত্রী তবু সে কলাবিভাগের সব খবর রাখে।

অর্চির হাতে সে যে নীল রঙের সুতোর সরু বেণীটি পড়িয়ে দিয়েছিল তা জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, একদিন সন্ধ্যায় আরশি অর্চিকে ডেকে তা পাল্টে দেয়। এটা কিন্তু তোর পড়াশুনোর পাহারাদার, অর্চিকে একহাতে বেষ্টন করে আরশি বলেছিল।

 

অর্চির পড়াশোনার উৎসাহ আরো বেড়ে যায় স্কুলে একজন নতুন স্যার এর আগমনে। ইনিও গঙ্গার ওপারের মানুষ। উত্তরবঙ্গে নতুন কেউ এলে, সহজেই তাকে চিহ্নিত করা যায়। তাঁদের মুখের ভাষা স্থানীয় ভাষার চেয়ে আলাদা এবং সুমিষ্ট। এখানে নানা উপভাষার মিশ্রনে যে ভাষায় অর্চিরা কথা বলে তা শুনে অন্তত কলকাতার লোকজনের কাছে আশ্চর্য লাগে। অর্চির সে অভিজ্ঞতা আছে। একবার তার আর তার দাদার কথা শুনে তাঁদের নিউ আলিপুরের আত্মীয় বোনটি তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মা ওরা এমন করে কথা বলে কেন? সবার কিনা জানা নেই তবে অর্চির মনে হয় গঙ্গার ওপারের মানুষগুলি সব দিক থেকেই যেন তাঁদের থেকে এগিয়ে, অনেক খোঁজ খবর রাখে তারা, তারা উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্রর নাটক দেখেছে, মাঠে স্বচক্ষে মোহনবাগান - ইস্টবেঙ্গলের খেলা তাদের দেখা, এমন কিছু ইংরেজি কিংবা বাংলা শব্দ তারা ব্যবহার করে, এমন কিছু মজার গল্প তারা বলে, যা অর্চিদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। ইকোনমিক্সের এই নতুন স্যারটিকে দেখেই অর্চির খুব পছন্দ হয়ে গেল। তাঁদের স্কুলে তিনি যেন এক নতুনত্বের দমকা হাওয়া নিয়ে এলেন। কথা বলায়, পড়ানোর কায়দায় এবং পোশাকের বিশেষত্বে তাকে ছাত্রদের অনেকেরই খুব পছন্দ হয়ে গেল। অর্চি একদিন বাড়িতে এসে বলল, আমি সুজন স্যার এর কাছে পড়বো।

 

0 Comments
Leave a reply