অর্চিষ্মান – চতুর্থ পর্ব

লিখেছেন:অপূর্ব দাশগুপ্ত

 

ডুয়ার্স ১৯৭২

 

বৈশাখ মাসের প্রথমদিকে একদিন দুপুরে ঘনিয়ে এল অন্ধকার। অর্চিদের স্কুল থেকে জলরঙে আঁকা ভুটান সীমান্তের যে পাহাড় জানলা দিয়ে দেখা যায়, সেটি কালো মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল। অর্চিরা জানলা দিয়ে দেখে পাশের পিচ রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়েরা প্রাণপণে প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে, বৃষ্টির আসন্ন আগমনের পূর্বাভাস তাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে। ভয় যত না বৃষ্টিকে, তারচেয়ে বেশি বজ্রপাতে। মেঘের ডাকে বাতাস ফাটছে বোমার মত, কেঁপে উঠছে বিস্তীর্ণ ভূমিখন্ড, যেন ভূমিকম্পের প্রথম ছোঁয়া লাগছে মাটিতে। বিরুদ্ধ বাতাস ঠেলে যাদের চলা, তাদের মুশকিল হচ্ছে বেশি সাইকেল এগিয়ে নিতে। রাস্তার ওপারে চা বাগানের শেড ট্রি গুলিকে দিশাহীনের মত নাচিয়ে দিচ্ছে পাগল বাতাস। ডাইনে বাঁয়ে তাদের আন্দোলন খর্বকায় চা গাছেদের প্রায় ছুঁয়ে আবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শেষে বৃষ্টি নামলে স্যাররা পড়া থামিয়ে দিয়েছেন। টিনের চালে ফাটছে জলের ফোঁটা, চিনে পটকার মত। তারপর আকাশ থেকে নেমে আসতে লাগল রাশি রাশি হিমশিলা, স্যারদের গলা ছাত্রদের কানে আর পৌঁছবে না। মুহূর্তে সবুজ মাঠের দখল নিল শ্বেত তুষারকণা। নিচু ক্লাসের কিছু ছেলে শিলা-বৃষ্টি থামতেই নেমে পড়ল মাঠে। ভিজে ভিজে তারা শিল কুড়াতে থাকে। বাতাস দিচ্ছে ঠান্ডা।

বৃষ্টি থামতে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। ছেলেরা সাইকেল নিয়ে ছুটল যে যার বাড়ির দিকে। অর্চি দাঁড়িয়ে ছিল স্কুলের বাইরে। তারা বন্ধুরা সকলে প্রায়দিনই, সে আরশি রাখী তমাল পলাশ, আরো দুয়েকজন  একসঙ্গে ফেরে। তাদের চা বাগান স্কুল থেকে মাইল তিনেক, একসঙ্গে গল্প করতে করতে ফেরা এক আনন্দ। আজ অর্চি দেখে স্কুলের গেট দিয়ে একাই বের হয়ে এলো আরশি। অর্চি ডাকে,

- আরশিদি। কতদিন অর্চি মনে মনে ভেবেছে আরশি কে সে আর দিদি ডাকবে না।একদিন সে বলেওছিল,

- তোমাকে আর আরশিদি ডাকবো না।

- আমি বলেছি তোকে ডাকতে। আরশি উত্তর দিয়েছিল।

কিন্তু অর্চি পেরে ওঠে না দিদি ডাক ছেঁটে ফেলতে। সে অনেকবার ভেবেছে যে তার সঙ্গে আরশিদির সম্পর্কটা ঠিক কী? অনেক মাথা ঘামিয়েও এই প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায় না। আরশি প্রাণপণে অর্চিষ্মান কে আগলে রাখতে চায়, যেন সে তার নিজস্ব সম্পত্তি। অর্চির জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় আরশির জানা চাই। সে কি টিফিন খেয়েছে, কত রাত অব্দি সে পড়াশুনো করেছে, সবকিছু। এমন কী এই যে অর্চি কিছুদিন আলিপুরদুয়ারে কাটিয়ে এলো, সেখানে নতুন মেয়ে বন্ধু হল কী অর্চির? আরশির ক্রমাগত তাড়া খেয়ে অর্চি শেষমেশ স্কুলের পড়ায় মন দিয়েছে।

অর্চি ভাবে আরশির প্রতি বিশ্বাস রাখা তার সবচেয়ে বড় কর্তব্য। কোনদিন কোন কারণেই সে আরশিকে দুঃখ দেবে না। এমন কিছু করবে না যাতে সে কষ্ট পায়। ক্লাস নাইনে ওঠার পর অর্চির চেহারায় এক বিশেষ ধরনের পরিবর্তন ধরা দিয়েছে। পূর্বের সেই বৈশিষ্ট্যহীন চেহারায় কোথা থেকে যেন এক অস্ফুট  লাবন্য এসে দেখা দিয়েছে। রোগা রোগা হাত-পায়ের পেশিগুলি বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তমাল,পলাশ, অর্চি এরা সবাই মিলে জোগাড় করেছে একটি বুল-ওয়ার্কার। ভোরে উঠে তারা মাঠে চক্কর কাটে। তারপর শুরু হয় বুল-ওয়ার্কার টানা টানি। নরম কচি ঘাসের মত তার গালে দেখা দিয়েছে শ্মশ্রুরাজি। কেবল তার চুলগুলি এখনো তার ললাট সহ চক্ষুদুটিকে আগের মতই ঢেকে রাখতে চায়।

অর্চি একদিন আরশিকে জিজ্ঞেস করেছিল, আরশিদি, আমি ঠিক বুঝতে পারিনা, তুমি কি আমাকে তেমনি ভালোবাসো, যেমন আমি তোমায় বাসি?

উত্তরে আরশি শুধু হাসে।

অর্চি মরিয়া হয়ে বলে, বল না, আমিই কী তোমার সবচেয়ে আপন? আমাদের যে সম্পর্ক তাই কী প্রেম?

উত্তরে আরশি বলেছিল, তুই এত ভাবিস কেন সূরজ, এতো ভাববার কী আছে রে, সম্পর্ক যে দিকে নিয়ে যায় আমাদের তেমনি চলবো আমরা।

 

আজ ওরা দুজনে গল্পে মশগুল হয়ে পথ ভেঙে চলে। আরশি হাঁটে, অর্চিও ওর পাশেপাশেই পা চলায়, শুধু সাইকেলটি সে হাতে ঠেলে  নিয়ে চলে। বৃষ্টি কমতে দু একজন মানুষ আবার পথে নেমেছে। পিচের রাস্তা পার হয়ে ওরা চা বাগানের সাদা নুড়ি বিছানো পথে পৌঁছায়। জনশুন্য পথ। দুদিকে ঘন চা বাগান আর তারই মধ্যে ছায়া-গাছ। অর্চি বলে, 

- আরশি দি তুমি সাইকেলে বস, আর কত হাঁটবো।

- ফেলে দিবি না তো?

- আগেও তো চরেছ তুমি, কতবার ফেলেছি?

আরশিকে এবার চিন্তিত দেখায়। চিন্তার সময়ে তার ভুরু দুখানি একত্রিত হতে চায়। ফলে কপালে যে কুঞ্চন দেখা দেয়, তা সুন্দর। অর্চিকে আরশির এই রূপ আজ আবারও মুগ্ধ করে। আরশি বলে, 

- শোন সূরজ, আমাদের নিয়ে নাকি খুব আলোচনা হচ্ছে সবখানে। আমার মা-ও সেদিন বললো, বড় হয়েছ বুঝে শুনে চলবে, তোমাদের দুজনকে নিয়ে খুব নিন্দে-মন্দ রটছে। তোমার বাবাও বলছিল অফিসেও বাবুরা বলাবলি করছে তোমাদের নিয়ে।

- আমি জানি। বাবার কানেও কে যেন তুলেছে।

- কাকু কিছু বলেছে তোকে?

- না। তবে বাবা জানে, আমি বুজতে পারি। মাও জেনেছে বর্ধমানে বসে।

- তাহলে? সাইকেলে উঠলে কেউ যদি দেখে তো আরও পল্লবিত হয়ে চারদিকে ছড়াবে রটনা। অর্চি পাত্তা দিতে চায়না, বলে,

- দূর ছাড়তো, ওঠো। এখন এদিকে এই দুপুরে কেউ আসবে না।

অর্চির সাইকেলের রডে উঠে বসে আরশি, বলে,

- কোয়ার্টার আসার আগেই নামাবি।

সাইকেল চলতেই, আরশির চুলের থেকে, নীল পাড়ের সাদা শাড়ি থেকে, অনাবৃত ঘার ও বাহু থেকে এক অপূর্ব সুবাস পেতে থাকে অর্চি। নর নারীর শরীর সম্পর্কের ভাল মন্দ নিয়ে অর্চির মনে অনেক দ্বিধা। প্রেম বলতে সে শরীরকে একদম বোঝে না। আবার শরীর সম্পর্কে সচেতন হলেই একমাত্র আরশির কথাই তার মনে আসে। সেই সময়ে একমাত্র তাকেই নিভৃতে একা পেতে তার ইচ্ছে হয়। আবার সে ভাবে শরীরে পৌঁছে গেলে মন কী আর থাকে? প্রেম কী নিভে যায় না? আজ এই বৃষ্টি ভেজা হওয়ায়, আরশির সুবাসে সে বড্ড ভীত হয়ে পড়ে।

এমন সময় আরশি বলে, এতো ঝুঁকে চালাচ্ছিস সাইকেল সূরজ, আমার ঘাড়ে তোর দাড়ি ঘষে যাচ্ছে। কুটকুট করছে।

অর্চি কিছু বলে না, অর্চির ভেতর থেকে তার অজান্তেই কে যেন বলে ওঠে – 

- তোমাকে একবার আদর করি আরশি। এই প্রথম সে ‘দি’ বলতে ভুলে যায়।

আরশি একটু কেঁপে ওঠে,  একটু ভয় পায় যেন,  দ্রুত বলে ওঠে,

- না না সূরজ, এত সুন্দর পরিবেশটা নষ্ট করিস না। আমি বরং নেমে পড়ি।

অর্চি এতক্ষণে নিজেকে ফিরে পায়। আরশি যেন তাকে চরম অপমান করেছে। কেন সে বলতে গেল। কেন বললো।

সে সাইকেলের ব্রেক কষে।

- নেমে পড় আরশিদি। আর একটু পথ বাকি। তুমি হেঁটে চলে যেতে পারবে।

- রাগ করিস না সূরজ।

অর্চি উত্তর দেয় না।

 আরশি সাইকেল থেকে নামলে অর্চি জোরে প্যাডেলে চাপ দেয়।

 

চা বাগানের বাবুদের নিজেদের মধ্যে রোজকার জীবনযাত্রায় গুরুতর সংঘাত তেমন নেই। চা বাগানের সমাজ জীবনে সংঘাত যতটুকু ছিল তা উৎপাদন ঘিরে। তিনটি সুস্পষ্ট সামাজিক বিভাজন সেখানে । সাহেব, বাবু আর কুলি। উৎপাদন ঘিরে ছিল কিছু চাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব । এই ত্রি-স্তরের সামাজিক জীবনে দূরত্ব বজায়  রাখা হত। সাহেবরা কখনো আসতেন না বাবুদের বাড়ির কোন অনুষ্ঠানে, কিংবা ক্লাবের গান বাজনার আসরে। সাহেবদের ছিল আলাদা ইয়োরোপিয়ান ক্লাব। বাবুরা থাকতেন নিজেদের মধ্যেই, কাজের বাইরে, নিজেদের ক্লাবে খেলা, গান বাজনা নিয়ে। কুলিরাও বাবুদের ক্লাবে আসত না। কিন্তু একবার এর  ব্যতিক্তম ঘটলো।

একদিন অর্চি আর তার বন্ধুরা, পরাগ, তমাল, স্বপন, পলাশ, বেণু এরা মাঠে বৃত্তাকারে বসে ছিল। ফুটবল পিটিয়ে ক্লান্ত সকলে। অন্ধকার নেমে আসছে এবার, তবে আলো একেবারে মরে যায়নি। অর্চিদের চেয়ে ছোট ছেলে মেয়েরা ওদেরই আশেপাশে ছোটাছুটি করছে। এবারে সকলে ফিরে যাবে যে যার ঘরে, সন্ধ্যা নেমে আসছে। একপাল মশা গোল হয়ে সবাইকে ছেড়ে শুধু বেনুর মাথার উপর পিন পিন শব্দে চক্রাকারে পাক খাচ্ছে। স্বপন বেনুকে জিজ্ঞেস করে, কী তেল মাখিস রে বেণু মাথায়? মশাদের তোকেই শুধু পছন্দ। এইসব এলোমেলো কথা চলছে তাদের। এমন সময় সাইকেল নিয়ে একজন সুদর্শন পুরুষ মাঠের পাশের রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। সিটে বসে বাঁ পা ঠেকা্লেন ভূমিতে, তারপর গলা তুলে অর্চিদের উদ্দেশ্যে বললেন, বসে বসে মাটি ভাপাচ্ছিস এখানে, কিছু চিন্তা ভাবনা করলি? কাল ছ’টা নাগাদ ক্লাবে সবাই চলে আয়। আরশি, রেখা, আর সবাইকে ডেকে নিবি। শীলাকে বলিস আমি বলেছি আসতে। শুভকেও।        

২৫ শে বৈশাখ আসতে কিছু দেরি আছে তবু এই মানুষটির ডাকে ছেলে মেয়েদের মধ্যে সাজো সাজো রব উঠে যায়। 

চা বাগানের কোয়ার্টারগুলি ছিল উঁচু বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। দুটি কোয়ার্টারের মাঝে এরকম দুটি বেড়ার মাঝে তৈরি হয়ে যেত নির্জন পথ। বেড়ার ওপাশে সবজি বাগান থাকারই কথা, তবে তারই মাঝে মাঝে থাকে হাসনুহনার, দোলোনচাঁপার ঝার। এদেরই পাঠানো সুবাসে ভরা গলির ভেতর-পথ সন্ধ্যার পর অনির্বচনীয় কিছুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকত। এখানে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে অর্চির সঙ্গে দেখা হত আরশির। দেখা হলেই অর্চির বাড়ানো হাতে আরশি তার চুল থেকে খসিয়ে নিয়ে ফুল দিত। বদলে অর্চি দিত চিঠি বা কবিতা কিংবা কবিতার চিঠি। ফুল ও কবিতার হাতবদল হতে যতক্ষণ সময় নেওয়া প্রয়োজন তারচেয়ে আরেকটু বেশি সময় নিত ওরা। ওই ক্ষণিকের স্পর্শটুকু ছিল ওদের তুমুল আনন্দে ভরা।

আজ যখন দেখা হল, দেখা গেল, অর্চির অনাগ্রহ রয়েছে ফুলের প্রতি।

- নিবি না?

- আমার স্পর্শ তো তোমার ভালো না আরশিদি।

- কী হল আবার। আরশির গলায় বানিয়ে তোলা হতাশা।

- কেন? সেদিন বললে না সাইকেলে বসে।

- পাগল! নে। তারপর ফুল হাতে নিয়ে আরশি বলে,

- লেখা কই?

- লেখা তো ভালো লাগে না তোমার।

- এটা কোথায় বসে বলেছিলাম। মোটর সাইকেলে? কিন্তু সেটা তোর তো নেই ।

- বলতে হয় না সব কথা। আমি বুঝি।

- কেমন করে বুঝিস?

- উত্তর নেই চিঠিগুলোর, তাই। 

আরশি ফুলটা অর্চির বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে,

- আমি অংক ভালোবাসি। তা বলে কাব্য অপছন্দ করি না। কিন্তু তোর মত কাব্য ভাষা আমার নেই। আমার লেখা তোর চিঠিগুলির যোগ্য হয়ে উঠতে পারবে নারে। তাই লিখি না।

অর্চি বলে, এই সব তোমার অজুহাত। আসলে তোমার কিছু বলার নেই আমাকে।

- একদম বাজে কথা সূরজ, আমি মনে মনে তোর সঙ্গে সবসময় কথা বলি।

অর্চির ভালো লাগে আরশির এই কথা। তার অভিমান মুহূর্তে উড়ে যায়, সে এবারে বলে,

- কাল শরদিন্দুদা আমাদের সবাইকে ডেকেছে ক্লাবে, সন্ধ্যায়। তোমাকেও বলে দিতে বলেছে।

- কি করা হবে বলেছে কিছু শরদিন্দুদা?

- কাল সব আলোচনা হবে।

 

পরদিন চা বাগানের বাবুদের ক্লাবে সেই ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে গেল। বাবুদের ক্লাবে সাহেবের প্রবেশ। ক্লাব খোলা হয়েছিল। ক্লাবের একদিকে কাঠের পাটাতনের তৈরি স্টেজ, তার উপরে কার্পেট পাতা। সেখানে সবাই এসে বসেছে। হারমোনিয়াম, তবলা পাশে রাখা। মেয়েরা বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছে। স্টেজের সামনে চেয়ার পাতা অনেকগুলি। বেতের বেশিরভাগ, কাঠেরও রয়েছে কিছু। উত্তরবঙ্গে কাঠের অভাব নেই আর আসাম থেকে আসে বেত। ক্লাবটি বেশ বড়। অনেকগুলি জানালা, গোটা চারেক দরজা। এককোণে চায়ের আয়োজন। টেবিলটেনিস বোর্ড রয়েছে একটা, এমনকি রয়েছে বিলিয়ার্ড বোর্ড। শরদিন্দুদা আসেননি তখনো। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে তবে তিনি আসবেন। শীলাদি গুণী শিল্পী, তিনি খবর দিলেন শরদিন্দুদার সঙ্গে তার কথা হয়েছে। এবার ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করা হবে। শীলাদি বললেন, আরশি তোকে ‘শ্যামা’ করতে হবে। ‘বজ্রসেন’ তো আমাদের বাগানে পাওয়া গেল না। পাশের বাগান থেকে সোনালিকে ডাকা হয়েছে। তারপর সবাই মিলে শীলাকে ধরা হলো, ও শীলাদি এখনো তো শরদিন্দুদা আসেননি, তুমি গান শোনাও নাগো একটা। শীলাদিরও আপত্তি নেই কোন। তিনি হারমোনিয়াম টেনে নিলেন। খানিকটা হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিয়ে বললেন, শ্যামারই একটা গান গাই, শোন তোরা, তারপর আরশির দিকে ফিরে বললেন, তুই মন দিয়ে শোন। শীলাদি গাইলেন, “ধরা সে যে দেয় নাই দেয় নাই”। ক্লাবের বাইরে একটা জিপ গাড়ি এসে থামার আওয়াজ পাওয়া গেল। শরদিন্দু এলেন? কিন্তু তিনি তো সাইকেলে আসেন। জিপের রহস্য বোঝা গেল যখন তিনি ক্লাবে ঢুকলেন সঙ্গে মুখার্জি সাহেবকে নিয়ে। অর্চিরা সকলেই অবাক হোল। অরবিন্দ মুখার্জি মাস খানেক হোল চা বাগানে জয়েন করেছেন, এসিট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে। তিনি আসার পর তার সম্পর্কে নানা কথা শোনা গিয়েছে। নতুন সাহেব তেমন প্রোটকল মানেন না। সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন, মেশেন। বাবুদের কোয়ার্টার থেকে বেশ দূরে তার কুঠি। তার কুঠির সামনে খেলার মাঠ। মাঠে আসতে গেলে তাকে অনেকটা ঘুরে আসতে হয়, কেননা ৫ ফুটের কাঁটা তারের বেড়া রয়েছে সামনে। শোনা গিয়েছে তিনি নাকি হাই জাম্প দিয়ে বেড়া ডিঙ্গিয়ে মাঠে ঢোকেন। 

মুখার্জি সাহেবকে নিয়ে যখন শরদিন্দু ক্লাবে এলেন , তখনও শীলার গান শেষ হয়নি। সে গীতিনাট্যের পরের গানটি গাইছে। শরদিন্দু ইঙ্গিতে শীলাকে গান চালিয়ে যেতে বলে সাহেব কে নিয়ে তিনি চেয়ারে বসলেন। গান শেষ হলে শরদিন্দু সকলের সঙ্গে অরবিন্দ মুখার্জির আলাপ করিয়ে দিলেন। অর্চিদের ছোটবেলাতেও চা বাগানে তারা বাঙালি সাহেব দেখেনি। কোম্পানি ছিল ইয়োরোপিয়ানদের, তাদের ম্যানেজাররা ছিলেন সাহেব বা আধা সাহেব। ধীরে ধীরে অনেক চা বাগান থেকে সাহেবী কোম্পানি চলে গেল। এবার যারা এলেন তারা পাঞ্জাবী কিংবা গুজরাটি। সাহেবরা চলে গেলেও তাদের কেতা এরাও বজায় রেখেছিল। কুলিদের সঙ্গে প্রকাশ্যে আর বাবুদের সঙ্গে সযত্নে তারা দূরত্ব বজায় রেখে গেছে। ইদানিং দুয়েকজন বাঙালি ছেলে আসছে চা বাগানে। আরিন্দমের বাবা ছিলেন শিলিগুড়ির কাছে এক চা বাগানের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ছেলেকে আসামের টোকলাই থেকে ট্রেনিং করিয়ে এনেছেন। সে যাই হোক অরিন্দম সকলের সঙ্গেই সহজে মিশে গেলেন। কিন্তু তাল কেটে গেল মাঝখানে একবার। শরদিন্দু যখন আরশির সঙ্গে আলাপ করাচ্ছেন অরিন্দমের, তিনি বললেন, মুখার্জি সাহেব এই হচ্ছে আরশি, লেখাপড়ায় খুব ওস্তাদ আর ওই এবারে আমাদের ‘শ্যামা’। মুখার্জি বললেন, কী পড়ছো তুমি এখন? সায়েন্স? আরশির হঠাৎ কী হোল কে জানে, সে উত্তর করলো, আমাকে আপনি বললে ভাল হয়। 

 

বর্ধমান ১৯৭৪

 

বর্ধমানে তার বন্ধু হয়নি এই কয়েক মাসে। আলমারির বইগুলি আছে, ট্রানজিস্টারটা আর বিকেলে সদরঘাটের বালি, বালির শেষে জল আর নৌকো। ওপাড়ে বাস ঘাটের হুল্লোড় আর ধুলো বালির ওড়াউড়ি। এই সব চেনা দৃশ্যগুলি, এই নিয়ে তার এখানের দিনগুলি যায়।

মানুষের চরিত্র রূপ পায় কী ভাবে, এ এক অপার রহস্য। সবটাই কী বংশ পরম্পরা? তাই যদি হত তবে অর্চিষ্মান সেনগুপ্তর একজন লড়াকু মানুষ হওয়া সমুচিত হত, তার বাবা কাকাদের মত। নিজের জন্য, নিজের পরিজনের জন্য সংগ্রামী, অথবা কাকা প্রিয়নাথের মত। পরিবার ছাড়িয়ে যিনি লড়তে চান সমাজ বদলের জন্য। কিন্তু অর্চি শুধু যেন বাঁচে তার নিজের মধ্যে। বাইরের চারদিকটা সে যেন দেখতেই পায় না। যা বাইরে ঘটছে তা যেন অবচেতন, আবছা। প্রিয়নাথ ও তার বন্ধুদের আলোচনা সে মন দিয়ে শোনে। সকলেরই অনেক পড়াশুনো। কেউ নিজের কথা, বাড়ির কথা বিশেষ বলে না। সকলেই  চায় সবকিছু বদলে যাক, রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি। সকলেই বিপ্লব চায়, কেউ আবার আরেকটু দ্রুত বিপ্লবের প্রত্যাশী। তাদের আলোচনায় ব্যক্তির আনন্দ বা শোকের কথা আসেই না। এদিকে চা বাগানের প্রকৃতি ও মানুষেরা যে গভীর ছাপ ফেলে গেছে অর্চির মধ্যে তার থেকে যেন উদ্ধার নেই অর্চির। সে ভাবে তবে কী সে  আত্মকেন্দ্রিক, বিষাদগ্রস্ত এক মানুষ হয়ে উঠছে।

যে দিন হরেকৃষ্ণ কোঙার মারা গেলেন সেদিন প্রিয়নাথের বন্ধু তপোব্রত এলেন। বাড়ির অবস্থা দেখার পর তিনি বলেছিলেন, আজ আমি কলকাতা ফিরছি না, থাকবো। পরে কাকিমাকে বললেন,  রাতে আমি রুটি খাই তবে ভাত হলেও আপত্তি নেই।

তার থাকার কারণেই সে রাত্রে বাড়িতে রান্নার আয়োজন হল। রাত্রে অর্চির সঙ্গে তিনি শুয়ে পড়লেন। সেদিন রাত্রে নানা গল্প তিনি করেছিলেন। একবার বললেন, আমি কলকাতায় ফিরছিলাম, ইচ্ছে করেই নেমে পড়লাম তোদের এখানে।। প্রিয়নাথকে তো চিনি। আর চিনি তাকেও যার মৃত্যুতে প্ৰিয় বিচলিত। এই লোকটা শিলিগুড়ি গিয়েছিলো জানিস, কৃষক আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে রফা করতে। এরা সে সময়ে চালাতো সরকার। ইনি সেই সরকারের মন্ত্রী বুঝলি, যারা আন্দোলনকে দমাতে পুলিশ পাঠিয়ে ছিল, ভেঙে দিয়েছিল দার্জিলিং জেলা কমিটি।

এর কিছুদিন পর একদিন বৃষ্টি হল সকালবেলা। কিন্তু ঠান্ডা হল না বাতাস এবং মাটি। বৃষ্টিবিন্দু তপ্ত মাটি ছুঁতেই মাটি রাগে ফুঁসে উঠলো। বারিবিন্দু আর মাটির সংঘর্ষ মুহূর্তে একটা গন্ধ উঠে এলো অর্চিদের বাড়ির সামনের গলি থেকে। জল-মাটির মিশেল গন্ধ। বৃষ্টি শেষে আকাশের আলো কমে এলো,  বাতাসে আগুনে-হলকা আর নেই, সকাল ১১ টায় অন্যান্যদিন রোদ আর তাপ যেমন প্রখর থাকে, আজ তেমন না। অর্চি সকালে বাড়িতেই থাকে। আজ সে প্যান্টের উপর পাঞ্জাবি চাপিয়ে বের হল। গলি থেকে বের হয়ে সে বাম দিকে হাঁটতে থাকে, দামোদরের দিকে। ডান দিকে গেলে নতুন বাজার, বীরহাটা পেড়িয়ে শহরের মূল কেন্দ্র কার্জন গেট। এই ইতিহাসবাহী গেটের তল দিয়ে যে রাস্তা গেছে সেটা পথচারী, রিক্সা, সাইকেলে ঠাস জমাট। দুদিকে  দোকান, গলি, তস্য গলি। গলিতে সিনেমা হল। বাজার, এইসব। বার কয়েক সে এসেছে এদিকে কিন্তু বারবার এদিকে আসার তার তাগিদ নেই। বড্ড ভিড় আর কোলাহল কেবল।

কয়েকদিন আগে এক বিকেলে সে অনেক দূর হেঁটেছিল নদীর পাড় ধরে। সদরঘাট থেকে মাইল তিন চার দূরে সেদিন সে দূরে বালির উপর লক্ষ্য করেছিল একটা কুঁড়ে ঘর। বালির মধ্যে কিছু ঘাস জঙ্গল। কয়েকটা বাবলা গাছ। সেই জঙ্গল আর গাছ ভেদ করে একটা পায়ে চলা পথ কুড়ে ঘরটির অভিমুখে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে বলে সে আর সেদিকে যায় নি সেদিন। আজ ভাবলো যাই না, দেখি গিয়ে কী আছে ওই ঘরে। পথ থেকে সে বালিতে নামে। সে সেই রোগা পথটি ধরবে বলে এগিয়ে যেতে যেতে দেখে যথারীতি মরার খুলি, ভাঙাচোরা কংকাল ইতস্তত পড়ে আছে। অপ্রশস্ত পথটা হলদেটে, শুকনো হলুদ ঘাসে ভরা। পদচিহ্ন কিছু দেখা যায়। একটা সবুজ রঙের লিকলিকে সাপ একটি বাবলা গাছ বেস্টন করে ছিলো। অর্চির পদশব্দে সে মুখ উপরে তোলে আরো উঁচু ডাল ও পাতার সন্ধানে। ধীরে সে উপরে উঠে যায়। বাড়িটির খড়ের জীর্ণ চাল কিছুটা কাত হয়ে আছে। বাঁশের কঞ্চির বোনা দেয়াল। সম্প্রতি তাতে মেরামত করা হয়েছে দুয়েক জায়গাতে। কেউ তবে থাকে এই আবাসে। একেবারে গেটের কাছে এসে একবার অর্চি ভাবে ফিরি, ফিরে যাই। কী দরকার এই রহস্যময় বাড়ি দেখে। কিন্তু পদক্ষেপ তার সামনের দিকেই এগোয়। কিশোর বেলা থেকে এতো অভিযানের বই সে পড়েছে,  আর এখন ভয় পেলে তার চলে কী করে? বাড়ির বেড়ার দরজাটা আধ খোলা। সে ভেতরে উঁকি দেয়। ছোট ছোট চৌকো রোদের চেক কাটা মাটির মেঝে দেখতে পায় প্রথমে। জাফরি দিয়ে রোদ ঢুকেছে। তারপর ঘরের একদিকে মাটির উনোনে চোখ পড়ে। উনোনের উপর একটা মাটির হাঁড়ি বসানো রয়েছে। তিন চার টুকরো আধপোড়া গাছের ডাল উনোন থেকে বাইরের দিকে টেনে দেওয়া। একটা শতরঞ্চি জড়ানো ময়লা বিছানা গুটিয়ে রাখা একপাশে। ভেতরে ঢুকে সে সবচেয়ে অবাক হল দেয়ালে ঝোলানো বড় একটা আয়না দেখে। কিছু পোশাক ঝুলছে বাঁশের দেওয়ালে। কিন্তু লাল প্লাস্টিকের ফ্রেমে আঁটা  এত বড় আয়না খাপ খায় না ঘরের অন্য সবকিছুর সাথে। দরজার বিপরীতে দেয়ালে জানালার মত একটা বড় ফাঁক। অর্চি সেখান দিয়ে দূরে বহতা দামোদর দেখতে পায়, অনেকটা বালিয়াড়ির ওপাড়ে। এখানে আর না, একটা টোকো গন্ধ আসছে নাকে। ফিরতে হবে। এমন সময় তার পাশে এসে পড়ে একটি ছায়া। সঙ্গে সঙ্গেই সে শুনতে পায় একটা রুক্ষ কণ্ঠস্বর, যেন বলে উঠোলো কে তুই?  অর্চি পেছন ফেরে, দরজা জুড়ে সে যা দেখতে পায়, ভূত দেখলেও সে এতটা চমকে উঠত না। বুকের ভেতরটা তার ধক করে ওঠে। পালাবার উপায় নেই, উপায় থাকলেও তার পায়ে বোধহয় দৌঁড়ানোর শক্তিটুকু অবশিষ্ট ছিল না। সে সন্মোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

তিন হাত দূরে দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে জীবন্ত কালী মূর্তি। মাথায় মুকুট, গহন কালো মুখ, মুখগহবর থেকে নির্গত রক্ত রঙের জিহ্বা। পিঠে আছড়ে পড়েছে  ঘন আঁধার কালো অলক রাশি। সে যে জীবন্ত তার প্রমান অর্চি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। কালী তার হাতের খাড়া নামিয়ে বেড়ার গায়ে গুঁজে রাখে, তারপর খুলে রাখে নরমুন্ডগুলি গলা থেকে, মায় জিভ পর্যন্ত খোলে।

- আগেও তোকে দেখেছি এদিকে। কে তুই? আসিস কেন এদিকে? কালী মা এবার স্পষ্ট করে কথা বলে। জিভ খোলার পর গলা তার স্পষ্ট হয়েছে।

অর্চির মাথা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসে। সে বুঝতে পেরেছে এ মানুষটি আসলে বহুরূপী। কিন্তু মানুষটি পুরুষ না নারী সে বুঝে উঠতে পারে না। জীভ খুলে নেবার পর মানুষটির কথা পরিষ্কার হয়েছে, কিন্তু তবু লিঙ্গ নির্ধারণ করা যাচ্ছে না তার। অর্চি বলে,

- আমি এখানকার মানুষ নই। নতুন এসেছি এখানে।

কিন্তু এই ব্যাখ্যায় কিছুই পরিষ্কার হল না।। অর্চি নিজেও তা বুঝতে পারে। তার কী যে হয় ভেতরে, তার মনে হয়, এই নকল কালী ঠাকুরের সামনে অনেক কথা বলে ফেলে হালকা হওয়া যায়। তার অতীত দিনের কথা, এখানকার বন্ধুহীন দিনগুলি, দামোদরের তীরে বিকেলের ভ্রমণ। সে অনেক কথা বলে চলে। এই কয়েক মাসের চুপ করে থাকা সে শেষ করে দিতে চায়। এই সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটি তার কথা অনুধাবন করতে পারছে কিনা সে খেয়ালও তার থাকে না।

ইতিমধ্যে মা কালী তার দুটি হাত থেকে মুক্ত হয়েছেন। রুপালি মুকুট খুলেছেন। মেঝেতে দেয়ালের কোণে বাঁশের গায়ে ঠেশ দিয়ে বসে অর্চির কথা মন দিয়ে শুনছেন। অর্চির কথা শেষ হলে তিনি বলেন,

- এদিকে আর এসো না তুমি। আমি তোমাকে চিনি। অনেকবার দেখেছি। এ জায়গাটা ভালো না। নানা খারাপ কাজকর্ম হয় এদিকটায়। তুমি যে এদিকে প্রায় আসো, একা একা ঘুরে বেড়াও, একা একা কথাও বলো, আড়াল থেকে আরো কয়েকজন লক্ষ্য করেছে।

- তাই? আমি তো জানি না এসব। আমি বেড়াতেই আসি।

- আর এসো না। আবার তাকে মনে করিয়ে দেয় মানুষটি।

 

সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে সে ঠিক করে আর নয়, আর সে যাবেনা সদর ঘাটে। সেদিন বিকেল হলে তাই সে কার্জন গেটের দিকে হেঁটে রওনা হয়। সদরঘাট রোড এসে মেশে জি.টি রোডে। আরেকটু এগোলেই ডান দিকে সে দেখতে পায় বেশ প্রসস্থ এক প্রাঙ্গন। তার মাঝে হলুদ রঙের বেশ লম্বা একটি হল। সে জানে এটি বর্ধমান টাউন হল। ভেতরে ঢুকে  দেখে অনেক মানুষ সেখানে, নানা বয়সের মানুষ, বৃদ্ধরা আছেন, তারা মাঠে বসে গল্পরত, যুবকেরাও। তারা  সাইকেল পাশে দাঁড় করিয়ে বেঞ্চে বা মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মেয়েদেরও দেখা যায়, কেউ কেউ শিশুদের নিয়ে এসেছে। অর্চি একটা ফাঁকা বেঞ্চে গিয়ে বসে। তখনো রোদ একেবারে মরে যায়নি। সবুজ রঙের বেঞ্চ। বেঞ্চের পেছনেই একজোড়া কৃষ্ণচূড়া  ছায়া বিলাচ্ছে। চোখের সামনে এতো মানুষ তবু নির্জনতা প্রিয় অর্চির মানুষজন আজ ভালো লাগতে থাকে। এমন সময় তিনটি অর্চিরই বয়সী ছেলে সাইকেলে চালিয়ে বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন অর্চিকে দেখিয়ে বলে, প্রবীর আমাদের ঠেক আজ দখল হয়ে আছে। অর্চি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, বলে আমি তো জানি না তোমরা বস রোজ এখানে, আমি অন্যখানে বসছি। প্রবীর নামের ছেলেটি বলে, আরে না বোস বোস তুমি। তোমাকে আগে দেখিনি তো এখানে। তাদের সঙ্গে আলাপ হয় অর্চির, এরা সবাই হায়ার সেগেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে তারই মত ফলের অপেক্ষায় আছে। সেদিনই তাদের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে যায় অর্চির। যাবার সময় তারা বলে কাল আবার এসো।

 

ডুয়ার্স, ১৯৭১

 

সারারাত বৃষ্টি হয়েছে কাল। মেঘ ডেকেছে নিরবচ্ছিন্ন আর বিদ্যুৎ ছিঁড়ে ফেলেছে আকাশ। আজ সোমবার, স্কুল আছে। বৃষ্টি সকালে চেপে না নামলেও, হালকা ছন্দে ঝরে চলেছে নাগাড়ে। অর্চি তাদের বারান্দায় কাঠের রেলিং এ বসেছিল কাঠের থামে হেলান দিয়ে। সামনে তাদের বাগান, সেখানে সবুজ গাছেরা আরো সবুজে সেজেছে। একটা কাক আমগাছের পাতার আড়ালে নিজেকে লুকোতে চাইছে। মাঝে মাঝেই সে ডানা ঝেড়ে কলকণার ফুলঝুড়ি ছোটাচ্ছে। অর্চি ভাবছিল আরো জোরে আসুক বৃষ্টি, সাড়ে দশটা নাগাদ ঘণ্টা খানেক ধুম বৃষ্টি হলেই চলবে। স্কুলে রেইনি ডে তাহলে অনিবার্য। অলস বৃষ্টিতে চা গাছেরা ভিজছে, ভিজছে রাস্তা, বাড়ি মাঠ। এমন সময়ে প্রীতমের বোনকে অর্চি ছাতা মাথায় তাদের গেট খুলে ঢুকতে দেখে।

রাখী বারান্দায় উঠে ছাতা নেভায়। অর্চি বলে, কি রে রাখী আজ রেইনি ডে হবে? রাখী হেসে উত্তর দেয়,

- এবার রোদ উঠবে।

তারপর একটা কাগজের টুকরো অর্চির হাতে দিয়ে বলে দাদা তোকে দিতে বলল। একথা সে কথার পর রাখী বলে,

- একটা গল্পের বই দে না অর্চি রাত্রে পড়বো। অর্চির চেয়ে দু তিন বছরের ছোট রাখী তবু সে অর্চিকে দাদা ডাকবে না।

অর্চি বলে, একটু দাঁড়া। সে ঘরে ঢুকে  ‘লা মিজারেবেল’ এর বাংলা অনুবাদ বইটি এনে রাখী কে দেয়।

- ভালো এটা? ভালো  বই না হলে নেবো না কিন্তু, রাখী বলে।

- প্রীতম থাকতে ভালো বইয়ের অভাব তোর?

- দাদার কথা আর বলিস না। আমাকে একটা বই দিয়েছে, ‘বিপ্লবের গান’, লেখকের নাম ও তেমনি, ‘চিন চিন মাও।‘

- আমাকে এই বইটা দেয়নি তো প্রীতম। ভালো লাগলো তোর?

- শুধু বিপ্লব আর বিপ্লব, মানুষের আর কিছু কাজ নাই নাকি?

- আর কি থাকবে?

- প্রেম, ভালোবাসা, হিংসেমি, গোয়েন্দাগিরি।

- বাপরে তুই তো বড়ো গ্রন্থ সমালোচক হয়ে উঠলি।

- দাদা আর কি বই দিয়েছেরে তোকে পড়তে?

- গোর্কির মা।

- এটা আমি পড়েছি।

রাখীর হাবভাব কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, যেন তার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে দাড়িয়াবান্ধা আর গোল্লাছুট খেলত, আর বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া বাধাত।

অর্চির ঠাকুমা আসেন বারান্দায়। রাখীকে দেখে বলেন,

- চা হইতেছে, খাবি নাকি মাইয়া।

- না ঠাকুমা।

- তয় রুটি তরকারি খাইয়া যা।

- স্কুল আছে ঠাকুমা। বাড়ি গিয়ে ভাত খেয়ে স্কুলে যাবো এখন।

- অর্চি তুই যাবি না স্কুলে? ঠাকুমা অর্চিকে বলেন।

- রেইনি ডে হবে ঠাকুমা। স্কুল হবে না।

রাখী চলে গেলে অর্চি কাগজের টুকরোটা খুলে দেখে, প্রীতম লিখেছে, আজ টিফিনের পর কালজানি নদীর ব্রিজের ওপাড়ে চলে আসিস। একা আসিস। সুতরাং অর্চিকে স্কুলে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বৃর্ষ্টিও ধরে আসে। অর্চি দেখে, আমগাছের কাকটি ইতিমধ্যে উড়ে গেছে।

 

টিফিনের পর কালজানির ওপাড়ে ব্রিজ পার হয় অর্চি। বর্ষার কালজানি চওড়া হয়ে বইছে। ভুটান পাহাড়ে কাল বৃষ্টি হয়েছে। সেখানেই তো কালজানির বাসা। তিস্তা থেকে আলাদা হয়ে সে এসেছে আবার তিস্তাতেই মিশে যেতে। শেষ আশ্রয় হবে তার ব্রহ্মপুত্রে। পথের থেকে যত ডাল পালা, মাটি সে বয়ে নিয়ে চলেছে। নদীর উপরের ব্রীজটি কাঠের খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে। সাইকেল নিয়ে ব্রীজের ওপাড়ে অর্চি পৌঁছে দেখে,  প্রীতম সাইকেল নিয়ে আগেই পৌঁছে  তার জন্য অপেক্ষা করছে।  অর্চি পৌঁছাতে প্রীতম বলল, আমার পেছনে পেছনে আয়। মাঝেরডাবরি বাঁ পাশে রেখে মাইল খানেক এগিয়ে একটা ছোটো মত জঙ্গল পার হল তারা। সামনে একটা ঝোরা। জল আছে হাঁটুর নীচ অব্দি, তবে স্রোত আছে। সাইকেল থেকে নেমে ওরা দুজনে জলে নামে। সাইকেল জলের উপর দিয়ে ঠেলে নিয়ে চলে। স্বচ্ছ জলের তলায় নুড়িদের রাজ্য, সবুজ শ্যাওলা সে রাজ্যকে  ছায়া দেয়, জলের নিচে এলোমেলো পাক খেতে খেতে। 

- কোথায় যাচ্ছি বলতো? অর্চি বলে।

- সামনে রাজবংশীদের একটি গ্রাম আছে, সেখানে খগেন কাকার বাড়ি যাবো। শেখর দা খোকন দা আছেন ওখানে।

- এরা কারা রে প্রীতম?

এরা পাভেলের মত ছেলে, এই দশকেই ভারতবর্ষকে  মুক্ত করবে।

- পাভেল?

- ইস্পাত পড়িস নি তুই?

- না। বুঝেছি রুশ বিপ্লবী বুঝি?

- রুশ দেশের পথে অনেক ত্রুটি বেরিয়েছে অর্চি, শেখরদারা মানে মাও সেতুং এর পথ।

শেখর ও খোকন জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। দুজনেরই কলকাতায় বাড়ি। অর্চি দেখে, এরা দুজন ছাড়াও আরো চার পাঁচটি যুবক উপস্থিত আছে। তাদের মধ্যে একজনকে অর্চি চেনে। তাদেরই স্কুলের, প্রীতমের সহপাঠী। তবে প্রীতম বিজ্ঞানের ছাত্র, এই রতন নামের ছেলেটি কলা বিভাগের। খগেনের বাড়িতে, উঠোনে বাঁশের তৈরি বেঞ্চে বসে  শেখর, রতন ছাড়া আরো দুয়েকজন। যাদের বেঞ্চে জায়গা হয়নি তারা বাঁশ ঝোপের পাশে একটা ঢিপি মত স্থানে বসেছে। প্রাথমিক আলাপের পর, শেখর অর্চির সঙ্গে কথা শুরু করে।

- তুমি তো কবি। কবিতা লেখ শুনেছি। প্রকৃতি, প্রেম ইত্যাদি নিয়ে লেখো। এর বাইরে যে মানুষ-জন তুমি দেখো তোমার চারপাশে। চা বাগানের ম্যানেজার, লেবার আর তোমরা, এদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে ভেবে দেখেছো কখনও। চা বাগানে রৌদ্রে জলে যারা জীবন পাত করছে, কারখানায় খাটছে, তাদের সঙ্গে সাহেবদের আর তোমাদের এত ফারাক কেন? তারা লেবার লাইনে জল, আলো, খাবারের অভাবে কাটাবে কেন? এসব ভেবে দেখেছ কখনও? বলতে বলতে শেখরের গলায় আবেগ এসে পড়ে। সে প্রশ্ন করে, অর্চি, এই যে তুমি চারপাশে এদের সবাই কে দেখছ, সাহেব, বাবু, শ্রমিক, এদের মধ্যে জীবনযাত্রার এই ফারাক নিয়ে তোমার মনে কখনো প্রশ্ন জেগেছে?

না, তেমন জোরালো প্রশ্ন অর্চির মনে কখনো জাগেনি। সে ছোটবেলা থেকে এরকমই দেখে আসছে। সে দেখেছে, রৌদ্রে জলে মদেশিয়া পুরুষ শ্রমিকেরা, মহিলা শ্রমিকেরা, টুকরি পিঠে ছুটছে, বাবুরা ধোপদুরস্ত পোষাকে অফিস যাচ্ছে, হেঁটে বা সাইকেলে। আর চার চাকার বাহনে আসা যাওয়া করেন সাহেবেরা, তারা আরামের জীবন কাটান বাংলো বা কুঠিতে। যা চলে আসে, যা দেখে আসা হয় তাকেই নিয়ম বলে মানুষ মেনে নেয়। অর্চিও সেরকমই দেখে আসছে। একেই স্বাভাবিক বলে সে মেনে এসেছে। যে যেমন জানে, যার যেমন কাজ, তার সে রকমই জীবন হবে তো!

এরকম আরো অনেক, এ যাবৎ না ভাবা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় অর্চিকে আজ। যেমন,

- তোমার কি মনে হয় তুমি স্বাধীন?

স্বাধীন? অর্চি ভাবে স্বাধীন আর কোথায়? সে খুবই ঘাবড়ে গিয়ে অনুচ্চ স্বরে বলে,

- আমাকে একটা রুটিনের মধ্যে থাকতে হয়, এটা আমার ভাল লাগে না।

- আরো একটু বড় প্রেক্ষিতে ভাবনি? সকলকে নিয়ে?

অর্চির নিজেকে নিয়েই মহা সমস্যা। তারই কূল কিনারা সে পায় না। সকলের ভাবনা তো দূর। না, সে রকম সে ভাবে নি।

রতন সহ সকলে শেখরের কথার মাঝে কোন কথা বলছিল না। শেখর এবার অর্চি কে বললো,

- তোমার জন্য ছোট একটা কাজ আছে অর্চি। আমি মিটিং শেষ হলে  তোমাকে বলবো।

এতক্ষণে রতন মুখ খোলে, বলে,

- অর্চি কী কোন দায়িত্ব নিতে পারবে? ওতো কবি। স্কুলের ম্যাগাজিনে একটি কবিতা লিখেছে। রোম্যান্টিক ভাবনায় ভরপুর।

খোকন দা বলেন, কবিরা বিপ্লবে যোগ দেয় না বলে তোমার মনে হয়? রতন আর কথা বাড়ায় না।

এরপর শুরুহয় তাদের আলোচনা। রাজবংশী কিছু ছেলে মেয়ে ইতিমধ্যে এসে সভায় বসেছে। এখন মূল বক্তা খোকন। সে যা বলে তার অনেক কিছুই অর্চি বুঝতে পারে না ভাল করে।

১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে যে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে সেটা নাকি প্রকৃত স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতার অর্থ হল সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর, যা এদেশে হয়নি। জাতীয় বিপ্লব, নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত ঠিকই কিন্তু দুটি এক নয়। খোকন দা ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, ভারত রাষ্ট্র আধা ঔপনিবেশিক পরমুখাপেক্ষী রাষ্ট্র, আর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস, দু একবারের বিচ্ছিন্ন ভূমিকা বাদ দিলে, সেটা সুবিধাবাদের ইতিহাস। সিপিএম ও সিপিআই উভয়েই বুর্জোয়া পার্লামেন্টমুখী দল। এরা দক্ষিণপন্থী সংস্কারবাদের প্রতিমূর্তি। আরো অনেক তত্ত্বের কথা হল।

অর্চির কানে অনেক নতুন শব্দ প্রবেশ করল সেদিন। অনেক কথা  মাথার উপর দিয়ে গেলেও, খোকনদার বলবার আবেগ তাকে স্পর্শ করে গেল। তার প্রতিটি উচ্চারণে ছিল বিশ্বাস ও সততা। সভা শেষে অর্চিকে আলাদা করে শেখর ডেকে বলল, তোমাদের চা বাগানে আমাদের এক রাত্রির শেলটারের দরকার হবে। তোমাদের বাড়িতে ক্লাবের চাবি থাকে। তুমি প্রীতম কে আগামী কাল রাতে চাবিটা দেবে। প্রীতম পরদিন ভোরে আবার তোমাকে চাবি ফেরত দিলে তুমি  সেটা যথাস্থানে রেখে দেবে। প্রস্তাবটা অর্চির ভালো লাগলো না, শেখর কে সে নাও বলতে পারল না, মনে মনে ভাবলো প্রীতম কে সে তার অসুবিধার কথা বুঝিয়ে বলবে।

ফেরবার পথে অর্চি প্রীতম কে বলেছিল, এত গোপনীয়তার কী আছে প্রীতম। বাবাকে বললেই তো হয় তোর দুয়েকজন বন্ধু আসবে চা বাগান দেখতে, ক্লাবে থাকবে। বাবা না করবে না। আমাদের বাড়িতে থাকলেও বাবা না করবে না।

প্রীতম কঠিন গলায় বলে, তা আর হয় না অর্চি, সিদ্ধান্ত একবার যখন হয়েছে, সেটা যে করে হোক করে ফেলতে হবে। তাছাড়া, এমন কী ব্যাপার চাবি আমার হাতে কাল রাত্রে দিবি, আমি তোর হাতে পরশু ভোর ভোর দিয়ে আসবো।

         

অর্চির বাবা ছিলেন স্টাফ ক্লাবের সেক্রেটারি। সেই সুবাদে ক্লাবের চাবি থাকত অর্চিদের বাড়িতে। বাবার টেবিলের দেরাজে সেটা রাখা থাকত। চাবি নিয়ে তেমন কোন কড়াকড়ি ছিল না। সন্ধ্যা বেলা ক্লাব খোলা হত, বাবুরা ক্লাবে যেতেন, তাও রোজ নয়। অর্চি ও তার বন্ধুরা দিনের বেলায় মাঝে মাঝেই চাবি নিয়ে ক্লাব খুলে টেবিলটেনিস খেলত। অনেকেই অতিথি হিসেবে, বা কাজে বাগানে এলে এখানে থেকে যেতেন। পুজোর সময় ঢাকিরা পুরোহিতমশাই এরাও সকলে থাকতেন।

গোপনীয়তার যে প্রয়োজন ছিল সেটা অর্চি টের পেল পরদিন সন্ধ্যায়। সেদিন ক্লাব খুলেছিল। সুনীল রাত ৯টা নাগাদ বাড়ি ফিরে চাবি রাখলেন দেরাজে। অনেক রাতে অর্চির জানালায় প্রীতম এসেছিল, চাবি নিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল অন্ধকারে, পরে ভোরবেলা চাবি ফেরত দিয়ে যায় সে। অর্চি তা ড্রয়ারে রেখে দেয়।

পরদিন সন্ধ্যায় ক্লাব খোলা হয় আবার। ক্লাব খুলে ভেতরের দৃশ্য দেখে হৈ চৈ পড়ে যায়। হৈ চৈ শুনে আর সবার মত অর্চি ও ছুটে যায় ক্লাবে। চা বাগানের নারী পুরুষ সবাই এসেছে, সকলের চোখে বিস্ময় আর আতঙ্ক। নাটকের স্টেজ, চেয়ার, টেবিল, ক্যারামবোর্ড, টেবিলটেনিস বোর্ড, সবকিছুই যেমন সাজানো থাকে তেমনি আছে। ক্লাবের দেওয়ালে মনীষীদের ছবি পরপর বড় করে বাঁধিয়ে টাঙানো থাকত। দেখা গেল সেগুলির মধ্যে শুধু দুজনের ছবি যথাস্থানে নেই। মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ। তারা ভূলুণ্ঠিত, ভগ্ন। কাঁচগুলি ছিটকে পড়েছে এদিকে ওদিকে। দেখলে মনে হয় প্রচণ্ড আক্রোশে তাদের আছাড় মারা হয়েছে । 

দুজনকে নিয়ে প্রতিক্রিয়া হল দুরকমের। বাঙালিদের অধিকাংশই খানিকটা গান্ধী বিদ্বেষী, হয়ত নেতাজির কারণে, এবং কমিউনিস্টদের তীব্র সমালোচনার কারণে। কিন্তু তবু তিনি জাতির পিতা। অনেকেই তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। অর্চি দেখে তার বাবা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গান্ধীজির ভগ্ন ছবির সামনে। তিনি জীবনভর গান্ধীর অনুগামী।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ? তার আসন সবার মনে বিশেষ আসনে প্রতিষ্ঠিত, তা তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়ে থাকুন আর নাই থাকুন। অর্চি দেখে রবীন্দ্রনাথের ছবি বেসিনের নিচে একধারে ভেঙে পরে রয়েছে। কিছুদিন আগেই ২৫ শে বৈশাখ উদ্‌যাপন করা হয়েছে। কবির ছবিতে মালাটি  শুকিয়ে ছিল। সেটিও পড়ে রয়েছে মাটিতে। কবির জন্মদিনের আগেরদিন তার ছবি ঘিরে আরশিদি যত্ন করে এঁকেছিল চন্দনের আলপনা। সারা জীবন ধরে কবি অনেক আঘাত পেয়েছিলেন, অর্চির মনে হল মৃত্যুর পর আরেকটি আঘাত দেবার পেছনে অর্চির হাত রয়ে গিয়েছে!

 

এইসময়, বাইরে পুলিশের গাড়ি এসে থামলো।

- ক্রমশ 

 

4 Comments
  • avatar
    Swapan Pariya

    28 July, 2024

    কাহিনী আরও ছড়াচ্ছে বুনট দীর্ঘ হচ্ছে। যেন শীর্ণতোয়া নদী ধীরে দু'পাড়ের চরিত্রদের নিয়ে চলেছে । যাত্রা যে কিছুটা দীর্ঘ এবং নদীপথ ক্রমপ্রশস্ত হবে তার আভাস ইতিমধ্যে অন্তত এবারের অংশ থাকে যেনবা বোঝা যায়।

  • avatar
    শঙ্কর দাশগুপ্ত

    28 July, 2024

    কৈশোর ও যৌবনের যে দুরন্ত আবেগ মানুষের জীবন প্রবাহকে নিত্যনতুন দোদুল্যমানতায় ভাসিয়ে নিয়ে চলতে চলতে অবশেষে কোনো এক দৃঢ়তর সমৃদ্ধিতে উপনীত হবে------এই আশায় রইলাম ।

  • avatar
    Debashis Mandal

    29 July, 2024

    North Bengal এর প্রকৃতি ও সেই সময়ের দিন লিপি খুব সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

  • avatar
    SAMIRENDRA NATH PANDE

    30 July, 2024

    সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে বিপ্লবের যে ঝলক ছিল তা আজ কোথায়? সমকালীন ছবিটি চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলার সার্থক প্রয়াস।এগিয়ে চলো

Leave a reply