জনৈক আমলার আমূল ভূমি সংস্কার জীবন - দ্বিতীয় পর্ব

লিখেছেন:নির্মাল্যকুমার মুখোপাধ্যায়

পর্ব ৫ 

পিটিশন দেওয়ার আগেই বর্গাদার খুন

 

ছ’মাসের রিগোরিয়াস ট্রেনিং একদিন শেষ হল। দেখা গেল আমরা তিরিশজন কানুনগো সবাই পাশ করে গেছি। কিছু থিয়োরি পড়ান হল, সেগুলো জমির নানা আইন। তার মধ্যে প্রধান হল অপারেশন বর্গা। ধারা উপধারা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যেন ল'কলেজের ক্লাস চলছে। তার সঙ্গে যুক্ত হল গণ্ডা কড়া ক্রান্তি তিলের হিসেব শেখা। ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস ঠাসা মস্তিস্কে সেসব হিসেব ঢুকতে আর চায় না। তবু ভাল লাগল দেখে, যে, রোজ ভোরবেলা মুর্শিদাবাদের বাঞ্ঝেটিয়ার মাঠে নেমে, কাদা মাটি বিষ্ঠালিপ্ত গাংটার্স চেইন টেনে টেনে মাপজোক করে করে, তেপায়া টেবিলের ওপর বিছানো সাদা শিটের ওপর পেন্সিল টেনে, স্কেল ফেলে ফেলে আমরা ছোট ছোট চৌকো চৌকো প্লটগুলোর ছবি এঁকে ফেলতে পেরেছি,  ফুটে উঠেছে একটা ছোট্ট এলাকার মৌজা ম্যাপ। 

পাশের পর এল পোস্টিং। দেখলাম, বেশ বড় সংখ্যক কানুনগোকে কোচবিহার পাঠানো হয়েছে। পকেটে টান নিয়েই উঠে পড়লাম কামরূপ এক্সপ্রেসে। 

হেড অফিসে কিছুদিন ডাম্প করে রেখে আমাদের ফের পোস্টিং হল হলকা ক্যাম্পে। হলকা মানে গরম কিছুর উত্তাপ জানতাম। এখন জানলাম দূরে দূরে গ্রামের ভেতরে অস্থায়ী সেটেলমেন্ট অফিসকেও হলকা ক্যাম্প বলা হয়। 

আমার প্রথম হলকা ক্যাম্পটি ছিল ভেলকির হাটে। শেষ বাসস্টপে নেমে জানতে পারলাম এইবার তিন কিলোমিটার হাঁটাপথ। সে পথ জুনের বর্ষায় কর্দমাক্ত। দুটো নদী পড়বে পথে যার ওপরে কোনও ব্রিজ নেই। একজন কিশোর এখান থেকে বাঁকে করে দু টাকার বিনিময়ে আমার বাক্স প্যাঁটরা কাঁধে করে নেবে। তার কাছে যথেষ্ট পরিমাণ নুন আছে। কোনও ভয় নেই। নদী দুটো পার হওয়ার পর পায়ের জোঁক ছাড়াতে কোনও সমস্যা হবে না। 

একঘন্টা পর দেখা দিল ভেলকির হাট। নদী দুটোতেই হাঁটু জল ছিল। সামারু জানালো, বৃষ্টি চালু থাকলে নাকি কোমর জল হতেও পারতো। পা ছাড়িয়ে কিছু জোঁক হাঁটু অবধি উঠেছিল। কোমর জল থাকলে জোঁকগুলো কোথায় উঠতো কে জানে!

হলকা ক্যাম্পটি টিনের দেওয়াল ও কাঁচা মাটির মেঝে দিয়ে তৈরি একটি হেটো দোকানঘর যার বারান্দায় সাদা কালো সাইনবোর্ডে খুব অস্পষ্ট অক্ষর বলছে এটাই সেটেলমেন্ট হলকা ক্যাম্প নং ৬৬।

ভেতরে সিনিয়ার কানুনগো, বছর তিরিশের ফর্সা রোগা রাজেনদা, বসে ছিলেন। তিনি দেখলাম, আমি যে আসছি জানতেনই না। এই অফিসে তিনি আটাত্তরে জয়েন করে সাড়ে তিন বছর ধরে ‘পচছেন’। আমি তার এখন মুক্তিদূত।

মহা সমাদরে তাঁর বাসায় নিয়ে গিয়ে চান খাওয়া করালেন। তাঁর স্ত্রী আসন্নপ্রসবা। তবু যত্ম করে রাঁধলেন শিঙি মাছের ঝোলভাত। আমার জন্যে আরেকটা বাসাও দেখা হল। পঞ্চাশ টাকা একটা টিনের ঘরের ভাড়া যেটা আসলে একটা বড় পাটের গুদামের অংশ। 

অফিসেও থাকা চলত কিন্তু সিনিয়ার বলল,

- জয়েন করেই কোনও আনঅথরাইজড ফেসিলিটি নিও না। দপ্তরটা নোংরা। যতটা পারবে নিজেকে ক্লিন রাখবে। মাথাটা সোজা রেখে হাঁটতে পারবে তাহলে।

অফিসে আমাদের বাদ দিলে তিনজন। পেশকার, আমিন আর যাঁচ মোহরার (অনেকটা ক্লার্কের সমতূল্য)। নাইট গার্ড রাতে এসে শোয়। তার সংগে আমার প্রথম মাইনের দিন প্রথম দেখা হয়েছিল।

দিন সাতেক জরিপের কাজে সিনিয়ারের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পে বসে এবং ফিল্ডে ঘুরে ঘুরে হাতে কলমে দলিল দেখে দেখে রেকর্ড করা শিখতে লাগলাম। 

সন্ধ্যে হলে বিদ্যুৎহীন সেই পাটগুদামে প্রবেশ করে হ্যারিকেনের আলোয় চাড্ডি সেদ্দপক্ক খাব বলে, হাট থেকে কিনে আনা হাঁড়িতে, জনতা স্টোভ জ্বেলে, চালে-ডালে-ডিমে একাকার করে ফোটাতে ফোটাতে চোখের জল পেছনে মুছতাম। রোজই হয় শক্ত, নয় গলে পেস্ট হয়ে যেত সেই বস্তুটি। 

বৌদি হঠাৎ অসুস্থ বোধ করায় ওনাকে নিয়ে, ছুটির দরখাস্ত আমার হাতে দিয়ে, সদরে চলে গেলেন রাজেনদা। এডমিশন করাতে হতে পারে। ভ্যান ভাড়া করে, নদীপারাপার এড়িয়ে, অনেকটা ঘুরপথে, অন্য একটা আউটলেট দিয়ে চলে গেলেন ওরা। আমি একেবারে একা কুম্ভ হয়ে থেকে গেলাম ভেলকির হাটে। ঠিক দুদিন পর বীভৎসতম অভিজ্ঞতাটি হল। তারিখটা ভুলব না এ জীবনে, ২৩/৭/১৯৮১। 

সাত সকালে হল্লা। জানলা খুলে দেখি লোকজন হলকা ক্যাম্পের দিকে ছুটছে। আগুন আগুন বলে চিৎকার উঠছে প্রবল। ক্যাম্পের ঠিক পেছনের একটা বাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। আমি বেরোলাম কিন্তু ছুটলাম না। দুচারজন যেতে যেতে জানাল,

- বুধুয়া বর্মনের বাড়িত্ আগুন লাগিছেন বাহে। মনে হয় কেউ লাগায়ে দিছং। তোমরালা অফিচার মানসি, উটিকোণায় এ্যালায় না জান বাহে। ঘরোত থাকেন। 

দীর্ঘ সময় ধরে জলটল ঢালার পর আগুন কমে এল। ধরাধরি করে কিছু মানুষ উল্টো দিকের হেলথ সেন্টারে কাউকে কলাপাতায় মুড়ে, ভ্যানে করে নিয়ে এল।

বেলা বাড়লে অফিসে গিয়ে শুনলাম বুধুয়ার অবস্থা খুব খারাপ। বোধহয় বাঁচবে না। কে আগুন দিল, কীভাবে আগুন লাগল, জিগ্যেস করলে কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। একটু যেন এড়িয়ে গেল স্টাফেরাও। হাটের ঝাঁপগুলো প্রায় বন্ধ।

বিকেলের দিকে পুলিশ এলো। বুধুয়ার ডেডবডি জিপে তুলল। আমার অফিসে এসে জানতে চাইল জমিজমা নিয়ে কোনো বিবাদ চলছিল কি না। দেখলাম, সাব ইনস্পেকটরেরও ধারনা আগুনটা কেউ লাগিয়েছে। উনি আমার বয়ান ডায়রিতে লিখে নিলেন। সেটা ছিল খুব সংক্ষিপ্ত - সিনিয়ার ছুটিতে। আমি সদ্য এসেছি। এ বিষয়ে কিছুই জানি না।

ফেরার সময় ওরা প্রাইমারি স্কুলের মাঝবয়সী টিচারটিকে, যিনি সব হাটবারে, বেলাশেষে, জনা চারেক হাটুরেকে নিয়ে একটা লাল পতাকা তুলে ধরে হাটটা চার পাক দিয়ে শ্লোগান দিতেন , 

- বামফ্রন্ট জিন্দাবাদ। শ্রমিক কৃষক কর্মচারী ঐক্য জিন্দাবাদ। দিকে দিকে দরকার বামফ্রন্ট সরকার,

আর শেষে আমার অফিসের সামনে এসে বলতেন,

- আমূল ভূমি সংস্কার করতে হবে। সমস্ত বর্গাদার আধিয়ারের নাম রেকর্ড করতে হবে,

তাঁকে তুলে নিয়ে গেল জিজ্ঞাসাবাদ করবার জন্য। 

অনেক কষ্টে পেশকারবাবুর পেট থেকে ফিসফিস করে যেটুকু বার হল তাতে জানলাম, এই কমরেড মাস্টার এখানে আধিয়ারদের কুবুদ্ধি দিয়ে দিয়ে বর্গা রেকর্ড করাতে চায়। কিন্তু জোতদার জোরালো কংগ্রেসী বলে জুত করতে পারে না। তবু বুধুয়াকে উসকিয়ে নিয়ে এসে একটা দরখাস্ত কী ভাবে লিখতে হবে, কদিন আগে জেনে গিয়েছিল। মনে হয় বিষয়টা সয়ানাথ জোতদারের কানে উঠে গেছে। তাই গোড়াতেই নিকেশ….

পেশকারের মুখ এটুকু বলতে গিয়েই বিবর্ণ হয়ে আসে। আমারও পেটের ভেতর নাড়িভুড়ি কেমন যেন পাক দিয়ে ওঠে। ঝিমঝিম শরীর নিয়ে আমি ঘরে এসে শুয়ে পড়ি। পরদিন থেকে আর অফিসমুখো হই না। ঘরেই শুয়ে থাকি। কারণ পেশকার বাড়ি যাওয়ার আগে আমাকে একা ডেকে বলে গেছেন, ইন্সপেক্টর নাকি জানিয়ে গেছেন, বর্গা সংক্রান্ত ব্যাপারে জেরার জন্য আমাকেও কোতোয়ালীতে ডাকা হতে পারে। 

 

পর্ব ৬ 

সমস্যা থেকে সাময়িক মুক্তি 

 

ভেলকির হাটের ভেলকিবাজির চোটে আমার তখন গভীর অবসাদ চলছে। অফিসে ঢুকতেই ভয় লাগছে। ভাবছি এই এল কোতোয়ালির শমন। একদিন দুপুরের দিকে একটা জিপ ঢুকল সশব্দে। জানলা খুলে দেখলাম গিয়ে থেমেছে একদম হলকা ক্যাম্পের সামনে। জানলা দরজা সব ভেতর থেকে টাইট করে বন্ধ করে চৌকির ওপর উঠে শুয়ে পড়লাম। 

খানিক বাদেই দরজায় ঠক ঠক। কে?

পেশকারবাবুর গলা পেয়ে সাহস এল। দরজা খুলতেই উনি বললেন,

- চার্জ অফিসার এসেছেন। আপনাকে ডাকে।

চার্জ অফিসার পদটি জেলাস্তরের একজন একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট-এর, যিনি জেলার কাজকর্মের খতিয়ান নিয়ে থাকেন মাসে মাসে। কানুনগোদের পোস্টিং অনেকটাই তার নিয়ন্ত্রণে। ইনি নিজেও একসময় কানুনগো ছিলেন। তারপর বিডিওগিরি কিছুদিন করে চার্জ অফিসার হয়ে আছেন। কথায় কথায় বলেন, 

- আই ওয়াজ আ কানুনগো। আই নো ইওর প্রবলেমস। 

এ হেন চার্জ অফিসার, রথীন রায়, আমাকে অফিসে ডেকে এনে বললেন,

- ডোন্ট ওরি। আপনাকে কোতয়ালি যেতে হবে না। আপনি যা জানেন, বা জানেন না, সেটাই একটা কাগজে লিখে আমার হাতে দিন। আমি সরকারি উকিল দিয়ে কোতয়ালি ম্যানেজ করে নেব। 

আমার মরা দেহে প্রাণ এল। 

উনি আরও বললেন,

- আই আন্ডারস্টুড ইওর ক্রাইসিস। রান্না করে খেতে পারছেন না। একা আছেন। রাজেন হয়ত চলে যাবে এইবার। ইউ আর ইন নিড অফ আ মেস। মাথাভাঙায় একটা মেস আছে। কাছাকাছি আপনাকে শিলডাঙা হলকা ক্যাম্পে দিয়ে দিচ্ছি। ওখানে প্রেমানন্দ আছে সিনিয়ার। খুব স্ট্রং অফিসার। মেসে থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করবেন। যান। 

রাজেনদা ফিরলে সব জানিয়ে শিলডাঙা রওনা দিলাম। রাজেনদা আমাকে চোখের জলে বিদায় দিল। 

শিলডাঙা গিয়ে দেখি আরও মারাত্মক অবস্থা। গোষ্ঠ রায়, দেউনিয়া (জোতদারের স্থানীয় প্রতিশব্দ) হলকা ক্যাম্পের মালিক। তিনি ওসি হোমগার্ড, রেশন ডিলার, দাতব্য চিকিৎসালয়ের ডাক্তার, ই ডি পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার এবং পঞ্চায়েত প্রধান। 

গ্রামের যতগুলো প্রশাসনিক পদ, সবই তিনি অলংকৃত করে বসে আছেন। তার বাড়িতেই আমাদের অফিস। এ ছাড়াও এলাকার ব্লক কংগ্রেসের তিনি অবিসংবাদিত নেতা। মাথাভাঙা, কোচবিহার এবং ময়নাগুড়িতে তার আলাদা আলাদা বাড়ি এবং ব্যবসাদি রয়েছে। 

প্রেমানন্দ আমাকে যা জানাল তাতে করে বুঝলাম যে, আমার পক্ষে মাথাভাঙা মেসে থাকা সম্ভব নয়। কারণ সেখানে কোনও সিট খালি নেই। মেসের চারটে বেড, একটায় আছে ব্যাঙ্কের অফিসার, একটায় ইলেকট্রিকের অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আর দুটোতে দুই কানুনগো, প্রেমানন্দ আর নিরাপদ বিসুই।  কাজেই আমাকে শিলডাঙাতেই থাকতে হবে এবং থাকার মতো একটা কাঠের দেওয়াল আর টিনের চাল দেওয়া ঘেরা বারান্দা আছে একমাত্র ওই গোষ্ঠ দেউনিয়ার বাড়িতেই। 

সেখানে হলকার কন্টিনজেন্সি স্টাফ, নাম - সুন্দরী মাসি, ঝাঁটপাট দেয়, সে রান্না করে দেবে। সকালে প্রেমানন্দ আর আমিনবাবু দুবেলা সেখানে খায়। আমি এলে আমিও আমিনবাবুর মতো, দুবেলাই খাব। ব্যাচেলার আমিনবাবু শোয় অফিসের ভেতর দুটো টেবিল জোড়া দিয়ে। সে শনি রবিও বাড়ি যায় না। মাতাল হয়ে মানসাই নদীর বাঁধের ওপর শুয়ে থাকে। 

 

পর্ব ৭ 

মানসাই নদীর জলে ও কার লাশ! 

 

মাস খানেক ধরে বিভাগীয় নানা কাজ শেখানোর পর একদিন প্রেমানন্দ অফিস ব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ করা মলিন হাফস্কেপ কাগজ খুলে আমার সামনে মেলে ধরে বলল, 

- এটা পড়।  

আধা শুকনো বল পয়েন্ট পেন দিয়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা-

কেশিও সাহেব [কানুনগো / Kanungo- ইংরাজিতে Kgo,‘কেজিও’- স্থানীয় অপভ্রংশ ‘কেশিও’]

মুই ত্যারতেড়ু বর্মণ, পিতা- ভ্যারকেসু, লাজো সিঙ্গের দুই বিঘা জমিত্‌ ভাগ চাষি। লাজো মোক্‌ জমি ছাড়ি দিবার কয়। তাই মোর নামখান্‌ বর্গা করিবার নাগিবে। 

মোজা [মৌজা] শিলডাঙা। 

থানা - মাথাভাঙা। কোচবিহার। 

ডান দিকে নিচে একটা ধ্যাবড়া বুড়ো আঙ্গুলের টিপছাপ। খুব সম্ভব ঘরে তৈরি কাজলের কালি ব্যবহার করা হয়েছে। আঙ্গুলের রেখাগুলো ঘষাকাচের মতো অস্পষ্ট। হাতের লেখা গ্রামের ইস্কুলের কোনো এক প্রাইমারির ছাত্রের মতো।

প্রেমানন্দ ভুরু নাচিয়ে বলল,

- নাও বোথ সাইডের জন্য নোটিশ লিখে ফেল। 

আমি ট্রেনিং-এর সময় নেওয়া অর্বাচীন বিদ্যেটি ফলিয়ে বললাম,

- অপারেশন বর্গায় তো ইন্ডিভিজুয়াল নোটিশ লাগে না। পিটিশনও লাগে না। ট্রেনিং-এ সিনিয়াররা বলেছে, গ্রামে গ্রামে সান্ধ্য মিটিং হবে, সেখানে চাষিরা আসবে। তারা যেন বর্গা করতে ভয় না পায় সেইজন্য আমাদের সাপোর্ট দিতে হবে। আরও বলেছে, বর্গা আছে, কাকের মুখে খবর পেলেই, ওপেন পাবলিক প্লেসে একটা নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়ে ফিল্ড এনকোয়ারি করে এসে রেকর্ড করে দেবেন। তাহলে তুমি কেন বোথ সাইডকে নোটিশ দেবে? 

ঈষৎ হেসে প্রেমা আবার ওর সার্কুলার বোঝাই ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বার করে আমাকে বলল,

- কিছুই জানে না মাস্টারমশাইরা। অপারেশন বর্গা কবে হাইকোর্ট বেআইনি ঘোষণা করে দিয়েছে। এটা পড়। 

কোর্টের ইংরাজি, আমি পড়ে কিছুই বুঝলাম না। প্রেমা বাঙলায় মানে করে করে পড়ল। দেখা গেল, ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে গভর্মেন্ট অপারেশন বর্গার পদ্ধতি নিয়ে যে সার্কুলার বার করেছিল, যেখানে যে ভাবে অপারেশন বর্গা রেকর্ড হবে বলে নির্দেশ ছিল সেটার বিরুদ্ধে কিছু জমির মালিক একজোট হয়ে দশখানা রিট পিটিশন হাইকোর্টে দাখিল করে এবং ২৮ শে মে, ১৯৭৯ সালেই জাস্টিস সব্যসাচী মুখার্জি সেই সার্কুলার বাতিল করে দেন। বলে দেন গ্রামে গ্রামে কেবল সান্ধ্য মিটিং করে নয়, পাবলিক প্লেসে নোটিশ ঝুলিয়েও নয়, সব সময় বোথ সাইডকে নোটিশ সার্ভ করে তবেই বর্গা তদন্ত করতে হবে। নাহলে রাইট টু ন্যাচারাল জাস্টিস বলে কিছু থাকছে না। 

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম এটা জেনে।

বললাম

- তাহলে এই অপারেশন বর্গা নিয়ে এতো হইচই কীসের, যার বৈধতার আয়ু ছিল মাত্র দশ মাস !!

প্রেমানন্দ শুনে হাসল মৃদু। 

নোটিশ ইস্যু হয়ে যাওয়ার দু দিনের মাথায় মানসাই নদীর [যার সরকারি নাম জলঢাকা, সেটেলমেন্ট ম্যাপে লেখা - জলধাক্কা] বাঁধের ওপর বিকেলের দিকে একটা হুডখোলা জিপ এসে দাঁড়াল। জানলা দিয়ে দেখলাম, একজন মহিলা, বয়স চল্লিশের আশেপাশে, পরনে সাদা পাঞ্জাবী, তার ওপর একটা কালো রঙের জহরকোট, খাকি ফুলপ্যান্ট, পায়ে কেডস্‌, স্টিয়ারিং থেকে লাফিয়ে নামলেন। পেছন থেকে লাফিয়ে নামল আরও দুজন পুরুষ। তাঁদের পরনে পাজামা এবং মিলিটারি শার্ট। কাঁধে বন্দুক। বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে টোটা ভরা বেল্ট। 

প্রেমা বলে উঠল,  

- ঐ দেখ, নোটিশ পেয়েই মালিক এসে হাজির। 

ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে এসে হলকার দরজা দিয়ে তিনজনই ঢুকে ফটাফট ফোল্ডিং চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল। মহিলাটি টেবিলের ওপর একটা প্লেন চারমিনারের প্যাকেট আর দেশলাই নামিয়ে রেখে বললেন,

- মণ্ডল সাহেব, আমি জানি আপনি খান না। কিন্তু নতুন সাহেব তো খান। নিন সাহেব। ধরান। আমার নাম লাজবন্তি সিং। 

আমি স্তম্ভিত হয়ে ওনাকে ভাল করে দেখলাম। শ্যামবর্ণা, বলিষ্ঠ, বেশ লম্বা, একবেণীর চুলের দুপাশে পাক ধরেছে। মুখচোখে নরম ভাব বিন্দুমাত্র নেই, বরং কড়া ধাঁচের পুরুষের চেয়ে কঠোর ওনার চাউনি। আমি তখন সিগারেট খাই, কিন্তু জাস্ট ভয়ে হাত বাড়ালাম না আমার প্রিয় ব্র্যান্ডের দিকে। 

পেছনের সারিতে বসে থাকা দুই যমজের দিকে হাফ ঘুরে বললেন,

- এঁরা আমার দুই যমজ ভাই, পান্না সিং আউর চুনি সিং। 

দুই যমজ ভাইয়ের মুখের রেখা একটুও কাঁপল না। বিশাল গোঁফের ওপরে খাড়া নাকের দুপাশে এবং ঝাঁকড়া মোটা ভুরুর নিচে অবস্থিত ভাবলেশহীন দুই চোখ আমাকে একটু এক্সরে করে নিল কেবল। 

লাজবন্তি আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নোটিশের কপিটা টেবিলের ওপর বিছালেন। বললেন,

- ত্যাত্তেড়ু কি কোনও পিটিশন দিয়েছে সাহেব? 

প্রেমা ধুরন্ধর কম নয়। বলল,

- আপনার কী মনে হয়? 

- দিয়েছে নিশ্চয়ই। নইলে আপনি তো নিজে থেকে খোঁচাখুঁচি করবার মতো অফসার নন। এসব ব্যাপারে আপনি ভীষণ সাচ্চা আদমি। আজ অবধি এক কাপ চা কোনদিন আপনাকে খাওয়াতে পারলাম না আমার বাড়ি নিয়ে গিয়ে। যাই হোক, কেউ ত্যাত্তেড়ুকে নাচিয়েছে আর ও ব্যাটাও নেচেছে। 

বলেই সুর পাল্টে বলে উঠলেন, 

- আচ্ছা স্যার, বর্গা হতে গেলে তো ফসলের ভাগ দিতে হয়? হামি যে টুকু জানি…

- ঠিকই জানেন।  

- সেটা আপনি বুঝবেন কী করে যে ও ভাগ দেয় কি না দেয়? আসলে আমার এতখানি জমিনে আজতক বর্গা পিটিশন দেওয়ার হিম্মত তো কেউ দেখায়নি। তাই জানতে চাইছি। 

- দেখুন লাজোজি, আপনি আমার কাছে এসে আমার আইন জানতে চাইছেন। কিন্তু মানুষকে আইন জানানো আমার কাজ নয়। তার জন্য উকিলবাবুরা বসে আছেন। আপনার তো মাথাভাঙা কোর্টে বাঁধা উকিল আছে। তারা কী বললেন এই বিষয়ে? 

দম নিয়ে লাজোজি বললেন,

- বললেন, এত হারামি আইন আর কোথাও নেই। বর্গা কেসের শুনানির সময় এই আইনে নাকি আপনার অফিসে উকিলবাবুদের ঢুকতেই বারণ করে রেখেছে। নইলে আমি তো এক ডজন উকিল ওইদিন নিয়ে আসতাম। 

- ঠিকই বলেছেন উনি। এনকোয়ারির সময় আমার এই নয়া অফিসার আর আমিনবাবু ফিল্ডে গিয়ে যেমন দেখবে তেমন রিপোর্ট দেবে আর সেইমতো ডিসিশন হবে। 

আমার তলপেট ভারি হয়ে গেল শুনেই। প্রেমা আমাকে পাঠাবে এইসব দুপেয়ে সিংহের গুহায়? 

ওঁরা চলে যাওয়ার পর প্রেমা আমার দিকে ফিরে বলল,

- জলে না নামলে সাঁতার কোনদিনই শিখতে পারবে না বস্‌। চিরকাল তো কেউ পাশে থাকবে না। একদিন তো ইন্ডিভিজুয়াল চার্জ নিতেই হবে। যাও যাও। আমি সজাগ থাকব ওইদিন। 

- এঁরা আসলে কারা? 

জলে নামার আগে আমি জল মাপতে চাইলাম। প্রেমা যে টুকু বলল, 

- এঁরা কোচবিহারের রাজার সেনাপতির বংশধর। ভারতভুক্তির সময় রাজত্ব চলে যায় রাজার। তখন রাজা এবং কর্মচারিদের নামে এস্টেট খুলে প্রচুর জমি রাখতে দেয় সরকার। লাজো সিং -এর বাবা, ঘোড়া একদমে যতদূর যায় ততদূর ছুটিয়ে নিজের এসটেটের সীমানা নির্ধারণ করে নেন। কিন্তু প্রফেসর জামাই এইসব গুলি বন্দুক কাঁধে স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করতে রাজি না হওয়ায় পালিয়ে যান। সেই থেকে লাজো সিং এইখানে রাজ করছে। 

সে রাতে ঘুম হয়নি। পরদিন আমিনবাবুকে নিয়ে দুখানা সাইকেল ম্যানেজ করে চললাম মাঠে। গিয়ে দেখি ভোঁ ভা। ত্যাত্তেড়ুর চিহ্ন কোথাও নেই। বাকি চাষিরা জানাল, 

- হয় হয়, দু বিগে ত্যাত্তেড়ু চাষ করে মোরা দেখচং, কিন্তু ভাগ ঠিকঠাক দেয় কি না, কতটা দেয়, না দেয় এইসব কবার না পারিম।

আমিনবাবু একটা কাগজে ওদের বয়ান লিখে ওঁদের দিয়ে টিপছাপ দিয়ে নিলেন এবং সাইকেলের মুখ ঘোরাতেই দেখা গেল চুনি আর পান্না সিং, দুই যমজ, মাঠের আল বেয়ে দৌড়ে আসছে। তাঁদের বিনীত অনুরোধ আমরা যেন লাজোজির বাড়ি গিয়ে একটু চা পান-গুয়া [সুপারি] খাই। উনি কাল রাতের ট্রেনে আর্জেন্ট কাজে হাইকোর্ট চলে গেছেন। বলে গেছেন যেন আপনাদের দেখভাল ঠিকভাবে করা হয়। এনকোয়ারি শেষ শুনে যমজদ্বয় খুবই হতাশ হলেন এবং কোথাও সই বা ছাপ দিতে রাজি হলেন না।

আমিনবাবু সবিনয়ে বললেন, 

- পরে আরেকদিন আসা যাবে। ডিউটিতে থাকাকালীন আমরা যেতে পারি না।

শুনানির দিন আরও ২৪ ঘণ্টা পরে নির্ধারিত। প্রেমা রিপোর্টটা ভাল করে দেখে বলল,

- কালও ওঁরা কেউ আসবে না। তুমি এক্সপার্টি [এক তরফা] রেকর্ড করে দেবে।

আমি রোজ কাক ভোরে উঠে বাঁধের ওপর যেমন মর্নিং ওয়াক করতে যাই তেমনই বার হলাম। তখনও অন্ধকার পুরো কাটেনি। মনটা অস্থির। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই, জীবনে প্রথম বর্গাদারের নাম রেকর্ড করতে হবে। বাঁধের পাড় থেকে বোল্ডার জড়ানো বড় বড় তারের জালের খাঁচা নদীর ওপর লম্বা ভাবে ফেলা। তাদের নাম স্পার। এরা বর্ষার ঢেউয়ের ধাক্কা থেকে বাঁধকে সামাল দেয়।

স্পারের একদম ডগায়, মাথার দিকে এগিয়ে গেলে দেখা যায়, নদীর ঢেউ এসে পায়ের নিচে বোল্ডারের গায়ে সাদা ফেনা তুলে আছড়ে ভাঙছে। সে দৃশ্য বড় চমৎকার। আমি বেশ খানিকক্ষণ বসে বসে দেখি। কিন্তু আজ স্পারের ডগায় গিয়ে নিচে উঁকি মেরেই চমকে উঠলাম। স্পারের বাঁ দিকে উজানের স্রোতে আটকে আছে উপুড় হওয়া একটা ডেডবডি। সম্পূর্ণ নগ্ন। তাঁর কালো বলিষ্ঠ উদোম পিঠের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে আর নামছে সাদা সফেন ঢেউগুলো। তালে তালে দোল খাচ্ছে আর পাক মারছে বডিটা।

 

পর্ব ৮

বর্গা-দরখাস্তকারী কোথায় গেল!

 

লাশ দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল প্রথমেই। চকিতে মনে হল, এইটা ত্যাত্তেড়ু নয়তো? মুশকিল হল, আমি ত্যাত্তেড়ুকে জীবনে কোনদিন দেখিনি। প্রেমা হয়তো দেখেছে পিটিশন জমা নেওয়ার সময়। আবার হয়তো সবটাই আমার মনের ভুল। সদ্য ঘটে যাওয়া বর্গা তদন্তের পর টেনশন থেকে  আমার মনে হয়তো এইসব ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি একটা বড় বোল্ডারের উপর বসে খানিক ধাতস্থ হয়ে নিলাম। তারপর ভাবলাম চুপচাপ ঘরে ফিরে যাই। কাউকে এই নিয়ে কিছু বলার দরকার নেই। প্রেমা এলে নিরিবিলিতে ওকে একবার বলব কেবল। 

যে স্পারের নিচে বডিটা আটকে ছিল সেটা মূল শিলডাঙা গ্রাম থেকে অন্তত এক কিলোমিটার উজানে। এমনিতে গ্রামটা ফাঁকা ফাঁকা। খুব বড় জোর খান পঞ্চাশ বাড়ি। এখানকার বাড়িগুলো দক্ষিণবাঙলার মতো ঘনবসতির নয়। একটা একটা পাড়া ক্লাস্টার করে খান দুতিন বাড়ি নিয়ে। সে ক্লাস্টার মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে, সুপুরি বাগান দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যেই সব। তারপর আবার হাফ কিলোমিটার দূরে পরের ক্লাস্টার। মাঝখানে চাষের ক্ষেত। পাট তামাক আর ধান লাগানো। পাট বড় হয়ে গেলে একবাড়ি থেকে আরেক বাড়ি দেখাই যায় না প্রায়। লোকসংখ্যা খুবই কম। কেবল গোষ্ঠ দেওয়ানি আর লাজো সিং-এর বাড়িতে ঘরের সংখ্যা বেশ বেশি। মিনিমাম খান দশেক করে টিনের চালা। ওঁদের বাড়িতে পরিবারের মেম্বাররা ছাড়াও প্রচুর কাজের লোক বাস করে। তাঁদের স্থানীয় নাম ‘কামলা’। এই কামলারা থাকে সপরিবারে। এদের খাওয়ার, শোওয়ার, পোশাক-আসাক, পান-গুয়া, ডাক্তার বদ্যি, বিয়ে শাদি সব দায়িত্ব দেউনিয়ার। বাচ্চাদের কেউ কেউ ইস্কুলে যেতে চাইলে দেউনিয়াই ব্যবস্থা করে দেবে। এখান থেকে নিকটতম প্রাইমারি ইস্কুল চার কিলোমিটার দূরে। পড়ুয়ারা সকালে উঠে খেয়েদেয়ে ঘণ্টাখানেক হেঁটে ইস্কুলে যায়। বিকেলে একই ভাবে ফিরে এসেই বাড়ির কোনো না কোনো কাজে লেগে পড়ে। এদের ঘরে কোন আলো জ্বলে না। কারণ, কেরোসিন লাগে আলো জ্বালাতে। অন্ধকার হয়ে গেলেও হ্যারিকেন জ্বলত কেবল দেউনিয়ার নিজের আর আমার ঘরে। সন্ধ্যে হয়ে গেলে এঁরা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিক ভাবে রাত তিনটে নাগাদ উঠে পড়ে আবার যার যার কাজে লেগে যায়। মেয়েরা রান্নাবান্না, জামাকাপড় কাচা, জল তোলা এবং ভোরের আলো ফুটলেই গোয়াল পরিষ্কার, বাসন মাজা, ঝাঁটপাট দেওয়া এইসব কাজে নেমে যায়। পুরুষরা গরুর জাবনা দেওয়া, বিচুলি কাটা, দুধ দোয়ানো, মাঠে চাষের কাজে নেমে পড়া, কাঠ চেরাই করা ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এদের কথাবার্তার আওয়াজে আমার ভোর রাতে ঘুম আপনিই ভেঙে যেত এবং আমি এদের ব্যবহার্য  হাঁড়ি বালতির শব্দ শুনে শুনে বুঝে নিতাম কে কী করছে। একটু বড় হলে মেয়েদের বিয়ে এমন ভাবে দেওয়া হত যাতে তারা দেউনিয়ার বাড়িতেই থেকে যায়। মানে, ছেলেটি হত দেউনিয়ার কোনও এক কামলা। ফলে মানব সম্পদ ঘরেই থেকে যায়। সে একটু বড় হলেই আবার বয়স উপযোগী কোন না কোন কাজে লেগে পড়ে। 

হিসেব করলে দেখা যাবে, জনা পঞ্চাশ মানুষ ঘুমের সময় বাদ দিয়ে সারাক্ষণ দেউনিয়ার কাজ করে চলেছে। এদের হাতে কোন মজুরি বা কিছু কেনার পয়সা দেওয়া হয় না। যার যা লাগবে দেউনিয়াকে বলতে হবে এবং দেউনিয়া সেটা বিবেচনা করে নিজে কিনে নিয়ে আসবেন। সারাদিন এবং মধ্যরাত অবধি এদের প্রতি নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে আমার এই অভিজ্ঞতা হচ্ছিল। আরও জানতে পারলাম ক্রমশ, যে এঁরা সবাই কোন না কোন ভাবে দেউনিয়ার আত্মীয়। সে গ্রাম-সম্পর্কে হোক বা রক্তের সম্পর্কে বা লতায়-পাতায়।

কিন্তু ত্যাত্তেড়ু কোনভাবেই লাজো সিং-এর সঙ্গে আত্মীয়তায় জড়িত থাকতে পারে না। লাজো কি তাই এইভাবে ত্যাত্তেড়ুকে চরম শিক্ষা দিল ?  তার সঙ্গে বাকি বর্গাদারদের কাছেও কি সেই ভয়ানক বার্তা পৌঁছে গেল? 

সামান্য কজন গ্রামবাসসী হলেও দেখলাম বেলা নটা নাগাদ সারি বেঁধে বাঁধের ওপর দিয়ে তারা অকুস্থলের দিকে হেঁটে চলেছে। নাইট গার্ড বদন মণ্ডল এসে ফিসফিস করে বলে গেল,

- স্যার, স্পারের গায়ে লাশ। আপনি তো ভোরবেলা ওইদিকে হাঁটেন রোজ। দ্যাখছেন নাকি?

আমি নিপুণ অভিনয় করে অজ্ঞতার ভান করি। প্রেমার বাস মাথাভাঙা থেকে সাড়ে নটায় এসে ঢুকতেই আমি বাসস্ট্যান্ডের এক কোণে ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে সব খুলে বলি। প্রেমা আমাকে মুখে তালা দিয়ে চাবিটা মানসাইয়ের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বলে।

অফিসে এসে ঠিক বেলা বারোটায় শুনানি শুরু করে। দু পক্ষের কেউ নেই। আমাকে বলে দেয় কী ভাবে অর্ডারটা লিখতে হবে। আমি যন্ত্রের মতো লিখে ফেলি,

- বেলা বারোটা অবধি অপেক্ষা করলাম। কোনো পক্ষই এলো না। আমিনের রিপোর্ট দেখলাম। স্থানীয় চাষিরা লিখিত ভাবে বলেছে ত্যাত্তেড়ু বর্মণ লাজবন্তী সিং-এর এই এই দাগ পাঁচ বছর ধরে ভাগে চাষ করে। অতএব, এক্সপার্টি আদেশ দেওয়া হল যে, এই দাগগুলোতে পিটিশনারের নাম বর্গাদার হিসাবে এত সাল থেকে চাষ করে বলে রেকর্ড করা হল।

প্রেমা সব কাগজের দু কপি করে তৈরি করে একটা কনফিডেন্সিয়াল লেখা খামের মধ্যে সিল ছাপ মেরে ঢুকিয়ে নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। আমাকে বলে, 

- কেসটা নিয়ে ঝামেলা হলে আমাদের অনেক দূর যেতে হতে পারে, তাই এক কপি আমার কাছে থাকবে। আরেক কপি, সবকিছু লিখিতভাবে জানিয়ে চার্জ অফিসার রায় সাহেবকে হাতে হাতে দিয়ে আসব। কে জানে, লাজো সিং প্রমাণ লোপাট করবার জন্য এই অফিস যদি জ্বালিয়ে দেয়। ও মহিলা সব পারে।  

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিলপিল করে গাঁয়ের মানুষ বাঁধের পাড় বেয়ে ডেডবডি দেখতে চলল। বদন ঘুরে এসে খবর দিল,

- কেউ চিনতে পারছে না স্যার। ওদিকে ত্যাত্তেড়ুর কোনও খবর নেই। ওর বাড়ির লোক খুবই টেনশনে আছে। মাথাভাঙা থানায় খবর দিয়েছে গোষ্ঠবাবু। পুলিশ আসছে বডি নিতে। 

প্রেমা মাথাভাঙা চলে গেল পাঁচটার বাসে আর পুলিশ ঢুকল সাড়ে পাঁচটায়। ভ্যানে চেপে একজন এস আই, একজন কনস্টেবল প্রথমেই গোষ্ঠবাবুর বাড়ির ভেতর মহলে ঢুকে গেল। দ্বিতীয় ভ্যানে ছিল দুজন ডোম। তারা ঢুকে গেল গোয়ালের পাশে পাটের গোডাউনে।  রাত বাড়লে আমি আওয়াজ শুনতে এবং গুণতে লাগলাম। 

ঝাঁঝালো মশলা দেওয়া রান্নাবান্না চাপল। ক্কঁক ক্কঁক শব্দ তুলে বেশ কটি দিশি মুরগি জবাই হল। টুং টাং আওয়াজ তুলে তরল ঢালাঢালি  হল। সেই রাতে আমাদের মেসের মেনুতেও চিকেন এল। দারোগা আর গোষ্ঠবাবু,  দুজন মিলে বার বার অজস্র ধরণের রসিকতায় ভেসে গেলেন। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। যেন কিছুই হয়নি কোথাও।   

পরদিন সকালে ভিড়ভাট্টা পুলিশি ধমক মেরে দূরে হটিয়ে দিয়ে লাশ তোলা হল। আমি যাইনি। বদনের কাছে ধারাবিবরণী শুনলাম আমি আর প্রেমা। বদন সরকারি লোক বলে একটু নিকটে যেতে অনুমতি পেয়েছিল। ফিরে এসে জানাল, সামনের দিকটা সারারাত ধরে মাছের ঝাঁক এসে এমনভাবে খেয়ে ফেলেছে যে লাশটাকে চেনাই যাচ্ছে না। কলাপাতা মুড়ে কালো পলিথিন জড়িয়ে সেই বডি নিয়ে ডোম দুজন আর কনস্টেবল সকালেই রওনা দিয়েছে মাথাভাঙা। দারোগাবাবু দুপুরের খাবার খেয়ে তবে যাবে। 

পাঁচটা নাগাদ প্রেমাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে ফিরছি, দেখলাম, বিচুলি বসিয়ে তার ওপর চট পেতে একটা ভ্যান রিকশা অপেক্ষমান। ভাবলাম কেউ টাউনে ফিরবে বোধয়। 

ঘরে ফেরার পথে দু’শ মিটার মতো কাঁচা রাস্তা। ঝোপঝাড়ে ঢাকা। সমান্তরাল ভাবে মানসাই সঙ্গ দিচ্ছে তার অপরূপ রূপসী শরীরটি মেলে। সহসা জল বিয়োগের তাগিদ অনুভব করলাম।  ঢাল বেয়ে মানসাই নদীর দিকে নেমে গেলাম বেশ খানিকটা। পেছনে মানুষ সমান খাড়াই আর সামনে নদীর কিনার। একটা ঝোপের ওপর বিয়োগ সেরে, ঘুরে, উঠতে যাব, কলকল শব্দের গলার আওয়াজ পেয়ে দেখতে পেলাম গোষ্ঠবাবু আর দারোগা রাস্তার পাশে, নদীর দিকে পেছন ফিরে একটা খেজুর গাছের নিচে পাশাপাশি বসে।  দুজনার মাথার পেছন থেকে পিঠ অবধি দেখা যাচ্ছে নিচের ঢাল থেকে। একটি মাথা কেশবিরল, চকচকে, দুচার গাছি সাদা চুল দিয়ে ঘেরা। আরেকটি পুলিশি টুপি দিয়ে ঢাকা। 

নির্জন এই স্তব্ধ বিকেলে ওঁদের সব কথা আমি নিচে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। রাস্তায় উঠলাম না। বরং একটা চওড়া গুঁড়ির  বাবলা গাছের পেছনে নিথর হয়ে আড়াল নিলাম। গোষ্ঠবাবুর গলায় হাসির সুর, 

- শেষমেস তুই মোক দিয়া ডোমের টিপছাপ দেওয়া করাবি? 

- করো করো, জীবনে একবার না হয় ডোম সাজলেই। সব সময় তো জোতদারি করছ। 

- কিন্তু মুই বাঁ হাতের আঙুল দিয়া আসল টিপছাপ না দিম্‌। 

- বেশ, তবে ডান হাতের আঙুল দিয়েই দাও। 

ঈষৎ নড়াচড়ার সঙ্গে গোষ্ঠবাবুর সকৌতুক গলা ভেসে এল,

- এই সাজিলাম পেল্লাদ ডোম, আর এই দিলাম নিতাই ডোমের ছাপ। না না। ডোমের টাকার ভাগ মুই না নিম্‌। ওটা তুইই রাখি দেও। 

ইন্সপেক্টারের গুলগুলে হাসি শোনা গেল। গোষ্ঠবাবু ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা উঁচু করে তুলে কালিটা দেখলেন খানিক। তারপর বললেন,

- মোর মাথাত্‌ তো কেশ বলতে সবই গায়েব। মুই এলায় হাতের কালি মুছুং কোটে? 

বলেই খপ করে বাঁ হাতে এস আইয়ের মাথা থেকে টুপিটা তুলে নিলেন। কলপ করা কালো মিশমিশে চুল সেখানে। সেই মাথা জুড়ে সযত্নে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মুছে নিলেন ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা। তারপর কাগজপত্র গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালেন দুজনাই। এগোলেন হাট খোলার দিকে। যে ভ্যান রিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এলাম ওখানে, মনে হল, এস আই ওটা চেপেই মাথাভাঙা ফিরবেন।  

ত্যাত্তেড়ুর কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।  প্রেমাকে টিপসই কাণ্ড জানাতেই ও বলল, 

- তার মানে ফাইল ক্লোজড। ত্যাত্তেড়ুকে আর কেউ কোনদিন খুঁজে পাবে না। কেবল সেটেলমেন্টের পাতায় ওর নাম বর্গাদার হিসেবে ফর এভার রয়ে যাবে। বর্গাদারের নাম কাটা, তুমি তো জান, দুনিয়ার প্রায় অসম্ভব কাজগুলোর মধ্যে একটা। 

বদন মাঝে মাঝে এসে জানাত, ত্যাত্তেড়ু যেন শূন্যে মিলিয়ে গেছে। ওর বউ বাচ্চা কেবল কাঁদে। আর কিছুই বলতে পারে না। বাকিরা কেউ মুখই খোলে না। সরে যায়। 

ঐ মৃতদেহ কি সত্যিই ত্যাত্তেড়ুর ছিল? আমি জানতে পারিনি আজও। কেউ পারবেও না আর। অপারেশন বর্গা বেআইনি ঘোষণার পর থেকে এইভাবে কত ত্যাত্তেড়ু যে কোথায় কীভাবে হারিয়ে গেছে কেউ জানেও না। 

 

চলবে-

 

1 Comments
  • avatar
    Debasis Sarkar

    22 April, 2024

    পড়ে বেশ অবাক হলাম । এইসব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জারিত লেখা আরও পড়বার জন্যে মুখিয়ে রইলাম ।

Leave a reply