পর্ব ১
কানুনগো কারে কয়
ভূমি সংস্কার শব্দটা শুনলেই বেশির ভাগ মানুষকে আজও আঁতকে উঠতে দেখি। বলতে শুনি, ওরে ব্বাপ রে, সেতো এক ভয়ংকর দপ্তর। চাকরি খোঁজার শুরুতে প্রথম দিন আমিও এই পদের নামটা শুনে আঁতকে উঠেছিলাম। ভূমি সংস্কার বিভাগের কানুনগো পদে স্নাতক নিয়োগ? সেটা আবার কী! খায় না মাথায় দেয়?
সায়েন্স নিয়ে বিটি কমপ্লিট করে ভেবেছিলাম মাস্টারি করব। কিন্তু 'বিধি', মানে 'সরকার' বাম; মানে তখন বাম আমল সদ্য শুরু হয়েছে এবং স্কুল সার্ভিস চালু হয়নি। মাস্টারি পেতে হলে হয় স্কুল-কমিটির হোমরাদের হাত করতে হয়, নয় দিতে হয় মোটা ডোনেশন। কোনটিই আমাদের পরিবারের সাধ্যের মধ্যে ছিল না।
সাতাত্তর সালে যখন এই চাকরির বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে বার হল, আমি জানতাম না, 'কানুনগো' জিনিসটা কী, খায় না মাথায় দেয়, কিন্তু বাবা জানতেন। কারণ বাবার কিছু পৈতৃক এবং তস্য পৈতৃকস্য-পৈতৃক সূত্রে পাওয়া, প্রায় চার পুরুষের প্রাচীন কিছু ভূসম্পত্তি, নদীয়ার উলা গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার পুবে, চুর্ণী নদীর তীরে পাহাড়পুর নামে আরেক গণ্ডগ্রামের ভেতরে ছিল। সেই গ্রামে আমি প্রথম জীবনে বাবার হাত ধরে, পরবর্তী কালে পাঁচ কিমি দূরের আমাদের শহর থেকে সাইকেল চালিয়ে বহুবার গেছি। গিয়ে দেখেছি, নদীর ধারে এক ভগ্ন প্রাসাদ। বাবার হিসেবে সেই প্রাসাদের ঘরের সংখ্যা, আস্ত অবস্থায় ছিল ৬৫। আমি কোনদিনই খান কুড়ির বেশি দেখিনি। কুড়ির মধ্যে তখনই দেখছি খান সাতেক বে-দখল। সেখানে একাত্তরের যুদ্ধের শরণার্থীরা এসে আশ্রয় নিয়েছিল, আর ফিরে যায়নি। পরে, যত বার গেছি, দেখেছি ঘর এক একটা করে ভেঙে পড়ছে কেবল ওই সাতখানা আস্ত আছে। একটু আধটু সারাই করে সেই শরণার্থীরা সেগুলো খুঁটিমুটি গেঁড়ে খাড়া রেখেছে।
বাবা, 'দেশের বাড়ি'-র সামনে, প্রায় ভাঙা এক শিবমন্দিরের চাতালে আমাকে নিয়ে জিরোতে জিরোতে মুখুজ্যে পরিবারের স্বর্ণযুগের কাহিনী শোনাত। চারিদিকে হাত ঘুরিয়ে বলত,
- মাঝখানে ভিটি বাড়িটাকে রেখে তোর নজর যতদূর যায়, ততদূর ছিল আমাদের সম্পত্তির চৌহদ্দি। বুঝলি? এই কম্যুনিস্টরা এসে সব্বনাশ হয়ে গেল। জমিদারি কেড়ে নিল। আমাদের এখন পয়সা দিয়ে জিনিস কিনে খেতে হচ্ছে।
অনেক পরে, প্রায় পাঁচ বছর চাকরি করবার পর আমি জানতে পারলাম যে জমিদারি কম্যুনিস্টরা নয়, কেড়ে নিয়েছিল কংগ্রেস এবং সেটা ১৯৫৩ সালেই। বাবাকে রোজ কম্যুনিস্টদের নামে গালিগালাজ করতে শুনতে শুনতে একদিন অধৈর্য্য হয়ে বলেই দিলাম সেই সত্য। বাবা কেমন নির্বাক হয়ে গেল। বলল,
- দেখা।
আমি তখন ১৯৫৩ সালের এস্টেট একুইজিশন আইনের সেই সব ধারাগুলো বিভাগ থেকে পাওয়া আইনের বই খুলে খুলে পড়ে পড়ে শোনাতে লাগলাম আর বাবা দু আঙুল দিয়ে কপালের মাঝখানটা টিপে করে বসে শুনল।
তারপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
- জহরলাল জমিদারদের সঙ্গে এত বড় বেইমানিটা করল কেমন করে ?
আমার স্কুল কলেজ জীবন যখন চলছে, পাহাড়পুরের দিগন্ত বিস্তৃত চৌহদ্দি ততদিনে অনেকটাই সংকুচিত। বাবারা পাঁচ ভাই ভাগ বাঁটোয়ারা এবং বিক্রি বাটা করে আরও সংকুচিত করে ফেলেছে। তখন সাকুল্যে আমার বাবার হাতে বিঘা পঞ্চাশ। ঘরে ধান চাল তেল ডাল সবই আছে। নেই কেবল কাঁচা টাকা। আমি বাবাকে চাল দিয়ে বদলে চা চিনি দুধ কিনে আনতে দেখেছি। চাঁদের কলার মতো সেই পঞ্চাশ বিঘা প্রতি বছর কমছে। মানে বিক্রি হচ্ছে আর আমাদের শহরের লেখাপড়ার, বাড়ি তৈরির যাবতীয় খরচা চলছে। বাবা তৎকালীন ম্যাট্রিক পাস, মুক্তোর মতো ইংরাজি বাংলা হাতের লেখার অধিকারি এবং ক্লাস টেন অবধি অঙ্ক শেখাতে পারবার যোগ্যতা নিয়েও তিন তিনটে সরকারি চাকরি পেয়ে করতে পারেননি। কারণ একটাই, সাহেব চাওয়ামাত্র ছুটি দেয় না।
তিনি, আমার মতো, একমাত্র পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন, কবে আমি পাস করে স্বাধীন দেশের সাহেবদের আন্ডারে একটা সরকারি চাকরি পাব এবং ইচ্ছা মতো বাড়ি আসতে পারব। বার বার বলছেন,
- তোর একটা চাকরি হলেই এই সব জমি আমি বেচে দেব। ভাগিদার নিয়ে এই অশান্তি আর সহ্য হয় না রে।
নকশাল আন্দোলনের সময় থেকেই ভাগিদারদের সঙ্গে গ্রামের ছোট বড় মাঝারি জোতদারদের অশান্তি শুরু। বাবারা জোতদার নয়, মধ্যস্বত্ত্ব ভোগী চিরস্থায়ী মোকরারি। এইসব শব্দের মানে আমি জেনেছি চাকরি করতে করতে, অনেক পরে। আপনাদেরও বলব।
আমাদের ভাগিদার দুজন। একজন হিন্দু আরেকজন মুসলমান। হিন্দু বর্গাদার জাতে নমশূদ্র এবং রিফিউজি বাঙাল। মুসলমান বর্গাদার জাতে ঘরামী কিন্তু আমদের বসতবাড়ির সংলগ্ন মুসলমান পাড়ার বাসিন্দা এবং ঘটি। দুই বর্গাদারদের ভেতর মারাত্বক রেষারেষি। উভয়েরই দাবি বাবুর সমস্ত জমি আমিই করব। ও আপনাকে কম ভাগ দেচ্ছে, আমি বেশি দেব। বাবা কিন্তু সেয়ানা, এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখবে না।
বাবা শীতের রোদে বারান্দায় বসে বসে পা দোলাতে দোলাতে এঁদের দ্বন্দ্ব ভীষণ এনজয় করত আর একজনকে লোভ দেখিয়ে আরেকজনকে টাইট দিত। হিন্দুকে বলত,
- ভাগ একটু বাড়া, তাহলে আলাহিমের থেকে নিয়ে সন্যাসির ভিটের আরও পাঁচ কাঠা তোকে দেব।
আবার মুসলমান ভাগিদারকে বলত,
- মহিম তোর থেকে বেশি দিচ্ছে পাট করে। তুইও পাট লাগা। একটু বাড়া। নইলে মহিমকে আরও দশ কাঠা দিতে হবে আমাকে।
আমি ছুটিতে বাড়ি এসে অন্যমনস্কতার ভান করে ঘরের ভেতর বসে বসে বাবার সঙ্গে দুই বর্গাদারের সংলাপ শুনতাম। আমার দপ্তর ততদিনে অপারেশন বর্গার পিণ্ডি চটকে, ঘাড় মটকে, গলায় পা দিয়ে আইনকানুন এবং যাবতীয় বেআইনি পদ্ধতির আদ্যশ্রাদ্ধ কীভাবে করতে হয়, সব গিলিয়ে দিয়েছে। আমি বাবার এবং দুই বর্গাদারের কথা শুনে হাসতাম। কিছু বলতাম না, কারণ দেখতাম, মালিক এবং বর্গাদারদ্বয়, কেউই আইনের প্যাঁচঘোঁচ কিছুমাত্র না জেনে কেমন তর্কে মেতেছে।
আমি এইসব আইন কোনদিন বাবাকে বা বর্গাদারদের জানাতাম না। কারণ, আইনগুলো এতোই মালিকের বিপক্ষে এবং কখনো কখনো বর্গাদারেরও বিরুদ্ধে, যে জানাজানি হলে হয় বাবা এঁদের গুলি করে মারবে, নয় এঁরা বাবাকে মাঠের ভেতরে ফেলে কুপোবে। জমিদারি চলে গেলেও বাবার সিন্দুকে তখনও একটা দোনলা টোটা ভরা বন্দুক ছিল। বার হতো কেবল লাইলেন্স রিনিউয়ালের দিন। আর হিন্দু বর্গাদার ছিল সড়কি কোঁচ বল্লম চালানো মালো। মুসলমান বর্গাদার ছিল গ্রামের মধ্যে চকচকে আধহাতি দা হাতে করে ঘুরে বেড়ান নাম করা ঘরামী।
পর্ব ২
চক্রব্যুহে ঢোকার রাস্তা
আনন্দবাজার পত্রিকার একটা কাটিং খুলে বাবা আমাকে বিজ্ঞাপনটা দেখাল। বলল,
- কেষ্টর দোকানে এটা চোখে পড়ল। কেটে নিয়ে এলাম।
কেষ্টদা আমাদের বাড়ির নিকটবর্তী আটাকল মালিক। তার দোকানে খবরের কাগজ রাখা হয়। বাবা, কিছু সমমনস্কদের সঙ্গে সেখানে বসে রাজা-উজির, থুড়ি, সিপিএম-নকশাল মারে আর কংগ্রেসকে বাঁচানোর চেষ্টা করে নিয়মিত। আমাদের বাড়িতে আনন্দবাজার কেন, কোন পেপারই আসত না। কেনার পয়সা ছিল না। অথচ, চাকরির পরীক্ষা দিতে হলে রোজ একটা করে বাংলা আর একটা করে ইংরাজি কাগজ দেখলে ভাল হয়। সেইজন্য যেতে হত পাবলিক লাইব্রেরীতে। সন্ধ্যেবেলা সেখানে গিয়ে আবার কোন খবরের কাগজের সম্পূর্ণ বডিটা পাওয়া যেত না।
বাবার হাত থেকে কাটিংটা নিয়ে দেখলাম। মিনিমাম গ্র্যাজুয়েট, যে-কোন শাখার হলেই চলবে, বয়স তিরিশের নিচে থাকলেই হবে, পাসপোর্ট সাইজ ফটোমটো, এডমিট মার্কশিটের জেরক্স সমেত এটেস্টেড করে জমা দিলে প্রথমে একটা লিখিত পরীক্ষা হবে। তারপর একটা ভাইবা। তারপর ট্রেনিং।
এই গোটা পদ্ধতিটি যথাযথভাবে উত্তীর্ণ হতে পারলে তবেই মিলবে - সাত রাজার ধন এক মাণিক, এই কানুনগো পদের গেজেটেড অফিসারের চাকরিটি।
পরীক্ষা হবে ইংরাজি, বাংলা, অঙ্ক এবং জিকে- মানে, জেনারেল নলেজের। ফুল মার্কস একশ করে চারশ। সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে ভাইবায় ডাকা হবে।
মুশকিল হল, বাজারে তখন হাজারো সাজেশন বই দেদার বিকোচ্ছে। পি এস সি ক্লার্কশিপ, এস এস সি ক্লার্কশিপ, রেলের ক্লার্ক, ব্যাঙ্কের ক্লার্ক এইসব বইয়ের ছড়াছড়ি। কলকাতা থেকে একশ কিলোমিটার দূরের আমাদের এই মফস্বল শহরে এবং স্টেশন চত্বরে যত বুকস্টল আছে সেসব উপছে পড়ছে এইসব সাজেশন বইতে। কিন্তু তার মধ্যে ‘কানুনগো কেমন করে হবেন’, সেই বই নেই। আমি বাবাকে বললাম,
- আমি তো কেবল ক্লার্ক হওয়ার জন্য পড়ছি। অফিসার হব, ভাবিনি তো কোনদিন। তাই তেমন বই-পত্তর তো নেই।
বাবা বলল,
- তুই এক কাজ কর। তোর প্রাইভেট টিচার পিনাকি আছে না? এখন রাইটার্সে চাকরি করে। ওঁকে একবার জিগ্যেস করে আয় তো।
পিনাকি স্যারের কাছে আমি হায়ার সেকেন্ডারি অবধি পড়েছি। তারপর বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর সাল অবধি কলেজে। সেখানে কোনও প্রাইভেট প্রফেসর ছিল না, মানে, রাখার ক্ষমতা ছিল না আর কি। পিনাকি স্যারের বাড়িতে আমরা ব্যাচ ধরে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি আর ম্যাথ পড়তে যেতাম। পড়াতে পড়াতে নিজেও রোজ গুলে খেতেন ‘কম্পিটিশন মাস্টার’ নামে একটা বেশ দুরূহ চাকরি পাওয়ার সাজেশন বই। পি এস সি দিতে দিতে একদিন তিনি রাইটার্সে ক্লার্ক হয়ে গেলেন। ততদিনে আমরা কলেজে। বাবার কথা শুনে গুটিগুটি রোববার তার বাড়িতে গেলাম।
তিনি ধ্যানস্থভাবে বললেন,
- এই ধরণের পরীক্ষা তো আমি আমার চাকরি জীবনে কোনদিন শুনিনি। মনে হয় বাহাত্তর তিয়াত্তর সালে একবার হয়েছিল। তখন তো আমি চাকরিতে আসিনি। তখন বেশ ভাল সংখ্যায় কানুনগো নিয়েছিল ভূমি দপ্তর। তাই ওইসব বইটই তুই কোথাও পাবিনে। রেগুলার নিয়োগ না হলে কি আর বই ছাপে কেউ? তুই এক কাজ কর। কম্পিটিশন মাস্টারটা নিয়মিত পড়তে শুরু করে দে। দরখাস্ত দিয়েই কিনে ফেল পুরনো ইস্যু যা যেখানে পাবি। আর নতুনগুলোর গ্রাহক হয়ে যা। এডভারটাইজের পর পরীক্ষা হতে হতে মাস ছয়েক টাইম থাকে সাধারণত। তোর যা মাথা, ঘষে মেজে নে। হয়ে যাবে।
শুরু করে দিলাম কম্পিটিশন মাস্টারের সঙ্গে মাথা ঘষাঘষি।
দরখাস্ত পাঠাতে বেশ বেগ পেলাম। দশ টাকা পোস্টাল অর্ডার। সঙ্গে ডাক মাশুল। এর আগে কয়েকজায়গায় পোস্টাল অর্ডার কিনে দরখাস্ত করেছি। হা হতোস্মি। ওদিকে কাঁচা টাকা রোজগার বলতে তখন আমার সামনে টিউশনির টাকা কটা ছাড়া আর কিছু নেই। ফাইনাল পরীক্ষার পরদিন থেকে টিউশন করি। বাড়িতে দুটো ব্যাচ, আর বাড়ি গিয়ে আরও দুটো। ব্যাচে দশ জন করে আর বাড়ি গিয়ে দুজন দুজন। রোজগার খারাপ না, টেনেটুনে দেড় দুশ উঠত। কিন্তু টাকা চোখে দেখতে পাই না। মাইনে বাবা আদায় করে।
বাবার হাতে একটা বাঁধান রেজিস্টার খাতা ছিল। সেখানে স্টুডেন্টদের নাম, ক্লাস আর মাস লেখা থাকত। মাসের দ্বিতীয় থেকে দশম দিন অবধি বাবা ক্লাসে এসে মাইনে আদায় করে খাতায় দাগ দিয়ে দিত। দশ তারিখের পর স্টুডেন্টকে বলত,
- কাল থেকে মাইনে না নিয়ে আর আসবি না।
কারণও ছিল। না চাইলে মাইনে দিত খুব কম গার্জেন। আবার, বাবার মতে আমি ছিলাম ভীষণ লাজুক। মাইনে চাইতে গিয়ে নাকি আমার জিভে পক্ষাঘাত হত। অগত্যা বাবাকেই দায়িত্ব নিতে হত।
সেই কাঁচা টাকা থেকে পোস্টাল অর্ডার এবং ডাকমাশুল চেয়ে নিয়ে আমি অতিকষ্টে, প্রবল অনিচ্ছা স্বত্বেও, অচেনা অজানা এক চাকরির জন্য পোস্টঅফিসে গিয়ে ‘রেজিস্টার্ড ইউথ এ ডি’ করে রাইটার্স বিল্ডিং-এ দরখাস্তটা পাঠালাম। দিন সাতেকের ভেতর এ ডি কার্ড ফিরে এল। চিট্ঠি পৌঁছ গয়া।
আমি সামনের পি এস সি ক্লার্কশিপে মন দিলাম। ক্লাস সিক্স থেকে টেন, নিয়মিত ইংরাজি, অঙ্ক, ভৌত এবং জীবন বিজ্ঞান পড়াতাম বলে ওই সব বইয়ের দাঁড়ি কমা ফুলস্টপ অবধি মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। যে কোন প্রশ্নর উত্তর ছিল কণ্ঠস্থ। এই চর্চা আমার চাকরির লিখিত পরীক্ষায় ভীষণ কাজে দিত। শতকরা নিরানব্বুইটা লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে যেতাম, কিন্তু আটকে যেত এসে ভাইবায়।
তখন ভাইবাগুলো ছিল, আমার ধারনায়, ক্যান্ডিডেটকে তাড়ানোর মেশিন। যত উদ্ভট প্রশ্ন হয়, সবই ভাইবায় করা হত। উত্তর না দিতে পারলেই মাথাটা কেমন যেন নিচু হয়ে আসতো। এক সময় প্রশ্নকর্তা বলতেন,
- আপনি আসুন। নেক্সট?
কলকাতা পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর তো প্রায় হয়েই গেল ধরে নিলাম। হাইট ওয়েট, দৌড় ঝাঁপ সব মিলে গেল। রিটেনে ভাল নম্বর। শুরু হল সেই ভাইবা। নিলেন স্বয়ং পুলিশ কমিশনার সত্যব্রত বসু।
সব প্রশ্ন কেন যে উনি দাঁতে দাঁত চিপে ব্রিটিশের মতো উচ্চারণে করছিলেন আমি জানি না। একবার তো মনে হল বলেই ফেলি,
- এটা কি লন্ডন পুলিশের পরীক্ষা?
ওনার অর্ধেক কথা বুঝতেই পারিনি। শুধু খেলাধুলার প্রশ্নে উনি জানতে চেয়েছিলেন, আমি কোন স্তরের ভলিবল খেলোয়াড়? রাজ্য, না জেলা?
প্রশ্নটা বুঝতে পেরে বলেছিলাম,
- নো স্যার, আই প্লে ইন পাড়া লেভেল।
- অয়াট ডু ইউ মিন বাই পাড়া লেভেল?
- মানে স্যার, লোকাল ক্লাব লেবেল। বাট আওয়ার টিম অল্যেজ বিকেম চাম্পিয়ান ইন দ্য টাউন ইন পাড়া লীগ।
উনি বলেছিলেন,
- নেক্সট?
বাইরে আসার পর গেটের কাছে টুলে বসে থাকা এক হৃষ্টপুষ্ট কনস্টেবল খৈনি ডলতে ডলতে আমাকে বলেছিল,
- কী হল?
সব শুনে বলল,
- রাজভবনে কেউ চেনা জানা আছে?
- না
- তাহলে সোজা ট্রেন ধরে বাড়ি চলে যান।
হতাশার শেষ প্রান্তে এসে আমি এই কানুনগো হওয়ার পরীক্ষাটা দি। আমার প্রথম এবং শেষ চাকরি পাওয়া এই পরীক্ষা দিয়েই। আর কোনও পরীক্ষা কেন দিইনি, সে-কথা পরের কোনও এক পর্বে জানাবো।
পর্ব ৩
সন্দেহজনক রাইটার্স বিল্ডিং এবং কবি তারাপদ রায়
পরীক্ষা দিলাম সাতাত্তরের মাঝামাঝি আর এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা এল আশি সালে। ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায় গোটা বিষয়টা। চিঠিটা পাওয়ার পরে চলে গেলাম বাড়ির কাছে Land Ceiling অফিসে। Land শব্দটা যখন লেখা আছে, বাকিটাও ওখানেই জানা যাবে।
ঢুকেই, দুর্গাদাস মুখার্জি, বি এ, কানুনগো গ্রেড ওয়ান, লেখা নেমপ্লেট লাগানো ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি মারলাম। ভেতরে বসে থাকা বয়স্ক অথচ হ্যান্ডসাম লোকটি আমাকে প্রায় তেড়ে মারতে এলেন,
- না না, এখন কোনো এটেসটেড-ফেড হবে না। আমি চরম বিজি। যাও যাও।
- স্যার, আমি ঐকাজে আসিনি। আমি কানুনগোর চাকরি পেয়েছি। কানুনগো ব্যাপারটা কী, জানতে এলাম।
মুহূর্তে তার মুখ আনন্দের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল,
- বস বস। আরে গুড। এরপর তো তুমিই এটেস্টেড করবে। বাড়ি কোথায়?
মহা সমাদরে বসিয়ে চা এনে, সবিস্তারে ভূমি সংস্কার নিয়ে যা বললেন, সেসব আমার মাথার অনেক ওপর দিয়ে উড়ে গেল। আরো বললেন, এটা নাকি থার্ড প্যানেল। এর আগে সাতাত্তরে পরীক্ষা দেওয়া দুটো ব্যাচ জয়েন করে গেছে। আমরাই শেষ ব্যাচ। এর পর থেকে আর বোর্ড অফ রেভিনিউ এই পরীক্ষা নেবে না। দিয়ে দেবে পাব্লিক সার্ভিস কমিশনের হাতে। আরও জানলাম, বাহাত্তর, চুয়াত্তর এবং সাতাত্তর সালে, বোর্ড অফ রেভিনিউ এই পরীক্ষা কন্ডাক্ট করে, নিজেরাই প্রশ্ন তৈরি থেকে খাতা দেখা এবং ভাইবা নিয়েছে। তারপর প্যানেল ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে। যখনই এই চাকরি ছেড়ে ভারি সংখ্যায় কানুনগোরা অন্য চাকরি নিয়ে চলে যায় তখনই আবার তলার প্যানেল খুলে নিচ থেকে ডেকে এনে সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করে ফেলছে। চুয়াত্তরে আবার নতুন পরীক্ষা হয়েছিল এবং সেই ব্যাচ ছিল সংখ্যায় সর্বাধিক। আর আমরা হলাম সাতাত্তরের 'লাস্ট অফ দ্য মোহিকানস'।
এত দীর্ঘ মেয়াদী প্যানেলের কথা আমি আর কোনো দপ্তরে দেখিনি, শুনিওনি ।
চলে আসার সময় দুর্গাবাবু একটা অদ্ভুত কথা বললেন,
- চাকরিটা ছেড়ে দিও না। দশ বছর মন দিয়ে লেগে থাক। যদি ঠিকঠাক ভাবে কাজটা মন দিয়ে শেখ, তারপর দেখবে কেউ তোমার ক্ষতি করতে চাইলে সে নিজে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তুমি যদি ভাব কাউকে টাইট দেবে তাহলে সে তার চোদ্দ গুষ্টি সুদ্ধ ফৌত হয়ে যাবে।
শুনে আমি তো হতভম্বের মতো বার হয়ে এলাম। তবে, পরবর্তী কালে দূর্গাদার কথার মর্ম বুঝতে আমাকে অনেক সময় ও প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছিল।
আরেকটা কথা আমার কেবলই মনে হতে লাগল, কেন যে এই সব কানুনগোরা চাকরিটা নিত এবং ছেড়ে চলেই বা যেত কেন? অনেকটা সেই দশ জন শ্রমিকের অংকের মতো। কেন তারা একটি কাজ রোজ সাত ঘণ্টা করে বাইশ দিনে করবে বলে শুরু করে সাত দিনের মাথায় ছয়জন চলে যেত কেউ জানে না। কিন্তু জয়েন করতে এসে আমি সেই কারণটা এক নিমেষে জেনে গেলাম। জানিয়ে দিলেন কবি ও সাহিত্যিক তারাপদ রায়। না, আমি সেইদিন তাঁকে কবি হিসেবে চিনতাম না। অনেক পরে লেখালিখি করতে এসে জানতে পেরেছি, আমার প্রথম দিনের দেখা সেই এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারিই ছিলেন কবি তারাপদ রায়। হায়, আমি অফিসের সাইনবোর্ডে লেখা নাম দেখে কেমন করে বুঝব পরবর্তী জীবনে অনেক বিষাদের মুহূর্তে তাঁর লেখা আমাকে শুশ্রূষা দেবে!
সেক্রেটারি এবং ডিরেক্টর, এই দুই শব্দ চাকরি পাওয়ার আগে আমার কাছে অন্য অর্থ বহন করত। সেক্রেটারি মানে, হয় ক্লাবের নয় পূজা কমিটির মাতব্বর। আর ডিরেক্টর হলেন তিনি, যিনি ফিল্ম বানান। কিন্তু দপ্তর আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে এখানে এঁদের কাজ আলাদা। ওজনে আরও অনেক বেশী ভারি।
প্রথম দিন রাইটার্সে ঢুকতে গিয়ে আমি ধন্দে পরে যাই। সেদিন ভোর থেকেই প্রবল নিম্নচাপ এবং তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। চলেছিল দিন দুই। আমাদের মফস্বলের হাওড়া শেয়ালদা, দুই লাইনেই তারের ওপর গাছফাছ পড়ে লণ্ডভণ্ড অবস্থা। আমার ট্রেন চার ঘণ্টা লেট। নেমে দেখি বউবাজার রোড হাঁটু জলে মগ্ন। আমি সেই জল ঠেলে হেঁটে হেঁটে চার্চের সামনে রাস্তা যখন ক্রস করছি তখন বিকেল সাড়ে চারটে বেজে গেছে। মহাকরণের পুব দিকের গেটের কোলাপ্সিবলের ফাঁক দিয়ে তখন, যে সামান্য কজন অফিসে এসেছে তারা ছাতা বাগিয়ে বাড়ি ফিরতে ব্যস্ত।
তবু পুলিশ আমাকে গেটে আটকাল। নিয়োগপত্র দেখাতে একগাল হেসে বলল,
- মিষ্টি কই?
আমি ইশারায় বললাম,
- ফেরার পথে হবে।
সে-নাছোড়, রাস্তা আটকাল। আমি একটা দু টাকার নোট দিয়ে বললাম,
- আমি তো মিষ্টি আনিনি। একটু আনিয়ে নিয়ে খাবেন।
চিরকুট লিখে পারমিশন করে নিয়ে ওদের নির্দেশ মতো দোতলায় যাব বলে ভেতরের উঠোনে পা দিলাম। দিয়েই চমৎকৃত হয়ে গেলাম। বৃষ্টির জন্য বিল্ডিঙের বাইরের শোভা ততটা দেখার সুযোগ পাইনি ঠিকই। কিন্তু ভেতরের কাণ্ড দেখে আমি অবাক। কী বলিষ্ঠ স্থাপত্য! কী মজবুত থাম! কী ডিজাইন আর কী সব জাফরি কাটা দরজা জানালা এবং সিঁড়ির রেলিং।
তখন খুব সিনেমা দেখতাম। শহরের হলগুলোয় মাঝে মাঝে রোববার সকালে বেনহুর এবং প্রথম দিককার জেমস বণ্ড টাইপের ইংরাজি সিনেমা আসতো। সেগুলো গিলতাম। ওদের দুর্গ, প্রাকার, যুদ্ধ, এইসব খুব টানত। আজ রাইটার্সের উঠোনে পা দিয়েই মনে হল আমি যেন সেইরকম একটা দুর্গের ভেতর এসে পড়েছি। ওই বয়সে বেশি গল্প উপন্যাস পড়লে আর সিনেমা দেখলে মানুষ একটা অন্য জগতে ঢুকে পড়ে। তখন সবাই মাথার ভেতরে যার যার নিজস্ব সিনেমা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর কে না জানে, সিনেমা তখন সবচেয়ে শক্তিশালি মাধ্যম। আমিও ছিলাম তার অন্ধ শিকার।
আমি মাথার ভেতরে আমার সিনেমা চালিয়ে দিলাম। তখন ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ পড়া শেষ। মনের মধ্যে চলে এল সেই স্মৃতি। যেন আমি এক সোলজার, যে লুকিয়ে ঢুকে পড়েছে শত্রু শিবিরের দুর্গের মধ্যে। সামনেই লোহার একটা ফাঁক ফাঁক সিঁড়ি দেখে আমার কল্পনা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তার মধ্যে নজরে পড়ছে আশেপাশের দেওয়াল জুড়ে পোস্টার যুদ্ধ। সেখানে বেয়নেট হাতে হেলমেট পরা সোলজারের ছবিও রয়েছে আবার রয়েছে মুষ্টিবদ্ধ শ্রমিক কৃষকের হাত। রয়েছে আগুন ঝরানো সব শ্লোগান। ‘মানছি না মানব না’ এবং ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’-য়ের বন্যা চারিদিকে। আমাকে আর পায় কে।
ফাঁক ফাঁক সিঁড়ি বেয়ে আমাকে দোতালায় উঠতে হবে। বৃষ্টির ছাঁট এসে সেই খোলা সিঁড়ি ধুয়েমুছে আমাকেও ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমি মাথা বাঁচিয়ে ওপরে উঠছি আর ভাবছি ওপর থেকে যদি কোনও সোলজার বেয়নেট উঁচিয়ে নেমে এসে বলে,
- হল্ট।
তাহলে আমি সন কনারির [তৎকালীন জেমস বণ্ড সাজতেন] কায়দায় হাত দুটো ঘাড়ের পেছনে তুলে দাঁড়িয়ে পড়ব। যদি বলে,
- পাসওয়ার্ড?
বলব,
- কানুনগো।
দোতলায় উঠে বোর্ড অফ রেভিনিউয়ের বড় হলঘরের দরজায় যখন এসে পৌঁছলাম তখন আমার সমস্ত শরীর জুড়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। কোনও সোলজার আমাকে আটকায়নি কিন্তু কেউ একজন যেন ফলো করে এতদূর চলে এসেছে আমার পিছু পিছু। না, বারান্দা দিয়ে সে আসেনি। অন্ধকার মেঘলা আকাশ, আর মিটমিটে আলোয় ঘেরা করিডোরের বাঁ পাশে যে খোলা ফাঁকা জায়গা, আরো ওপরে, দক্ষিণে, রাইটার্স- এর চূড়ার মতো উঁচু উঁচু যে গম্বুজ আর মূর্তিগুলো ভিজে চলেছে অনবরত, সেইখান দিয়ে, মানে, ওই খোলা জায়গা দিয়ে, বাতাসে ভর করে, যেন সে আমাকে অনুসরণ করতে করতে এসে, আমি যেই মুখ তুলে তাকিয়েছি, ওমনি সাঁট করে সরে গেল। না, কোনও ছায়ামূর্তি নয়, একটা অস্তিত্ব। মুহূর্তে আমি গা ভারি পাথর। একটু অপেক্ষা করে ভাল করে চারিদিক দেখে নিয়ে আমি ঢুকে গেলেম প্রথম হলের ভেতরে।
আলো জ্বলছে, পাখা ঘুরছে ঠিকই কিন্তু চেয়ারটেবিল নিরানব্বুই ভাগ ফাঁকা। একজন ঘাড় গোঁজা মানুষ আমার চিঠিটা হাতে নিয়েই ইশারায় ডান হাতের সুইং ডোর দেখিয়ে দিলেন। খড়খড়ি দেওয়া দরজার বাইরে নেমেপ্লেটে লেখা - তারাপদ রায়। অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি। ল্যান্ড এন্ড ল্যান্ড রিফর্মস ডিপার্টমেন্ট।
আমি সুইং ডোর ঠেলে মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে বললাম,
- আসবো স্যার?
পর্ব ৪
গেজেটেডের স্বপ্নে চিড় এবং রাইটার্স বিল্ডিং-এর স্থপতির অস্তিত্ব অনুভব
ভেতর থেকে গম্ভীর এবং বাজখাঁই গলায় একটা স্বর ভেসে এল,
- আসুন।
ঢুকে দেখি ফাইলের পাহাড়ের আড়াল থেকে চেয়ারে উপবিষ্ট তারাপদ রায় সাহেবের যেটুকু অঙ্গ দৃশ্যমান, তাতে, তাঁকে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি না বলে, অনায়াসে ভারতীয় কুস্তিটিমের প্রাক্তন কোচ বলা যেতেই পারে। হাতের ঠোঙার ভেতর থেকে মুড়ি খাবলা মেরে তুলে তুলে মুখে ছুঁড়ে দিতে দিতে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললেন,
- বসুন। মুড়ি কটা খেয়েনি আগে।
দেখলাম অর্ধেকের বেশি মুড়ি তাঁর মুখগহ্বরে না গিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভুঁড়ির ওপর এবং টেবিলে এসে পড়ে নাচছে অথচ তিনি খুব আরাম করে বাকিটুকু চিবোচ্ছেন। খেতে খেতেই গালের একপাশ খালি করে বলে উঠলেন,
- মুড়িই খাবেন। সব সময় সঙ্গে রাখবেন। পেট যেন খালি না থাকে। যা ডিউটি আপনাদের।
বলে ঠোঙা পায়ের নিচে বাস্কেটে ফেলে দিয়ে হাত বাড়ালেন। আমি নিয়োগপত্রের গোছাটা এগিয়ে দিলাম।
উনি নাম জিগ্যেস করেই চলে গেলেন একদম শেষ পাতায়। বললেন,
- অ্যাক্সেপটেনস্ লেটারটা ফিল আপ করে এনেছেন?
সেটা আবার কী? আমি তো ভাল করে পড়িনি সব কটা কাগজ। পড়লেও বুঝিনি সরকারি ভাষা। উনি শেষ পাতাটা খুলে নিয়ে আমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন,
- ভেবে চিন্তে সই করবেন কিন্তু। বেশ কিছু শর্ত আছে।
আমি নীরব। বললেন,
- এক নম্বর শর্ত, ছ’মাসের ট্রেনিং। কোনও ছুটি বলে কিছু থাকবে না এই ছ মাস। মাসে দু’শ টাকা করে স্টাইপেন্ড পাবেন। খোলা আকাশের নিচে রোদে জলে ফিল্ড ট্রেনিং হবে ভোর থেকে বেলা বারোটা অবধি। নিজের ব্যবস্থায় এবং খরচে এলাকায় ঘর নিয়ে থাকতে হবে। আপনাদের ব্যাচের বেশির ভাগ ছেলেরই মুর্শিদাবাদে সেই ট্রেনিং হবে। ট্রেনিং শেষে একটা পরীক্ষা হবে, তাতে আপনাকে ৪০ পারসেন্ট নম্বর মিনিমাম পেতে হবে। নইলে আপনি ফেল করবেন এবং চাকরিটা পাবেন না। ট্রেনিংয়ের ওই দুশ টাকা করে মোট ছ মাসে বারোশ টাকা আপনাকে ফেরত দিতে হবে। আর পাস করলে ওয়েস্ট বেঙ্গলের যে কোনও জায়গায় আপনাকে পোস্টিং নিয়ে চলে যেতে হবে।
একটু থেমে বললেন,
- এইসব শর্তে যদি রাজি থাকেন তাহলে নিচে সই করে দিন। ওখানে লেখা আছে, আমি সব জেনে বুঝে এই চাকরি গ্রহণ করলাম।
মনটা কূ-ডাক দিল। এ কেমন ধরণের গেজেটেড অফিসারের চাকরি? এটা তো চাকরিই নয়, অস্থায়ী একটা ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। লিখিত এবং ভাইবা দিয়ে পাস করে আসার পরেও আবার পরীক্ষা? তাতে ফেল করলে স্টাইপেন্ড ফেরত? নিজেকে বড্ড কেমন যেন দাসখত দিয়ে চাকরি নিতে চলেছি বলে মনে হল।
বাবা সঙ্গে নেই। পরামর্শ করবার উপায় নেই। কিন্তু 'বেগার্স চয়েস' বলে একটা শব্দ পড়েছিলাম। সেটা মনে পড়ল। পাঁচ বছর ধরে বসে থাকা বেকার তো বেগারই। তার আবার চয়েস কীসের? দিলাম একটানে সই করে।
কাগজটা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,
- কেন এইসব করা হচ্ছে জানেন? জয়েন করলেই দাদারা সব বুঝিয়ে দেবে। একদল বলবে এই চাকরি কোনও ভদ্র ঘরের ছেলে করতে পারবে না। পালাও। সেই শুনে, এবং ফিল্ডে নেমে অনেকেই পালাবে অথবা পালানোর চেষ্টা করবে। কেউ কেউ পারবে। কেউ কেউ পারবে না। তখন আবার আমাদের প্যানেল খুলে তলা থেকে ডাকাডাকি করতে হবে, টাকাপয়সা ফেরত নিতে হলে তো সাংঘাতিক ফাইল ওয়ার্ক। সে এক জন্তন্না। তাই আগেভাগে সব লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
আমার মুখের চামড়ায় টান ধরছে দেখে বললেন,
- তবে আমি বলব, থেকে যেতে। এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কোনও দপ্তরে এখন নেই। আপনাদের কাজের ওপর বাংলার ভূমি সংস্কার কর্মসূচীর ভাল মন্দ নির্ভর করছে। হাজার হাজার বর্গাদার আপনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মাত্র তো পাঁচটা বছর। তারপরেই তো আপনারা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে যাবেন। মিনিমাম বিডিও। ব্যাস।
বাড়ির একদম গায়ে এস ডি ও অফিস, মুন্সিফ এবং ফৌজদারি আদালত, থানা এবং সাবডিভিশন লেবেলের জেলখানা থাকায়, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কী, ভালই জানতাম। তবে আমাদের মতো বেকারদের ওনাদের কাছে একটাই স্বার্থ ছিল। মার্কশিট অ্যাডমিট অ্যাটেস্টেট না করে দিলে আমরা চাকরির দরখাস্ত করতেই পারতাম না। তাই ডেপুটিদের খুব সম্ভ্রমের চোখে দেখতে হত।
ওনারা জিপে করে যাতায়াত করতেন। কোয়ার্টারের উঠোনে শীতের রাতে আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। আমরা দূর থেকে দেখতাম। ওনাদের মেয়েরা ফুটফুটে সুন্দরী হলেও সরাসরি তাকাতে ভয় পেতাম। কারণ, বাবা ম্যাজিস্ট্রেট। সব মিলিয়ে ডেপুটি জিনিসটা আমাদের বেশ টানত। কিন্তু প্রত্যেক বার পি এস সি, ডাব্লু বি সি এস কোশ্চেনগুলো দেখে ভিরমি খেতাম। মনে হত, ভীষণ কঠিন, পারব না। আমাদের মফস্বললের ভাল ভাল ছেলেরাও শুধু আত্মবিশ্বাস আর কোচিং-এর অভাবে বি সি এস দিতে পারেনি। এখন কানুনগো থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে যদি বিডিও হওয়া যায়, মন্দ কী!
বাস্তবে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রোমোশন পাওয়ার আহ্বান পেতে আমাদের ব্যাচের লেগেছিল তিরিশ বছর। কেন? সে সব কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।
সই সাবুদ করে উঠতে উঠতে সন্ধ্যে নিবিড় হয়ে গিয়েছিল। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে থেকে আমি উঠতে গিয়েও ভয় পেলাম আবার। মনে পড়ে গেল সেই অনুসরণকারির কথা। আমতা আমতা করে তারাপদ স্যারকে বলেই ফেললাম ব্যাপারটা,
- স্যার, আসবার সময় মনে হল এই বারান্দা অবধি কেউ আমাকে ফলো করে আসছে। আমি তাকাতেই সাঁট করে সরে গেল। ব্যাপারাটা কী স্যার?
শোনামাত্র উনি হাঁক পাড়লেন,
- গোবিন্দ-ও-ও-ও।
বছর সত্তরের একজন বাঁকা বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন। ওনাকে বললেন,
- সাহেবকে মেন গেট অবধি ছেড়ে দিয়ে এস। টর্চ নিয়ে যাও। লোডশেডিং হতে পারে।
আমাকে বললেন,
- চিন্তার কিছু নেই। লিয়ন সাহেব এসেছিলেন। মানে স্যার থমাস লিয়ন। এই বিল্ডিংয়ের আরকিটেক্ট । মনে রাখবেন এই রাইটার্স বিল্ডিং কিন্তু ১৭৮০-র ডিজাইন। যেই নতুন কেউ প্রথম এই বাড়িতে আসে লিয়ন সাহেব তাঁকেই ফলো করেন। দেখতে চান লোকটা বিল্ডিং দেখে মুগ্ধ হল কি না। ব্যাস, ওইটুকুতেই উনি খুশি। অনেকেই ফিল করে না, আবার করেওছে অনেকে। আমাকেও প্রথম দিন ফলো করেছিলেন। উনি হার্মফুল নন। আপনি, মনে হচ্ছে সেনসিটিভ, তাই টের পেয়েছেন।
আমি নির্বাক।
থাবার মতো হাতটা বাড়িয়ে বললেন,
- আসুন, বেস্ট অফ লাক।
অনেক পড়ে ওনার লেখা পড়তে পড়তে বুঝেছিলাম, রসবোধ এবং উপস্থিত বুদ্ধি কোন স্তরে উন্নীত হলে আমার সঙ্গে প্রথম দিনেই উনি এই ধরণের রসিকতা করতে পেরেছিলেন।
31 May, 2024
অসাধারন তোমার লেখনী। খুব সুন্দর হয়েছে। আমি তো এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম। অভিনন্দন জানাই নির্মাল্য। ভালো থেকো।
30 June, 2024
খুব সুন্দর লেখার স্টাইল। সাবলীল। এক পাঠক হিসেবে আমি মুগ্ধ! একই ক্যাডারের আধিকারিক হওয়ার সুবাদে আমি গর্বিত এবং আশান্বিত। যথার্থ সাহিত্যিক হয়ে ওঠার মতো সব গুণই আপনার মধ্যে বর্তমান। ভালো ও সুস্থ থাকুন। আর এ-ভাবেই লেখার আনন্দ,— সমস্ত সদস্য বন্ধুদের মধ্যে, মনোযোগী পাঠকদের মধ্যে বিস্তৃত হোক আপন গৌরবে।
30 June, 2024
শুরুটা খুব ভালো হয়েছে।। আমার ও প্রথম দিনের কথা মনে পড়ছিল।। আমি ১৯৭৯ র ব্যাচ।। লেখার বাঁধুনি বেশ ভাল।।