আমার পুনর্জন্ম

লিখেছেন:মানবেন্দ্রনাথ রায়

মালয়, ইন্দোনেসিয়া, ইন্দো-চীন, ফিলিপাইনস, জাপান, কোরিয়া এবং চীনে দেড় বছর দীর্ঘ পরিক্রমা শেষ করে ১৯১৬ সালের গ্রীষ্মে সান ফ্রান্সিসকোতে এসে পৌঁছলাম। এক কপি বাইবেল এবং ঘড়ির চেনে সোনার ক্রশ ঝুলিয়ে একজন পন্ডিচেরিবাসীর পাসপোর্ট নিয়ে প্যারিসে ধর্মতত্ত্ব অধ্যায়নের ছুতোয় প্রাশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিলাম। ততোদিনে আমেরিকাও যুদ্ধের অস্থির জোয়ারের স্বাদ পেতে শুরু করেছে।

পরদিন খবরের কাগজে বড় করে ছাপা হলঃ ‘রহস্যময় বিদেশীর আমেরিকা আগমন ------ বিখ্যাত ব্রাহ্মণ-বিপ্লবী অথবা বিপজ্জনক জার্মান গুপ্তচর।’ তাড়াহড়ো করে প্রাতরাশ সেরে আমি হোটেল থেকে চম্পট দিয়ে সন্নিকটের ‘পোলো অল্টো’ টাউনে এলাম। এই শহরেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে আমার পরিচিত ধর্মগোপাল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করলাম। ধর্মগোপাল তখন বিশ-বাইশ বছরের তরুণ যুবক এবং ইতিমধ্যেই সে কবি হিসেবে খ্যাত। আমার বন্ধু যাদুগোপালের ছোট ভাই সে। আমাকে সে খুশি মনে গ্রহণ করে পরামর্শ দিল পুরনো পরিচয় মুছে ফেলে একজন নতুন মানুষ হিসেবে জীবন শুরু করতে। সেইমতো, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে এম.এন. রায়ের জন্ম হল। পশ্চিম উপকূলে মাস কয়েক কাটিয়ে আমার আত্মিক ও রাজনৈতিক পুনর্জন্ম কে উদযাপন করতে মহাদেশ পেড়িয়ে আমি নিউ ইয়র্ক পৌঁছলাম।

জার্মানির সঙ্গে সন্ধি করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে একজন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী হিসেবে আমি আমেরিকায় এসেছিলাম। শতাব্দীর প্রায় সিকি ভাগ সময় পরে নেতাজী যেমন, তেমনি, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভাবি নেতাজীর মত আমিও জার্মানির পথে রওনা হয়েছি। একের পর এক দীর্ঘ দুঃসাহসিক অভিযান থামলো এসে নিউ ইয়োর্কে। যদি কোনদিন ভারতের বাইরে ভারতীয় বিপ্লবের লোমহর্ষক অথচ শিক্ষণীয় নয় এমন কাহিনী লিপিবদ্ধ করি তখন এই থামার কারণ বলবো। এই যে থেমে যাবার হতাশা, একে শুধু হতাশা বলা যাবে না, বরং, অন্তত আমার কাছে তা ছিল এক বড়ো আশীর্বাদ। এ ঘটনা আমাকে বেফায়দা অতীতের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল, যে অতীত ছিল সংকীর্ণ। দ্বিধা ছিল, তবু দ্বিধা নিয়েই আমি এক অনাগত নতুন জীবনের দিকে দৃষ্টি মেলতে পেরেছিলাম। সেই অনাগত ভবিষ্যতে ঘটতে চলেছে কষ্ট-স্বীকারযোগ্য অভিযান-সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং শেষ পর্যন্ত, এমনকি নৈরাশ্য পর্যন্ত। এখানেই শুরু হয়েছিল নতুন এক পৃথিবীতে আমার যাত্রার আরম্ভ। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনদের শেষ ছয় মাসের নিরপেক্ষতার সময়কালে ভারতীয় দেশপ্রেমিকরা তাঁদের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনের আশায় ‘মুক্তি’র এই দেশে এসেছিল। ইতিপূর্বে তাঁরা যে ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার চালিয়েছিল তাতে আমেরিকানদের বহু গোষ্ঠীর উৎসাহব্যাঞ্জক সমর্থন তাঁরা পেয়েছিল। লালা লাজপর রায়ের মত দেশ-ছাড়াদের  উদারতন্ত্রী সংবাদমাধ্যম ও মঞ্চগুলিতে যথেষ্ঠ অধিগম্যতা ছিল। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই সহযোগিতা বা সন্ধি স্থাপনের ব্যাপারে পক্ষপাত মেনে চলতেন না, ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী প্রোপাগন্ডাগুলি জার্মান প্রচারের সঙ্গে মিশে যেত আর সেগুলিকে আমেরিকান নিরপেক্ষতার বিরোধী বলে ধরে নেওয়া হত। ‘তিনি আমাদের যুদ্ধ থেকে দূরে রেখেছেন’ এই স্লোগান তুলে উইলসন ১৯১৬ সালের ভোটে জিতেছিলেন, কিন্তু ৬ মাসের মধ্যেই উইলসন প্রশাসন নিরপেক্ষতার নীতি পরিত্যাগ করেছিল কেননা এই স্লোগান আর কাজ দিচ্ছিল না। এই পরিবর্তনকালীন সময়ে জার্মান বিরোধী বিদ্বেষ সে দেশে তুঙ্গে উঠেছিল। এই অস্থির পরিস্থিতিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের ব্রিটিশ-বিরোধী প্রচার স্বাভাবিক কারণে জার্মান-অনুকূলে প্রচার হিসেবে নিন্দিত হচ্ছিল। একেবারে রাতারাতি ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা আমেরিকার সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হল। আমেরিকান বিপ্লবের পরম্পরায় ব্রিটিশ-বিরোধী আপীল কেউ আর সে দেশে শুনতে পছন্দ করছিল না। ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের জার্মানির গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহ করা হতে লাগল এবং আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দিলে ভারতীয়দের দলে দলে গ্রেফতার করা হল।

আগুন যথেষ্ট উদ্দীপ্তই ছিল, লুসিটানিয়া জাহাজ নিমজ্জিত হলে আগুনে ঘৃতাহূতি পড়ল। বিরাট পরিমান আমেরিকান ডলার ঝুঁকির সম্মুখীন হল। যদি আঁতাত শক্তি পরাজিত হয় তবে এই অগাধ টাকাকড়ি জলে যাবে। আমেরিকার আদর্শবাদ যা কিনা প্রেসিডেন্ট উইলসনের মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছিল তা প্রথম থেকেই বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের প্রতি ছিল সহানুভূতিপ্রবণ  কেননা এ দুটি দেশই প্রুসিয়ার যুদ্ধলিপ্সার শিকার হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকার শক্তিশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চাইছিল নিরপেক্ষতা। যেই না জার্মানি সাবমেরিন আমেরিকার লাভজনক অস্ত্র বেচাকেনায় গোলমাল বাধালো, ওমনি আমেরিকার আপতিক শান্তিপ্রিয়তা উবে গেল। ইয়োরোপে তাদের যে অগাধ টাকাকড়ি খাটছিল তা রক্ষা করতে আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিল।

১৯১৭ সালের গোড়ার দিকে আরেকটি ঘটনা ঘটে গেল যার অনিবার্য প্রভাব এসে পড়ল আমেরিকার আদর্শবাদী রাজনীতির উপর। ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি জারের রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেছিল এবং এই মিত্রতা যতদিন বজায় থাকবে ততদিন উইলসনের ‘পৃথিবীকে গণতন্ত্রের জন্য নিরাপদ করা’র ডাকের আর গুরুত্ব থাকছিল না। প্রুসিয়ার সামরিকবাদ এবং জার-শাসিত রাশিয়ার বর্বরতার মধ্যে কোন একটিকে বেছে নেওয়া কি চলে? যদি রাশিয়ার স্ট্রীম-রোলার রাইন অঞ্চলে পৌঁছে যায় তখনও কি গণতন্ত্র ইয়োরোপে নিরাপদ? এই গন্ডগোলের প্রশ্লটির অবসান অবশ্য হল ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন রুশ রাজতন্ত্রের অবসানে সেখানে উদারনৈতিক গণতন্ত্র  প্রতিষ্ঠিত হল। আইন আদালতের অনেক নটঘট জনিত গোলমাল আর দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের অপরিসীম অপদার্থতার মধ্যে দিয়ে নতুন আমলের উদ্ভব হয়েছিল বলে এ সরকার ছিল দুর্বল। তার পক্ষে জার্মান আক্রমণ রোখা সম্ভব ছিল না। এরকম আশঙ্কা ছিল যে রাশিয়াকে গ্রাস করে যুদ্ধবাজ জার্মান দেশ পশ্চিমের দিকে নজর ফেলবে। অক্ষশক্তির ব্যাপার তখন আর সামলানো যাবে না।

এরকম নাটকীয় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘পৃথিবীকে গনতন্ত্রের জন্য সুরক্ষিত করো’ এই ডাক খুবই গুরুত্ব পেয়ে গেল। রাজনৈতিক আদর্শবাদ চতুর ব্যবসায়ী হিসেবনিকেশের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধে সক্রীয় অংশগ্রহণের পক্ষে আমেরিকার জনমতকে প্রভাবিত করলো। সেইসঙ্গে, চাপের মুখে থাকা গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি স্বস্তি পেল।  জুন মাসের ৭ তারিখে আমেরিকা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। আমেরিকার কংগ্রেসে একটি মাত্র অসম্মতির কন্ঠ, একজন মহিলা সদস্যার, শোনা গিয়েছিল। যখন ‘সমস্ত যুদ্ধের পরিসমাপ্তির জন্য যুদ্ধ’ এই মতের পক্ষে পাশার দান পড়ল, তখন এই একাকিনী সদস্যা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।

প্রসঙ্গক্রমে, আমেরিকার তাবর তাবর জার্মান প্রচারক এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের জন্য এই ঘটনা ছিল এক রূঢ় আঘাত। সে দেশের জার্মান সমর্থকরা এক অলীক ধারণায় বিশ্বাস করত যে ২০ মিলিয়ন জার্মান-বংশদ্ভূত আমেরিকান, ব্রিটিশ-বিরোধী আইরিশ-আমেরিকান নাগরিকদের সহায়তায় বিদ্রোহ সংঘটিত করবে, সাম্রাজ্যবাদী মিত্র শক্তির সঙ্গে যুক্ত তাদের মাতৃভূমিকে বাঁচানোর তাগিদে। আমেরিকায় বসবাসকারী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা মনেপ্রাণে ব্রিটেনের পরাজয় কামনা করত এবং সেই সূত্রেই জার্মান-সেনা বাহিনীকে অপরাজেয় মনে করত। সে কারণে তারা তাদের জার্মান বন্ধু ও পৃষ্টপোষকদের চাতুরিতেও বিশ্বাস করতো। কিন্তু ‘হাইফেন’ চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত আমেরিকানরা, যাদের কিনা  জার্মান-উপজনন, তারা যুদ্ধের উন্মাদনায় মেতে উঠে তাদের আশ্রয়দাতা পিতৃভুমির অনুগত রইল। যারা তাদের অন্য এক ভূমিকায় দেখার আশায় মশগুল ছিল তারা এই ভাবে হতাশ হল। আপ্তবাক্য হিসেবে ‘রক্ত জলের তুলনায় জমাট’ একথা হয়ত সত্য, কিন্তু বাস্তব জীবনে তা খুবই তরল। নতুন বাসভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ত কায়েমি স্বার্থ পুরাতন পিতৃভূমির প্রতি আবেগময় আনুগত্যের থেকে বড় হয়ে দেখা দিল। আসলে, বাস্তব-আনুগত্য নির্ধারিত হয় স্বার্থচিন্তানির্ভর কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে,  আবেগ সেখানে গৌণ। 

জার্মান ও তার সুহৃদদের জন্য নৈরাশ্যের চাইতেও মন্দ এক অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল। কূটনৈতিক সুরক্ষার আড়ালে জার্মান প্রোপাগন্ডা-প্রধানগন কাজ করতেন। তাদের গুপ্তচরেরা ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, তারপর তারা একত্রে ভারতে অস্ত্র পাঠাবার বিষয়ে পরিকল্পনা করতেন। গোটা ব্যাপারে একধরণের ছল-চাতুরি ছিল। বিষয়টা কয়রকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, একটা র‍্যাকেট কাজ করতো। স্টার-হ্যান্ট নামে একজন আমেরিকান ওয়াশিংটন এমবেসির নৌ-দপ্তরের কর্তা, ক্যাপ্টেন ভন প্যাপেনের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ নিয়েছিল। কথা ছিল সে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চাটার্ড জাহাজে তা ভারতে পৌঁছে দেবে। ১৯১৬ সালে দক্ষিণ-ক্যালিফর্নিয়ার ‘সান দিয়েগ’ বন্দর থেকে জাহাজ রওনাও হয়েছিল। জাহাজ ভর্তি গোলা-বারুদ ভারতে রওনা হয়েছে এই খবর আমাদের কাছে পৌঁছেছিল। এই অমূল্য সম্পদ গ্রহণ করতে আমি জাভা পৌঁছে দেখলাম যে, সেই মহা অভিপ্রেত জাহাজটি আসলে অস্ট্রেলিয়ার নৌ-বহর কতৃক কবলিত একটি ট্যাংকার। অভিগ্রস্ত সেই জাহাজটিকে সিঙাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় বিপ্লবীদের জার্মান সাহায্যের প্রতিশ্রুতির কাহিনী ভবিষ্যতে কখনো বলা যাবে। বর্তমানে ছোটকরে যে ঘটনার উল্লেখ করবো তাতেই বোঝা যাবে সমস্ত বিষয়টি কতখানি মেকি ছিল------এসব আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার, অর্থ উপার্জন আর সারল্যে পূর্ণ ভারতীয় বিপ্লবীদের বোকা বানানো। ১৯১৫ সালের শেষ দিকে আমি বাটাভিয়ায় স্টার-হ্যান্টের সঙ্গে দেখা করি, সে তখন এক বিলাসবহুল হোটেলে রয়েছেন, তখনো জার্মান সিক্রেট-সার্ভিসের তিনি নেক নজরে। পরে  তার সঙ্গে আমাকে মেক্সিকোতে ফের দেখা করতে হয়, তখনও সে কোন এক রহস্যময় কর্মে লেগে রয়েছে।

যুদ্ধে যোগ দেবার কয়েক মাস আগে আমেরিকার স্টেট- ডিপার্টমেন্ট জার্মান বৈদেশিক অফিসকে ভন প্যাপেনকে বহিস্কার করার নির্দেশ দেয়। তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ যে সে কূটনৈতিক সুবিধাকে অন্যায় কাজে লাগিয়েছে। অন্যায় কাজ হল মিত্র একটি দেশের বিরুদ্ধে কাজ-কর্মকে মদত দিয়েছে। এটা জানা কথা যে, জার্মান গুপ্তচর বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বিপ্লবীদের গোপন যোগাযোগের বিষয়টি আমেরিকান গুপ্তচরদের অজানা ছিল না। এ কথাও সত্য যে আমেরিকান গুপ্তচরেরাও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আমার বিশ্বাসের যথেষ্ঠ কারণ আছে, স্টার-হ্যান্ট ছিলেন এদের মধ্যে একজন। অন্যদিকে অনেক জার্মান-এজেন্ট ছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকে বেশ উচ্চপদস্থ, যাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল অর্থ উপার্জন করা, পিতৃভূমির যুদ্ধজয়ের বিষয় তাদের কাছে ছিল গৌণ। ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মে আমি যখন মেক্সিকোতে যাই তখন এরকম দুজন মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল যাদের আমি জাভাতে দেখেছিলাম। মেক্সিকোতে এসে দেখি এরা এখানে বেশ আরামের জীবন যাপন করছে। 

নিরপেক্ষতার যতদিন পর্যন্ত কোন গুরুত্ব ছিলনা ততদিন, বিবিধ নানারকম জানা-অজানা কারণে আমেরিকান সরকার ‘নিরপেক্ষতার আইন’কে লঙ্ঘন করার জন্য  হিন্দু - জার্মান ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় নি। কিন্তু জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া এবং নিউ ইয়োর্কে বেশ কয়েকজন জার্মান এজেন্ট ও ভারতীয় বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করা হল। কিছু চটকদার সংবাদ-সংস্থা ছিল যাদের দূর-প্রাচ্য দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে শাখাপ্রশাখা ছিল, তারা সারম্বরে মহাদেশের বাইরেও হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রের প্রকাশ্যে আসার সংবাদ ছড়িয়ে দিল। লালা লাজপত রায়ের মিটিং শুনে ফেরার পথে, এক সকালে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরে আমিও গ্রেপ্তার হলাম।

১৯১৬ সালের শরতে আমি যখন নিউইয়র্কে এলাম তখন লালা লাজপত রায় সেখানে ছিলেন। এর আগের বছর ভারতের স্বাধীনতার হয়ে প্রচার করতে তিনি আমেরিকায় এসেছিলেন এবং নিজ যোগ্যতায় ভারতের স্বাধীনতার স্বপক্ষে সেখানকার মুক্তমনা মানুষদের সহানুভূতি আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। বিজয়ী নায়কের মত তিনি ইংল্যান্ড হয়ে দেশে ফিরছিলেন। ইংল্যান্ডে তাঁকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয় না অথবা বলা হয় নিজে ঝুঁকি নিয়ে তিনি যেতে পারেন। অর্থাৎ তিনি দেশে ফিরলে গ্রেপ্তার হতে পারেন। সন্দেহ করা হত আমেরিকায় থাকতে তিনি শত্রু পক্ষের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক কিছু কার্যকলাপে যুক্ত হয়েছিলেন। ঔপোনিবেশিক দেশের আর সকল জাতীয়তাবাদীদের মত তিনিও ছিলেন জার্মানপন্থী; কিন্তু কোন গোপনীয় বিষয়ের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত থকতেন না, মানুষটা ছিলেন তিনি সাবধানী। তাঁকে বন্দি করা হয়নি, তিনি ফিরে এলেন আমেরিকায় এবং আগের থেকেও অনেক তিক্ততা নিয়ে তীব্রভাবে ব্রিটিশ-বিরোধী হয়ে ফিরে এলেন। ইতিমধ্যে ‘ল্যান্ড অফ লিবার্টি’র দেশে রাজনৈতিক অবস্থার প্রভূত পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ব্রিটিশ-বিরোধী যোদ্ধাদের কপালে তখন আরো অনেক দুঃখজনক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া বাকি। সংবাদপত্রে কিংবা যে কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে কোন প্রচাার মানে জার্মানিকে সাহায্য করা এই অযুহাতে তাঁর উদারনৈতিক বন্ধুরা তাঁর পাশে আর দাঁড়ালো না। 

বৃদ্ধ মানুষটি নিঃসঙ্গ এবং মনের দিক থেকে এতোটাই স্বগৃহাভিমুখী হয়ে পড়েছিলেন যে বিদেশী খাবার-দাবারকে পর্যন্ত ঘৃণা করতে শুরু করলেন। আমি তার মধ্যাহ্ন ভোজের জন্যে ভারতীয় খানা বানালে তিনি ভারি খুশি হতেন। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি রসগোল্লা বানাতে পারো? বাংলার সংস্কৃতি পাঞ্জাবকেও প্রভাবিত করেছে দেখে, আমি রসগোল্লা বানাতে লেগে পড়লাম। সুসভ্য সেই অশিষ্টতার দেশে ছানা পাবার সম্ভবনা নেই। ফুটন্ত দুধে অ্যাসিড ফেলে বাড়িতেই তা বানাতে হবে। ছোট করে বললে গল্পটা এরকম দাঁড়ায় যে আমার প্রচেষ্টা সফল হওয়ায় আমি নিজেই বিস্মিত হলাম, আর সেই বৃদ্ধ মানুষটি একেবারে শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠলেন। আমরা বন্ধু হয়ে উঠলাম, তবে আমাদের বন্ধুত্ব যে শুধু পানভোজনে জমে ইঠেছিল, তা নয়, আমরা দুজনেই নিজের নিজের মতো করে সে সময়  হতাশ ও ভগ্নোদ্যম মানুষ। তিনি চান দেশে ফিরে গিয়ে, মরবার পূর্বে শেষবারের মত একটা বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করবেন আর আমি চাই জার্মানিতে গিয়ে তাদের সাহায্য নিয়ে এক সেনাদল গড়ে দেশকে স্বাধীন করবো। আমাদের পরস্পরের বেদনা নিভৃতে কোলাকুলি করতো আর আমাদের হাতের বাইরে থাকা পরিস্থিতে যতটা সম্ভব আমরা দুজনে দুজনকে সান্ত্বনা দিতাম।

মনোমত সঙ্গ পাবার জন্য আমরা র‍্যাডিক্যালদের নধ্যে নতুন বন্ধু খুঁজে নিলাম। সোস্যালিস্ট, সিন্ডিক্যালিস্ট, এনারকিস্ট, (কমিউনিস্টরা তখনো অনুপস্থিত) এদেরকেই সে সময়ে আমেরিকায় র‍্যাডিক্যাল বলা হত। এরা ব্রিটিশ বা জার্মানি কারোরই  বিরোধী ছিল না, এরা ছিল শান্তিবাদী, যুদ্ধ-বিরোধী এবং কেউ কেউ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। একজন একেশ্বরবাদী অধ্যাপকের মতামত শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম, তার মতে উপনিবেশ কোন অর্থনৈতিক সম্পদ নয়। জাতীয়তাবাদী হিসেবে আমরা তাদের সমাজ-বিপ্লবের মতবাদের বিরোধীতা করি, তাদের মার্ক্সবাদী বস্তুবাদকে আমরা নাকি আমাদের  সহজাত আধ্যাত্মিকতার অস্ত্র দিয়ে জোরদার আক্রমণ করি। যাইহোক, তারা পরাধীন মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং লাজপত রায়কে  সভায় বলবার আয়োজন করে দিলেন। শ্রোতা স্বল্প কিন্তু বাগ্মীদের আপন কন্ঠ আপনারই  কর্ণকুহরে মধুর লাগে। লাজপত রায় ছিলেন বাগ্মী আর আমি তখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ডে একজন ষড়যন্ত্রী মাত্র, বাগ্মী নই।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং মার্ক্সীয় বস্তুবাদকে খন্ডন করার এক নতুন মিশন আমাদের জাতীয়তবাদী চৈতন্যে আঘাত দিল। এইসব বিরুদ্ধ মতবাদীদের, যারা নাকি আমাদেরই বন্ধু, তাঁদের সঙ্গে লড়তে গেলে তাঁদের তত্ত্বগুলি ভালভাবে জানা প্রয়োজন। আমি তো কপর্দক শূণ্য, লালা লাজপত রায় মার্ক্সের এবং সমাজতান্ত্রীক সর্বোত্তম লেখাগুলি নিয়ে এলেন। আমার ক্ষেত্রে এগুলোর প্রভাবে আমাদের উদ্দেশ্যই  সংকটের মুখে পড়ল। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, লালা আছেন মঞ্চে যোদ্ধার ভূমিকায়। আমার স্বদলদ্রোহিতা আমার প্রতি তাঁর স্নেহকে আঘাত করল না। অবশেষে আমার জীবনে একটা গুরুতর সময় এলো যাকে বলা যায় রাস্তা বদলের লগ্ন। 

একদিন লালা লাজপত রায় তাঁর বক্তৃতা শেষ করেছেন, তার বলার বিষয় ছিল, যতদিন পর্যন্ত এক মহান ও প্রাচীন সভ্যতা ঔপনিবেশিক অধীনতায় রয়েছে ততদিন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শোষনের তত্ত্ব আলোচনা অবান্তর। তাঁর সুদীর্ঘ ব্রিটিশ-বিরোধী বক্তৃতা এবং ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের দারিদ্র বর্ণন অবশ্যই শ্রোতাদের বিচলিত করেছিল। মানুষের প্রতি মানুষের সমস্ত রকমের শোষণের বিরুদ্ধে সকলেই। হঠাৎ অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স। হলের পেছন দিক থেকে একজন প্রশ্ন করতে উঠে দাঁড়াল। সভায় উপস্থিত সবার সঙ্গে তিনি ঐক্যমত হয়ে বললেন যে আমরা সকলেই ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে এবং ভারতের ন্যায়সঙ্গত আকাঙ্ক্ষার সপক্ষে, তবে তিনি সকলের হয়ে জানতে চান যে  ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা সে দেশের দারিদ্র দূর করতে কী পন্থা গ্রহন করবে? তারপর  বক্তা ও প্রশ্নকর্তার মধ্যে প্রাণবন্ত কথপোকথন চলল। বক্তার এড়িয়ে যাওয়া উত্তর -- ‘আরে আগে তো আমরা গৃহকর্তা হই’------ কাউকেই পরিতৃপ্তি দিল না। এবারে প্রশ্নকর্তা তাঁর যুক্তিকে জোরালো করতে উত্তেজক একটি প্রশ্ন রাখলেন-- “বিদেশী শোষকদের বদলে দেশী পুঁজিপতিদের দ্বারা শোষিত হলে ভারতীয় সাধারণ মানুষের জন্য ফারাকটা কী হবে?” লালাজী চরম ক্রোধান্বিত হয়ে চতুর প্রত্যুত্তর করলেন----'ভাই এর লাথির সঙ্গে বিদেশী লুটেরার লাথির অনেক পার্থক্য আছে।’ শ্রোতৃবর্গ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। প্রথমদিকে আমিও ‘হবস’ (hobes) দের (আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনের অতি বামেদের ছোট করতে এই নামে ডাকা হত) ধৃষ্টতায় লালাজীর ক্রোধের সরিক ছিলাম কিন্তু আমিও শেষে অস্বস্থি বোধ করতে লাগলাম। নিশ্চয়ই আমাদের চিন্তায় কিছু গলদ আছে, একটা আলোর রাশ্মি যেন আমার মস্তিস্কে ঝলক দিয়ে উঠল, এ এক ভিন্নতর আলো।

আমি একাই সভা থেকে বেড়িয়ে এলাম। তখনও আমি খুবই বিভ্রান্ত। তবু অস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার এক অন্য রূপ দেখতে পেলাম। লালাজী ও অন্যান্য ভারতীয়দের এড়িয়ে আমি নিয়মিত নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে কার্ল মার্ক্সের লেখাগুলি পড়তে লাগলাম এবং এই লেখাগুলির নতুন অর্থ খুঁজে পেলাম। মার্ক্সবাদের জড়বাদী দর্শন ব্যতিরেকে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করতে আমার আর বেশি বিলম্ব হল না। এই মতবাদ ছিল শেষ পরিখা যাকে বহুদিন ধরে আমি রক্ষা করে এসেছিলাম।

বেশ কিছুদিন ধরে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে শান্তিবাদের ওপরে একটা প্রবন্ধ লিখছিলাম। আমার তত্ত্বটা ছিল এরকমঃ উপনিবেশবাদ যুদ্ধের জন্য দায়ী, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য পরাধীন দেশের মানুষদের, বিশেষত, ভারতবর্ষের জনগণের স্বাধীনতা পাওয়া প্রয়োজন। এখন আমার মনে হল, প্রবন্ধে আন্তর্জাতিক সংঘাতের যে মূল্যায়ণ আমি  করেছি এবং তা থেকে যে সিদ্ধান্ত টেনেছি তা সন্দেহসূচক। নতুন করে যে প্রবন্ধ লিখলাম তা পূর্বেরটির চেয়ে দীর্ঘতর। প্রবন্ধটি ছাপাবার জন্য আমি একজন প্রখ্যাত সোস্যালিস্ট সাংবাদিককে লেখাটা দেখালাম। এর কিছুদিন পর র‍্যাডিক্যাল বিদ্বজ্জনেদের এক সভায় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা, আমার লেখায় সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অর্থনৈতিক বিষয়গুলিকে যুদ্ধের আসল কারণ হিসেবে তুলে ধরায়  আমাকে অভিনন্দন জানালেন। একজন নতুন রুপান্তরিত সদস্য হিসেবে তিনি আমাকে সমধর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। ভারতবর্ষ থেকে প্রথম একজন সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত হলেন।

এর কিছুদিন পরেই আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দিল। আমি মেক্সিকোতে পালিয়ে গিয়ে গ্রেপ্তারি এড়ালাম। আমার প্রথম সমাজতান্ত্রিক প্রবন্ধ ছাপার অক্ষরে দেখার সুযোগ আর হলো না। আমার নতুন নির্বাসনে বসে আমি স্প্যানিশ ভাষা শিখে একজন শিক্ষকের সাহায্যে প্রবন্ধটি অনুবাদ করলাম। আমার লেখাটি, “প্রেসিডেন্ট উইলসনকে লেখা খোলা চিঠি”  হিসেবে প্রকাশিত হল। শিরোনাম দেওয়া হল  El Camino Para la Paz Duradera Del Mundo---বিশ্ব-শান্তির  স্থিতিশীল পথ ।  এম.এন.  রায়ের প্রথম কলম চালনার প্রয়াস। 

 

অনুবাদ- অপূর্ব দাশগুপ্ত।

 

0 Comments
Leave a reply