আজও টিনটিন

লিখেছেন:রুদ্রজিৎ পাল

টিনটিন। এই একটা নাম আমাদের ছোটবেলায় যে উন্মাদনার জন্ম দিত, তার কোনও তুলনা নেই। প্রত্যেকটা গুণে গুণে ৬২ পাতার কমিক্স। সেই বয়সে আমাদের চোখে বিশাল আর্ট পেপারে ছাপা বই যেন একটা অন্য গ্রহের প্রতিনিধি। দামও সেরকম। মানে, একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে বছরে একটার বেশি টিনটিনের বই কেনা মুশকিল। বইয়ের পেছনের কভারে এই সিরিজের অন্যান্য বইয়ের নাম লেখা। এরকম নতুন একটা টিনটিন কমিক্স হাতে পেলে আমাদের মনের যে কী ভাব হত, সেটা এখন কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। আজকে যখন সমস্ত বিদেশি কমিক্স চাইলেই পাওয়া যায়, তখন কারুর পক্ষে বোঝা মুশকিল যে, সেই আশির বা নব্বইয়ের দশকে এই একটা কমিক্সের বইয়ের জন্য আমরা কিভাবে অপেক্ষা করতাম। সেই সাথে সেই বইয়ের পেছনের কভার থেকে মিলিয়ে দেখা যে, আর কটা কিনতে বাকি আছে!

বই হিসাবে প্রকাশের আগে বাংলার একটি জনপ্রিয় শিশু-কিশোর পত্রিকায় প্রত্যেক সংখ্যায় দু-পাতা করে ধারাবাহিক ভাবে এই কমিক্সের প্রকাশ সেই সময়ে সেই পত্রিকার জনপ্রিয়তাকে শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। এরকম বহু কিশোর-কিশোরী সেই সময়ে ছিলেন যারা সেই পত্রিকা হাতে পেলেই সর্বপ্রথমে সেই দুটো পাতা পড়ে নিতেন। আর কালেভদ্রে বেরোত কভার স্টোরি হিসাবে কমিক্স। সেই ক্ষেত্রে পত্রিকার দুটো সংখ্যায় পুরো বইটা শেষ হত। যেমন “চাঁদে টিনটিন” বা “মমির অভিশাপ”। এইসব সংখ্যার বিক্রি হত অনেক বেশি এবং প্রথম বা দ্বিতীয়বারে গিয়েও দোকানে বই পাওয়া যায়নি, এরকম অনেকবার হয়েছে। পরে ছাপা হয়ে যে কমিক্স প্রকাশিত হত, তার দাম হত সেই সময়ের মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে বেশ চোখ গোল গোল হয়ে যাওয়ার মত। কিন্তু পত্রিকায় দু খেপে যে কমিক্স বেরোত, তার দাম অনেক কম। আমার মত অনেকেই সেই পত্রিকা থেকে কমিক্স কেটে আলাদা করে বই বানিয়ে রেখে দিত। তখন অ্যামাজন আসেনি। এরকম বিদেশী কমিক্স কেনার জায়গা, কলকাতায় অন্তত, খুব কম ছিল। শপিং মল তখনও নেই। এক যাওয়া যেত সেই খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেটে। সেই সময়ে আমাদের যেসব বন্ধুর বাবা বিদেশে যেতেন, তাদের কাছেই একমাত্র ইংরেজি টিনটিন পাওয়া যেত। কলকাতা শহরে এরকম কয়েকজন ভাগ্যবান কিশোর-কিশোরী ছিল সেই সময়ে, যাদের কাছে বাংলায় প্রকাশের আগেই ইংরেজি টিনটিনের বই ছিল। কেউ বিদেশ গেলে ফেরার সময়ে বাড়ির বাচ্চাদের জন্য উপহার হিসাবে টিনটিনের বই নিয়ে আসত। 

তবে, আমার মতে, বাংলা টিনটিন পড়লে যে ভালোলাগা, সেটা সবসময়ে ইংরেজি বইয়ে থাকত না। ক্যাপ্টেন হ্যাডকের সেই গালাগালি, প্রোফেসর ক্যালকুলাসের সেই ভুলোমনা কথা, এগুলো যেন বাংলায় অতিরিক্ত ভালো লাগত। টিনটিনের একদম প্রথম যে বই, সোভিয়েত দেশে টিনটিন, সেটা এই রাজ্যে প্রকাশিত হয়েছিল সব বইয়ের শেষে। এটা আবার ছিল সাদা কালো। ছবির মান খুব একটা ভালো নয়। অন্তত বাকি টিনটিন পড়ে তখন যে মানের ছবিতে চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সেই তুলনায় এই সাদা কালোর ছবি নেহাৎ কাঁচা কাজ বলেই মনে হয়। আর ডায়ালগও খুব সাধারণ মানের। এই বইটি সবার শেষে বাংলায় অনূদিত হয়ে ভালোই হয়েছে। প্রথমে এটা পড়লে আমার মনে হয় অনেকেই হয়তো পরের গুলো আর পড়তেনই না! 

টিনটিনের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার (ছবিঋণ - টিনটিন.কম)

বাংলা কমিক্স বলতে তখন ছিল হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টে আর ছিল উত্তর ভারতের বিখ্যাত কমিক্স স্ট্রিপ, চাচা চৌধুরীর বাংলা সংস্করণ। এছাড়া অমর চিত্র কথা ছিল, কিন্তু সেগুলো ঠিক কমিক্স নয়; বরং জীবনী, নীতিকথায় ভর্তি। সেগুলো থেকে কমিক্সের মজা পাওয়া যেত না। সেগুলো যেন ছবি দিয়ে ভর্তি মহাপুরুষের জীবনীর বই। কিন্তু টিনটিন ছিল এদের সবার থেকে আলাদা, মানে “এ ক্লাস অ্যাপার্ট”। প্রথম কথা হল, দেশ বিদেশ ঘোরা। হাঁদা ভোঁদার কমিক্স পাক খেত ওই এক নাম না জানা আধা শহর-আধা-গ্রামে। নন্টে ফন্টে সেই এক বোর্ডিং স্কুলে। এগুলো মজাদার কমিক্স ঠিকই, কিন্তু সেই ঘুরে ফিরে কয়েকটা চরিত্র নিয়েই পাতার পর পাতা চলেছে। কিন্তু এর তুলনায় টিনটিন? এক জায়গায় চলে যাচ্ছে দুর্গম হিমালয়ে, আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছে মিশরে। মনে রাখতে হবে যে তখন ইউটিউব, ভিডিও ক্যামেরা ইত্যাদি কিচ্ছু নেই। বাইরের জগতের জানলা বলতে সেই দূরদর্শন, যেখানে দিনের বেশিরভাগ সময়ে চাষের উপকারিতা আর পুরনো বাংলা গানের প্রোগ্রাম। নইলে কিছু মোটা চশমা পরা লোকের গম্ভীর গম্ভীর সাক্ষাৎকার। এমনকি পরে বাংলা দূরদর্শনে যে “ছুটি ছুটি” প্রোগ্রামটা এল, সেখানেও কয়েকটা ভালো সিনেমা বাদ দিলে সেই পল্লীগীতি আর নীতিকথা। কে শুনবে? টিভি বাদ দিলে ছিল কিছু ম্যাগাজিন। কিন্তু যেগুলোতে বিদেশের সুন্দর ছবি থাকত, সেগুলো সব ইংরেজি আর দাম অত্যন্ত বেশি।  আজকে যেমন এখনই চাইলে ইউটিউব খুলে ইন্দোনেশিয়ার আগ্নেয়গিরির ভিডিও দেখা যায়, সেটা তখন ভাবাও যেত না। ফলে অনেক পাঠক, বিশেষত মধ্যবিত্ত ঘরের কিশোর-কিশোরী, তাদের কাছে পৃথিবীর জানালা ছিল এই টিনটিন। এই বইয়ের পাতায় ভর করেই তারা চলে যেত একবার চীন, একবার আমেরিকা, একবার প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে। এছাড়া কত রকম অ্যাডভেঞ্চার! কখনও মরুভূমিতে জিপগাড়িতে বা উটে করে, কখনও জাহাজে, আবার কখনও মহাসমুদ্রে ভেলায় ভেসে। আবার আছে সেই সমুদ্রের দ্বীপে জাপানি বাঙ্কারের ভেতরে অ্যাডভেঞ্চার। আর অবশ্যই আছে রকেটে করে চাঁদে যাওয়া। আশি নব্বইয়ের দশকে ভারতে এমন কোনও কমিক্স ছিল না যেখানে এরকম অ্যাডভেঞ্চার বা অভিযানের বর্ণনা থাকত। ময়ূখ চৌধুরীর কিছু কমিক্স হয়ত ছিল, কিন্তু সেগুলো সাদা কালো আর সেগুলোতে এরকম নির্মল আনন্দ ছিল না। বেশিরভাগ সময়ে ভারতীয় কমিক্স সেই সময়ে ওই পাড়ার মস্তানি, স্কুলের দুষ্টুমি বা কিছু উদ্ভট ভারতীয় সুপারম্যানের কাণ্ডকারখানায় ভর্তি থাকত। ফলে, আবার বলছি, টিনটিন ছিল সবার থেকেই আলাদা। কাউকে নিন্দা না করেই বলা যায় যে, সেই সময়ে আমরা টিনটিন হাতে পেলে অন্য সব কমিক্স ফেলে দিতাম। 

টিনটিনের গল্পে অবশ্যই ভিলেন থাকত। কিন্তু খুব বেশি, যাকে বলে “সেরেব্রাল” ভিলেন নয়। এমন সব অপরাধ, যেটা কিশোর মনের কাছে সহজপাচ্য। যেমন চোরাচালান, অন্য দেশের গুপ্তচরের কীর্তি বা অপহরণ। খুব বেশি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা নেই। খুন বেশ কয়েকবার হয়েছে। কিন্তু সেগুলো একদম রক্তারক্তি কাণ্ড নয়। ভায়োলেন্স সেরকম নেই। আর “পান্না কোথায়” এর মত বইয়ে তো সেভাবে ভিলেন বলেই কিছু নেই। একটা ভুল বোঝাবুঝি নিয়েই পুরো বইটা চলেছে। এই বইটা পড়লে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি হয়। অথচ, পরে ভেবে দেখলে দেখবেন যে, এই বইতে সেভাবে কোনও কাহিনীই নেই। তবে এটাও ঠিক যে, সেই সময়ে বসে হার্জে মিডিয়ার বাড়াবাড়ির একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছিলেন। পাপারাৎজিদের অত্যাচার কেমন হয়, নিজের নামে কেচ্ছা মিডিয়ায় বেরোলে মানুষ কী করে, এইসব আধুনিক জীবনের সমস্যা খুব সুন্দরভাবে উনি এই বইতে দেখিয়েছেন। 

এবার প্রশ্ন হল, টিনটিন কে? এই যে ২৩টা বই, (আর একটা অসম্পূর্ণ ধরলে ২৪) কোথাও কিন্তু টিনটিনের পদবী বলা নেই। এই “টিনটিন” নামটা ওর আসল নাম না ডাকনাম, সেটাও কেউ জানে না। তবে সেই সময়ে বহু ইউরোপীয় বা আমেরিকান কমিক্স-এ হিরোর এরকম ডাকনাম থাকত। যেমন ব্যাটম্যান। কিন্তু এই সব কমিক্সে এই হিরোদের আসল নাম কোনও না কোনও সময়ে বলাই হত। এদের একটা সম্পূর্ণ “ব্যাক স্টোরি” থাকত। কিন্তু টিনটিনের গল্পে সেভাবে ব্যাক স্টোরি নেই। টিনটিন রিপোর্টার, একটা বাড়িতে একা নিজের কুকুর নিয়েই থাকে। এটুকু জানা যায়। কিন্তু আর কিছু জানা নেই। এরপর ক্যাপ্টেন হ্যাডকের সাথে ওর আলাপ হয় এবং টিনটিনের সাহায্যেই ক্যাপ্টেন নিজের পৈত্রিক বাড়ি, মার্লিনস্পাইক হল, উদ্ধার করেন। এই থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব। এর বেশি কিছু জানা যায় না। তবে “টিনটিন” নামটা তখনকার সুপারহিরো বইয়ের জগতের অ্যান্টিথিসিস হিসাবেই বোধহয় দেওয়া হয়েছে। এরকম সাধারণ নাম দিলে পাঠকের চোখে পড়বে বেশি। টিনটিন যেন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। 

এইখানে বলে রাখা দরকার যে টিনটিনের বইয়ের বিশ্লেষণ আমার সাধ্যের বাইরে। পৃথিবীতে বহু বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে টিনটিন নিয়ে সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক চর্চা হয়। টিনটিনোলজি বলে একটা গবেষণার শাখাই আছে। অজস্র ওয়েবসাইট আছে, অজস্র গবেষণামূলক বই প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং টিনটিন নিয়ে সিরিয়াস চর্চা করতে হলে প্রচুর অন্যান্য উপকরণ রয়েছে। একটু খুঁজলেই আপনারা দেখবেন যে টিনটিন নিয়ে প্রচুর পি এইচ ডি থিসিসও হয়ে গেছে! 

যাইহোক, আমাদের আলোচনায় ফেরা যাক। টিনটিন কে? তার বয়স কত? এই নিয়ে খুব বেশি উল্লেখ এইসব বইতে নেই। এবং সেই ১৯৪০ থেকে ১৯৭০এর শেষ অবধি টিনটিনের বয়স খুব বেশি বাড়েও না। টিনটিন যেন পিটার প্যান। চির বালক বা ইংরেজিতে যাকে বলে, ম্যান বয়। টিনটিন শ্বেতাঙ্গ ঠিকই, কিন্তু ওর ধর্ম বা রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে খুব একটা খোঁচাখুঁচি নেই। ছোটবেলায় যখন পড়া হয়, তখন ওই চমক এবং অ্যাডভেঞ্চারই চোখে পড়ে। কিন্তু বড় হয়ে ভাবলে কিন্তু টিনটিনের বইয়ের বেশ কিছু সমস্যা চোখে পড়ে। প্রথম সমস্যা এই শ্বেতাঙ্গ পরিচয় নিয়ে। টিনটিনের বইতে বহু জায়গায় টিনটিনকে অন্যান্য জাতির তুলনায় উচ্চমার্গের বলে দেখানো হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের তো বেশ অপমানজনকভাবেই চিত্রিত করা হয়েছে। টিনটিন ইন কঙ্গো বইটা এই কারণে এতটা বিতর্কিত। আমাদের দেশে লোকে এইসব বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই এই বইটি নিষিদ্ধ। এমনকি একবার তো একজন আফ্রিকান ছাত্র খাস বেলজিয়ামেই এই বই নিষিদ্ধ করার জন্য আবেদন করেছিলেন। এই বইটি এখনকার পাঠকের চোখে সত্যিই খুব নিম্নশ্রেণীর। আফ্রিকার অধিবাসীদের যেভাবে এখানে দেখানো হয়েছে, সেটা কোনও বিচারেই সমর্থনযোগ্য নয়। আফ্রিকার অধিবাসীদের দেখানো হয়েছে নিম্নবুদ্ধির আধা মানুষ, আধা পশু হিসাবে। ইউরোপ থেকে “সাহেব” গিয়ে এদের রক্ষা করবে! টিনটিন এখানে ইউরোপীয় কলোনি সাম্রাজ্যের প্রতীক। আর এখন ওইরকম ইচ্ছেমত বন্য পশু হত্যার বিবরণও কেউ মেনে নেবে না। ফলে একজন ইউরোপীয় বিস্ময় বালক আফ্রিকায় গিয়ে সব তছনছ করে দিচ্ছে, এই থীম নিয়ে লেখা কমিক্স কে আর এখন ফিরে দেখবে? হার্জে নিজেও পরবর্তীকালে এই বইটি নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন।

হার্জে নামটা কি করে এসেছিল জানেন তো? এই কমিক্সের স্রষ্টার আসল নাম জর্জ রেমি। তাহলে নামের আদ্যাক্ষর কী হল? জি আর, তাই তো? উনি সই করার সময়ে এই দুটো অক্ষর উল্টে দিতেন। তাহলে কী দাঁড়াল? আর জি? সেখান থেকে হার্জে! 

টিনটিন ইন টিবেট কমিক্সে লিনে ক্লেয়ারের ব্যবহার (ছবিঋণ - টিনটিন.কম ) 

এই হার্জের হাতেই প্রথম সৃষ্টি হয় “লিনে ক্লেয়ার” স্টাইলের কমিক্স। অর্থাৎ, টিনটিনের বইয়ে যেরকম দেখা যায়। স্পষ্ট লাইনে আঁকা চরিত্র। কোনও শেডিং বা হ্যাচিং নেই। বাড়িঘর সব স্পষ্ট, এবং প্রচণ্ড ভালো ডিটেইলিং। একটা গাড়ি আঁকলে সেই গাড়ির হেডলাইটঅবধি নিখুঁত। এরকম স্পষ্ট ছবি শিশুমনে যে কি ভীষণ আলোড়ন তোলে, সেটা যারা ওই বয়সে টিনটিন না পড়েছে, তারা বুঝতে পারবেই না। অনেকে হয়ত ভাবছেন যে নিসর্গের দৃশ্য কী এই স্টাইলে ফুটবে? সেটা বোঝার জন্য টিনটিনের বইয়ে দেখুন। “তিব্বতে টিনটিন” গল্পে হিমালয়ের দৃশ্য, বা “চাঁদে টিনটিন” গল্পে চাঁদের দৃশ্যঃ এই সব কিন্তু খুব সুন্দর করেই ফুটে উঠেছে। অনাবশ্যক রঙের খেলা নেই। যেটুকু আঁকা, সেখানে স্পষ্ট রঙ। আর্টের বিচারে কতটা ভালো, বলা মুশকিল, কিন্তু শিশু পাঠকের বিচারে এটা সুপারহিট। টিনটিন যখন যেখানে গেছে, সেখানকার পরিবেশ, পোশাক বা বাড়িঘরের ছবি একদম নিখুঁতভাবে সেই কমিক্সে রয়েছে। মনে করে দেখুন “নীলকমল” গল্পে চীনা নানা দেওয়ালচিত্রের বা চীনা ল্যাম্পের ছবি। বা “ফারাওএর চুরুট” গল্পে মিশরের পিরামিডের ভেতরের হায়ারোগ্লিফিক্সের ছবি? এক কথায় অপূর্ব। সেই সময়ে বাংলায় কমিক্স আঁকছিলেন ময়ূখ চৌধুরী। ওনার আঁকার হাত খুবই ভালো। কিন্তু আমার মনে হয়েছে কিছু প্যানেলে অনাবশ্যক বেশি শেডিং। টিনটিনের গল্পে কারুর মাংসপেশির ছবি আছে? নেই। কিন্তু ময়ূখ চৌধুরীর ছবিতে মানুষ তো বটেই, ঘোড়ার অবধি পেশির অ্যানাটমি ডিটেলে দেখানো হয়েছে। 

আজকের টিনটিন চর্চায় বারবার উঠে আসে টিনটিনের বইয়ে এইসব রেসিস্ট চরিত্রচিত্রণ। যেমন, ভেবে দেখুন ভারতে যখন টিনটিন এসেছে, তখন ভারতের রাস্তা বলতেই দেখানো হয়েছে যে গরু শুয়ে রাস্তা আটকে রেখেছে। “ফারাওএর চুরুট” গল্পে দেখানো হয়েছে যে কুট্টুস একটা গরুকে তাড়া করেছে বলে স্থানীয় ভারতীয়রা তাকে বলি দিতে নিয়ে গেছে। নটরাজের মূর্তির সামনে নাকি কুকুর বলি দেওয়া হয়! ভারতীয় শাসকদের দেখানো হয়েছে বোকা বা সরলমতি হিসাবে। টিনটিন এসে তাদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবে। এটা সেই কঙ্গোর আফ্রিকানদের যেভাবে দেখানো হয়েছে, অনেকটা সেইরকম। ভারতীয় সাধুদের দেখানো হয়েছে কুচক্রীরূপে। ইউরোপে অনেক সমালোচক বলেন যে, টিনটিনের গল্পে ইহুদিদের সবসময় ভিলেন হিসাবে দেখানো হয়েছে। এমনকি এই কারণে টিনটিনের কিছু গল্প পরবর্তীকালে পরিবর্তনও করতে হয়েছে। ভারতীয়রা সেভাবে প্রতিবাদ করেনা বলে এইসব নেগেটিভ ভারতীয় চিত্র পরিবর্তন হয়নি। 

এই একই কাজ করা হয়েছে আরবদেশীয় লোকেদের দেখানোর সময়ে। আরবের লোক মানেই যেন বেদুইন, আর তারা শুধু চীৎকার করে বা বন্দুক হাতে ঘুরে বেড়ায়। ঠিক সেইভাবে বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের দেখানো হয়েছে আদিম মনোভাবাপন্ন হিসাবে। আমেরিকায় নেটিভ আমেরিকানরা টিনটিনকে একটা খুঁটিতে বেঁধে কুঠার ছুঁড়ে মারার চেষ্টা করে। “সূর্যদেবের বন্দী” গল্পে দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীরা টিনটিনকে জ্যান্ত পোড়ানোর চেষ্টা করে। এইসব থেকে পাঠকের কিন্তু এইসব আদিবাসী সম্পর্কে বিরূপ ধারণা হতে পারে। ইতিহাসের সাক্ষ্য এটাই যে, এইসব দেশে আদিবাসীরাই কিন্তু টিনটিনের মত ইউরোপীয় কলোনিস্টদের হাতে অনেক বেশি সংখ্যায় মারা পড়েছিল। কলোনিয়াল দৃষ্টিতে এককালে এইসব দেশের আদিবাসীদের এরকম অসভ্য হিসাবে দেখানো হত। হার্জের কাহিনীতে ওনার নিজের দেশ, বেলজিয়ামের সেই ইতিহাসের উত্তরাধিকারই বিধৃত হয়ে রয়েছে। 

টিনটিনের গল্পে বাস্তববাদী অ্যাডভেঞ্চারই বেশি। তবে দু’একটা গল্পে সায়েন্স ফিকশানের কিছু ছোঁয়া লেগেছে। যেমন “উল্কা রহস্য” বা “ফ্লাইট ৭১৪”। এই ফ্লাইট ৭১৪ হল টিনটিনের শেষের আগের গল্প। এটা কিন্তু বেশ দুর্বল একটা গল্প এবং সেরকম চমকও কিছুই নেই। বরং হঠাৎ করে যে ভিনগ্রহীদের নিয়ে আসা হল এখানে, সেটা কিন্তু টিনটিনের এর আগের গল্পগুলির ঐতিহ্য নষ্টই করেছে। এর থেকে “কালো সোনার দেশে”র মরুভূমিতে অ্যাডভেঞ্চার অনেক ভালো। এই “কালো সোনার দেশে” গল্পেও কিছুটা সায়েন্স ফিকশান আছে। কারণ একটা ট্যাবলেট খেলেই সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গোঁফ দাড়ি হু হু করে বেড়ে যাবে, এটা তো ঠিক আর সত্যিকারের বিজ্ঞানের রীতি নয়! সত্যজিত রায়ের “সোনার কেল্লা” গল্পে এক জায়গায় দেখানো হয়েছে যে তোপসে হাতে এই বইটা নিয়ে পড়ছে। সুতরাং সেই সিনেমায় যে টিনটিনের ভক্ত সত্যজিৎ ফেলুদার সেই মরুভূমিতে উটে চড়ার দৃশ্য দেখাবেন, সেটা তো স্বাভাবিক। “কালো সোনার দেশে” গল্পেও টিনটিনের এরকম উটে চড়ার দৃশ্য রয়েছে। অবশ্য টিনটিনের গল্পে টিনটিন পুরো আরবী সাজ করে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ায়। সত্যজিতের গল্পে অবশ্য ফেলুদা বাঙালি পোশাকেই উটে চড়েছে!

সাহিত্যে বলা হয় যে ভালো হিরো হতে গেলে লাগে ভালো ভিলেন। টিনটিনের গল্পে সেরকম ভিলেন হল রাস্তাপপুলাস। মানুষপাচার সহ নানা অপকর্ম করে বেড়ান এই বিশাল ধনী ব্যবসায়ী। অবশ্য ফ্লাইট ৭১৪ গল্পে এসে ইনি, যাকে বলে, নিজের নেমেসিসের মুখোমুখি হন। কিন্তু এটা বাদ দিলে টিনটিনের চারপাশের অনেক লোকই কিন্তু, যাকে ইংরেজিতে বলে, বাফুন। দুই যমজ পুলিশের বোকামো, ক্যাপ্তের হ্যাডকের নির্বুদ্ধিতা ইত্যাদির জন্য টিনটিনকে আরও বেশি বুদ্ধিমান মনে হয়। কিন্তু চারপাশের এইসব অদ্ভুত বোকাদের দলের কাণ্ড বাদ দিলে দেখা যাবে যে, টিনটিন অনেক সময়েই যে সব কাজ করেছে, সেগুলো সাধারণ বুদ্ধির কাজ। কিন্তু চারপাশের জোকারদের জন্য সেইসব কাজকেই মনে হচ্ছে অসাধারণ। ভারতীয় বা বাংলা সাহিত্যে অনেক সময়েই অতিপ্রাকৃত কিছু একটা এনে গল্পের শেষটা মিলিয়ে দেওয়া হয়। সেই চেষ্টা টিনটিনের গল্পে খুব বেশি নেই। একমাত্র বলা যায় যে, “তিব্বতে টিনটিন” গল্পে ইয়েতিকে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে সেটাও একদম গল্পের শেষে। মমির অভিশাপ গল্পেও একটু অতীন্দ্রিয় শক্তির উল্লেখ রয়েছে, যেখানে পুতুলের গায়ে পিন ফুটিয়ে সেই অভিযাত্রীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এরকম দুএকটা বিচ্যুতি বাদ দিলে বাকি গল্প মোটামুটি বাস্তববাদী। 

বিপ্লবীদের দঙ্গলে - আনন্দ প্রকাশনী (ছবিঋণ - উইকিপিডিয়া) 

টিনটিনের গল্পে আরেকটি সমস্যা হল যে, কোনও উল্লেখযোগ্য মহিলা চরিত্র নেই। তবে এটা সেই সময়ের অনেক শিশুসাহিত্যের সম্পর্কেই বলা যায়। মাত্র গত কুড়ি কি তিরিশ বছর হল শিশুসাহিত্যে মহিলা পুরুষ ব্যালেন্স এসেছে। নইলে সত্যজিতের ফেলুদা গল্পে বা বিভূতিভূষণের “চাঁদের পাহাড়” গল্পেও মহিলা চরিত্র নেই। টিনটিনের শেষ গল্প, “বিপ্লবীদের দঙ্গলে” অনেক কারণেই একটু স্বতন্ত্র। প্রথমত, এই গল্পে রাষ্ট্রবিপ্লবের মত থীম নিয়ে কাহিনী এগিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই গল্পে টিনটিন সাহায্য করেছে এই শর্তে যে ক্ষমতা দখলের পর প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না। আর তৃতীয়ত, এই গল্পে প্রথম একটু গুরুত্বপূর্ণ মহিলা চরিত্র রয়েছে, আলকাজারের স্ত্রী! রাষ্ট্রবিপ্লবে, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে যে সাধারণ মানুষের কোনও লাভ নেই, সেটাও খুব সুন্দর করে বোঝানো হয়েছে বইয়ের শেষে। রাজার নাম পাল্টে গেছে। কিন্তু সেই গরিব লোকেরা যে আবর্জনার মধ্যে বাস করত, সেখানেই এখনও বাস করছে, এটা দেখানো হয়েছে। একটা শিশুসাহিত্যের বইয়ে এরকম ছবি খুব বেশি কিন্তু দেখা যায় না। 

যত দিন যাবে, ততই আগের সাহিত্যের মূল্যায়ন পালটাবে। এতে দোষের কিছুই নেই। কিন্তু আশির এবং নব্বইয়ের দশকের পশ্চিমবঙ্গের কারুর ছোটবেলা টিনটিন ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। সেই সময়ে আমাদের চেনা অনেকের ডাকনাম ছিল টিনটিন। কলকাতায় দুএকটি দোকান হয়েছিল “টিনটিন” নামে। স্কুলে বন্ধুদের মধ্যে আলোচনার একটা বড় বিষয় ছিল টিনটিন। ‘অমর চিত্রকথা’ আমরা সবাই ওই সময়ে পড়েছি। কিন্তু সেটা নিয়ে কোনদিন কোনও আলোচনা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আসলে গল্প, ছবি আঁকা আর কাহিনীর চমক মিলিয়ে টিনটিন এমন একটা প্যাকেজ ছিল, যেটার আকর্ষণ কেউ এড়িয়ে যেতে পারত না। টিনটিনকে সেই সময়ে সব কিশোর ভাবত নিজেদের থেকে একটু বড় দাদা, যে তাদের মনের সব ইচ্ছে পূরণ করতে পারে।  টিনটিনের চরিত্র এমনভাবে আঁকা হয়েছিল যে ওর মুখটা যতটা ইউরোপীয়, ততটাই বাঙালি বা চীনা। ফলে সব কিশোর টিনটিনের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পারত। 

 

0 Comments
Leave a reply