ওরা পাঁচ জন বন্ধু। সুজন, লেবু, ভোঁদা, চিকন আর ঝন্টু। অনেক দিন হল, সেই ছোটবেলা থেকে, ওদের সঙ্গে সুজনের জীবন জুড়ে গেছে। বন্ধুদের ছেড়ে ও থাকতে পারে না। এমনকি ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারে না। একদিন বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়া হলে ওর চারদিক শূন্য মনে হয়।
এবছর প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আজ ছুটির দিন হওয়ায় খাওয়ার পর সারা দুপুর ঘরের মেঝেতে শুয়ে একবার ডান হাত আর একবার বাঁ হাতে পাখা নাড়াতে নাড়াতে দু'হাতই ব্যথা হয়ে গেছে। সুজন অপেক্ষা করছিল কখন সাড়ে তিনটে চারটে বাজবে আর বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে যাবে। ওদের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই। রাতে হ্যারিকেন আর হাত পাখাই ভরসা।
সুজনের ক্লাস এইট। বাবা ডি. এম. অফিসের পিওন। মা নিপাট গৃহবধূ। মাকে ও কখনও কোনও কিছু নিয়ে অভিযোগ বা প্রতিবাদ করতে দেখেনি। শোকে দুঃখে অভাবে অনটনে মা শুধুই কাঁদে। মায়ের কান্নায় ওর বুক পুড়ে যায়। কিন্তু ও কী করবে?
শহরের বুকে ওদের দু'কামরার একটা পুরনো একতলা ছোট বাড়ি আছে। বাড়িটা বাবা পৈতৃক সূত্রে পেয়েছে। ইটের পাকা বাড়ি হলেও এখন জরাজীর্ণ দশা। বহুকাল বাড়ি সারানো হয়নি। সুজন বোঝে বাবার সে সামর্থ নেই। বর্ষাকালে ছাদের ফাটল দিয়ে ঘরের মধ্যে জল পড়ে। দেওয়াল থেকে চুনবালির পলস্তরা খসে ঝুরঝুর করে বালি ঝরে পড়ে। আলকাতরা লেপা দরজা জানালাগুলোয় ভিতরে ভিতরে ঘুণ ধরেছে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলে মনে হয় অন্ধকার গিলে খেতে আসছে।
বাড়ি থেকে বেরোনোর দরজার মাথায় একটা মাধবীলতার ঝাড় আছে। শুনেছে ঠাকুরদা শখ করে লাগিয়েছিল। ঠাকুরদার মুখ এখন মনে পড়ে না। ওর কোন ছেলেবেলায় ঠাকুরদা দেহ রেখেছে। এখন সেসব ঝাপসা। মাধবীলতার ঝাড়ের পাশেই ওদের খাটা পায়খানা। বাড়িতে ঢোকা আর বেরোনোর সময় পায়খানা আর মাধবীলতা ফুলের গন্ধ মিলেমিশে নাকে ধাক্কা মারে। এই বয়সেই সুজন বুঝে নিয়েছে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হলে তাড়াতাড়ি ওকে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে রোজগারের ধান্দায় নেমে পড়তে হবে।
ওদের তো তাও শহরের মধ্যে একটা পাকা বাড়ি আছে, লেবু, চিকন, ঝন্টুদের তাও নেই। ওরা থাকে শহরের একপ্রান্তে খোড়ো ঘরে। ভোঁদা তো থাকে বস্তির মধ্যে একটা ঝোপড়িতে। ওর বাবা হকার। কাঁধে ঝোলা আর গলায় মালার মতো নানান জড়িবুটির প্যাকেট ঝুলিয়ে বাজারে, রাস্তায়, কোর্ট কাছারির সামনে হেঁকে বেড়ায় — হাতকাটা তেল, দাদের মলম, দাঁতের মাজন, ইলেকট্রিক লোশন, ইঁদুর মারার বিষ। ওতে আর ক'টাকা রোজগার হয়। ভোঁদাই বলে — সংসার চলে না। দুইডা ভাতের লগে বহুত মেহনত করতে হয়।
ভোঁদার পড়াশোনায় মাথা কম কিন্তু মজবুত চেহারা। শরীরে প্রচণ্ড শক্তি। কয়েক বছর নিষ্ফল চেষ্টার পর পড়াশোনায় পুরোপুরি ইস্তফা দিয়ে দিয়েছে। বলেছে — ও হালার ল্যাখাপড়া আমার দ্বারা হইব না। ওর পরে এক ভাই আর বোন। ওর মা মুড়ি ভাজে আর সকলে মিলে খবরের কাগজের প্যাকেট বানায়। ভোঁদা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো খবরের কাগজ কিনে আনে, প্যাকেট তৈরি হয়ে গেলে সেগুলো কয়েকটা বাঁধা দোকানে দিয়ে আসে। এছাড়া মায়ের ভাজা মুড়ি টিন ভর্তি করে বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দেয়। তবু ও সব সময় হাসিখুশি থাকে। কী করে যে থাকে!
দেওয়ালের তাকে বাবার একটা টাইম পিস থাকে। সেদিকে তাকিয়ে পৌনে চারটে বাজে দেখে সুজন তড়াক করে উঠে পড়ে। বেরোতে বেরোতে মাকে বলে — মা, আসছি।
মা বলল — এসো। ফিরতে বেশি দেরী কোরো না বাবু।
রাস্তায় বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরে একটু হাঁটলে বড় রাস্তা। মানুষের শরীরের প্রধান ধমনীর মতো রাস্তাটা শহরের বুকের উপর দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে চলে গেছে। সেই রাস্তা থেকে শাখাপ্রশাখার মতো চওড়া আর সরু পথ, উপপথ, গলিঘুঁজি বেরিয়ে দু'পাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই পথ আর উপপথের ধারে ধারে গড়ে উঠেছে এই শহরের জনবসতি। সুজনদের বাড়ির কাছে শহরের মাঝামাঝি এই বড় রাস্তার উপর সীতারাম বেনারসিদাস মেমোরিয়াল ধর্মশালা বা শুধুই ধরমশালা। এই শহরের কোনও একজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী তার কোনও পূর্ব পুরুষের স্মৃতি রক্ষার্থে এই বিরাট তিনতলা বাড়িটা তৈরী করেছিলেন। গেটের মাথায় বড় বড় অক্ষরে লাল সিমেন্টে লেখা ধর্মশালার নাম এখনও চোখে পড়ে।
এই মফস্বল শহরটাকে শহর না বলে একটা গঞ্জ বলাই ভালো। কয়েকটা দোকান আর অফিস - আদালত ছাড়া অন্য কোনও অর্থনৈতিক উদ্যোগ বিশেষ নেই। লোকেরা অধিকাংশই গরীব, চাষবাসের উপর নির্ভরশীল। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য তাদের সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়। কয়েকজন ধনী লোকের কয়েকটা জমকালো বাড়ি থাকলেও, বাকী বাড়িগুলো রংচটা, জীর্ণ আর ধুলিধূসর। খড় আর টিনের চালার বাড়িও কম নেই। পুরনো আমল থেকে এখানে একটা মিউনিসিপ্যালিটি আছে, তবু অধিকাংশ রাস্তা আর নর্দমা এখনও কাঁচা। এখানে সবে রাস্তায় বিজলি বাতি জ্বলতে আরম্ভ করেছে। কিছু ধনীর বাড়িতে বিজলি আলো আর পাখা ঢুকে পড়লেও, বেশির ভাগ বাড়িতে রাতে হ্যারিকেন বা লম্ফ জ্বলে।
এখানে মানুষের জীবন চলে ঢিমিয়ে ঢিমিয়ে। সারাদিন পাখিদের মতো ধীরেসুস্থে দানা খুঁটে সন্ধ্যায় সবাই ঘরে ফেরে। এত দারিদ্র্য ও কষ্টের মধ্যেও মনের প্রসন্নতা মানুষ হারিয়ে ফেলেনি। রাস্তায় চেনা কারও সঙ্গে দেখা হল দু'দণ্ড দাঁড়িয়ে ভালোমন্দের খবর নেয়। কিংবা চায়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ খোশগল্প বা হাসি-তামাশা করে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুজন ধর্মশালাকে বাঁয়ে রেখে শিবপুকুরের দিকে পা বাড়াল। শিবপুকুরের পাশে শিব মন্দির। সেই মন্দিরের দাওয়ায় বসে ওরা আড্ডা দেয়। এখানেই ওদের জমায়েত হয়। যোগাযোগের ঠিকানাও এটা। সুজন ভাবল — এহ্ গরমের ঠেলায় আজ বেরোতে দেরী হয়ে গেছে। ওরা এতক্ষণে শিবপুকুরে এসে গেলে কেলো হবে। কেউ ওকে ছেড়ে কথা বলবে না।
পিছন থেকে ঝন্টুর গলা শুনতে পেল । ডাকছে — সুজু, অ্যাই সুজু! দাঁড়া।
দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরে সুজন দেখল ঝন্টু হনহন করে ওর দিকে আসছে। লক্ষ করল আজ ধর্মশালা সেজেগুজে উঠেছে। মাঝে মাঝেই এরকম সেজেগুজে ওঠে। নানারকম উৎসব অনুষ্ঠান লেগে থাকে। কখনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বেশিরভাগ সময়ই বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠান। তখন ধর্মশালা আলোয় ঝলমল করে। গেটের সামনে রঙিন কাপড়, আলো আর ফুল দিয়ে সাজানো হয় তোরণ। তোরণের কপালে লাগানো হয় হিন্দিতে স্বাগতম বা ইংরেজিতে ওয়েলকাম লেখা বোর্ড। সেখানে অনেক গাড়ি ও মানুষের ভিড় জমে যায়। সেইসঙ্গে কুকুর ও ভিখারিরাও জুটে যায়। অনুষ্ঠানগুলো প্রায় সবই মাড়োয়ারি, পাঞ্জাবী বা অন্য কোনও অবাঙালী সম্প্রদায়ের। এখানকার বাঙালীদের মধ্যে এখনও বিয়ে বাড়ি বা অনুষ্ঠান বাড়ির ধারণা গড়ে ওঠেনি। তাদের অনুষ্ঠান হয় বাড়ির ছাদে অথবা ফাঁকা জায়গায় ম্যারাপ বেঁধে। তাদের মনোভাব ছিল — ওদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী? আমরা আমাদের মতো আছি, ওরা ওদের মতো থাক। এই ধরনের ফূর্তি আর আড়ম্বর এখানকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে মানানসই নয়।
ধর্মশালার সামনে সুজনের পাশে এসে ঝন্টু একবার থমকে দাঁড়াল — শালাদের কত ঘ্যাম দেখ। জায়গাটাকে এক্কেবারে ম্যাজেন্টাস বানিয়ে দিয়েছে।
ঝন্টু ওই রকমই। সব সময় কোডে কথা বলে। ওর কোডগুলোও খুব লাগসই হয়। মনের কথা স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। সুজনরা কেউ অমন করে বলতে পারে না। তাই ওর কথায় সবাই মজে যায়।
ঝন্টুর ধুলো-ভরা খালি পা। তবু সুজনের একটা হাওয়াই চপ্পল আছে। সেটারও স্ট্র্যাপ ছেঁড়া। সেফটিপিন মেরে এখনও চালাচ্ছে। আর বেশি দিন চলবে বলে মনে হয় না। বাবার কাছে নতুন স্ট্র্যাপ কেনার টাকা চাইতে সঙ্কোচ হয়। বাকীদের সকলের খালি পা। তবে এনিয়ে কারও মনে কোনও ক্ষোভ নেই। খালি পায়ে থাকাটাই সকলে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। ঝন্টুদের খোড়ো মাটির বাড়ির সামনে একটা জামির গাছ আছে। একবার সুজন খেয়ে দেখেছে। দারুণ টক। লবণ দিয়ে খেতে হয়। কোর্টের কাছে ঝন্টুর বাবার ঘুপচি মতো চায়ের দোকান। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঝন্টু বাবার দোকানে বসছে। দোকানে বসলেও ও প্রতিদিন বিকেলে আসে। ফুটবল খেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তারপর বাড়ি ফেরে। ফুটবল খেলার সময় ঝন্টু একটা শাড়ির পাড় বের করে অ্যাঙ্কলেটের মতো পায়ে পেঁচিয়ে কষে বেঁধে নেয়, খেলা শেষে আবার রিলের মতো গুটিয়ে পকেটে রেখে দেয়। আসল অ্যাঙ্কলেট কেনার পয়সা কোথায়?
ওরা দু'জন শিবপুকুরে পৌঁছে দেখল ভোঁদা আগেই এসে মন্দিরের দাওয়ায় বসে আছে। ওদের দেখে ক্ষুব্ধ গলায় বলল — তুরা আজও দেরী করলি? আমি বইলা কখন থিকা বইয়া আছি। লেবু আর চিকনা হালায় গেল কই?
বলতে বলতে লেবু ও চিকন এসে হাজির। ওদের সঙ্গে পাড়ার আরও কিছু ছেলে এসেছে। লেবু বেজার গলায় বলল — সবাইকে হাঁকডাক করতে দেরী হল। চল, মাঠে যাই। আর দেরী করার মানে হয় না। লেবুর হাতে ফুটবল। ওরা হইহই করে হাসপাতালের মাঠে খেলতে চলল।
চিকনের মাথা খুব পরিষ্কার। স্কুলে যায়। ওর বাবা নেই। মা, দাদা আর দুই বোন আছে। দাদা একটা চাকরি করে। দাদার রোজগারে ওদের সংসার চলে। চিকন বুঝে ফেলেছে কিছু করতে হলে লেখাপড়াটা ওকে চালিয়ে যেতেই হবে।
লেবুকে ওরা একজন ফুটবল প্রতিভা বলে মনে করে। সুজন যেটুকু ফুটবল খেলা শিখেছে, তা লেবুর কাছে। স্কুলে খেলা না থাকলে লেবু প্রতিদিন বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে আসতো। খেলাটা ওর ভিতরে ছিল। পড়াশোনায় মোটামুটি। স্কুলে যেতো ফুটবল খেলার জন্য। স্কুলের ফুটবল টিমের ও একজন নির্ভরযোগ্য ফুটবলার। ইন্টারস্কুল তো খেলেই, জেলা স্তরে খেলে এর মধ্যেই ও স্পটারদের নজরে পড়ে গেছে। সুজনের বিশ্বাস ও একদিন রাজ্য স্তরে খেলবে। খেলার সময় সারা শরীর দিয়ে কী আশ্চর্য কৌশলে বলটা আগলে ও মাঠ পাড় করে গোলে ঢুকিয়ে দেয়, সকলে সেটা হাঁ করে দেখে। বলটা ওর শরীরময় একটা পোষমানা প্রাণীর মতো ঘোরাঘুরি করে। বল আর লেবুর শরীর একই ছন্দে ছোটে, লাফায় আর পাক খেয়ে বিপক্ষ খেলোয়াড়দের পাশ কাটিয়ে নাচতে নাচতে বিপক্ষের গোলে ঢুকে যায়। সুজনরা সকলে ফুটবলের পিছনে মরিয়া হয়ে দৌড়ে ঘাম ঝরাতো, এটা যেন ওদের কাছে একটা লড়াই। দাঁতে দাঁত চেপে কোনও কিছুর সঙ্গে হেস্তনেস্ত করে ফেলার একটা প্রচণ্ড জেদ। এভাবেই ওরা ভিতরের যাবতীয় তিক্ততা, ক্ষোভ আর না-পাওয়ার গ্লানি শরীরের ঘামের মতো ঝরিয়ে দিতে চায়।
দুই
খেলা শেষে ওরা পাঁচজন আবার শিবপুকুরের মন্দিরের দাওয়ায় এসে বসে। আসার সময় দেখেছে ধর্মশালা আলোয় ঝলমল করছে। রঙিন কাপড়ে তৈরী আলোকিত তোরণের সামনে অনেক গাড়ি আর সুসজ্জিত মানুষজন দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছে, হাসাহাসি করছে। ওদের শরীরের ঘাম পুকুরের জলের উপর দিয়ে বয়ে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ায় একটু একটু করে শুকোয়। এই সময় ওদের খুব খিদে পায়। কিন্তু কী খাবে? সুজন জানে কারও পকেটে কোনও রেস্ত নেই যে কিছু কিনে খাবে।
সেদিন আকাশে চাঁদ ছিল না। তারাদের ক্ষীণ আলো এসে পুকুরের জলে এসে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে ভোঁদা কেমন হেসে বলল — হালারা রাইতকে কেমন দিন কইরা ফ্যালাইছে।
চিকন গরগরে গরম গলায় বলল — সব কালো টাকা বুঝলি। ব্ল্যাক মানি। নইলে এভাবে কেউ টাকা ওড়ায়?
লেবুর গলায় ঝাঁজ ফুটে উঠল — সাদা হোক, কালো হোক, ওদের টাকা আছে, আমাদের নেই। কোনও দিনও হবে না। এটাই তফাৎ, বুঝলি এটাই তফাৎ।
সুজন আলো-অন্ধকারের মধ্যে লেবুর মুখ দেখার চেষ্টা করছিল। ক্ষোভে যন্ত্রণায় ও এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছে না। ওর বাবা মাতাল। রোজগারের একটা অংশ চলে যায় মদে। ওদের সংসারে অনন্ত অভাব। খেলার জগতে রোজগারের একটা উপায় পেয়ে গেলে ও বেঁচে যায়। প্রাণপণে ও সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সুজন লেবুকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে বলল — টাকা কীভাবে হয় কে জানে। শুধু এটুকু জানি কিছু লোকের টাকা আছে আর বেশির ভাগেরই নেই।
ঝন্টু এবার ভারিক্কি চালে বলল — সে জন্যে অনেক ক্যারিকুচু আর অ্যান্টিফস লাগে গুরু।
ঝন্টুর কথায় সকলে হো হো করে হেসে উঠল। এমনকি লেবুও। সেই হাসিতে আড্ডার এতক্ষণের গুমোট ভাবটা কেটে গেল।
ভোঁদা হাসতে হাসতে ঝন্টুকে বলল — তুই হালায় এক্কেরে এঁটেল খইচ্চর।
লেবুকে হাসতে দেখে সুজন বলল — তুই অত সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? আমরা জানি কোনও দিন আমাদের টাকা হবে না — ব্যাস। কোনও রকমে হেসেখেলে জীবনটা কেটে গেলেই আমরা খুশি।
নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে ভোঁদা বলল — কথাডা ঠিক কইছস সুজু। গতর খাটামু খামু। ইয়ার থিক্যা বেশি আর কী চাওন লাগে?
সুজনের মনের কথাটাই লেবু মুখ ফুটে বলে ফেলল — খুব খিদে পেয়েছে রে।
লেবুর কথায় সবাই চুপ। কেউ কোনও কথা বলছে না। দুপুরে খাওয়ার পর কারও পেটে আর কিছু পড়েনি। তার উপর ফুটবল খেলার পরিশ্রম। সবার পেটেই এখন গড়ুরের ক্ষুধা। খিদে যে কী এটা ওরা সকলেই জানে। ছোট থেকেই খিদেকে সঙ্গী করে আজ এই বয়সে এসে পৌঁছেছে। ছোটবেলায় এর ওর বাগান থেকে ফলপাকুর পেড়ে খেয়েছে। বাগানের মালিক গালমন্দ করলেও গায়ে না মেখে ওরা হি হি করে হেসেছে। অন্যরা এগুলো ছেলেমানুষের কাণ্ড বলে মনে করতো। সব ছেলেরাই এমন করে। ভোঁদা গিরগিটির মতো তরতর করে গাছে উঠে বাতাবি লেবু, জামরুল, আম, আতা যা পেতো পেড়ে আনতো। লেবুও ভালো গাছে চড়তে পারে। যেদিন যা পাওয়া যেতো ওরা পাঁচজনে তারিয়ে তারিয়ে খেতো। এখন ও রকম ছেলেমানুষি করার বয়স আর ওদের নেই, কিন্তু খিদেটা আছে, বরং অনেক গুণ বেড়ে গেছে। খিদেটা ওদের জীবনে একটা স্বাভাবিক ঘটনা। জন্মাবধি ওরা এটা দেখে এসেছে। তাই খিদে নিয়ে ওদের কোনও আদিখ্যেতা নেই।
লেবুর কথায় শিবপুকুর এখন নিশ্চুপ। অন্ধকারে আলো ফেলতে ফেলতে রাস্তা দিয়ে দু'একটা গাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে। তারই যা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সকলে উশখুশ করছে। দমবন্ধ এই অস্বস্তিকর স্তব্ধতা ওদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। সেই সময় ঝন্টু ফস করে বলে উঠল — গুরু, হাবলার দোকান থেকে কিছু চুরি করে আনবো?
ভোঁদা এবার অন্ধকার চিরে চিৎকার করে উঠল — অ্যাই চোপ, একদম চোপ। আর একডা কথা কইলে কাইটা ফেলামু। আমরা কি চোর?
রাস্তায় নেমে একটু ডানদিকে গেলে হাবলের চপ-মুড়ি পাউরুটি-বিস্কুটের দোকান। ঝন্টু সেটারই ইঙ্গিত করছিল। ভোঁদার ধমকে একবারে নুইয়ে গেল।
লেবু বলল — মনে নাই ছোটবেলায় চড়ুইভাতি করতে গিয়ে তুই কী করেছিলি। ডিমওয়ালা ধরতে পারলে তোর হাত পা ধড় মুণ্ডু সব আলাদা করে দিতো।
ঝন্টু নিখুঁত হাতসাফাই করতে পারতো। বছর চারেক আগের কথা। তখন ওরা আরও ছোট। সেটা পৌষ মাস। মাথায় খেয়াল চাপল শহর থেকে কিছু দূরে একটা আমবাগানে ওরা চড়ুইভাতি করবে। চাল ডাল তেল নুন যে যার বাড়ি থেকে একটু করে নিয়ে আসবে। জ্বালানির কাঠকুটো এদিক ওদিক থেকে জোগাড় হয়ে যাবে। মাংস কেনার পয়সা নেই। শুধু পাঁচটা ডিম কিনতে হবে। ডিম কেনার সময় কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। বাজার থেকে বেরিয়ে ঝন্টু পকেট থেকে আরও তিনটে ডিম বের করেছিল।
লেবু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল — কোথায় পেলি?
ঝন্টু দাঁত বের করে হেসেছিল — হাত কা সাফাই গুরু।
শুনে ভোঁদা দাঁত কিড়মিড় করে বলেছিল — চুরি করছস?
ঝন্টু ভয় পেয়ে বলেছিল — এগুলো সবাই ভেজে খাবো।
ভোঁদা আরও রেগে গিয়ে বলেছিল — মাইরা হালার বদন বিগরাইয়া দিমু। যা, এহনই ফিরৎ দিয়া আয়।
ঝন্টু ডিমগুলো কীভাবে ফেরত দিয়েছিল ওরা জানে না, তবে ওকে বুঝিয়েছিল — গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া এক জিনিস, কিন্তু দোকান থেকে কিছু চুরি করা মারাত্মক অপরাধ। ধরা পড়লে বিপদে পড়তে হবে।
কিছু সরিয়ে ফেলার জন্য ঝন্টুর হাত সর্বদা নিসপিস করতো। কিন্তু বন্ধুদের ভয়ে নিজেকে সামলে রাখতো। ওর মাথায় সব সময় নানা রকম ফন্দিফিকির গিজগিজ করতো। ও হাত সাফাইয়ের নমুনা আর একবার দেখিয়েছিল বড়বাগানের মেলায়। বিশাল মেলা। শুধু শহরের লোকই নয়, দূর দূর গ্রাম থেকেও লোকেরা আসে এই মেলা দেখতে। মেলায় অনেক রকম দোকান বসে। গৃহস্থালীর নানা রকম জিনিস, কাঠের দরজা জানালা, এমনকি গরুর গাড়ির চাকাও মেলায় পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে সার্কাস, নাগরদোলা, বিদ্যুৎ কন্যা, মরণ কুয়ো, ম্যাজিক এসব তো থাকেই।
খেলার পর ওরা পাঁচজন মেলা দেখতে গিয়েছিল। খেলা শেষে ওদের প্রচণ্ড খিদে পায়। মিষ্টি আর নানা রকম খাবারের দোকানগুলোকে দেখে খিদে আরও বেড়ে যাচ্ছিল। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ওরা একটা চানাচুরের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। একটু দাঁড়িয়েই ঝন্টু কেমন ছটফট করে উঠল। ওর চোখমুখ তখন অন্যরকম দেখাচ্ছিল। বলল — অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে থকে গেছি। চল, কোনও ফাঁকা জায়গায় গিয়ে একটু বসি। ওর এমন আচরণে সবাই বিস্মিত । তারপর কিছু দূরে গাছের নীচে গিয়ে সকলে গিয়ে বসতে ঝন্টু জামার তলা থেকে বড় সাইজের একটা চানাচুরের প্যাকেট বের করে বলে — নে খা। দারুণ খিদে পেয়েছে মাইরি।
সকলে ঝন্টুর দিকে অবাক চোখ তাকায়। চিকনই প্রথম বলে — ফের চুরি করেছিস!
সঙ্গে সঙ্গে ঝন্টু দু'হাতে কান ধরে বলেছিল — মাইরি বলছি, খিদেতে মাথার ঠিক ছিল না। খিদেটা মাথায় চড়ে কেমন ঝিনচাক করছিল। জীবনে আর কখনও করবো না। এবারের মতো তোরা আমাকে মাফ করে দে।
চানাচুর চিবোতে চিবোতে বিমর্ষ গলায় ঝন্টু আবার বলে — শালা পেটের জ্বালা। আর কিছু নয়, পেটের জ্বালায় একটু আধটু চুরি করে খেতাম, এই কিরা কেটে বলছি আজ থেকে সব বন্ধ। আর কখনও এ গোখুরি কাজ করবো না। তবে একটা কাজ আমরা করতে পারি।
ও আর কী বলে শোনার জন্য সকলে ওর মুখের দিকে তাকায়। কাঁদো কাঁদো গলায় ঝন্টু বলল — আমরা তো ভিখিরি। ভিখিরিরও অধম। আমরা ভিক্ষা করবো।
শুনে সুজনের গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। এ কাজ ওরা কেমন করে পারবে। দেখল ভোঁদা ঝন্টুর দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। লেবু আর চিকন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ওদের দেখে সুজনের ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছিল। খিদেয় ওর পেটও আগুনের মতো জ্বলে। কিন্তু চুরি তো দূরের কথা, ভিক্ষা করার কথাও ও কখনও চিন্তা করতে পারে না। অথচ মেলায় কত রকমের খাবার দোকান। বড় বড় লোহার চাটুতে মোগলাই পরোটা ভাজা হচ্ছে। ওরা কখনও মোগলাই পরোটা খায়নি। ডেভিল চপ, কবিরাজি কাটলেট কিংবা কাপের আইসক্রিমও খায়নি। ওগুলো এখানে কেবল মেলার সময়ই আসে, অন্য সময় আসে না। দেখলে পেটের মধ্যে খিদে ঘুরপাক খায়। পকেটে একটা পয়সা নেই, অথচ মোগলাই পরোটা, ডেভিল চপ, কবিরাজি কাটলেট, আইসক্রিম — সব খেতে ইচ্ছা করে। একদিন গ্যালারিতে বসে সার্কাস দেখারও ইচ্ছা । কিন্তু ভিক্ষা কী করে করবে?
চানাচুরের প্যাকেট কীভাবে ফেরত দেবে ঠিক করতে না পেরে সেদিন চুরির চানাচুর সকলে ভাগ করে খেয়েছিল। চানাচুর খাওয়া শেষ করে হাতের প্যাকেটটা গুলি পাকিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে হঠাৎ লেবু চেঁচিয়ে উঠেছিল — শালা আমরা সবাই ভিখিরির বাচ্চা। ভিখ্ মাঙবো তাতে লজ্জা কিসের? লজ্জার আমি গুষ্টি বেচি।
সেই জীবনের প্রথম আর শেষ সুজনরা বড়বাগানের মেলায় ভিক্ষা করেছিল। মেলায় চেনা আধ-চেনা অনেক লোকের সঙ্গে ওদের দেখা হচ্ছিল। প্রথম প্রথম লজ্জা লাগলেও ক্রমশ ব্যাপারটা ওদের কাছে একটা খেলার মতো হয়ে উঠেছিল। ওদের বয়স কম। কেউই ভিখারির মতো দেখতে নয়। অনেকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও, ওদের ভিক্ষা করার উদ্দেশ্য জেনে অনেকেই হেসে কিছু কিছু করে দিলেও সুজনের নিজেকে খুব হীন বলে মনে হচ্ছিল। অন্য বন্ধুরা গ্রাহ্য না করলেও ওদের হাসিতে যে অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য মাখানো ছিল সুজন সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল। মেলা বলেই ওরা উদার হয়ে পয়সাকড়ি দিচ্ছে, অন্য সময় একটা পয়সাও দেবে না। আধ ঘন্টার মধ্যে ওদের ভালোই রোজগার হয়, তাতে সার্কাস দেখা আর মোগলাই পরোটা ও ডেভিল চপ দুইই খাওয়া হয়েছিল। ফেরার সময় সুজন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল মরে গেলেও জীবনে ও আর কোনও দিন কারও কাছে হাত পাতবে না।
ওদের জীবন ছিল পরিবর্তনহীন, একই রকমভাবে একই গতিতে বয়ে যাচ্ছিল। উত্তেজনার লেশমাত্র ছিল না। এভাবেই হয়তো ওরা হতদরিদ্র জীবনে সামান্য উত্তেজনা আনতে চাইতো। কিন্তু উত্তেজনার সেই আয়োজনটুকুও হতো খুব নগণ্য। হয়তো নিন্দাজনক আর হাস্যকর। বড় জীবন, বড় ভাবনা ছিল ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এইভাবে ওরা একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে একটু একটু করে নেমে যাচ্ছিল। তখনও সেটা বোঝার মতো বয়স সুজনের হয়নি।
ওরা সকলেই প্রায় সমবয়সী। হয়তো দু'এক বছরের ছোট বড় হতে পারে, কিন্তু তাতে কিছু আটকায়নি। যেমন ভোঁদা সুজনের থেকে দু'বছরের বড়। একদিন সুজন ভোঁদাকে বলেছিল — আমরা হলাম রাস্তার ধারের আগাছার মতো। নিজে নিজে যেমন তেমনভাবে বেড়ে উঠেছি। সবাই আমাদের মাড়িয়ে যাবে বুঝলি।
ভিতরের কষ্ট চেপে তিক্ত হেসে চিকন বলেছিল — আমার কিন্তু মনে হয় রাস্তার পাশে পড়ে থাকা আবর্জনার মতো আমাদের জীবন। সবাই পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, পা দিয়েও কেউ মাড়াবে না।
ঝন্টু হাসে। মজা তামাশা করে সব সমস্যা উড়িয়ে দিতে চায়। দাঁত বের করে হেসে বলেছিল — দ্যাখ, আমরা ক্যান্টাকারাস ছুঁচোদের মতো বেঁচে আছি আর চাদ্দিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছি।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে লেবু বলেছিল — আমাদের ভবিষ্যৎ কী বল তো?
সুজন মাথা নেড়েছিল — জানি না। ভাবতেও ভয় হয়। মনে হয় চারদিক অন্ধকার।
তারপর শিবমন্দিরের দাওয়ায় ওরা স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। কেউ কোনও কথা বলছিল না। একটু উশখুশ করে ভোঁদা বলেছিল — একডা কথা কমু?
চিকন বলেছিল — বল।
— আমি হল্যাম গিয়া একডা আহাম্মক। তোগোর মতো ভাবতে পারি না, কইতেও পারি না। মনে ভাবি একমুঠ ভাত জুইটা গ্যালেই আমি খুশি। ইয়ার বেশি কিছু চাই না। কিন্তু ভাতডাই যে জোটে না ভাই।
ভোঁদা সেদিন একটা ভয়ঙ্কর সত্যের মুখে সকলকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। যার উত্তর কারও জানা ছিল না।
তিন
এরপর একটা বছর পেরিয়ে গেছে। শহরে লোকজন আর যানবাহন ক্রমেই বাড়ছে। সুজনের ক্লাস নাইন আর চিকনের এইট হয়েছে। লেবু সুজনের থেকে এক বছরের বড়। ও আরও এক বছর ক্লাস এইটেই থেকে গেছে। হেড স্যার ওকে প্রমোশন দেননি। বলেছেন — আর একবছর থাক। মন দিয়ে খেল। আগামী বছর দেখবো।
লেবু ভেঙে পড়েছিল। বলেছিল — জান লড়িয়ে খেলে এ বছর স্কুলকে ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ন করলাম, তার কোনও দাম দিল না রে। এ জীবনে বোধহয় আমার স্কুল লাইফ শেষ হবে না। স্কুল থেকে পাশ করে বেরোতে পারলে ভেবেছিলাম খেলা দেখিয়েও একটা কাজের চেষ্টা করা যাবে।
সেই সময় এই শহরে প্রতিদিন নানা রকম ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। শহরে নতুন নতুন ভিখিরি আর পাগলরা আসছিল। একদল ছোট ছেলে ঢিল ছুঁড়ে হাতের টিপ প্র্যাকটিস ক'রে রাস্তার আলোর বাল্বগুলো ভেঙে দিয়েছিল একদিন। সেদিন শহরের রাস্তাগুলো অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। একদিন একটা মেয়েকে রাস্তা দিয়ে প্রথম সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখেছিল। এর আগে কোনও মেয়েকে ওরা সাইকেল চালাতে দেখেনি। সুজনদের কারও সাইকেল ছিল না। ওরা সাইকেল চালাতেও জানতো না। ঘটনাটা ওদের চমকে দিয়েছিল। তুমুলভাবে ওরা জীবনের পরিবর্তন চাইছিল, অবস্থার বদল চাইছিল, কিন্তু ওদের জীবনে কোনও বৈচিত্র্য ছিল না।
তাও সুজনরা নিয়মিত মাঠে খেলতে যেতো, শিবমন্দিরের দাওয়ায় বসে আড্ডা দিতো, ঝন্টুও নতুন নতুন কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আমদানি করে আড্ডা জমিয়ে তুলতো। খেলা শেষে মাঠ থেকে ফেরার সময় প্রায়ই ধর্মশালাটাকে আলো মেখে সেজেগুজে থাকতে দেখতো। তখন ধর্মশালার গেটের সামনে মানুষ, গাড়ি, ভিখিরি আর কুকুরের ভিড় লেগে থাকতো। সন্ধ্যায় শিবমন্দিরে এসে বসলে চারদিক থেকে অন্ধকার ওদের ঘিরে ধরে। তখন সুজনের বুকের ভিতরটা খুব ফাঁকা বলে মনে হয়। যেন একটা ফাঁপা নলের মতো। জোরে ঘা দিলেই ঠং ঠং করে আওয়াজ বের হবে।
গরম কাল। এক সন্ধ্যায় খেলার পর ফেরার পথে ঘটনাটা ঘটল। ধর্মশালার কাছে এসে অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও ওখানে ভিড় জমে থাকতে দেখল। লোকগুলো প্রায় সকলেই অবাঙালী। এই গরমেও অনেকে স্যুট-টাই পরে আছে। রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। আলোকিত ধর্মশালায় মাইকে জোরে হিন্দি গান বাজছে। লোকগুলোর হাতে বড় বড় চৌকো সাইজের প্যাকেট। প্যাকেট থেকে খেতে খেতে ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর হাসির ফোয়ারা তুলছে। ওদের কথাবার্তা ও হাসির শব্দে জায়গাটা সরগরম হয়ে উঠেছে। কেউ কিছুটা খেয়ে বাকী খাবার ভিড় জমানো ভিখিরিদের দিয়ে দিচ্ছে। কেউ আবার খাবারের টুকরো কুকুরদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে।
দেখল ধর্মশালার বারান্দায় রাখা একটা ড্রাম। সেটা বরফের মধ্যে রাখা অগুনতি কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে ভর্তি। ওই লোকগুলো সেই ড্রাম থেকে ইচ্ছা মতো বোতল নিয়ে গলায় ঢালছে। তখনও এখানে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়ার তেমন চল হয়নি। ঘোল, লেবু বা সিরাপের শরবতই চালু ছিল।
ওদের কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়া দেখে ভোঁদার চোখ চকচক করে উঠল — ওডা ওরা কী খায় রে?
চিকন হয়তো কোথাও কাউকে খেতে দেখে থাকবে। বলল — কোল্ড ড্রিঙ্কস।
— সেডা আবার কোন সুমুন্দি?
চিকন আবার বলল — ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা শরবত।
ঝন্টু চোখ বড় বড় করে বলল — কোল্ড ড্রিঙ্কস কখনও খাইনি রে। ওদের খাওয়া দেখে মনটা কেমন তুড়ুক তুড়ুক করছে।
একজন সর্দারজি ড্রাম থেকে একটার পর একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল তুলে গলায় ঢালছিলেন। হঠাৎ একটু দূরে ওদের পাঁচ জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসলেন। তারপর একটা বোতল উঁচু করে তুলে ধরে ওদের দেখিয়ে বললেন — আও ইয়ার, পিয়োগে? আও আও, পিও।
আচমকা এই ডাকে ওরা হকচকিয়ে গিয়েছিল। ভাবতেও পারেনি যে সর্দারজি ওদের ডাকতে পারে। কী করবে বুঝতে না পেরে ঝন্টু আর লেবু পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল। বোতলের দিকে তাকিয়ে লোভে ওদের চোখ চকচক করছে।
সর্দারজি আবার বললেন — শরমানা মৎ। আও, ঠাণ্ডা পিও।
সর্দারজির পাশে দাঁড়িয়ে আরও দু'তিন জন এতক্ষণ মজা দেখছিল। এবার তারাও বলল — হাঁ হাঁ, আও।
ঝন্টু লেবুকে জিজ্ঞাসা করল — কি রে, যাবি? এত করে ডাকছে।
ঝন্টুদের ইতস্তত করতে দেখে ওই দলের সকলে একসঙ্গে বলতে থাকল — হাঁ হাঁ, আও আও।
ওদের হাসি আর আও আও ডাকে সুজনের সারা শরীরে, আগে যা কখনও হয়নি, একটা বিতৃষ্ণার ঢেউ বয়ে গেল। ওই ডাকে কেমন একটা ঔদ্ধত্য আর তাচ্ছিল্য মাখানো আছে। ওর মাথা ঝা ঝা করতে থাকল। আও আও ডাকগুলো ওর গালে যেন একটার পর একটা থাপ্পরের মতো পড়তে থাকল।
প্রথমে ঝন্টু গেল। পিছন পিছন লেবু। ওরা ভিখিরিদের যেমন দিচ্ছিল,ঝন্টু আর লেবুর হাতে সেভাবে খাবার আর কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল তুলে দিল। তারপর বাকীদের দিকে চোখ পড়ল — আরে ইয়ার, তুমলোগ ভি আও।
মাইকে তখন স ধন কাওয়ালি গান বাজছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আলোর বন্যায় ভেসে যেতে যেতে লেবু আর ঝন্টু অনভ্যস্ত হাতে গলায় কোল্ড ড্রিঙ্কস ঢালছে। সুজন দেখল লোভী চোখে চিকন ও ভোঁদা সেদিকে তাকিয়ে আছে। ওরা সম্মোহিতের মতো ওদিকে এগিয়ে যেতে যেতে সুজনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল — আয় সুজু।
ওদের লোভী চোখের দিকে তাকিয়ে সুজনের পায়ের নীচের মাটি সরে যাচ্ছিল। ওরাও যে ঝন্টু আর লেবুর মতো ওকে ছেড়ে যাবে ভাবেনি। ওর গলা একটু কেঁপে গেল — না।
চিকন দাঁত খিঁচিয়ে বলল — কেন রে শালা? পেটে খিদে মুখে লাজ?
ওরা যত ওই খাবার আর কোল্ড ড্রিঙ্কসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সুজনের মনে হচ্ছিল ও ততই একা হয়ে যাচ্ছে। এতদিনের বন্ধুত্ব। কত কথা মনে পড়ছিল। সেই বড়বাগান মেলা। চানাচুর চুরি করে খাওয়া। তারপর নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। তবু কেউ ওরা ওকে বুঝল না।
ওকে বিদ্রূপ করল। যতই লোভনীয়, দামি আর ভালো খাবার হোক ওটা যে বিষ এটা কি জানে না? ওটা খেলে যে একটা বিষক্রিয়া হয় এটাও কি জানে না ওরা? ও চিৎকার করে করে বলতে চাইল — চিকন, ভোঁদা, তোরা আমাকে একা করে দিয়ে যাস না। আয়, ফিরে আয়। কিন্তু বুঝতে পারছিল ওরা আর ফিরবে না।
ওরা সুজনের মনের কথা শুনতে পাচ্ছিল না। যেন শোনার ক্ষমতাই লোপ পেয়েছে । সব অনুভূতি, সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শিকার যেমন বাঘের গ্রাসের দিকে এগিয়ে যায়, ওরা ঠিক তেমনভাবেই সুজনকে ভুলে, জগৎ সংসার ভুলে, সর্দারজির হাতে ধরা খাবার আর কোল্ড ড্রিঙ্কসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সুজন ভিতরে ভিতরে দুঃখ যন্ত্রণা ঘৃণায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল।
সুজন বুঝল সব শেষ হয়ে গেছে। আর না দাঁড়িয়ে জোরে পা চালিয়ে সেখান থেকে এক রকম পালিয়ে যেতে যেতে মাথা ঝাঁকিয়ে সুজন নিজেকেই বিড়বিড় করে বলছিল — আমার এতদিনের সুখ দুঃখের সাথী, আমার বন্ধুরা আজ আমার হাত ছেড়ে দূরে চলে গেল। আগাছার মতো এই জীবনটা এখন আমি বাঁচবো কাদের নিয়ে? দুঃখ দারিদ্র্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, এই জীবনটা যারা একদিন মজা করে বাঁচতে চেয়েছিল, আমার সেই অপাপবিদ্ধ বন্ধুরা আজ সত্যি সত্যিই ভিখিরি হয়ে গেল।
যেতে যেতে সুজনের কানে যত সর্দারজির আও আও আও ডাক ধাক্কা মারছিল, ও ততই দ্রুত ওই প্রলোভন, ওই হাতছানির বিষাক্ত ছোবল থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছিল।